গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলছিল সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। ১৯৭১ সাল থেকে দীর্ঘ ৫৪ বছর সিরিয়াবাসীর ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল বর্বর আসাদ পরিবার। অবশেষে গত রোববার (০৮ ডিসেম্বর) হায়াত তাহরির আশ-শাম (এইচটিএস) -এর শীর্ষ নেতা মুহাম্মদ আল জাওলানির নেতৃত্বে সফল সামরিক অভিযানের ফলে দীর্ঘ কয়েক যুগের স্বৈরশাসনের অবসান হলো। পৃথিবী এক চরম বাস্তবতাকে উন্মোচন করল, যা দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়ঙ্কর। বলাবাহুল্য, এই পরিবারের হাতে গোটা সিরিয়া পার করছিল ইতিহাসের এক অন্ধকারতম অধ্যায়। বিশেষ করে, স্বৈরশাসক আসাদের শাসনে সেখানকার কারাগারগুলো যেন মানবতার জন্য এক দুঃস্বপ্নময় রাত হয়ে উঠেছিল। বন্দিদের প্রতি আচরণ ও নির্যাতনের ভয়াবহতা এবং সেই সময়কার নির্মম দৃশ্যাবলি যেন কল্পনা কিংবা হরর থ্রিলারকেও হার মানায়। এ যেন নিছক একটি নির্যাতনের কাহিনীই নয়, বরং একটি জাতির অমিত সম্ভাবনা, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে জীবন্ত দাফন করার সুপরিকল্পিত গভীর ষড়যন্ত্রের চিত্র।
সিরিয়াকে আসাদমুক্ত করার পরদিন সকালেই সাইদনায়া কারাগারে অভিযান চালানো হয়। অন্ধকার ও দুর্ভেধ্য কারা প্রকোষ্ঠ থেকে সকল বন্দিকে মুক্ত করার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে উদ্ধার কর্মীরা। কারাগারের গেইট খুলে দেওয়ার পর বন্দিরা সব বের হয়ে আসতে শুরু করে। বের হওয়ার পর হতবিহ্বল হয়ে পড়েন বন্দিরা। বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে, তারা মুক্ত হয়েছেন। তাদের মনের সকল অনুভূতি যেন শেষ হয়ে গেছে। কেউ কেউ অঝোরে কান্না করছেন। কেউ আবার বুঝতেই পারছেন না—কী করতে হবে এখন! মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে শুধু ফ্যালফ্যাল করে শূন্যে তাকিয়ে আছেন, যেন নতুন পৃথিবীর ভিন্ন কোনো গ্রহে এসে পৌঁছেছেন তারা।
এছাড়া আরও জানা যাচ্ছে কারাগারের ভেতরের ভয়ংকর সব তথ্য যা শোনা মাত্রই গা শিউরে ওঠে। অজানা আতঙ্কে হিম হয়ে আসে পুরো শরীর। নীচে ধারাণুক্রমে সাইদনায়া কারাগারের অজানা বিচিত্র সব তথ্য তুলে ধরা হলো—
সাইদনায়ার জন্ম
১৯৮৭ সালে বাশার আল আসাদের স্বৈরাচারী পিতা হাফিজ আল আসাদের হাতে ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয় সাইদনায়া কারাগার। পরবর্তীতে এর ভেতরের নির্যাতন, বঞ্চনা এবং ভিড়ের কারণে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ‘অ্যামনেস্টি ইনটারন্যাশনাল’ এই কারাগারকে ‘আল মাসলাখুল বাশারি’ ( المسلخ البشري) তথা ‘মানবতার কসাইখানা’ নামে আখ্যায়িত করে। ২০০৮ সালের রক্তাক্ত ঘটনার কারণে এটি আস-সিজনুল আহমার (السجن الأحمر) বা ‘লাল কারাগার’ নামেও পরিচিতি পায়। যেখানে স্বৈরাচারী আসাদ সরকার অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে নিজ দেশের জনগণকে হত্যা করত। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে গোপনীয় এবং ভয়াবহ স্থানগুলোর অন্যতম, যা ছিল হাজারো সিরীয় পরিবারের মনে গভীর শোক ও আতঙ্কের নাম।
