হলুদ কথোপকথন

আব্দুল আজিজ

বই : বেহুলার বয়ঃসন্ধিকাল

লেখক : আব্দুল আজিজ

প্রচ্ছদ : আইয়ুব আল আমিন

প্রকাশনী : জলধি

পৃষ্ঠা : ৭৯

১. ক্যাম্পের ছেলে

তাজমহল রোডের মাজা বরাবর বড় মিনারঅলা মসজিদের কাছে এসে গাড়িটা হালকা ব্রেক কষে থামে। রাস্তাটা জুমার নামাজের জন্য ব্লক দেখে আর সামনে এগুতে পারল না।

ড্রাইভার মাথা ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকিয়ে বলল, ম্যাডাম রাস্তা নামাজের জন্য ব্লক, আপনি থাকেন আমি একটা চা খেয়ে আসি। ম্যাডাম সানগ্লাসটা নামিয়ে বলল, যাও, দ্রুত এসো। নামাজ শেষ হয়ে যাবে। তারপর সে ঘড়ি দেখতে দেখতে বলল, ক্লাইন্ট কিন্তু দুইটার মধ্যেই পৌঁছাতে বলেছে!

ড্রাইভার বলল, আমরা দুইটার আগেই পৌঁছে যাব ম্যাডাম।

নামাজ শেষ হলে মুসুল্লিদের ভীড়ে ভাগ্যাহত ভিক্ষুকদের দল তাদের অপরিষ্কার হাত পাততে পাততে হারিয়ে যায়।

ড্রাইভার চায়ের দোকানে সিগারেট ধরিয়ে দূর থেকে দেখে তাদের গাড়িটার পাশে ঘুরঘুর করছে একটি দশ বারো বছরের ছেলে । তার হাতে সস্তা রঙিন আইসক্রিম। সেটা খেতে খেতে ছেলেটা গাড়িটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। এরমধ্যে আরও কয়েকটি ছেলে এসে থেমে থাকা গাড়িটার জানালা দিয়ে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করছিল।

ছেলেটা গাড়ির জানালায় ঠকঠক করে শব্দ করলে ভেতর থেকে ম্যাডাম জানালার কাচ নামিয়ে জিজ্ঞাসা করে কী খবর?

ছেলেটার চোখে মুখে অদ্ভুত রকমের একটা হাসি খেলে যায়৷ ভিতরে আসবে?

ছেলেটা মাথা নাড়ায়। তার সাথে আরও যে ছেলেগুলো গাড়িটা দেখছিল তারাও চিৎকার করতে থাকে। আমরাও ঢুকবো, আমরাও ঢুকবো!

ততক্ষণে ম্যাডাম তার গাড়ির গেট বন্ধ করে দিয়েছে।

গাড়িতে বোরিং লাগছিল দেখে ছেলেটার সাথে সে কথা বলা শুরু করে। কথা বলতে বলতে ম্যাডামের ফোনে একটা কল আসে, হ্যালো! হ্যাঁ বলেন। আমি আসছি, রাস্তা নামাজের জন্য ব্লক ছিল তাই সেখানেই আটকে আছি। আর পাঁচ মিনিট।

কথা শেষ হলে ম্যাডাম তার ফোনে ফেইসবুক স্ক্রল করতে করতে ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করে, তুমি ক্যাম্পের ছেলে?

ছেলেটা বলে হ্যাঁ।

তারপর ম্যাডামের ফোনটা হাতে নিয়ে ছেলেটা দেখতে থাকে। আর উর্দুতে কীসব বলে হেসে গড়িয়ে পড়ে।

সিগারেট শেষ করে গাড়ির ড্রাইভার এসে দ্যাখে তার ম্যাডামের পাশে বিহারি ছেলেটা বসে তামাশা করছে, সাথে মোবাইলটা নতুন সেন্ডেল দেখার মতো উলটে পালটে দেখছে।

এই বাইঞ্চোত তুই কি করস গাড়ির ভিতরে!

