পাঠকের স্মরণে থাকার কথা–একজন বিশিষ্ট হিন্দু সম্পাদক এক নিবন্ধে দাবি করেছিলেন–“মুসলমানরা ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে হিন্দি ভাষার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যচর্চার প্রতি কখনো মনোযোগ দেয়নি। আর ঘটনাক্রমে হিন্দিতে কেউ দুয়েক কলম লিখলেও অন্য মুসলমানরা তাকে ‘কাফের’ ফতোয়া দিয়েছে।”
এর জবাবে আমরা ‘আন-নদওয়া’ পত্রিকায় ‘মুসলমানদের উদারদৃষ্টি’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম, যেখানে মুসলমানদের উদার মানসিকতার বিস্তর আলোচনা হয়েছে এবং মুসলমানরা সংস্কৃত ও হিন্দি ভাষার রচনাবলি অনুবাদ ও প্রচার-প্রসারের মধ্য দিয়ে কীভাবে এই ভাষার হেফাজতে অংশগ্রহণ করেছিল, তা দেখানো হয়েছে। এখনকার নিবন্ধটি সে লেখারই দ্বিতীয় কিস্তি। এখানে দেখানো হবে—অনুবাদ ও প্রচারে অংশগ্রহণ ছাড়াও খোদ মুসলিমরাই হিন্দি ভাষায় কী কী মহামূল্যবান রচনা উপহার দিয়েছে এবং কাব্যচর্চার কোন শিখরে আরোহণ করেছে।
আমাদের খেয়াল রাখা উচিত, সংস্কৃত ভাষা পরিত্যক্ত হয়েছে অনেককাল ধরেই। অর্থাৎ, হিন্দুরাই দীর্ঘদিন যাবৎ এই ভাষায় লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছে এবং ইসলামি যুগে এসে বলতে গেলে কোনো বইপত্রই এ ভাষায় রচিত হয়নি। এ সময় হিন্দুদের লেখালেখি ও কাব্যচর্চা মূলত ছিল হিন্দি ভাষায়। এ জন্য মুসলমানরাও যা কিছু রচনা করেছে, এ ভাষাতেই করেছে। সাধারণ মহলে এ কথাটি প্রসিদ্ধ যে, হিন্দি ভাষায় সর্বপ্রথম কাব্যচর্চার স্বাক্ষর রেখেছেন আমির খসরু। তবে বাস্তবতা হলো, এর ধারাবাহিকতা অনেক আগ থেকেই চলে আসছে। মাসউদ সাদ সালমান আমির খসরু তারও প্রায় দুশো বছর আগেকার গজনি সালতানাতের সুপ্রসিদ্ধ কবি। সমস্ত ঐতিহাসিক সূত্র তার ব্যাপারে একমত, তিনি হিন্দি ভাষাতেও একটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
এ বিষয়টিকে শুধু ওয়ালা দাগিস্তানি অস্বীকার করেছেন এ কথা বলে যে, বিদেশি ভাষায় কাব্যচর্চা অসম্ভব। এর জবাবে মৌলবি গোলাম আলি আযাদ বলেছেন, মাসউদ সাদ সালমান ইরানি বংশোদ্ভূত হলেও তার জন্মস্থান লাহোর। আর কোনো ভারতীয়র পক্ষে হিন্দি ভাষায় এই স্তরে পৌঁছা অসম্ভব কিছু নয়। কবি আমির খসরু সংস্কৃত ও হিন্দিতে কতটুক দক্ষ ছিলেন, তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। তিনি ‘মসনবিয়ে না-সিপাহর’-এ স্বয়ং নিজের সংস্কৃতজ্ঞানের কথা উল্লেখ করেছেন। আফসোসের বিষয়, তার মূল হিন্দি ভাষায় রচিত কবিতাগুলো আজ বিলুপ্তপ্রায়। অন্যান্য ভাষার মধ্যে শুধু তার সে কবিতাগুলো মজুদ আছে, যা তিনি ফার্সি ও হিন্দিতে ভাষান্তর করেছেন।
আমির খসরুর পর শেরশাহের আমলে কবিতার ময়দানে এলেন মালিক মুহাম্মদ জায়সি। তিনি হিন্দি ভাষার এমন জাঁদরেল কবি ছিলেন, স্বয়ং হিন্দুরাও তার সমকক্ষ আজ পর্যন্ত পেশ করতে পারেনি। তার কাব্যগ্রন্থ ‘পদুমাবৎ’ আজও তার নাম আলোকিত করে রেখেছে এবং ভারতের ঘরে ঘরে তা ছড়িয়ে আছে। এ যুগে সবচেয়ে বড় হিন্দু কবি ধরা হয় কালিদাসকে, যিনি রামায়ণের হিন্দি অনুবাদ করেছেন। বিশেষজ্ঞদের মত হলো, ভাষাশক্তির বিবেচনায় রামায়ণ থেকে পদুমাবৎ কোনো অংশেই কম নয়। সাধারণ পাঠকও বিষয়টি আঁচ করতে পারবেন—পদুমাবৎ-এর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পড়লেও আরবি-ফার্সি শব্দের ব্যবহার একরকম পাওয়াই যায় না। দুয়েকটি শব্দের দেখা মিললেও তা বিবেচনাযোগ্য নয়। কারণ, বিদেশি শব্দের অল্পস্বল্প ব্যবহার রামায়ণেও আছে।
