হানান হাবাশি। ১৯৯০ সালে গাজায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গাজার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য পড়েছেন। পরে ইংরেজি ভাষা প্রশিক্ষক ও অনুবাদক হিসেবে কাজ করেছেন। হাবাশি ২০০৮ সালে গাজায় ২৩ দিনব্যাপী ইসরায়েলের কাস্ট লিড অপারেশন চলাকালে চতুর্থ দিন ডায়েরি লেখা শুরু করেন। এরপর ‘এল ফর লাইফ’ নামে প্রথম ছোটগল্প প্রকাশিত হলে গল্পে তার শক্তিমত্তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। বুদ্ধিবৃত্তিক আলাপেও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন, যখন বলেন, ‘ফিলিস্তিনকে লেখার দায়িত্ব শুধু ফিলিস্তিনিদেরই, অন্য কারও নয়।’ অনূদিত গল্পটি গাজার খ্যাতিমান সাহিত্যিক শহিদ ‘রিফাত আলারির’ সম্পাদিত ‘গাজা রাইট্স ব্যাক’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া।
বাবা, কেমন আছ? অনেক দিন হলো তোমার সঙ্গে বসে কথা বলিনি; যেন সেই প্রতিশ্রুতিটা ভুলেই গিয়েছিলাম যে, আমি তোমাকে একটা করে চিঠি লিখব, আর প্রতিবার আমার ‘ছোট্ট হৃদয়’ আনন্দে ভরে উঠবে। আজকাল মনে হয়, একটা আনন্দভরা চিঠি কখনো লেখা হবে না। তাই প্রাপ্তি ছাড়াই লিখছি; যেন তোমাকে লিখতে গিয়ে যে তৃপ্তি অনুভব করতাম, তা থেকে আমাকে বঞ্চিত না করো।
আজ তোমার চলে যাওয়ার এগারো বছর পূর্ণ হলো। এখন বুঝতে পারছি, তোমাকে কতটা মিস করি। তোমার অভাব এমন এক অজেয় দানব, যাকে জয় করা সম্ভব নয়। জীবন এখন ইতিহাস পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার চেয়েও অনেক বেশি জটিল। অথবা আন্টি কারামার পরিবারের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার চেয়েও। তোমাকে কী বলব? গাজা আজকাল, আসলে কয়েক বছর ধরে, ভীষণ হতাশাজনক। তোমাকে ছাড়া কাটানো সব গ্রীষ্মের মধ্যে এই গ্রীষ্মটা সবচেয়ে খারাপ। একটু ভালো বাতাস নেওয়া এখন এক বিলাসিতা।
প্রায়ই করার কিছু থাকে না। ঘরে নির্লিপ্ত বসে থাকি। সূর্যের আলোয় ভরে থাকে পুরো ঘর। তাকিয়ে থাকি সেই ছোট্ট গুলির দাগ, আর কুৎসিত ফাটলের দিকে। হ্যাঁ, রাইফেল যে-ফাটল তৈরি করেছিল। চোখ জ্বালা করে! তারপরও অনেক সময় তাকিয়ে দেখি। মনে করার চেষ্টা করি, সেই সৈনিকটা দেখতে কেমন ছিল। সেই বিশালদেহী মানুষ, যে তোমাকে আমার বিছানা থেকে টেনে নিয়ে গেছে। তোমার গল্প শেষ করার সুযোগও দেয়নি। কিছুই মনে করতে পারি না, শুধু তার ধুলোমাখা কালো বুট আর সেই ভীতিকর রাইফেল ছাড়া। মুখটা কেমন তার চেষ্টা করেছি কল্পনা করতে, কিন্তু সবসময় মনে হয়, সে আসলে এক মুখহীন দানব। খুব বেশি দূরের হলেও ভাবি, তার জীবন, তার পরিবার, তার প্রিয় স্ত্রীর কথা, তার সেই বুদ্ধিমান ছেলের কথা, যে অঙ্কে ভালো নম্বর পায়। বাবা, এমন কি হতে পারে, যা আমাকে বাবাহীন হওয়ার বেদনা, আর এক অসমাপ্ত গল্পের কষ্ট নিয়ে বাঁচতে বাধ্য করেছে, তা-ই সেই মানুষটাকে আনন্দ দেয়?
