সীরাতপাঠ : প্রয়োজনীয়তা এবং আমাদের ক্ষমাহীন উদাসীনতা

কাজী একরাম

মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনই এক নিখুঁত ও পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্ব যে, তাঁর সামগ্রিকতা, পরিপূর্ণতা ও সার্বজনীনতা মহাবিশ্বের প্রতিটি অংশকে, প্রতিটি অণুকে এবং মানবজীবনের প্রতিটি দিক-কোণকে প্রভাবিত করেছে। ইবাদত বা লেনদেন, নৈতিকতা বা সমাজ, আদালত বা রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় অধ্যাদেশ বা কূটনৈতিক সম্পর্ক, যুদ্ধের ব্যবস্থা বা ঘরোয়া বিষয়, সব কিছুর মধ্যেই তাঁর ব্যক্তিসত্তা একটি নিখুঁত উদাহরণ হিসাবে প্রতিভাত। তাঁর সীরাত মানবজীবনের সবটুকুজুড়ে ব্যাপৃত। নবুওয়তের পূর্বের জীবনে তিনি একজন বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী, সর্বোত্তম স্বামী, একজন ভালো বন্ধু, এতিম-অনাথের আশ্রয়, বিধবা ও দরিদ্রজনের সহানুভূতি এবং সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার ধারক আল আমীন। আর নবুওয়তের পর একজন মহান দাঈ, যুদ্ধে মহান সেনাপতি, মদীনা রাষ্ট্রের প্রধান, একজন সফল বিচারক, একজন সফল শিক্ষক, একজন সফল নেতা, একজন সফল রাজনৈতিক। মহান আল্লাহ তাই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কিয়ামত অবধি সর্বোত্তম আদর্শ হিসেবে উম্মাহর সামনে উপস্থাপন করেছেন। বলেছেন, নিশ্চয়ই তোমাদের এমন প্রত্যেকের জন্য আল্লাহর রাসূল এর মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে, যে আল্লাহ ও শেষ দিবসে প্রত্যাশা রাখে এবং বারবার আল্লাহকে স্মরণ করে। (আল-আহযাব : ২৯)

একজন মুসলিম হিসেবে, আমাদের বিশ্বাস হলো শুধুমাত্র মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ব্যক্তিত্বই আমাদের জন্য নিখুঁত ও আদর্শ উদাহরণ। আমাদের এই দাবি শুধু ভক্তি ও ভালোবাসাজাত নয়, বরং যুক্তি-বুদ্ধির সিদ্ধান্তও এটাই এবং ইতিহাসের সাক্ষ্যও এটাই যে, প্রতিটি মানুষের সফলতা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত শিক্ষাধারা ও জীবনদর্শন অনুসরণের মধ্যেই নিহিত। ড. মুস্তফা আস সিবায়ি তাঁর ‘সীরাতুন নবী দুরূস ওয়া ইবার’ গ্রন্থে, সীরাতের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ব্যক্ত করেছেন, যেগুলোর অধ্যয়ন শুধু ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে পরিচিতিই দেয় না, আত্মা ও বুদ্ধিকেও শক্তিশালী করে। এই অধ্যয়ন যেমন উলামা, দ্বীনের প্রচারক এবং সমাজ সংস্কারকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সাধারণ মুসলমানদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ; যাতে তারা জানতে পারেন ইসলামই সকল সংকট, সমস্যা, দুঃখ এবং দূর্দশার একমাত্র সমাধান। আমরা সেসকল বৈশিষ্ট্য ঈষৎ সংযোজনসমেত এখানে উল্লেখ করছি।

 