মালিক মুহাম্মদ জায়সি পদুমাবৎ ছাড়াও দুটি কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন, যা তার উত্তরসূরিদের কাছে এখনও বিদ্যমান। অবশ্য তা ছাপার হরফের মুখ দেখেনি।
বাদশাহ আকবরের সময় হিন্দি ভাষা আরো ব্যাপকতা লাভ করে। হিন্দির চর্চা তখন এ পর্যন্ত পৌঁছেছিল যে, মন্ত্রীবর্গ, এমনকি রাজপুত্ররা পর্যন্ত হিন্দিতে কাব্যরচনা করত। জাহাঙ্গীর তার আত্মজীবনীতে আকবর শাহের ছেলে শাহজাদা দানিয়ালের আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘তিনি হিন্দি সংগীতের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। মাঝে মাঝে হিন্দিতে ভালো কবিতাও রচনা করতেন।’
আবদুর রহিম খান-ই-খানা[1]আবদুর রহিম আকবরের রাজসভার হিন্দি ও তুর্কি ভাষার সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি … Continue reading আকবরি দরবারের নবরত্নদের একজন এবং হিন্দি কাব্যচর্চায় তার দখল ছিল পূর্ণ। ‘তুজকে জাহাঙ্গীর’-এ তার মৃত্যুর আলোচনায় এসেছে, ‘খান-ই-খানা যোগ্যতা ও প্রতিভায় অনন্য ছিলেন। তিনি আরবি, তুর্কি, ফার্সি ও হিন্দি জানতেন। পাশাপাশি সব ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও বর্ণনামূলক জ্ঞান রাখতেন। তিনি ফার্সি ও হিন্দিতে চমৎকার চমৎকার কবিতা লিখেছেন।’
বাদশাহ জাহাঙ্গীরের সময়ে ‘গাওয়াসি’ নামে এক কবি ছিলেন। তিনি ‘তুতিনামা’ নামক প্রসিদ্ধ এক রচনাগ্রন্থকে এমনভাবে কাব্যরূপ দিয়েছিলেন, যার প্রতি পঙ্ক্তিদ্বয়ের প্রথমটি ফারসি ও দ্বিতীয়টি ছিল হিন্দিতে।
একই সময়ে মোল্লা নুরি নামক এক লোক ছিলেন। তিনি থাকতেন আজমপুর। ফাইযির[2]তার প্রকৃত নাম শেখ আবুল ফায়েয মোবারক। তিনি আকবরের রাজসভার সভাকবি ও … Continue reading সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। যদিও তার ভাষা ছিল ফার্সি, তবু তিনি মাঝেমধ্যে হিন্দি ব্যবহার করতেন। উর্দু বাক্যশৈলীও তার ভাষায় পাওয়া যেত।
আকবর ও জাহাঙ্গীরের আমলে কবিতায় সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধি পেয়েছিলেন শেখ শাহ মুহাম্মদ ইবনে শেখ মারুফ ফেরবলি। তিনি ছিলেন বিলগ্রামের অধিবাসী। এক ভ্রমণে এক হিন্দু বালিকার উপস্থিত বুদ্ধি তার খুব পছন্দ হয়েছিল। তখন তিনি মেয়েটিকে লালন-পালনের জন্য সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। এই বালিকার সঙ্গেই প্রশ্নোত্তরের ছলে তার অধিকাংশ দোঁহা (দুই পঙ্ক্তির কাব্য) ও কাবিত (পাঞ্জাবি কবিতার একটি ধারা। এটি চার স্তবকে লেখা হয় এবং চতুর্থ স্তবকটি অন্য তিনটি স্তবকের তুলনায় সামান্য ছোট বা ভিন্ন ওজন বা মাত্রার হয়) রচিত হয়েছে।
একবার ফেরেবলি সাহেব এক লম্বা সফর থেকে ফিরে আসার পর তাকে দেখে আনন্দে বালিকার চোখ ভিজে ওঠে। তখন তিনি কবিতা রচনা করলেন—
তোমার চোখ অশ্রুসিক্ত হলো কেন প্রিয়া?
