বদলা
তাহা মুহাম্মদ আলী
সময় সময়
মনে হয়
যে মানুষটি হত্যা করেছে আমার বাবাকে,
আর গুড়িয়ে দিয়েছে আমাদের বসতি-ভিটা,
খণ্ডিত এক ভূ-খণ্ডের দিকে ঠেলে দিয়েছে আমাকে,
তার সাথে যদি লড়াইয়ে নামতে পারতাম।
যদি সে হত্যা করতো আমাকে,
শেষমেশ বিশ্রামে যেতে পারতাম আমি,
আর যদি সুযোগ আসতো আমার,
আমি বদলা নিতাম!
কিন্তু সেই শত্রু লড়াইয়ে নামার কালে
যদি জানা যেতো—
তার একজন মা রয়েছে,
যে কিনা অপেক্ষা করছে তার জন্য,
বা একজন বাবা,
ছেলের আসতে
কিছুটা দেরির কারণে
বুকের বাম পাশটায় চেপে ধরে যে,
তাহলে তাকে হত্যা করতাম না আমি,
সুযোগ থাকলেও না।
একইভাবে…
তাকে হত্যা করতাম না আমি
যদি জানতাম কোনো ভাই বা বোন আছে তার
যারা তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে,
আর অপেক্ষা করে সারাটা সময়
তাকে একনজর দেখবার জন্য,
কিংবা যদি থাকে স্ত্রী
তাকে স্বাগত জানাতে,
বা সন্তান,
যারা এক মুহূর্তও সইতে পারে না তার অনুপস্থিতি,
বাবার আনা খেলনা পেলেই লাফিয়ে ওঠে আনন্দে,
অথবা যদি তার বন্ধু কিংবা সঙ্গী থাকে,
চেনাজানা প্রতিবেশী,
কারাগার বা হাসপাতালের ইয়ার-দোস্ত
বা স্কুলের সহপাঠী…
যারা তার কুশল জানতে চায়,
তাকে পাঠায় সম্ভাষণ।
কিন্তু যদি দেখা যায় নিঃসঙ্গ সে,
গাছ থেকে ছেঁটে ফেলা বিচ্ছিন্ন একটা ডালের মতো,
যার না আছে মা, না আছে বাবা,
না আছে ভাই কিংবা বোন,
নেই স্ত্রী, নেই সন্তান,
আত্মীয়, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব কিছুই নেই,
তাহলে তার সেই নিঃসঙ্গতায়
নতুন করে আর কোনো যন্ত্রণাই
ঢালতাম না আমি,
মৃত্যুযন্ত্রণাও না।
বরং পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়
তার দিকে ফিরেও না তাকানোতে
সন্তুষ্টি খুঁজে নিতাম;
কেননা আমি জানি,
তার প্রতি বিন্দুমাত্র মনোযোগ না দেয়াই
এক কঠিনতম প্রতিশোধ।
তাহা মুহাম্মদ আলী। ফিলিস্তিনি কবি। জন্ম- ১৯৩১; মৃত্যু- ২ অক্টোবর ২০১১।
কাটা ঠোঁট
সামিহ আল-কাশিম
আমার তো ভীষণ ইচ্ছে ছিল
তোমাকে শোনাবো—
মৃত এক বুলবুলির গল্প,
আমার তো ভীষণ ইচ্ছে ছিল
তোমাকে বলবো
…সে গল্পটা!
যদি না ওরা আমার ঠোঁট কেটে নিতো
সামিহ আল-কাশিম। ফিলিস্তিনি কবি। জন্ম: ১১ মে, ১৯৩৯; মৃত্যু: ১৯ আগস্ট, ২০১৪
পদচিহ্ন
মুইন বাসিসু
ভাই আমার,
আমার ঘাড়েও যদি ওরা তরবারি শান দেয়,
হাঁটু মুড়ে বসবো না আমি;
আমার রক্তাক্ত মুখের ওপর
ওদের চাবুকের আঘাতেও না,
ভোর যদি এতোটাই নিকটবর্তী
পিছু হটবো না আমি;
আমাদের প্রচণ্ড ঝড়গুলোকে
পরিপুষ্ট করে যে ভূমি
জেগে উঠবো সেখান থেকে।
ভাই আমার,
তোমাকে হাঁটু গেড়ে বসাবে বলে
জল্লাদ যদি তোমার চোখের সামনেও
আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় কসাইখানায়,
যাতে তুমি করুণা ভিক্ষা চাও;
আমি আবারো বলছি, দাঁড়াও মাথা উঁচু করে
আর দেখো আমাকে কতলের দৃশ্য!