প্রথম বৈশিষ্ট্য

এটি একজন নবী, একজন মহান সংস্কারকের প্রকৃত সীরাত। এই জীবনী আমাদের কাছে এমনভাবে উন্নীত হয়েছে যা নবী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতির সত্যতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহের অবকাশ রাখে না। সীরাতের এই বৈশিষ্ট্য সন্দেহাতীত এক সুনির্দিষ্ট সত্য। এই বৈশিষ্ট্যে কোনো নবী বা রাসূল তাঁর মোকাবিলা করতে পারে না। মুসা আলাইহিস সালামের জীবনী যথাযথ বিবরণে আজ বিদ্যমান নেই এবং তার প্রকৃত জীবনী বের করতে এমনকি তাওরাতকেও সমর্থন হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। ইহুদী পণ্ডিতগণ এতে পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে দিয়েছেন। যীশুর (আলাইহিস সালাম) জীবনীর ক্ষেত্রেও অবস্থা তথৈবচ। যে সংকলনটিকে ইনজিল (গসপেল) বলা হয়, তার সংকলকদের নিয়েও ঢের মতবিরোধ রয়েছে যে, তারা আসলে কারা এবং তারা কোন প্রজন্মের ছিল?

এটি তো বিভিন্ন ধর্মের নবী-রাসূলদের জীবনীর হালচাল, অন্যদিকে দুনিয়ার অন্যান্য মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা ও দার্শনিকদের জীবনী মানে বানোয়াট গল্পকাহিনি এবং প্রজন্মান্তরে চলে আসা কিছু উপাখ্যান মাত্র। একটি কুসংস্কারমুক্ত স্বাধীন মন কখনই সঠিক বলে যাকে বিশ্বাস করতে পারে না। এককথায়, সবচেয়ে সঠিক সীরাত ও জীবনধারা এবং জ্ঞানগত যুক্তি-প্রমাণ এবং অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতায় সত্যে পৌঁছেছে, তা কেবল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জীবন! Mohammad and the Origin of Islam শীর্ষক রচনায় আর্নেস্ট রেনানের স্পষ্ট স্বীকারোক্তি : ‘অন্যান্য ধর্ম যেমন রহস্যাবৃত দোলনায় লালিত হয়েছিল, ইসলামের ব্যাপার সম্পূর্ণ বিপরীত, ইসলামের অভ্যুদয় হয়েছে ইতিহাসের পরিপূর্ণ আলোকে। ইসলামের শিকড়গুলো ভূপৃষ্ঠের দৃশ্যমান স্তরে প্রোথিত এবং তার প্রবক্তা ষোড়শ শতাব্দীর সংস্কারকদের মতই আমাদের কাছে সুপরিচিত।’

 

দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য

নবীজীর জীবনের সকল স্তর সম্পর্কে আমরা পূর্ণ অবগত। তার বাবা-মায়ের বিয়ে থেকে নিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর পুরো জীবন সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। আমরা তাঁর জন্ম, শৈশব, যৌবন, প্রাত্যহিক জীবন এবং নবুওয়তের পূর্বের উপার্জন, এই উদ্দেশ্যে মক্কার বাইরে সফর করা, তারপর নবুওয়ত লাভ করা, অর্থাৎ যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে ভালোভাবে আমরা ওয়াকিবহাল। এরপর পরবর্তী সম্পূর্ণ পরিস্থিতিও অত্যন্ত সুস্পষ্ট, পূর্ণাঙ্গ ও দৃশ্যমান আকারে আমাদের সামনে হাজির, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনকে সূর্যের চেয়েও উজ্জ্বল করে তোলে। ব্যক্তিগত জীবন, উঠা-বসা, খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ, চেহারা-সূরত, কথো-পকথন, পরিবারের সদস্যদের সাথে আচরণ, ইবাদত-বন্দেগি, বন্ধু-বান্ধবের সাহচর্য ও সামাজিকতা, সমগ্র জীবনই আমাদের চোখের সামনে। বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সীরাত বর্ণনাকারীদের পরিশ্রম এতদূর যে, তারা তাঁর বরকতময় মাথা ও দাড়িতে সাদা-পাকা চুলের সংখ্যাও বর্ণনা করে দিয়েছেন। এর দৃষ্টান্ত অন্য কোনো রাসূলের জীবনে পাওয়া যায় না। এ থেকে জানা হয়ে যায় যে, তিনি শেষ নবী হিসেবে পৃথিবীতে এসেছিলেন।