আমার আগমন কি তোমার পছন্দের নয়!
বালিকাটি অস্ফুট স্বরে বলল,
আপনি বিহনে আমার চোখ ধূলিমলিন হয়েছিল। অশ্রু দিয়ে তা-ই এখন ধুয়ে নিচ্ছি।
মৌলবি গোলাম আযাদের স্মৃতিকথা ‘সারদে আযাদ’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে প্রচুর পরিমাণে শেখ মুহাম্মদের কবিতা উদ্ধৃত হয়েছে।
তৈমুর সুলতানরা রাষ্ট্রভাষা ফার্সিকে যেমন চোখে দেখতেন, হিন্দিরও তেমন মূল্যায়ন করতেন। আর এ কারণেই হিন্দি কবিতা দিনকে দিন উন্নতি লাভ করছিল। রাজা সুরাজ সিং একবার এক হিন্দু কবিকে জাহাঙ্গীরের দরবারে পাঠালে সেই কবি বাদশার সামনে একটি কবিতা পাঠ করলেন। সে কবিতা শুনে বাদশাহ তাকে একটি হাতি উপহার দিয়েছিলেন।
জাহাঙ্গীরের আদেশে সে কবিতাগুলো ফার্সিতে অনুবাদ করা হয়। কবিতার বিষয়বস্তু ছিল এমন—সূর্যের সন্তান থাকলে কখনো পৃথিবীর বুকে রাত নামত না/ সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের সন্তান পৃথিবী আলোকিত করে তুলত। শুকরিয়ার বিষয়/ওপরওয়ালা আপনার পিতা আকবর শাহকেও এমন এক সন্তান দিয়েছেন/আপনার পিতার ইন্তেকালের পর প্রজারা তার শূন্যতা অনুভব করেনি।
খুব আফসোসের সঙ্গে বলতে হয়, এক শ্রেণির লোক বাদশাহ আলমগীরকে একজন গোঁড়াপন্থি হিসেবে উল্লেখ করে এবং মনে করে, তিনি হিন্দি ভাষা ও হিন্দি জ্ঞানজগতের ব্যাপারে বিদ্বেষ পোষণ করতেন। অথচ বাস্তবতা হলো, মুসলমানরা তার সময়ে হিন্দি ভাষার প্রতি যতটা মনোযোগী হয়েছিল, ইতিপূর্বে তা ঘটেনি।
জমির নামক ইরানের এক প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন। তিনি বাদশা আলমগীরের সময় ইরান থেকে আগমন করেন এবং রাজকর্মকর্তা নিযুক্ত হন। তিনি হিন্দিতে পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। যদিও তার সংস্কৃত ও হিন্দি উচ্চারণ নির্ভুল ছিল না, তবু হিন্দিতে তিনি দারুণ কবিতা বলতেন। ‘ইয়ারজাতক’ নামি সঙ্গীত বিষয়ক একটি বিখ্যাত হিন্দি পুস্তক তিনি ফার্সিতে অনুবাদ করেন। ‘ইয়াদেবেযা’য় মৌলবি গোলাম আলি আযাদ বিলগ্রামী তার সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বাদশাহ আলমগীরের শাসনামলে তিনি ইরান থেকে ভারতে আসেন এবং রাজকর্মচারীর পেশায় নিয়োজিত হন। ভারতে এসে তিনি এই প্রদেশের ভাষা শিখেছিলেন। তার উচ্চারণ ভালো ছিল না, তবে বাক্যবিন্যাস ছিল খুব পরিপক্ব।’