ম্যাডাম তার ড্রাইভারকে কিছু বলার আগেই, ড্রাইভার ছেলেটার হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বলে, ম্যাডাম ফোনটা আগে ধরেন৷ ওর ব্যবস্থা আমি করতাছি।

কান ধরে কুকুরের বাচ্চার মতো ছেলেটাকে টানতে টানতে একটি বাইকের শো-রুমের সামনে নিয়ে ধমকা-ধমকি শুরু করল।

এরই মধ্যে লোকজন জুটে গেছে৷ তারপর যখন ছেলেটাকে দেখল, তারপর বলল ও তো ক্যাম্পের বদমাইশ!

মানে সে অপরাধ করেছে।

ড্রাইভার ছেলেটাকে এমনভাবে ধরেছে যে ভয়ে সে কাঁদতে শুরু করল৷ চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে৷

ড্রাইভার তো আজ ছেলেটাকে ক্যাম্পের হোটেলের নানা পদের ভর্তার মতো পিটিয়ে ভর্তা বানিয়ে ফেলবে৷

আরও মানুষ জুটল। সবাই মজা দেখছে। হ্যাঁ ধরা গেছে তাকে। এরা একেকটা দুর্ধর্ষ, মোবাইল ছিনতাই করাতে এক্সপার্ট। মোবাইল ছিনতাই থেকে শুরু আর মাদক দিয়ে শেষ, এর মধ্যে বিশাল কিছু ঘটিয়ে ফেলে।

সবাই যখন ছেলেটার কান্নারত মুখের দিকে তাকিয়ে মজা দেখছে তখন কয়েকজন বলল ছেড়ে দেন ভাই।

ড্রাইভার বলল আমার ম্যাডামের ফোন জানালা থেকে চিলের মতো ছো মেরে নিয়ে গেছে।

সে তো নেয়নি। ভীড় থেকে একজন বলল।

সে না নিলেও তাদের মধ্যেই কেউ একজন নিয়েছে। একে আজ ছাড়ছি না।

এরকম ধস্তাধস্তি চলল কিছুক্ষণ। তারপর একজন বয়স্ক লোক বলল ছেড়ে দেন৷ ও তো চুরি করেনি তাহলে এসব করছেন কেন?

ড্রাইভার চুপ করে রাগে ফুঁসছে।

এই গ্যাঞ্জামের ভেতর কোত্থেকে একজন উড়ে এসে ছেলেটাকে চড়-থাপ্পড় মারতে লাগল। ছেলেটা মা গো! বলে আরও জোরে কাদঁতে শুরু করল।

সবাই হতবাক হয়ে বলল আরে আপনি ছেলেটাকে ওভাবে মারছেন কেন?

যে লোকটা এসে মারছিল, ছেলেটার মতো সেও ক্যাম্পের একজন বাসিন্দা।

পরিস্থিতি এমন যেন যে কেউই তাদের মারতে পারে। ওরা জন্ম নিয়েছে অপবাদ ঘাড়ে নিয়ে মার খাওয়ার জন্য। সমাজের অবৈধ সন্তান বলে কিছু থাকে নাকি? হ্যাঁ থাকে! অবশ্যই থাকে এবং আমাদের চারপাশেই থাকে।

ড্রাইভার তার ম্যাডামকে বলল, ম্যাডাম এই বাইঞ্চোতকে কী করব?

ম্যাডাম মৃদুস্বরে বলল ওকে ছেড়ে দাও, ঝামেলা করিও না। দ্রুত গাড়ি ঘুরাও বাড়ি যাব।

ড্রাইভার অবাক হয়ে বলল, কেন বাড়ি ম্যাডাম!

ক্লাইন্ট কল করেছিল, শালার বউ নাকি বাড়ি চলে আসছে।

দুইটার মধ্যে পৌঁছাতে পারিনি।

গাড়ি ঘুরাও।

ড্রাইভার ছেলেটাকে ছেড়ে দিল। ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে ছেলেটা হাসল। ম্যাডাম ও সানগ্লাসটি নামিয়ে হেসে হাতে চকোলেট ধরিয়ে দিয়ে বলল, বাড়ি যাও।

গ্যাঞ্জাম ভেঙে গেল।

ছেলেটা চোখ মুছতে মুছতে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর যে লোকটা ছেলেটাকে চড়-থাপ্পড় মেরেছিল সে তার কাছে গিয়ে প্যান্টের পকেট হাতাতে থাকে। কোন পুরিয়া আছে?