 

তৃতীয় বৈশিষ্ট্য

রাসূলের সীরাত এমন এক ব্যক্তির জীবনী যাকে আল্লাহ তাঁর রাসূল বানিয়েছেন, কিন্তু এই জীবনী মানুষের সীমা ও অনুশীলনের বাইরে নয়। পৃথিবীতে উপকারী উপদেশ, সুমিষ্ট বাণী ও চমৎকার শিক্ষামালার অভাব নেই, অভাব হলো কর্ম ও অনুশীলনের। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে পয়গাম প্রদান করেছেন, নিজ কর্ম দ্বারা তা কার্যকর করে দেখিয়েছেন। শান্তি ও যুদ্ধ, দারিদ্র ও ঐশ্বর্য, বান্দা ও প্রভুর সম্পর্ক, মানুষের সাথে সম্পর্ক, সামাজিক জীবন, ব্যক্তিগত জীবন—রাসূলুল্লাহ এসবেরই ব্যবহারিক নমুনার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন, তাঁর সাহাবীগণ এর অনুশীলন করেছেন এবং তাঁদের পরে অগুণতি মানুষ এটি অনুসরণ করে এর কার্যকরতার প্রমাণ দিয়েছেন।

 

চতুর্থ বৈশিষ্ট্য

কেবলমাত্র মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনীই আমাদেরকে এমন প্রমাণ সরবরাহ করে, যা তাঁর নবুওয়ত ও রিসালাতের সত্যতা সম্পর্কে কোনোরূপ সন্দেহ থাকতে দেয় না। এটি একজন ইনসানে কামিলের জীবনী, যিনি তার আহ্বান নিয়ে ধাপে ধাপে এগিয়েছেন। অলৌকিকতায় ভর করে নয়, বরং প্রাকৃতিক উপায়ে সমস্ত ধাপ অতিক্রম করেছেন। দাওয়াত দিতে গিয়ে নির্যাতিত হয়েছেন। তাবলীগ করেছেন, ফলে সাহাবীদের একটি জামাত পেয়েছেন। ক্ষুধা সয়েছেন। দেশ ছেড়েছেন। লড়াই করতে বাধ্য হয়েছেন তো লড়াই করেছেন। সঙ্গীগণ তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁর নেতৃত্ব ছিল প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার এক শ্রেষ্ঠতম নমুনা। অতএব, যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকাল করছেন, তখন তাঁর দাওয়াহ তরবারির জোরে নয়, বরং তাবলীগ ও আমলের মাধ্যমে সমগ্র আরবে ছড়িয়ে পড়েছিল। যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দাওয়াতের ইতিহাস জানেন, তিনি জানেন, আরবরা যেভাবে তাঁর বিরোধিতা করেছিল, যেভাবে তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল এবং তাঁর ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল, তা সত্ত্বেও, প্রতিটি যুদ্ধে লোক ও অস্ত্রের অভাব সত্ত্বেও, তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। যেভাবে তিনি মৃত্যু পর্যন্ত শান্তি ও চুক্তি বজায় রেখেছিলেন এবং যেভাবে তেইশ বছরের অল্প সময়ের মধ্যে তার দাওয়াহ ছড়িয়ে পড়েছিল এবং যে শক্তি ও ক্ষমতা অর্জিত তার হয়েছিল তা এই কারণে যে তিনি সত্যই আল্লাহর নবী ছিলেন, কারণ আল্লাহ কোনো মিথ্যাবাদীকে এভাবে সাহায্য করতে পারেন না। কাজেই, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সীরাত যুক্তির ভিত্তিতেও তাঁর নবুওয়তের সত্যতা প্রমাণ করে।

