বই : রুবাইয়্যাত-ই-মাশরিক
লেখক : সাইফ সিরাজ
প্রচ্ছদ : সাইফ সিরাজ
প্রকাশনী : উপকথা
পৃষ্ঠা : ১২৮
এবং
বই : আমি কোথাও নেই
লেখক : সাইফ সিরাজ
প্রচ্ছদ : মাইশা তাবাসসুম তাবিয়া
প্রকাশনী : উপকথা
রুবাইয়্যাত-ই-মাশরিক থেকে
ক.
সুরের লহরীতে আকুল আবেদন ভোরের মোনাজাতে
গোলাম অবনত অলোক সুধা কোরআন তেলাওয়াতে
দিনের যাত্রা শুরু রাতের মায়াবনে জীবন খেয়ে খেয়ে
অপার সুধা-সুখে ব্যাকুল ফেরেশতা রবের কায়েনাতে।
খ.
চাইতে আমার জিহ্বা কাঁপে দিইনি আগের হিসাব
তোমার দানেই বাড়ছি আমি বাড়ছে আরো নিসাব
গোপন করো দয়া-ও তোমার দিচ্ছো আমায় যতো
এজলাসে রব কাল দিও না করতে আমায় বিলাপ।
গ.
অচল কয়েন করছে বহন হাজার বোধের মাথা!
ঝড়ছে ক্রমশ নৃবিজ্ঞানের জটিল গোপন পাতা
আমার প্রেমের আলাপগুলো থাকুক নীরব রাতে
তোমার ভাবের পরশ পেলেই খুলবে কথার খাতা।
ঘ.
সলতেবিহীন রাতের প্রদীপ আলোয় ভরে আছে
সন্ন্যাসী তার ধ্যানের ভেতর চলছে প্রেমের কাছে
রাতের মিনার ঘুমের ঘোরে দেখছে নদীর আলো
অলোক পথিক প্রেমের দিদার পেলেই তবে বাঁচে।
ঙ.
ঠিকানা জানি না তোমার আকাশে আমি চিল
প্রায় উড়ে আসি ডেকে উঠি যেনো বা মিছিল
তোমার শরীরে আমাকে গোপনে রেখে দিতে
করো হে! আমায় নজরে পুড়িয়ে কালো তিল!
আতাফুলের ঘ্রাণ অথবা ফানার পথ
সুবহে সাদিকের একটু পর; মুসল্লি পায় আতাফুলের ঘ্রাণ
ভেতরে গভীর মায়াবন উতলা হয়েছে শোনো! সুবহান
তাহাজ্জুদে অলোক আয়না দেখার আগে মুখের অভিধান
অনুবাদ করেছে আমার— জীবনের শব্দার্থে নাফরমান!
মসজিদে নিথর কার্পেট যেনো অবিকল আমার নিঃস্ব বুক
সেজদাবিহীন প্রতিনিয়ত চেয়ে ফিরে প্রেমের কান্নার সুখ
ক্বালবের অতল-দেশে আমিত্বের সমাধি; হলো খুব উৎসুক
গাফেল আমার; চেতনার কপাটে লিখে দিয়েছি মাবরুক!
আযান হওয়ার সময় যেনো কান্নায় ডাকে হাজার মুয়াজ্জিন
মনে মনে গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ্দোয়াল্লীন!
নাফর-মানির ব্যাপক আয়োজন করে যায় মানুষ এবং জ্বীন
আমি তখন গোপন ক্ষমার আশায় পাপের ঘরেই করি ঋণ!
দিনের আলোয় যেই পৃথিবীর; পথিক আমি হয়ে যাই নির্ভার
সে তো নির্বোধ! তার প্রেমবিনা কোনভাবে দেবে না নিস্তার
কী এক! রঙিন শাড়ির ভেতর বৃদ্ধার কঙ্কালে ভোগের সম্ভার
খোলার ভুলেই! গভীর মোহে আটকে হই; মোহগ্রস্ত বৃদ্ধার!
ফানার পথিক আমার আয়নায় আমার চেহারা কোথাও নেই
রোদের চমক বালির ওপর আয়নার মতো নিরন্তর থাকবেই
অথচ আমি আমাকেই রোজ; খুঁজে ফিরি নিজের অজান্তেই
আমার মুক্তির সবগুলো পথ অবশেষে পাই তোমার কাছেই!