আলমগীরের অনুসারীদের মধ্যে ‘দানাহ’ নামে একজন কবি ছিলেন। তার সম্পর্কে মৌলবি গোলাম আলি আযাদ লিখেছেন যে, ‘তিনি হিন্দি ছন্দ খুব ভালো বলতেন।’
হিন্দির মৌখিক ব্যবহার ও কাব্যচর্চা সে যুগে এতটাই ব্যাপক হয়ে উঠেছিল যে, বড় বড় আলেম, এমনকি সুফিগণও এই ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতেন। তখন শায়েখ গোলাম মোস্তফা নামে একজন বড় আলেম ছিলেন। তিনি ছিলেন মুরাদাবাদের অধিবাসী। তিনি মাকুলাতের জ্ঞানার্জন করেছেন হযরত মোল্লা কুতুবুদ্দিন শহিদ সালবির কাছ থেকে। হাদিসশাস্ত্রের জ্ঞান নিয়েছেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী রহ.-এর খানদান থেকে। তাসাউফের জগতে তিনি শায়েখ জান মোহাম্মদ শাহ জাহানাবাদীর মুরিদ ছিলেন। চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, চিত্রাংকন ও যুদ্ধবিদ্যায়ও তার দখল ছিল। বাদশাহ আলমগীরের সময় রাজকর্মকর্তা নিযুক্ত হয়ে তিনি ‘দাকান’ চলে যান এবং কিছুদিন পর কাজে ইস্তফা দিয়ে আবার ফিরে আসেন। তার মৃত্যু হয় এচালপুরে, ১১৪২ হিজরিতে। হিন্দি ভাষায় তার দক্ষতা কেমন ছিল, তা মৌলবি আলি আযাদের এই কথা থেকে বোঝা যায়, ‘অনেক ব্রাহ্মণ শায়েখের খেদমতে এসে সমস্যার সমাধান করত এবং তিনি ভালো হিন্দি কবিতাও আবৃত্তি করতেন।’
আবদুল জলিল বিলগ্রামী (মৌলবি গোলাম আলি আযাদের মাতামহ) আলমগীরের দরবারের একজন সদস্য ছিলেন এবং হিন্দি ভাষার চমৎকার একজন কবি ছিলেন। তিনি ফার্সি কবিতার মধ্যেও অনেক সময় হিন্দি ব্যবহার করতেন।
মোহাম্মদ শাহের সময়ে যখন জয়পুরের রাজা জয়সিংহ বিশ লাখ রুপি দিয়ে মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং গণিতশাস্ত্র চর্চায় পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছিল, তখন আলেমগণ তার আদেশে ‘শরহে চাগমিনি’র কাজ সম্পন্ন করেছেন এবং তার হিন্দি তরজমা করেছেন। মৌলবি আযাদ ‘সাবহাতুল মারজান’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘হিন্দুস্তানের আলেমগণ জয়সিংহের আদেশে শরহে চাগমিনি, জ্যোতির্বিদ্যা ও প্রকৌশলবিদ্যার কিতাবসমূহ আরবি থেকে হিন্দিতে অনুবাদ করেন।’
শরহে চাগমিনি এমন জটিল কিতাব, উর্দুতে যার অনুবাদ সম্ভব নয়। এ থেকে অনুমান করা যায়, যে আলেমগণ একে হিন্দিতে রূপান্তর করেছেন, হিন্দি ভাষায় তাদের দখল কতটুকু!