এখানে মনে রাখতে হবে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছ থেকে প্রকাশিত অলৌকিক ঘটনাগুলো আরবদের ঈমান আনয়নের মূল কারণ ছিল না, বরং আমরা এমন কোনো অলৌকিক ঘটনা দেখতে পাই না যার কারণে কাফেররা ইসলাম গ্রহণ করেছিল, বরং যারা মুসলমান হয়েছিল, আপন বুদ্ধি ও বিবেকের সন্তুষ্টির মাধ্যমে মুসলমান হয়েছিলেন। আর যখন কাফের কুরাইশরা পূর্ববর্তী জাতিসমূহের মত অলৌকিক ঘটনাপ্রদর্শনের দাবী জানায়, তখন আল্লাহ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এর জবাবে তাদেরকে বলতে আদেশ দেন : আর তারা বলল, আমরা তোমার কথা শুনব না যতক্ষণ না তুমি আমাদের জন্য জমিনকে ফেটে একটি ঝর্ণা বের না করো অথবা তোমার জন্য একটি খেজুর ও আঙ্গুরের বাগান সৃষ্টি হবে যাতে নদী প্রবাহিত করো। হয় আকাশকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে তোমার দাবি অনুযায়ী আমাদের উপর পতিত করো, অথবা আল্লাহ ও ফেরেশতাদেরকে আমাদের সামনে নিয়ে আস, অথবা তোমার জন্য স্বর্ণের ঘর তৈরি কর, অথবা আকাশে আরোহণ কর এবং আমরা তোমার ঊর্ধ্বগমনে বিশ্বাস করব না, যতক্ষণ না আমাদের কাছে এমন একটি লেখা নাযিল করবে যা আমরা পড়তে পারি। আপনি তাদেরকে বলুন, হে নবী, আমার পালনকর্তা পবিত্র, আমি কি পয়গাম বহনকারী ব্যক্তি ছাড়া আরও কিছু। (বনি ইসরাইল : ৯০-৯৩)

তদুপরি, অলৌকিক ঘটনাগুলি কেবল তাদের উপরই একটি যুক্তি হতে পারে যারা তা প্রত্যক্ষ করে এবং পরবর্তী লোকেরা যারা নবীকে দেখেননি, বা তাঁর অলৌকিক ঘটনাগুলিও দেখেননি, তারা শুধুমাত্র যৌক্তিক এবং সুনির্দিষ্ট কারণেই তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। এবং সেই যৌক্তিক প্রমাণের মধ্যে সর্বাগ্রে হলো আল কুরআন। এই কিতাব একটি বুদ্ধিবৃত্তিক মুজিযা; যা প্রত্যেক ন্যায়পরায়ণ ও বিবেকবান ব্যক্তিকে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সত্যতা এবং নবুওয়ত ও রিসালাতের সত্যতায় বিশ্বাস করতে বাধ্য করে। সূরা আনকাবুতে আল্লাহ সুস্পষ্টভাবে বলেন, এরা বলে যে, এই ব্যক্তির উপর তার রবের পক্ষ থেকে নিদর্শন নাযিল করা হলো না কেন? বলুন, আল্লাহর কাছে নিদর্শন রয়েছে এবং আমি তো প্রকাশ্য সতর্ককারী মাত্র। আর এই লোকদের জন্য কি এই নিদর্শন যথেষ্ট নয় যে, আমি আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি যা তাদের কাছে পাঠ করা হয়? নিশ্চয় এতে বিশ্বাসীদের জন্য রহমত ও পথনির্দেশ রয়েছে। (আনকাবুত : ৫০-৫১)

যে ব্যক্তি কুরআন গভীরভাবে অধ্যয়ন করবে, সে বুঝতে পারবে যে এই কিতাবটি সন্তুষ্টি ও সান্ত্বনা প্রদানের নিমিত্ত বুদ্ধিমত্তার বিচারকে, বাস্তব ও দৃশ্যমান চিত্র এবং পরিপূর্ণ অভিজ্ঞানকে অবলম্বন করেছে, কারণ রাসূল ছিলেন একজন উম্মী এবং এই উম্মীয়তকে কুরআন তাঁর নবুওয়তের সত্যতার পক্ষে প্রমাণ হিসেবে পেশ করেছে।