অন্ধকার যখন সমস্তটা গ্রাস করে, তখন আমি জানালার পাশে বসি। বিদ্যুৎহীন বাড়িগুলোর পেছনে চোখ বুলাই, অনুভব করি গাজার শান্ত রাতের মিষ্টি সুগন্ধ, বুকের গভীরে টেনে নিই নির্মল বাতাস। তারপর ভাবতে থাকি তোমাকে, আমাকে, ফিলিস্তিনকে, সেই ফাটলকে, খালি দেয়ালটাকে, তোমাকে, মাকে, তোমাকে, আমার ইতিহাস ক্লাসকে, তোমাকে, খোদাকে, ফিলিস্তিনকে—আমাদের অসমাপ্ত গল্পকে।
তোমার কোমল কণ্ঠে সায়েরের গল্প বলার মুহূর্ত আমার মন জুড়ে ভাসে। এখনও মনে আছে, তুমি যখন বলেছিলে সায়ের আর আমার খুব মিল—আমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। তুমি বলেছিলে, তার চোখ আমার মতোই বুনো, আর আমার হাসি তার লাজুক মিষ্টি হাসির মতো।
আমি এখনও জানি না, সায়ের কে বা তার আবাস কোথায়। কিন্তু আমি সবসময় তোমার গল্পের নায়কদের বিশ্বাস করতাম। ভুলতে পারি না কীভাবে তোমার চোখ ঝলমল করে উঠত, যখন তুমি বলতে, সে এতিমখানার পেছনে কিছু জলপাই গাছের চারা লাগিয়েছিল। খোদা তোমার সেই হাসি রক্ষা করুক। মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা চারাগুলো সুখী করুক। ভুলতে পারি না, কীভাবে তুমি আমার চোখে চোখ রেখে বলেছিলে, “সে এমন এক ছেলে, যে তার পুরো পরিবারকে মৃত্যুর কাছে হারিয়েছে, কিন্তু জীবনের প্রতি বিশ্বাস হারায়নি। আমি চাই, তুমিও তার মতো শক্ত হও।”
বাবা, তোমার কি মনে পড়ে, যখন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, সায়ের কি একজন ইসরায়েলি সৈন্যকে হারানোর মতো শক্তিশালী ছিল? তুমি হাসলে—তুমি সবসময় হাসতে—কিন্তু কোনো উত্তর দিলে না। তুমি চাইলে, আমি নিজের মতো করে উত্তর খুঁজে নিই। তুমি বলেছিলে, সায়ের মাত্র বারো বছর বয়সি একটা ছেলে। এতিমখানার এক মেয়ে, আমাল, জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে প্রলাপ বকল, কেউই কারফিউ ভেঙে বাইরে যেতে সাহস করল না, সায়ের, ডাক্তার আনতে বেরিয়ে পড়ল। তারপর…
তারপর যেন পৃথিবী জ্বলেপুড়ে একটুকরো নরক হয়ে গেল, বাবা। তারপর তুমি আর রইলে না।
আমি কতবার যে সায়েরের গল্পটা শেষ করতে চেয়েছি। যখনই শেষ করার কথা ভাবি, ক্লান্তি আমাকে ঘিরে ধরে। মাথার ভার বেড়ে যায়। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। কিন্তু তুমি তো জানো, বাবা, যেকোনো গল্প সম্পূর্ণ করতে দুজনের দরকার হয়, একা হয় না।
সায়ের আমার জীবনে আরেক ‘তুমি’। তোমার ছবিটার মতো, যা ফাটলটার ওপরে রাখা আছে। তোমার কেফিয়া, যার কালো রং ধীরে ধীরে গৌরবময় ধূসর রূপ নিয়েছে।
একবার ভাবি তোমার আত্মার সঙ্গী, মায়ের কথা—নিশ্চয়ই তুমি তাকে সায়েরের গল্প বলেছিলে। কল্পনা করি, তোমরা দুজন কত রাত কাটিয়েছ মুখে হাসি আর চোখে মুগ্ধতা নিয়ে। পরিষ্কার মনে আছে, যখনই তোমরা একসঙ্গে থাকতে, মা যেন নতুন এক পৃথিবী খুঁজে পেতেন এবং তোমাদের আলাপ কখনো শেষ হতো না। তোমার কণ্ঠের সুর শুনি, মায়ের হাসির প্রতিধ্বনি শুনি—যে-হাসি থেমে গেছে বহু আগে। না, বাবা, চিন্তা করো না, মা এখনও হাসেন। যদিও দিনদিন আরও ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছেন। প্রায়ই ভাবি, মা এমন কী জানেন, যা আমি জানি না, যা তাকে এই তিক্ত একাকিত্বের মধ্যেও বাঁচিয়ে রাখে? একদিন তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, “সায়েরের শেষ পর্যন্ত কী হলো, মা?”