দেখো জল্লাদকে,
আর আমারই রক্তে ভেজা তরবারি!
আমাদের নির্দোষ রক্ত ছাড়া
কী আর দেখাবে সেই খুনি?
রাত্রিবেলা বন্দুকের মুখে
ওর পরিখা থেকে
ওকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ওরা,
তারপর কারাপ্রকোষ্ঠের অন্ধকারে
নিক্ষেপ করা হয়েছিল সেই বীরকে,
সেখানে শেকল ছাড়িয়ে
উড্ডীন এক নিশানের মতো ছিল সে।
শেকল হয়ে উঠছিল জ্বলন্ত মশাল,
আর জ্বালিয়ে দিয়েছিল
যা কিছু ঢেকে রেখেছিল আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে।
আর আজও বেঁচে আছে সেই বীর,
আজও কয়েদখানার রুদ্ধ প্রকোষ্ঠের দেয়ালে দেয়ালে
শোনা যায় তার বিজয়ী পদধ্বনি।
মুইন বাসিসু। ফিলিস্তিনি কবি। জন্ম: ১০ অক্টোবর ১৯২৬; মৃত্যু: ২৩ জানুয়ারি, ১৯৮৪।
জেরুজালেম
নিজার কাব্বানি
চোখের জল শুকিয়ে আসা অব্দি কেঁদেছি আমি,
প্রার্থনা করেছি মোমের আলো নিভে যাওয়ার আগ পর্যন্ত,
রুকুতে ছিলাম যতোক্ষণ না রুকু নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে
সওয়াল করেছি মোহাম্মদ আর ইসার ব্যাপারে
ও জেরুজালেম, পয়গম্বরদের সুবাসে মোড়া
আরশ আর জমিনের সংক্ষিপ্ততম পথ
ও জেরুজালেম, বিধিবিধানের তীর্থ
আনত চোখ আর দগ্ধ আঙুলের সৌম্যকান্তি শিশু
তুমিই সেই ছায়াচ্ছন্ন মরুদ্যান
যার ছায়ায় হেঁটে গেছেন নবী,
বিষাদে ছাওয়া তোমার সমস্ত পথ,
রোনাজারি করছে তোমার সকল মিনার।
ও জেরুজালেম, শোকের পোশাকে আবৃতা
কে বাজাবে পুনরুত্থান দিনের ঘণ্টি?
ক্রিসমাসের সন্ধ্যায়
শিশুদের জন্য বয়ে আনবে উপহার?
ও জেরুজালেম, দুঃখের নগরী,
কান্নায় ছলছল চোখ,
কে থামাবে তোমার ওপরে চলা
এই জুলুম, ও ধর্ম-চূড়ামণি?
কে মুছে দেবে তোমার রক্তাক্ত দেয়াল?
সুরক্ষা দেবে ইঞ্জিলের
আর উদ্ধার করবে কোরান?
যিশুকে যারা হত্যা করেছে
তাদের হাত থেকে কে বাঁচাবে যিশুকে?
কেই-বা বাঁচাবে ইনসানকে?
ও জেরুজালেম, নগরী আমার
ও জেরুজালেম, প্রেয়সী আমার
আগামীকাল ফুলে ফুলে ছেয়ে উঠবে লেবুগাছগুলো,
আনন্দে মাতোয়ারা হবে যয়তুনের গাছ,
নেচে উঠবে তোমার চোখ,
ফিরে আসবে মোহাজির যতো কবুতর-
তোমার পবিত্র ছাউনিতে,
আর আবারো খেলায় মাতবে তোমার শিশুরা,
গোলাপশোভিত পাহাড়ে পাহাড়ে-
পিতা আর পুত্রের পুনর্মিলন হবে,
ও দেশ আমার,
ও শান্তি আর যয়তুনের দেশ।
ফিলিস্তিনি কবি মুরিদ বারগুতি’র কবিতা
কারাগার
লোকটি বললো :
আশীর্বাদপুষ্ট, খাঁচায় বন্দি পাখিরা
কেননা ওরা অন্তত জানে
কারাগারের সীমানা।
নিস্তব্ধতা
নিস্তব্ধতা বললো :
সত্যের কোনো প্রয়োজন নেই কথা বলবার,
অশ্বারোহীর মৃত্যুর পর
তার ফিরে আসা ঘোড়াই
বলে দেয় সব,
কোনো শব্দোচ্চারণ ছাড়া।