এই ক্ষেত্রেও, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সীরাত অন্যান্য সমস্ত নবীদের জীবনী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, যাদের জীবনী আমাদেরকে বলে যে, লোকেরা তখনই তাঁদের উপর বিশ্বাস করেছিল, যখন তারা তাঁর হাতে অলৌকিক ঘটনা এবং বিস্ময় দেখেছিল। তাঁদের আহ্বানের নীতির সত্যতার ক্ষেত্রে তারা যুক্তির বিচারও অনুসরণ করেননি। এর বিপরীতে, মুজিযা বা অলৌকিক বিস্ময় দেখে এক ব্যক্তিও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি বিশ্বাস আনয়ন করেনি। একইভাবে, কুরআন সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে যে, মুহাম্মদ একজন মানুষ, একজন রাসূল এবং নবুওয়তের দাবিতে অলৌকিকতায় নির্ভর করা যায় না। সে তো বুদ্ধিবৃত্তি এবং হৃদয়কে সম্বোধন করে, সুতরাং আল্লাহ যাকে পথ দেখাতে চান, তিনি তার বক্ষ ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। (আনআম : ১২৫)

 

পঞ্চম বৈশিষ্ট্য

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সীরাত মানব জীবনের সকল বিভাগ ও ক্ষেত্রের জন্য শিক্ষা সরবরাহ করে। এটি সেই যুবকের জীবন আমাদের সামনে তুলে ধরে, যে নবুওয়তের আগে সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত হিসেবে স্বীকৃত ও সুবিদিত ছিল। সেই দাঈ রাসূলের জীবন আমাদের সামনে পেশ করে, যিনি এক আল্লাহর দিকে ডাকতেন এবং তাঁর দাওয়াত ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সর্বোত্তম পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। আপন পয়গাম জানাতে তিনি সর্বোচ্চ পর্যায়ের শক্তি, সক্ষমতা এবং প্রচেষ্টা ব্যয় করতেন। একইভাবে, আমাদের কাছে এমন একজন রাষ্ট্রপ্রধানের দৃষ্টান্ত হাজির করে, যিনি তার রাষ্ট্রকে সর্বোত্তম এবং সবচেয়ে সঠিক উপায়ে পরিচালনা করতেন এবং বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তা, আন্তরিকতা ও সততার মাধ্যমে এর সুরক্ষা ও সাফল্য নিশ্চিত করতেন। একইভাবে, আমাদের সামনে বর্তমান এমন একজন নবীর জীবন, যিনি একজন পিতা, সহানুভূতি ও ভালবাসার আঁধার, একজন দায়িত্বশীল স্বামী, যিনি তার স্ত্রী ও সন্তানদের সকল অধিকার ও দায়িত্ব পালনকারী ছিলেন। এমন নবী যিনি একজন মুরব্বী হয়ে তাঁর সাহাবীদেরকে এমন অনুকরণীয় প্রশিক্ষণ করতেন যে, তাদের হৃদয়ে নিজের হৃদয় ঢেলে দিতেন এবং তাদের আত্মায় নিজের আত্মাকে স্থাপন করতেন, যার কারণে তারা তাদের ছোট বড় সমস্ত বিষয়ে তাঁর আদেশ অনুসরণ করে চলতেন। তিনি ছিলেন সেরা বন্ধু যিনি বন্ধুত্বের দায়িত্বগুলি বুঝতেন এবং ভালোভাবে পালন করতেন, যার কারণে তাঁর সঙ্গীরা তাঁর প্রতি নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসা লালন করতেন, তাকে তাদের নিজেদের পরিবার এবং প্রিয়জনদের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। একজন বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী, একজন সামরিক নেতা, একজন সফল বিচারক, একজন সফল শিক্ষক, একজন সফল রাহবর, একজন সফল রাজনৈতিক নেতা এবং একজন সত্যিকারের কূটনৈতিক। অর্থাৎ, প্রত্যেক দাঈ, প্রত্যেক নেতা, প্রত্যেক পিতা, প্রত্যেক স্বামী, প্রত্যেক বন্ধু, প্রত্যেক পরামর্শদাতা, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য সর্বোত্তম নমুনা রয়েছে তাঁর জীবনাদর্শে।