তিনি তখন শেষ প্লেটটি ধুচ্ছিলেন। নল বন্ধ করলেন, কিছুক্ষণ সিঙ্কের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, হঠাৎই সরে গেলেন। “সায়ের কে?” তিনি জিজ্ঞেস করলেন, চোখ সংকুচিত করে।
“সায়ের,” আমি উত্তর দিলাম। তার মুখে অস্বস্তির ছাপ দেখে আবার বললাম, “সায়ের। বাবার সায়ের!”
তার প্রতিটি নড়াচড়ায়, প্রতিটি না-বলা শব্দে, দূর থেকে এক গল্পের আভাস দেখছিলাম। “মা! সায়ের, সেই শক্তিশালী ছেলেটি, যে এতিমখানায় জলপাই গাছ লাগিয়েছিল।” আমি তাকে কথা বলানোর চেষ্টা চালিয়ে গেলাম।
“শক্তিশালী, তাই তো? জীবন কখনো না কখনো তোমার কাছে পৌঁছাবেই, তা তুমি যতই শক্ত হও বা শক্ত থাকার ভান করো না কেন। এটা তোমাকে দুর্বল করে না, সোনা; এটা তোমাকে মানুষ বানায়।”
বাবা, আমি জানি, তুমি মাকে এখন দেখলে চিনতে পারবে না, একেবারে নতুন মানুষ। আমিও পারি না চিনতে। মা একটু তিরিক্ষি মেজাজের হয়েছেন। তার মধ্যে অনেক ‘জ্ঞান’ এসেছে। আবার জিজ্ঞেস করলাম, তিনি আসলেই জানেন কি না সায়েরের কী হয়েছিল। সে কি এতিমখানায় ফিরে গিয়েছিল?
“সে ফিরে গিয়েছিল। আমরা সবাই ফিরে যাব,” তিনি নিচু স্বরে ফিসফিস করে বললেন।
সেই রাতটি আমি কাটালাম সায়েরের ঘর আর মায়ের চোখে থাকা দূরের জীবনের কথা ভেবে। ভাবছিলাম, কোনটা বেশি কষ্টকর: বাইরের ড্রোনের ভয়ংকর গুঞ্জন, নাকি ভেতরের কঠিন প্রশ্নগুলোর শব্দ।
দুই সপ্তাহ আগে, দাদা আমাদের প্রতিবেশী আবু ফেরাসের সঙ্গে জাতিসংঘের ত্রাণসংস্থার খাদ্য কুপনের জন্য বের হলেন। ঘর থেকে তিনি বের হলেন সুস্থ, ফিরে এলেন পাগল। আবু ফেরাস বললেন, দাদা তিন ঘণ্টা টানা জ্বলন্ত রোদে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অবশেষে কুপন পাওয়ার মুখে তিনি বিতরণকারী লোকটাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি আমাকে কী দিচ্ছ?”
তার উত্তর ছিল সরল, “খাবার!”