ছেলেটা বলে, কিসের পুরিয়া?

লোকটা নিজের ইঙ্গিতময় ভাষা ব্যবহার করল। ছেলেটা ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল কিন্তু কোন উত্তর দিল না।

লোকটা বলল, ক্যাম্পের কোথায় থাকিস?

ভয়ে মুখ কালো করে ছেলেটা উত্তর দিল ঠিকই, কিন্তু মুখে চকোলেট থাকায় কী বলল তা স্পষ্ট বোঝা গেল না৷

ভাগ শালে বাইঞ্চোত! ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে লোকটা চলে গেল।

 

২. হলুদ কথোপকথন

ফায়ার সার্ভিসের ওপর অভিযোগ এনে একজন বিহারি বলল, এই যে আগুন লাগল পুড়ে শেষ হয়ে গেল সব কিন্তু তারা কি আগুনের হাতে লুটপাট হয়ে যাওয়া মালপত্র বাঁচাতে পারল?

পাশের জন বলল ওরা কি খোদা! যে বাঁচাতে পারবে?

ওপরের কথোপকথন শুনতে শুনতে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া কৃষি মার্কেটের সামনের এক খাবার হোটেলের দিকে এগিয়ে যাই।

পুড়ে ধ্বংস শশ্মানের মতো জায়গাটিতে প্রথম কয়েকদিন পুলিশ লাঠি হাতে বসে থাকত। সেখানে আগুন নিভে গেলেও ধোঁয়ার কুণ্ডুলি দেখা যেত। এখন অবশ্য পুলিশ, ধোঁয়া কিছুই নাই। তবে চাপা জমাট ছাই থেকে একটা বিশ্রী গন্ধ বের হয়।

ছাইয়ের স্তূপের মধ্যে আশেপাশের গরিব বিহারি মানুষেরা লোহার শিক নিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিনিস খুঁজে বের করে। যেমন আধ পোড়া কাপড়, স্টিলের জিনিসপত্র, পুড়ে যাওয়া তারের ভেতরের তামা, চিনামাটির মগ, বাটি ইত্যাদি। কিন্তু সবার লক্ষ্য পুড়ে যাওয়া স্বর্ণের দোকানের আশেপাশের স্তূপ থেকে সোনার গয়না টয়না পাওয়ার আশা। কিন্তু তাদের সবার আশায় পোড়া ছাই।

তবুও থেমে নাই তারা, সবাই সবার মতো করে খুঁজে চলেছে। কেউ বারণ করছে না। আর সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে উন্নয়নের খাতিরে দ্রুত পরিষ্কারের কাজ চলছে।

হোটেলে ঢোকার মুখে রান্নার গমগমে আয়োজন দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। খুশবু নিতে নিতে হোটেলে ঢুকে দেখি মানুষে গিজগিজ করছে। শত শত কথোপকথন ঘুরপাক খাচ্ছে এই হোটেলের ভেতর। কোথাও বসার জায়গা নাই। যেন দুদিন আগে এখানে কিছুই হয়নি! চোখ বুলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। দেখি খাবার অর্ডার নিতে আর বিলের কাগজ ধরিয়ে দিতে ব্যস্ত হোটেল বয়গুলো।

মানুষের তৃপ্তি সহকারে খাওয়া দেখে মনে হলো ক্ষুধার চেয়ে বড় কিছু নাই। পুড়েছে! আবার হবে। পেট তো থেমে থাকবে না! আল্লাহ কেন যে পেট দিয়েছিল? এই পেটের জন্যই তো মানুষের এত কম্পিটিশন।

এক্সকিউজ মি! হ্যাঁ ভাই, এই যে এদিকে। আসছি, কী দিব রুটি না পরোটা? তার সময় নাই। অর্ডারটি দিয়ে অপেক্ষা করছি। ভাবছিলাম পেটের কাছে শোকের কোনো দাম নাই। গমগমে হোটেলের ভেতর আমার ভাবনাটা হয়তো কারো কারো কথোপকথনে প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসছে। এরকম হলুদ কথোপকথন ছাড়া খাওয়া জমে ওঠে না। কারণ অনেক সময় হজমের ক্ষেত্রে এই কথোপকথন কোকাকোলার চেয়েও দারুণ কাজ করে।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