আমরা এই পর্যায়ের পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ বা অনুরূপ ব্যাপকতা ও সামগ্রিকতার সন্ধান আর কোথাও কারো মাঝে পাই না। ইতিহাস আমাদের সামনে যাদেরকে সফল ব্যক্তি হিসেবে হাজির করে, তারা জীবনের ক্ষেত্রবিশেষে শ্রেষ্ঠত্ব ও সাফল্য অর্জন করে তাতে বিখ্যাত হয়েছিল। একক মানুষ যিনি সকল শ্রেণী, গোষ্ঠী এবং প্রতিটি ব্যক্তির জন্য সফল ও স্বার্থক আদর্শ হতে পারেন তিনি কেবল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

 

আমাদের ক্ষমাহীন উদাসীনতা

দুঃখের বিষয় যে, আজ আমরা মুসলিমরা সীরাত অধ্যয়নে এবং এর অনুসরণে যেভাবে অবহেলা করছি এবং এর পয়গামকে ভুলে যাচ্ছি, তা হয়তো এ যুগের ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়; আমরা জানি না রাসূলের নৈতিকতা ও আচরণ কেমন ছিল? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্ত্রীদের সাথে কেমন ব্যবহার করতেন? বন্ধুদের সাথে তাঁর আচরণ কিরূপ ছিল? কাফির ও মুনাফিকদের প্রতি তাঁর মনোভাব কী ছিল? মদীনারাষ্ট্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কীভাবে শাসন করতেন? রাসূলের করুণা ও দয়া, পরিশ্রম ও সহানুভূতি, খোদাভীতি ও আল্লাহমুখিতা, সাহস ও আস্থা, সততা ও ন্যায়নিষ্ঠা, উদারতা ও মহানুভবতা, নিঃস্বার্থতা ও দায়িত্ববোধ, বিনয়, ধৈর্য ও তাওয়াক্কুল, এর পাশাপাশি গার্হস্থ্য জীবনে সর্বোত্তম সঙ্গী, দয়ালু প্রধান, এভাবে জাতীয় জীবনে ন্যায়বিচার, সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব, সরকার পরিচালনা, জনপ্রীতি, রাজনৈতিক বোঝাপড়া, বন্ধুদের প্রতি সদ্ভাব, শত্রুদের প্রতি সদাচার—অর্থাৎ যেই মহান নৈতিকতা ও পরিপূর্ণতার ভিত্তিতে বিশ্বজগতের প্রভু যাকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় ভূষিত ও অধিষ্ঠিত করেছেন, আমরা সে-সব সম্পর্কে অজ্ঞ এবং বেখবর!

একদিকে মুসলিম উম্মাহ এক বিপর্যয়কর ও সংকটময় পরিস্থিতির মধ্যে পতিত, অন্যদিকে অগণিত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ইসলামবিরোধী শিবির পাশবিকতা, ধূর্ততা দিয়ে ইসলামকে মুছে ফেলতে সতত ব্যস্ত। তাদের আক্ষেপ হলো কবে তারা পার্থিব উপকরণ, বস্তুগত জীবনের বিলাসিতা এবং শারীরিক সম্ভোগের প্রলোভনে মুসলিম তরুণ প্রজন্মকে আত্মিক ও আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য ও সুখানুভব থেকে বঞ্চিত করবে। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শিক্ষার প্রকৃত চেতনাকে বিকৃত করে মুসলমানদের হৃদয় থেকে তাঁর ভালোবাসার ভাব-চিহ্নকে মুছে দেবে। তাই একদিকে ইসলাম বিদ্বেষী লেখক গবেষক ও পক্ষপাতদুষ্ট প্রাচ্যবাদীরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মহান সত্তা সম্পর্কে সন্দেহ ও সংশয় ছড়িয়ে দেয়, তাঁর ব্যক্তিত্বকে নিছকই বস্তুগত স্তরে মানুষের সামনে তুলে ধরে, তাঁর গুণাবলী ও পূর্ণতাকে অস্বীকার করে এবং নবুওয়তের অবস্থান, তাৎপর্য নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক করে, অপরদিকে, এই সুযোগে নবীর অবমাননাকারীরা তাঁর মাকাম ও মর্যাদার উপর আপত্তি তুলতে শুরু করে।