এ সময়ে সৈয়দ নিজামউদ্দিন বিলগ্রামী সংস্কৃত ও হিন্দি ভাষা-সাহিত্যে অনেক প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। সংস্কৃত ভাষা অর্জনের জন্য তিনি বেনারস সফর করেন এবং সেখানে থেকে এই ভাষা পূর্ণ আয়ত্ত করেন। হিন্দি সঙ্গীতে দক্ষতার কারণে লোকে তাকে ‘নায়েক’ বলত। তিনি হিন্দিতে সঙ্গীত বিষয়ক দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার মৃত্যু ১০০৯ হিজরিতে। ‘সারদে আযাদ’-এ তার অনেক কথা উদ্ধৃত হয়েছে।
সাইয়েদ খাইরুদ্দিন বিলগ্রামীর পুত্র সাইয়েদ রহমতুল্লাহ হিন্দি ভাষার একজন প্রসিদ্ধ শিক্ষক ছিলেন। পাশাপাশি তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও ছিলেন। তখন ‘চন্তমন’ নামে এক বিখ্যাত হিন্দু কবি ছিল। চন্তমনের এক শাগরিদ একবার রহমতুল্লাহর খ্যাতি শুনে তার সঙ্গে দেখা করতে এল এবং চন্তমনের একটি দোঁহা তার সামনে পাঠ করল। সাইয়েদ রহমতুল্লাহ সেই দোঁহার ভুল ধরে দিলেন এবং চন্তমন পরে তা শুনে নিজের ভুল শুধরে নিল। এমনকি সে সাইয়েদ রহমতুল্লাহর প্রশংসায় একটি দোঁহাও রচনা করে ফেলল। সাইয়েদ রহমতুল্লাহ ১১১৮ হিজরির ১৩ই রবিউল আউয়ালে ইনতেকাল করেন। সারদে আযাদ-এ তার অনেক দোঁহা পাওয়া যায়।
সাইয়েদ গোলাম নবি ছিলেন আবদুল জলিল বিলগ্রামীর ভাতিজা। তার জন্ম ১১১১ হিজরিতে। সাইয়েদ আবদুল জলিল সে সময় বাদশাহ আলমগীরের সঙ্গে দক্ষিণাত্য অভিযানে ছিলেন। সেখানে ভাতিজার জন্মসংবাদ শুনে চিন্তায় পড়ে গেলেন এবং এই অবস্থায়ই ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমের মধ্যে তিনি সুন্দর এক স্বপ্ন দেখলেন এবং সে মোতাবেক ছেলেটির কল্যাণকামনা করে বললেন যে, সে কবি হবে। আল্লাহর কুদরতে সে ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছিল। আরবি ও ফার্সি ভাষায় দক্ষতা তৈরির পাশাপাশি হিন্দি কাব্যচর্চায়ও তিনি ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। ১১৬৩ হিজরিতে আফগানিস্তানের যুদ্ধে তিনি নবাব উজিরের সহচর ছিলেন এবং যুদ্ধের ময়দানেই মৃত্যুবরণ করেন। তিনি হিন্দিতে ‘আংদারপান’ নামে ১৭৭ দোঁহাবিশিষ্ট একটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন।
তখন সাইয়েদ বরকতুল্লাহ নামে একজন বড় ফকিহ ছিলেন। তিনি হিন্দি কবিতাও লিখতেন। তার ছদ্মনাম ছিল ‘পায়মি’। হিন্দিতে তার যে কাব্যসমগ্র তৈরি হয়েছিল, তিনি নিজেই তার নামকরণ করেছিলেন ‘পেহমপুরাস’। সারদে আযাদ-এ তার কবিতাও পাওয়া যায় অনেক।
উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও অনেকে আছেন, যারা হিন্দি গদ্য ও কাব্যরচনায় খ্যাতি অর্জন করেছেন। বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থে তাদের আলোচনা পাওয়া যাবে। এখন কথা হলো, এতকিছু আলোচনার পরও কি আমাদের হিন্দু ভাইদের কাছে এ কথা গ্রহণীয় মনে হবে যে, মুসলমানরা কখনো হিন্দি সাহিত্যের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেনি? আর কেউ দুয়েক কলম লিখতে গেলে তাকে কাফের ফতোয়া দেয়া হতো? হিন্দু ভাইদের একটা কথা মনে রাখা উচিত, মুসলমানরা এমনই উদার জাতি—শুধু অতীতেই নয়; বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতেও কেউ এর দৃষ্টান্ত পেশ করতে পারবে না।
(প্রবন্ধটি উর্দু ভাষার ওয়েবসাইট ‘রিখতা ডটকম’ থেকে গৃহীত। প্রবন্ধের নাম ‘ভাষা, যবান আওর মুসলমান’)
তথ্যসূত্র:
↑1 | আবদুর রহিম আকবরের রাজসভার হিন্দি ও তুর্কি ভাষার সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি ছিলেন আকবরের অভিভাবক বৈরাম খানের সন্তান। তিনিই বাবরের আত্মজীবনী ‘বাবরনামা’ ছাগাতাই তুর্কি ভাষা থেকে ফার্সিতে অনুবাদ করেছেন। তার ‘খান-ই-খানা’ উপাধি আকবরের কাছ থেকে পাওয়া। আকবরের দরবারে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুদক্ষ নয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। তারা আকবরকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতেন। এই নয়জন গুণী ব্যক্তিকে একত্রে নবরত্ন বলা হতো।–অনুবাদক |
---|---|
↑2 | তার প্রকৃত নাম শেখ আবুল ফায়েয মোবারক। তিনি আকবরের রাজসভার সভাকবি ও নবরত্নদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।–অনুবাদক |