২৮ নভেম্বরের মধ্যাহ্নে একজন কালো বুড়ো, সরকারি হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের কাউন্টারের সামনে রক্ত দেওয়ার জন্য থরথর করে কাঁপছিল। সরকারি হাসপাতালে ইন্টার্ন করা ছেলেটি বুড়োর কাছ থেকে প্রথমে কাগজ তারপর রক্ত নেওয়ার আগে তার হাত চাইল। বুড়ো কাউন্টার হোলের ভেতর হাত আগিয়ে দিলেন। যেমন চিমনিতে কালো কাঠ! জ্বরে বুড়োর শরীর দাউদাউ করে জ্বলছে। তার শরীর থেকে টেনে বের করা হলো রক্ত।
আপনার সাথে কেউ আসেনি? ছেলেটি জিগ্যেস করল। বুড়ো বলল ‘না বাবা’।
বাইরে মানুষের কলহ ও উচ্চস্বরে চিৎকার শোনা যাচ্ছে, কিন্তু এটা যে হাসপাতাল তা কেউ ভ্রুক্ষেপ করছে না। ক্ষমতার দম্ভে একজন পোশাকি ভদ্রলোক অভদ্রের মতো হাসপাতালের মধ্যেই ফোনে কাকে শাসানি দিয়ে যাচ্ছিল। তুই আয় তোকে এখানেই পুঁতে ফেলব। উপস্থিত জনতা কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে লোকটার দিয়ে তাকিয়ে আবার নিজ নিজ কাজে চলতে লাগল। বুড়ো লোকটা এদের মধ্য থেকে ছিটকে পড়ল বারান্দার মোটা দেওয়ালের কাছে। যেন ছিচকে চোর অথবা নাশকতার মামলায় অভিযুক্ত কোন আসামি!
এই হাত বেশ জটিল। সবসময় কাজ চায়। কাজ খোঁজে! বিলাপ করে। সময় পেলে নীতিকথা নীতিগল্প শোনানোর জন্য মুঠি শক্ত করে তোলে।
হ্যাক!
হ্যাক!
বুড়োটা বমি করে ফেলল। প্রাচীন গুহার মতো দেয়াল চেপে ধরে রইল। নিজের প্রকট বিশ্বাসের মতো।
কালো বোরখা পরিহিত একটি ছায়াকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে আরেকটি বৃহৎ ছায়া।
নাসিমা!
নাসিমা!
আমার মেয়েটাকে কেউ ডেকে দাও।
চাচা আপনার মেয়ের নামে কেস হয়েছে।
নাসিমার নামে?
হ্যাঁ।
বুড়ো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। জ্বরের ঘোরে পাওয়া মেয়েটির সাথে বুড়োর কথোপকথন চলতে থাকে।
দূর থেকে একজন মেয়ের কণ্ঠ শোনা গেল, যার গলা বেশ চড়া। জীবন নিয়ে অতিষ্ঠ। ইচ্ছে থাকলেও সেসব ক্লিনিকে যেতে পারেনি, হুট করে বড়লোকরা যেখানে অঢেল টাকা আগে রিসিপশনে ঢেলে মরতে যায়। বেহেস্তি কায়দায় আপ্যায়ন, বোরাকের মতো দ্রুতগামী লিফট। গোটা এরিয়া শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। ঘাম নেই, ঘাম থেকে সৃষ্ট দুর্গন্ধ নেই। হাসিহাসিভাবে হেঁটে বেড়ানো কর্মচারী। আছে সুগন্ধি অক্সিজেন। মার্জিত কর্পোরেট-বিশিষ্ট নিয়মকানুন। নীল এবং লাল রংয়ের গুচ্ছ গুচ্ছ বসার কেদারা।
হাসপাতালে আপনি এসব কী শুরু করেছেন? সরুন সরুন! আমি অনেকক্ষণ ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। দেখুন আমার মা কত অসুস্থ! আমি খুব বিপদে আছি। আজ বৃহস্পতিবার। যে করেই হোক আমাকে রিপোর্টটা বাইরে থেকে এনে হলেও ডাক্তারের কাছে দেখাতে হবে।
পাশ থেকে একজন মহিলা বলে উঠল, শোনো তোমার বিপদ দেখলে যারা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে তাদের কী হবে?
এরকম অসংখ্য করুণতর দৃশ্য পার করে বুড়ো লোকটা তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছিল। ডাক্তার জিজ্ঞেস করেছিল জ্বর কত দিন? এই তো তিন দিন। টেস্টগুলো করান। তারপর রিপোর্ট নিয়ে কাল আসুন। পাশ থেকে একজন নার্স বলল, স্যার আজ বৃহস্পতিবার। কাল-পরশু দুদিন অপেক্ষা করতে হবে। ডাক্তার ‘ওহ’ বলে সেই কালো বুড়োকে ছেড়ে দিল।
যাক না। এরকম কত বান্দা আসছে যাচ্ছে আমি কী করব?
