রোজার শেষ সপ্তাহ। সেদিন গরম একটু কম পড়েছে। সম্ভবত শনিবার। কিছু বই কেনার জন্য গেলাম বাতিঘর বুক ক্যাফেতে। যাওয়ার পথে তীব্র জ্যাম। গরম কিছুটা কম হলেও লোকাল বাসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার মতো উপযোগী না। বাতিঘরে পৌঁছানোর পর দেখলাম যেই বইগুলো কিনতে এসেছিলাম সেগুলো স্টক আউট। এই গরমে আবার বাসায় ফেরার সাহস হলো না। দিনের তখন আরও অর্ধেকটা বাকি। ইফতার অব্দি শীততাপ পরিবেশেই কাটাবো বলে মনস্থ করলাম। সন্ধ্যা নামলে বাড়ি ফেরা যাবে। কিন্তু এতটা সময় করবোটা কী? বইয়ের দোকানে বই দেখা ছাড়া আর কী কাজ… ইতি-উতি ঘুরে বই দেখতে লাগলাম।
সেদিনের সেই দুপুরে আমি খোঁজ পেয়েছিলাম সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের। বাংলার এই সুলতানের নাম আমি শুনেছি, পড়েছি অনেকবার। কিন্তু তিনি যে ঢাকার অদূরেই শুয়ে আছেন জানতাম না। ঈদের পর কয়েকদিন ছুটি আছে। তখন সুলতানের কবর দেখতে যাবো বলে ঠিক করলাম।
ঈদ চলে গেল, সুলতানের কবর দেখতে যাওয়ার কথা জানালাম কয়েকজন বন্ধুকে। আগের রাত অব্দি সব কথা ঠিকঠাক থাকলেও সকালে দেখা গেলো আমি ছাড়া কেউ নেই। এ যেন প্রকৃতির মধুর প্রতিশোধ। এতকাল আমি বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে শেষ মুহূর্তে পিঠটান দিয়েছি। এখন আমাকে একা রেখে সবাই পিঠটান দিল! কী আর করা। কবিগুরুর সেই অমোঘ বাণীই এখন ভরসা, ‘একলা চলোরে…’
সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের কবর সোনারগাঁয়ের মোগরাপাড়া এলাকায়। বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁ এখন বিখ্যাত পানাম নগরের জন্য। মোগরাপাড়া বাসস্ট্যান্ডে নামার পর গুগল ম্যাপে দেখলাম প্রায় সাড়ে চার মাইল ভেতরে সুলতানের কবর। অটো ছাড়া তেমন কোনো বাহন নেই। একটা অটোরিকশা এসে থামল আমার সামনে। আমি তখনও গুগল ম্যাপে ব্যস্ত।
“যাবেন কই?”
“সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের মাজার।”
“এইডা আবার কই?”
“এইদিক থেকে ভেতরে দেখাচ্ছে ম্যাপে।”
“পাঁচ পিরের মাজার?”
“না, গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের।”
রিকশাওয়ালা আমাকে টানা কয়েকটা মাজারের নাম বলল। ম্যাপে দেখলাম তার বলা একটা মাজারের কাছাকাছি সুলতানের কবর। উঠে পড়লাম রিকশায়। ওই মাজার অব্দি নিয়ে যেতে পারলে বাকিটা হেঁটে যাওয়া যাবে। রিকশা ভাড়া চাইলো সত্তুর টাকা। বাঙালির যা স্বভাব। টাকা নিয়ে মুলামুলি করা। আমিও তাই করলাম। কিন্তু রিকশা যখন গ্রামের ভেতর ঢুকছে তখন বুঝতে পারলাম সত্তুর টাকা নেহায়েত কম হয়ে গেছে। একদম মাটির কাঁচা রাস্তা। চারদিকে সবুজ ফসলের মাঠ। অনেক দূরে দূরে বাড়ি। মানুষজন খুব একটা দেখা যায় না। গুগল ম্যাপে সাড়ে চার মাইল দেখালেও বাস্তব পথে সেটা সম্ভবত পাঁচ মাইলের উপরে গিয়ে ঠেকল। এই গণ্ডগ্রামই কী একসময় রাজধানীর অংশ ছিল? যেতে যেতে ভাবলাম, এই গ্রামেই শুয়ে আছেন বাংলার স্বাধীন সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম শাহ। একসময় যার নামেই হয়ত তটস্থ থাকত বাংলা, তার নাম বলে বেশি সুবিধা করতে পারলাম না। কেউ চিনল না এই নামের কারো কবর…
বইয়ের পাতায় ঘুরে বেড়ানো সুলতানেরা কালচক্রে বনে যান সূফী-দরবেশ-পীর। সন্দেহ হলো সুলতান কোনো পীরের ছদ্মবেশেই সম্ভবত ঢাকা পড়েছেন। গিয়াস উদ্দিন আযম শাহ নিজে কবিতা লিখতেন। কখনও আরবিতে, কখনও ফারসিতে। পারস্যের কবি হাফিজের সাথে ছিল তার পত্র-যোগাযোগ। তার পৃষ্ঠপোষকতায় শাহ মুহম্মদ সগীর রচনা করেছিলেন বিখ্যাত ‘ইউসুফ জোলেখা’ কাব্য। কৃত্তিবাসকে বাংলায় রামায়ণ অনুবাদ করার নির্দেশনাও কি তিনি দিয়েছিলেন?