প্রকৃতপক্ষে, এর দায় আমাদের। সীরাতের অধ্যয়ন ও অনুসরণ এবং এর প্রকৃত দাবি ও গুরুত্বের উপলব্ধি খোদ আমাদের হৃদয় থেকে মুছে গেছে। আমাদের জীবনের ধারা এমন হয়ে গেছে যে, সীরাত অধ্যয়ন ও অনুসরনের অভাবে উদ্ভূত এই গুরুতর শূন্যতা ও বঞ্চনার বোধটুকুও আজ অন্তর্হিত হয়ে গেছে! এর জন্য অতএব আমরা ছাড়া আর কেইবা বেশি দায়ী!

 

বর্তমান যুগে সীরাতের প্রাসঙ্গিকতা

সত্য যে, সীরাতের প্রয়োজনীয়তা প্রতিটি যুগেই ছিল, কিন্তু বর্তমান সময়ে এর গুরুত্ব-প্রয়োজনীয়তা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কেননা, বর্তমান যুগ বিশ্বায়ন (Globalization)-এর যুগ, এবং সমগ্র বিশ্ব একটি বৈশ্বিক ব্যবস্থা (Global System)’র দিকে তীব্র গতিতে ধাবমান। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আকাশ স্পর্শ করছে। প্রতিদিন নিত্য নতুন উদ্ঘাটন এবং আবিষ্কার হচ্ছে, বস্তুবাদের বন্যা এতই অনর্গল যে, থামছেই না, সর্বত্র বিলাস-সামগ্রীর প্রাচুর্য। শহর এবং গ্রাম এখন আধুনিক সুযোগ- সুবিধা দিয়ে সজ্জিত, কিন্তু মানুষের জীবন শেষ নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা, শান্তি ও সমৃদ্ধির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া বেরিয়ে গেছে, বরং সেই জাহেলিয়াতের যুগ আবারও ফিরে আসতে উদ্যত, যার মূলোৎপাটনের জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেরিত হয়েছিলেন। জাহেলিয়াত, কুসংস্কার, লুণ্ঠন, মেয়েশিশু হত্যা, অধিকার হরণ বর্তমান জাহেলিয়াতের ইশতিহারে পরিণত হয়েছে। এমন এক বিশৃঙ্খল যুগে ও উত্তাল পরিবেশে সমগ্র মানবতা আজ কেবলই এক উদ্ধারকারী নেতৃত্বের জন্য অপেক্ষমান। এমতাবস্থায় আমরা কেবল একটি প্রদীপ দেখতে পাই যেটি তার রশ্মিপাতে এই পথের অভিযাত্রীদেরকে গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা রাখে এবং যার আলোর মাঝে মানুষের জন্য কেবল এই দুনিয়ার নয়, পরকালের পরিত্রাণেরও দিশা রয়েছে। প্রদীপটি হলো এই ‘সীরাত’। কেননা, ইতিহাস সাক্ষী, যদি মানবতার কল্যাণকামী কেউ থেকে থাকে, তাহলে তিনি হলেন শেষ যমানার নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

 