কিছুই করার নেই। যন্ত্রণা, কষ্ট নেওয়ার কোনো মানুষই নেই।
নাসিমা আমার মেয়ে।
চাচা ওকে পুলিশ খুঁজছে।
কেন?
ভোর চারটার দিকে নাসিমা লোক জড়ো করে গার্মেন্টস মালিকদের বিরুদ্ধে গেটের সামনে মিছিল করেছিল বলে।
নাসিমার তিন মাসের বেতন বাকি। বস্তিতে ঘর ভাড়া বাকি, মুদি দোকানদার প্রতিদিন খোঁজ নেয়, ভালো সাবান, দামি পেস্ট ধারে কিনে বলে খোঁচা মারে। নাসিমার মোবাইলে খারাপ খারাপ ম্যাসেজ দেয়।
কিন্তু আপনার মেয়ে তো পুলিশকে পিটিয়েছে।
নাসিমা পেটাবে?
হ্যাঁ। পত্রিকায় ছেপেছে। নাসিমা ও তার সঙ্গীদের হাতে কয়েকজন পুলিশ আহত।
সময় কেটে যায়। বুড়ো একটা সময় চুপ করে যায়। জ্বরের ঘোরের ঘোড়া ছুটিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে চোখ বুজে। তার শরীর এত কাঁপছে যে মশা স্থির হয়ে বসতে পারছে না। হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ভ্রমণ শেষে মাছিগুলো এখানে এসে ব্যর্থ হয়।
আব্বা দেখ আমি এসেছি।
বুড়ো চোখ মেলে, দ্যাখে তার মেয়ে নাসিমা এসেছে।
তোর স্যার টাকা দিয়েছে? নাসিমা বলে টাকা দেয়নি।
রক্ত পানি করা হালাল টাকা! তবুও দিল না।
ওরা খাচ্ছে। ও টাকা তো ওদের কাছে হারাম। ওরা কি এটা জানে না যে গরিবের হক মেরে খাওয়া কত বড় জুলুম। ক্ষমতার গদিতে বসে আছে একেকটা হারামখোর!
তুই এখানে এলি তোর নামে নাকি কেস হয়েছে?
শক্ত হয়ে নাসিমা বলে, হ্যাঁ হয়েছে। তুমি এখানে পড়ে আছো? এই হাঁটার পথে! জায়গা নাই।
তুই ভালো আছিস?
নাসিমা ব্যথায় কোকাচ্ছে। পুলিশের কাছে মার খেয়ে নিঃস্ব হাতে বাবার কাছে ফিরে এসেছে মেয়েটি।
বুড়ো বলে, নাসিমা তুই চলে যা। তোর নামে মামলা হয়েছে পুলিশ তোকে খুঁজছে।
বুড়োর বিড়বিড় মাগরিবের শেষ মসজিদের আজানের মতো মিলিয়ে যায়। এক এক করে হাসপাতালের লাইটগুলো জ্বলে ওঠে।
হাসপাতালের বারান্দা কাঁপিয়ে একজন আয়া চিৎকার করছে। শুনলাম দুদিন ধরে পড়ে আছে এখানে। কেউ বলেনি কেন আগে?
একজন নার্স বলল, আপা উনার রিপোর্ট। লোকটার ডেঙ্গু জ্বর হয়েছিল। দুদিন ধরে জ্বরের ঘোরে কার সাথে যেন মাঝেমধ্যে কথা বলত। আয়ার হইচই করার ফলে হাসপাতালে নানা কারণে আসা মানুষ আগ্রহে জড়ো হলো। সবাই বুড়োটাকে চেনার চেষ্টা করছে কিন্তু কেউ তাকে চেনে না। বুড়োটা এই শহরে রিক্সা চালাত। কতজন তার রিক্সায় উঠে শহরের শিরা উপশিরায় পৌঁছেছে কিন্তু মনে রাখেনি। এই শহরে কেউ কাউকে তেমন প্রয়োজন ছাড়া মনে রাখে না। বুড়োর শাদা লোমের উদাম বুকে মাছি বসছে তারপর উড়ে যাচ্ছে। মুখ ফাঁক হয়ে গেছে। দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে হলুদ মুত গড়িয়ে বারান্দার পাঁচিল ছুঁয়েছে। পাঁচিলের ওপাশে সদ্য ফোটা লাল গোলাপ বাতাসে দুলছে।
আয়া সবাইকে সরিয়ে বলল, এত দেখছি রাতের মরা। জনগণের ভীড় দেখে আয়াটা বিরক্ত হয়ে বলল, আপনারা জীবনে মরা দেখেননি!
উপস্থিত সবাই মুখে মোনালিসার মতো অদ্ভুত হাসি এনে বলল, আমরা এখানে মরা দেখার জন্য তো দাঁড়াইনি।
আয়াটা চোখ ঘুরিয়ে জিগ্যেস করল, তাহলে!
আসলে কী সুন্দর গোলাপ ফুটেছে, তাই দেখছি।
মজা পাইনি
লেখা তেমন সুন্দর না
আমরা সুন্দর গোলাবটি দেখছি!
আমাদের দৃষ্টিতে গোলাপ আটকায়, মানুষ না।