এসব ভাবতে ভাবতে গ্রামীণ জনপদ মাড়িয়ে পৌঁছলাম ‘কালো পীরের মাজার’-এ। স্থানীয়রা এই নামেই চিনে সুলতানের কবর। কেউ কেউ বলে কালা দরগা। রিকশাওয়ালাকে বেশ প্যারা দিয়েই নিয়ে এসেছিলাম আমি। কবরের সামনে এসে থামতেই সে বলল, ধুরু মিয়া এত কাহিনি করা লাগে? কালা দরগার কথা কইলেই তো নিয়ে আসতে পারতাম।”
কবরের পাশে একটি ফলক যদিও আছে, তবুও তাকে পীর মনে করে মানুষজন। কবরের সামনে পৌঁছুতেই দেখলাম দুইটা অটো দাঁড়িয়ে আছে। সমাধি সৌধের ভেতর থেকে কান্নাজড়িত মুনাজাতের আওয়াজ আসছে। রিকশা থেকে নামতে নামতে চকিতে ভাবলাম, এই রিকশা ছেড়ে দিলে মোগরাপাড়ায় আজকে আর আমি ফিরতে পারব না। ঢাকায় যাওয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার। তাই রিকশাওয়ালাকে বললাম, দশ মিনিট অপেক্ষা করেন। আমি আবার ফিরব।

ছবি : সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের মাজার এবং লেখক
মোনাজাত করা দলটা ভেতরে থাকতে ঢুকব কী ঢুকব না বুঝতে পারছিলাম না। সাতপাঁচ ভেবে ঢুকেই গেলাম। কালো পাথরের সমাধি একটা কাপড় দিয়ে ঢাকা। এটাকে ঠিক গিলাফ বলা যায় না। সস্তা, ম্যাড়মেড়ে কাপড়। সুলতানের কবরে একটা মখমলের গিলাফও জুটল না।
ভেতরে ঢুকে আবিষ্কার করলাম এই মাজারের একজন খাদেমও আছে। খাদেম তাড়া দিয়ে লোকগুলোকে বের করে দিচ্ছে। তার হাতে সময় নেই একদম, অনেক কাজ, অনেক ব্যস্ত সে। গেটে তালা দিয়ে চলে যাবে সে। তাড়া খেয়ে ভেতরে থাকা সবাই বের হয়ে গেলেও আমি বের হলাম না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এতদূর থেকে এসে দুইটা মিনিট থাকতেও পারবো না!
“কই আপনের হয় নাই?”
“আমি উনাদের সাথে আসি নাই। একটু আগে ঢুকছি। থাকি কিছুক্ষণ?”
“তাড়াতাড়ি করেন, তাড়াতাড়ি করেন। এখনও গোসল করি নাই, নামাজ পড়ি নাই, যামুগা।”
বাইরে থেকে একজন দর্শনার্থী তখন বলল, “কাপড়টা একটু সরাবেন? ছবি তুলতাম।” খাদেম তেতে উঠল।
“আরে না না। এই কাপড় সরানো যাইবো না। যেমনে আছে এমনেই তুলেন।” কাপড়টা হালকা একটু সরিয়ে বলল সে। আমি ঝটপট কিছু ছবি তুলে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এর মধ্যেই অটোতে আসা দর্শনার্থীর (নাকি পুণ্যার্থী?) দল চলে গেল। আমিও বের হব, রিকশা দাঁড়িয়ে। তখনি খাদেমের একটা একটা কথা কানে বাড়ি খেলো।
“একটা মোম বাতি জ্বালানোর টাকা দিতে পারে না আবার বড় বড় কথা।”
আমার যা বুঝার বুঝে গেলাম। পকেট থেকে একশো টাকার নোট বের করে ধরিয়ে দিলাম সুলতানের খাদেমের কাছে। প্রথমে তো নিতেই চায় না। বললাম, একটা আপনার চা-নাস্তার টাকা। এরপরেই পাশার দান ঘুরে গেল। খাদেম আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে পুরো কবর দেখাল। কাপড় টাপড় সরিয়ে দিয়ে বলল, ছবি তুলেন। আমার ছবিও তুলে দিল কবরের সাথে।
সুলতান প্রচুর দান করতেন। তিনি পবিত্র মক্কা ও মদীনার তীর্থযাত্রীদের সব ধরনের সাহায্য করতেন। শোনা যায় তিনি একাধিকবার মক্কা ও মদীনা শহরের অধিবাসীদের জন্য প্রচুর উপঢৌকন পাঠিয়েছিলেন। এত দূরের দেশ বাংলা থেকে মক্কা মদীনায় উপঢৌকন, ভাবা যায়? কথিত আছে যে, তিনি ইসলামি শিক্ষা বিস্তারের জন্য মক্কার উম্মে হানির ফটকে একটি এবং মদীনার ‘বাব আল-সালামে’র (শান্তির দ্বার) নিকটে অপর একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করান। এ প্রতিষ্ঠান দুটির জন্য তিনি প্রয়োজনীয় অর্থও প্রদান করেন। এ দুটি মাদ্রাসা ‘গিয়াসিয়া মাদ্রাসা’ নামে পরিচিত। সেই সুলতানের কবর যে দেখাশোনা করছে, তার দুরবস্থা দেখে খুব মায়া লাগল। কিন্তু ইতিহাসের লিখন যে এমনই।
সমাধিসৌধ থেকে বেরিয়ে রিকশায় উঠলাম। রিকশা এগিয়ে যাচ্ছে মোগরাপাড়ার দিকে। পেছনে পড়ে যাচ্ছে সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের সমাধি। যেভাবে পেছনে পড়ে গেছে তার অবদান ও কীর্তি। একসময় পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল সমাধি স্তম্ভ। মনে মনে হাসলাম। নাহ, সুলতান নিশ্চিহ্ন হবেন না। কোনো না কোনো নামে টিকে থাকবেন। হোক সেটা সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম বা কালো পীর, তিনি হারাবেন না।