করণীয় প্রস্তাব

(১) সাধারণভাবে মুসলিম উম্মাহ এবং বিশেষ করে আলেমদের দায়িত্ব হচ্ছে বিশ্বের জাতিসমূহের নেতৃত্ব ও নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করা, যা নববী উত্তরাধিকার হিসেবে তাদের উপর অর্পিত হয়েছে। সুতরাং উম্মাহর সম্মুখীন সমসাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা, হোক তা ধর্মীয় বা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক, প্রতিটির কারণ পর্যালোচনা করে সীরাতের আলোকে এর সমাধান ও কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত করতে হবে।

(২) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফাযায়েল, শামায়েল ও খাসায়েল ছাড়াও সীরাতকে আধুনিক বিভিন্ন দিক থেকে অধ্যয়ন করা। সীরাত নিয়ে উত্থাপিত প্রশ্নের অ্যাকাডেমিক, ব্যবহারিক, এবং আকলি-নকলি যুক্তির আলোকে উত্তর দেওয়া। একই সাথে এই দিকটি তুলে ধরা যে, ইসলাম শুধু প্রথম কয় শতাব্দীর নয়, বরং প্রতিটি যুগের সমস্যার সমাধান দেয় এবং সমস্যার সমাধান ও সমস্যা থেকে উত্তরণ পেতে সীরাতের দিকে প্রত্যাবর্তন প্রতিটি যুগের প্রয়োজন।

(৩) সীরাতের নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও সার্বজনীন দিকগুলি অমুসলিমদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য, সীরাতে রাসুলকে সঠিক শৈলী ও পন্থায় এবং সময়ের চাহিদা অনুসারে প্রতিটি ভাষায় উপস্থাপন করতে হবে।

(৪) ইবাদাত ও শরীয়তের বিধি-বিধান ছাড়াও, আমাদের সম্মিলিত জীবন, রাজনৈতিক কৌশল এবং অন্যান্য জাতির সাথে আচরণের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহর আচরণ ও কর্মপন্থাকে সামনে রাখতে হবে।

(৫) সীরাত বিষয়ক লিটারেচারকে ব্যাপক, সহজলভ্য ও সর্বজনীন করতে হবে।

(৬) সর্বোপরি আমাদেরকে সীরাতের চেতনা ও মর্মবস্তুকে সংবেদনশীলতার সাথে অনুধাবন ও অবধারণ করতে হবে। আমাদের নৈতিকতা ও কর্মে তা প্রতিফলিত করতে হবে এবং ব্যবহারিকভাবে উসওয়ায়ে হাসানাহকে তুলে ধরতে হবে। যতদিন পর্যন্ত আমাদের জীবনধারা সীরাতের অনুগামী না হচ্ছে, ততদিন বৈষয়িক উন্নতির সমুদয় উপায়-উপকরণ মজুদ করা সত্ত্বেও আমাদের সাফল্য ও মুক্তির সম্ভাবনা নেই।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
3 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
শেখ জাবেদ
শেখ জাবেদ
1 year ago

কয়জন বাঙালি আলেমের লিখিত মৌলিক সিরাতগ্রন্থ আছে?
আফসোস, সবই অনুবাদ, হায় আফসোস।

ইজতিহাদ মাহমুদ
ইজতিহাদ মাহমুদ
1 year ago

সুন্দর পর্যালোচনা ও পরামর্শ। সীরাতপাঠে ব্যাপক আগ্রহী করে তুলতে হবে নিজেকে ও আমার আশেপাশের সমাজবদ্ধ গোষ্ঠীকে। অমুসলিমদের মাঝেও সিরাতের সৌন্দর্যতা প্রকাশ করতঃ লিটলম্যাগ বিতরণীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিৎ।

এই প্রবন্ধে প্রচুর শব্দ ও একই অর্প্রথবোধক বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে। এটা একটু কমিয়ে আনলে ঝড়ঝড়ে একটা ভাব চলে আসতো, বুঝতে সহায়ক হতো।

SaJid
SaJid
1 year ago

সাধারণদের জন্য সিরাত পাঠের প্রাথমিক কিতাবাদি ও পাঠ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হলে ভালো হতো

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