পরিচয়
কেউ একজন পরিচয় জানতে চাইলে
আকিকায় দেওয়া নাম বলেছিলাম
প্রশ্নকর্তা অবাক হয়ে বললেন,
“এতো এতো জ্ঞান-বিজ্ঞান করে তাহলে
দু’টো আলগা শব্দের ভেতরে বন্দি হলে!”
এরপর থেকে নিজের পরিচয় খুঁজতে
শুরু করি আমি। আমার পরিবার আর
পৃথিবী আমাকে যতগুলো পরিচয় দিয়েছে
সবগুলোই চিহ্ন কেবল। এর একটিও
‘আমি’ সত্তার ওজন বহন করতে পারে না!
নিজের পরিচয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে
যতগুলো পরিচয় আমি পেয়েছি
সবগুলো যাচাই করার পর দেখি
চারপাশে কেবলই কল্পনা আর বুদবুদ।
বুঝলাম সত্যিকারের পরিচয় জানার পর
কারও আর পরিচয় দেওয়ার কিছু থাকে না!
শরীয়ত
বিপুল দ্রোহ নিয়ে তেতে আছে ভাবসরোবর। উজিয়ে চলার তীব্রতা কমছে না। নিমন্ত্রণ যেখানে; চিনি না সেই গন্তব্য। যেখানে যাওয়ার নয়; সেখানেই ফেলেছি নোঙর। সব হাতছানি দেখা যায়। সবার কাছেই যাওয়া যায়।
কিছুটা প্রকাশ্যে। কিছুটা গোপনে। অবনত থাকার প্রতিজ্ঞা। লৌকিক অনুরাগে নিয়ন্ত্রিত আবেগের অবয়বে সিদ্ধান্তের বাহাস। আহ্বান আসে অলোক; আত্মার কাতরতায় করে যাই আত্মসমর্পণ। পালিয়ে ফিরে আসি। বারবার মুখ লুকিয়ে আবার দৃশ্যমান হই। অতীতের ভুল মুছে আগামীর পথ চিনি। বর্তমানের বুকে অনুতাপের চিত্রকল্প এঁকে; অপেক্ষায় থাকি অলোক অনুবাদের।
নিয়মের অনুগামী সভয়ে। আত্মনিয়ন্ত্রণে বাঁচে অনুরাগ। সমর্পনে নির্ভার হয়ে খুঁজি তাকওয়ার পথ। ত্যাগের মিছিলে স্লোগান দিয়ে লুটিয়ে পরি সিজদায়। অনুরাগে বেতাব ফকির হয়ে যাই। বিনয়ের জাম্বিলে চাই ক্ষমার প্রতিদান। দাসত্বের সুখে গোপন রাখি না কিছুই। বিশ্বাস আমার চলার পথের বিনিয়োগ হয়ে যায় অনায়াসে। কৃতজ্ঞতার জন্য শব্দ খুঁজে চলি অনবরত। সমাধির ভাবনাতে মুক্তির বাণিজ্য করি তোমার সঙ্গে। আমার অস্তিত্ব জুড়ে আমিত্বহীন নিবেদনে অনন্ত সুখের স্বপ্ন বুনি।
মুনাজাতে অশ্রু। সিজদাতে নিশ্চল নিথর। রোজায় ব্যাকুল গোলাম। যাকাতের গোপন আলাপে নিঃশর্ত নিবেদন। হজ্বের সফরে নিতান্ত কিশোর যেনো; মুক্তি পেলো পিতার চোখ-রাঙানি থেকে।
খোদা! আমার শব্দ নিতান্ত কম। তোমার কাছে মূলত আমি এক আদেশের বাটন। আমি দেখি। আমাকে দেখে। অনুভব করি। আমাকে দেখো। এই দেখাদেখির ভেতর দিয়ে যেই চেনাজানা নিয়ে আসে পরিচয়; সে আমার নিবেদন! আমার ভেতর-বাহির খুলে যায় যিকিরের মগ্নতায়!