“আর এই কুপন দিয়ে আমি ঠিক কবে আমার জাফা ফিরে পাব?” দাদা চিৎকার করে উঠলেন।
বুঝতেই পারছ, কী ধরনের হট্টগোল হয়েছিল। আবু ফেরাস তাকে জোর করে বাড়ি নিয়ে এলেন।
এই ঘটনা নিয়ে আমি বেশি ভাবতে চাই না। জানি, তোমার চলে যাওয়ার পর তার জীবন শুধু একটা লেবুগাছ আর প্রিয় সন্তানের শোকে আটকে গেছে। তিনি আর সেই মানুষ নেই, যার সঙ্গে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতাম। তিনি আর বিশ্বাস করেন না—আমাকেও না। তিনি বলেন, মানুষ লড়াই করে, মরে ফিলিস্তিন ফিরে পাওয়ার জন্য। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারাও ফিরে আসে না, ফিলিস্তিনও না।
তিনি কসম করে বলেন, তুমি এখন জাফায় বসে আছ, এক লেবুগাছের নিচে, আমাদের চমৎকার নীল সমুদ্রে ডুবে যাওয়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছ। দাদা বলেন, তুমি আর কখনো ফিরে আসবে না, কারণ এই পৃথিবীতে কে-ই বা জাফার স্বর্গ ছেড়ে আসতে চায়?
দিনদিন আমি দাদার কুঁচকে যাওয়া মুখের ভাঁজ আর সেই পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলোর প্রেমে পড়ছি, বাবা, দাদার দুর্বল হৃদয়ের স্পন্দন শুনতে পাচ্ছি।
তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, দাদাকেও আমি সায়ের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, “সায়ের এই নোংরা পৃথিবীতে আর নিঃশ্বাস ছাড়তে রাজি হয়নি। সে অন্য কোথাও বড় হয়ে ওঠার পথ বেছে নিয়েছে। আমার দিকে এমন উদ্ভট মুখে তাকিয়ো না। হ্যাঁ, মৃত মানুষও বড় হয়, কিন্তু তারা কখনো বুড়ো হয় না।”
তার উত্তর ছিল তো মায়ের চেয়েও বিভ্রান্তিকর। “আমি বিশ্বাস করি না। সায়ের কখনো মৃত্যুর সুযোগ নিতে পারে না। তাহলে আমাল? সে কি এতটা স্বার্থপর ছিল যে, আমালকে মরতে রেখে চলে যাবে?” আমি হু হু করে কেঁদে উঠলাম।
“আমাল কে?” দাদা উদাসীন গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
আমি হালকা বোধ করলাম। হাসলাম। উত্তর দিলাম, “আমার বড় হয়ে যাওয়া বন্ধু। আপনি তাকে অবশ্যই একদিন দেখতে যাবেন।”
দাদার কপালে চুমু খেলাম। তার গায়ে লেবুর ফুলের সুবাস। মনে হলো, তার কুঁচকে যাওয়া ভাঁজে আস্ত একটা লেবু বাগান লাগিয়েছেন। বাবা, তিনি কীভাবে বলার সাহস পেলেন, সায়ের মারা গেছে? আমার বিশ্বাস মারা যায়নি। বছর হতে পারে জীবনের দৈর্ঘ্য। কিন্তু বিশ্বাস? তা নিঃসন্দেহে জীবনের প্রস্থ।
পরের দিন আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলাম। সূর্যোদয় দেখলাম। সায়েরের কী ঘটেছিল তা জানার জন্য অপেক্ষা করতে পারছিলাম না। তোমার গৌরবময় কেফিয়া গলায় পেঁচিয়ে বের হয়ে পড়লাম। আন্টি কারামার বাড়ি পৌঁছে দরজায় অধৈর্য হয়ে ধাক্কা দিতে লাগলাম। বাইরে দশ মিনিটেরও বেশি অপেক্ষা করছি, কেউ সাড়া দিচ্ছে না। ফিরে যাব ভাবছি, তখন আন্টি দরজা খুললেন। তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। কীভাবে তিনি ঘুমাতে পারেন, যখন আমি জানি না, সায়েরের গল্পের শেষটা কী?