ইশকের মায়া-সংসার
রঙ তরপিনে মিশলেই লোপ হয় যে ঘনত্বের
সেই গুণ হারালেই রঙ পায় ঘর চমকের কাজ
অশ্রুর পতনের পর – কষ্টের অবিরাম হাত
নিশ্চুপ করে প্রস্থান, বুক ভার নেমে উদ্ভাস
পর্যাপ্ত সুখের ক্ষণ…
বন্যার্ত জমিনের উর্বর যেই মৃত্তিকা দলদল-
কর্দম হয়ে হাসফাঁস খুব করছিল শুষ্কের
দর্শন পেতে বারবার। রোদ মিশ্রণে কর্দম;
সুখ হয় কৃষকের যেই, হুটহাট পৃথিবীর বুক
স্বস্তির ফেলে নিঃশ্বাস।
দিন রাত হলে করবেই উৎসব জোনাকির দল
আলপথ আলোময় আহ্! রাত্রির চোখে আফতাব
নক্ষত্র অবুঝ হয় – যেই, ফুল ফোটে রাত্রির
রাত নামলে মিনার হয় দর্শক, নিশাচর চুপ
ঘুমহীন সাধকের চোখ বন্ধন খুলে; ইশকের
সাক্ষাৎ খুঁজে নিশ্চল ধুকপুক করে অন্তর–
মৌ-ময় পৃথিবীর সব।
বীজ মিশলে, মাটির হয় সৃষ্টির নেশা সম্ভব
জন্মের ক্ষুধা পায় ক্ষেত মুক্তির আশা খাদ্যের
প্রেমহীন কোন সৃষ্টির প্রাণ নেই বলে প্রেম হয়-
তাই সব প্রেমিকের ঘর – বৃক্ষের কিবা চিত্তের
সত্তার মিলনেই হয় – সৃষ্টির যত উল্লাস
আত্মার বিলিনেই সব ইশকের মায়া সংসার
আর নয় কিছু চিন্তার…
স্থিতি বিন্দুর প্রেমে
এক.
আমি এসেছিলাম পথহীন পথে। পেছনের সমস্ত চিহ্ন মুছে দিতে দিতে দেখলাম পথ নাই। পথ নাই ফেরার। পথ নাই এগিয়ে যাওয়ার। দীনতা জেনেই ‘আমি’ হয়েছিলাম। খুব সহজ ছিল বায়বীয় হওয়া। আরো সহজ ছিল; থেমে থাকা, পথ নেই ভেবে নিজেই পথ হয়ে যাওয়া, ভাষার ভেতরে ধ্বনির মূর্ছনা তুলে নিজেকে ভুলে যাওয়া অথবা নিয়তির প্রতি বিক্ষোভ রেখে ক্রমশঃ ক্ষয়ে যাওয়া; পথের অপেক্ষায়!
দুই.
গন্তব্যহীন পথিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে; আমি চেয়েছিলাম অবিরাম পথ। অথচ পৃথিবীর কোথাও চলার জন্য রাখিনি পথের মানচিত্র। আসার ভূগোল থেকে যাওয়ার মঞ্জিল ভুলে, পেয়েছি শূন্য ‘আমি’। পথের জন্য কুরবানী হয় পাহাড়, ঢেউ, আবেগ কখনও বাতাস। আর আমি পথকেই কুরবান করে থামিয়ে দিয়েছি ফেরার এবং যাওয়ার গতি।
তিন.
মধ্যবর্তী আমিত্বে ঠাঁয় দাঁড়িয়েছি। অথচ দাঁড়ানোর ঐতিহ্য নাকি ‘গন্তব্যে’ অথবা ‘অপেক্ষায়’। স্থিতি বিন্দুর প্রেমে পথের ‘পেছন’ মুছে ‘সামন’ হারালাম। নিজস্বতা কিনতে চেয়ে কিনেছি আবেগ; দোকানি দিল ঐতিহ্য, প্যাকেট খুলে দেখি কেবলই ‘আমি’। এরপর ‘আমি’ বেঁচতে গিয়ে দাম না পেয়ে ছুঁড়ে ফেললাম। অবাক ব্যাপার; ‘তুমি’র পদাঘাতে সেই ‘আমি’ হয়ে গেল পথ। ততক্ষণে বাকি থাকলো শুধু অনিবার্য শূন্যতা।
চার.
এরপর— পথ আছে নাকি নাই! ছিল নাকি ছিল না! থাকবে নাকি থাকবে না! শব্দ, ধ্বনি, পরিভাষা, গন্তব্য, আমি কিংবা বিন্দুর হিসেব-নিকেশ জুড়ে গমগমে নিরবতা ছাড়া সব প্রশ্ন ডুবতে থাকুক!