তিনি আমাকে ভেতরে আসতে বলে বললেন, তিনি কাপড় পালটে আসছেন।
“প্লিজ, না!” উত্তরে দ্রুত বললাম।
তিনি চোখ কুঁচকে তাকালেন, মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, “তোমার কী হয়েছে? দাদুর কি কিছু ঘটেছে? তুমি এত সকালে কীভাবে এলে, মাসের পর মাস আমাকে দেখতে আসো না। আল্লাহ, তার কী হয়েছে?”
আমি তাকে শান্ত করতে এবং তার চিন্তা দূর করতে চেষ্টা করলাম, “সায়েরই আমাকে এত সকালে এখানে এনেছে।”
হ্যাঁ, বাবা, আমি আন্টি কারামাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কারণ আমি জানতাম, ছোটবেলা থেকেই তিনি তোমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। তিনি গর্ব করে বলতেন, তোমাকে তিনি ইংরেজিতে ফিলিস্তিন (Palestine) বানান করতে শিখিয়েছিলেন। পি ফর প্যাশন, এ ফর অ্যাসপিরেশন, এল ফর লাইফ, ই ফর এক্সিস্টেন্স, এস ফর স্যানিটি, টি ফর ট্রাস্ট, আই ফর ইউ, এন ফর নেশন, ই ফর এক্সলটেশন। তুমি সঠিকভাবে লিখেছিলে। এবং তুমি এটি যেখানে পারতে লিখতে। দেয়ালে, টেবিলে। গাছের গায়ে কেটে কেটে লিখেছিলে। শেষমেশ এটি তোমার হৃদয়ে গভীরভাবে খোদাই করে নিয়েছিলে।
“সায়েরের কী?” আমার সরাসরি প্রশ্নের জবাবে তিনি সোজাসাপটা উত্তর দিলেন।
আমার হৃদয়ে আবার আশা উঁকি দিলো। আন্টি যে সায়েরকে চিনতেন, তা বোঝার আনন্দে। চোখে চোখ রেখে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “পৃথিবীর এই অংশে কোথাও কি এমন বিশেষ কিছু আছে?”
তিনি আমার কথায় রাগ করে বললেন, “তুমি যদি এই পৃথিবীর এই অংশে বিশ্বাস না করো, তবে তুমি কখনো সায়েরের যোগ্য হতে পারবে না।”
আমার ভীষণ লজ্জা লাগল।
অবশেষে আমরা রওনা হলাম। আন্টি আমাকে এমনসব জায়গা দেখালেন, যেখানে আগে যাইনি। ক্যাম্পের সরু, অন্ধকার রাস্তায় গেলাম। মনে হলো তুমি আশেপাশেই আছ। ‘বিশেষ জায়গার পথে হাঁটতে হাঁটতে আন্টি কারামা ক্যাম্পের প্রতিটি পরিবারের গল্প বলতে থাকলেন। গল্পগুলো যেন আমাদের সঙ্গী হয়ে চলছিল। জিজ্ঞেস করলাম, “কীভাবে তুমি এতসব গল্প জানো?”
তিনি বললেন, “আমাদের নাকবা তো কোনো গোপন বিষয় না।”
তার কথায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। অথচ আমার চোখে তিনি ছিলেন কেবল একজন নীরস ইতিহাস শিক্ষক। প্রথমবার জানলাম, তিনি কখনো পদোন্নতি চাননি। তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষকের বেশি হতে চাননি। তিনি শিশুদের প্রতি বিশ্বাস রাখতেন। বললেন, তিনি শিশুদের সেই পবিত্র, ছোট্ট হৃদয়ে থাকা আশা কখনো ছেড়ে যেতে পারতেন না।
“আমরা এসে গেছি,” বললেন তিনি।
আমি একেবারে অবাক হয়ে গেলাম। এটা কি আদৌ কোনও ‘জায়গা’?
আমি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। আন্টি কারামা পোড়া ঘরের অবশেষ দেখে আনন্দ পাচ্ছিলেন। মাটি থেকে বের হওয়া একধরনের সুগন্ধ আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। আন্টির নীরব হাসি আমার হৃদয়ের ওপর যেন আরও ভারী হয়ে উঠল। স্থানবোধ হারিয়ে ফেললাম। আমি কোথাও নেই। আমি সবখানে আছি। এখানেই আছি।
আন্টির ফলের মতো মিঠা সুর জীবন্ত হয়ে উঠল, “খোদার দয়া! তুমি কি অনুভব করতে পারছ না? তোমার বাবা পুরো যৌবন এখানকার শিশুদের ফিলিস্তিন বানান শেখাতে কাটিয়েছেন। পি ফর প্যাশন, এ ফর অ্যাসপিরেশন, এল ফর লাইফ…
কয়েক সেকেন্ডের জন্য আশঙ্কা হলো, আন্টি কারামাও পাগল হয়ে গেছেন। “কোন শিশুরা, আন্টি? এটা তো খালি একটা শূন্য প্রান্তর।”
তিনি একটা বড় রাগ গিলে ফেললেন। আবার ধ্বংসস্তূপের দিকে ফিরে গেলেন। হাসলেন। কাঁদলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন।
“এই জায়গার সঙ্গে সায়ের আর আমালের কী সম্পর্ক?” আমি তার দীর্ঘশ্বাসে বাধা দিলাম।
“তুমি জানো, মেরয়াম,” তিনি মমতামাখা কণ্ঠে জবাব দিলেন। বললেন, “তুমি যদি সাহসের প্রার্থনা করো, খোদা কি তোমাকে সাহস দিয়ে দেন, নাকি সাহসী হওয়ার সুযোগ দেন? তুমি যদি সত্যের প্রার্থনা করো, খোদা কি তোমার হাতে তার সত্য তুলে দেন, নাকি তোমার চোখ খুলে দেওয়ার সুযোগ দেন?”
“জীবন পরিশ্রমের ওপর নির্ভর করে, আমি মনে করি,” সংক্ষেপে উত্তর দিলাম।
“তাহলে চোখ খোলো, সোনা। পোড়া ঘরের পেছনে তাকাও, নিজেই উত্তর পাবে। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। তাকে বিশ্বাস করি, যার কাছে তোমার বাবা সায়েরের গল্প বলেছিলেন। বিশ্বাস করি, তোমার বাবা চেয়েছিলেন, সায়ের ফিরে না আসুক তুমি এতিমখানায় ফিরে আসো।”
আমার লজ্জা হলো, বাবা। মনে হলো, তোমার আরও ভালো একজন উত্তরসূরি প্রাপ্য। মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকালাম। হাসলাম। কাঁদলাম। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। পোড়া ঘরের ঠিক শেষ প্রান্তে এতিমখানার সেই জলপাই গাছটা দাঁড়িয়ে। সায়েরের চারাগুলোও বড় হয়েছে। সেখানে আর কিছু ছিল না। তবু সেই গাছটুকুই আমার জন্য, আমালের জন্য, সায়েরের জন্য, আর তোমার জন্য যথেষ্ট, প্রিয় বাবা।
অন্ধকার যখন সবটুকু গ্রাস করে, তখন আমি জানালার পাশে বসি। বিদ্যুৎহীন বাড়িগুলোর পেছনে তাকাই। গাজার শান্ত রাতের মিষ্টি সুবাস গ্রহণ করি। তাজা বাতাস বুকের গভীরে টেনে নিই। তারপর ভাবি তোমাকে, আমাকে, ফিলিস্তিনকে, এতিমখানাকে, জলপাই গাছকে, তোমাকে, আমালকে, মাকে, তোমাকে, আমার ইতিহাস ক্লাসকে, আন্টি কারামাকে, তোমাকে, খোদাকে, ফিলিস্তিনকে, আর সায়েরের গল্পকে।
চমৎকার গল্প। ভালো লাগলো সায়েরকে, ফিলিস্তিনকে…
‘আন্টি কারামা’ কেন! ‘কারামা আন্টি’ নয় কেন!
জানালে উপকৃত হতাম।