সাইদনায়ার ভয়ার্ত কাহিনীগুলোর যেন অন্ত নেই। সাইদনায়া কারাগারের ভেতরের অধিকাংশ তথ্য-উপাত্ত উঠে এসেছে আসাদ সরকারের পতনের পর মুক্ত বন্দিদের মুখ থেকেই। এছাড়া আসাদ সরকারের পতনের আগে যারা সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরতে পেরেছিলেন, তাদের থেকেও জানা গেছে তার ভয়াবহতার নির্মম চিত্র।[1]যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-হুররাহ ; ৮ ডিসেম্বর ২০২৪
কারাগারের গঠন ও অবস্থান
সাইদনায়া কারাগারটি দামেস্কের উত্তরে একটি পাহাড়ি অঞ্চলের গোপন জায়গায় অবস্থিত। ত্রিমুখী এ ভবনটির আয়তন প্রায় ১.৪ বর্গকিলোমিটার, যা ১৮৪টি ফুটবল মাঠের সমান। এটি সিরিয়ার সমস্ত আন্তর্জাতিক মানের ফুটবল মাঠের সমষ্টির চেয়ে প্রায় ৮ গুণ বড়। কারাগারটি সিরীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয় এবং এখানে বিচার বিভাগের কোনো কর্তৃত্ব নেই, যার ফলে বন্দিদের অধিকার সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘিত হয়।[2]সৌদি আরবভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল আরাবিয়্যাহ: ৯ ডিসেম্বর, ২০২৪
সাইদনায়ার নকশা
সাইদনায়া কারাগার সিরিয়ার অন্যতম সামরিক সুরক্ষিত কারাগার। কারাগারের বাইরের নকশা একটি ডিজিটাল (ফরেনসিক আর্কিটেকচার) মডেল। কারাগারটি এমন এক বিশেষ নকশায় নির্মিত, যা এটিকে বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ সামরিক কারাগারে পরিণত করেছে। এই কারাগারটি তিনটি বৃহৎ ভবন দ্বারা গঠিত, যে ভবন তিনটির প্রান্তভাগ ভবনগুলোর একটি কেন্দ্রবিন্দুতে এসে মিলিত হয়েছে। এই নকশাটি ‘মুসাদ্দাস’ (المسدس) বা ‘পিস্তল’ নামে পরিচিত।
প্রতিটি ভবনে তিনটি তলা রয়েছে এবং প্রতিটি তলায় দুটি উইং স্থাপিত। প্রতিটি উইংয়ে থাকার জন্য ২০টি যৌথ কক্ষ বা সেল রয়েছে, যার প্রতিটির দৈর্ঘ্য ৮ মিটার এবং প্রস্থ ৬ মিটার। এসব কক্ষ এক সারিতে সাজানো হয়েছে এবং জানালা থেকে বেশ কিছুটা দূরে রাখা করছে। তবে, প্রতি চারটি কক্ষের জন্য একটি বায়ু চলাচলের কেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে ঘরের ভেতর শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য যথাযথ বাতাস চলাচল করতে পারে।[3]আল জাজিরা; ৮ ডিসেম্বর, ২০২৪
বন্দুকের বিন্দু (نقطة المسدس)
বন্দুকের বিন্দু (نقطة المسدس) বা ‘পিস্তলের পয়েন্ট’ হলো সেই এলাকা— যেখানে তিনটি ভবনের শেষ প্রান্ত এক মোহনায় এসে মিলিত হয়েছে। এটি সাইদনায়া কারাগারের সবচেয়ে সুরক্ষিত এবং নিরাপত্তা বেষ্টিত স্থান। এখানে মাটির তলায় অবস্থিত কক্ষগুলি এবং একক কারাগারের (সেল) কক্ষসমূহ স্থান পেয়েছে। এখানে ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন নিরাপত্তা প্রহরা থাকে। যাদের কাজ হলো বন্দিদের কার্যকলাপের উপর সার্বক্ষণিক নজরদারি করা এবং তাদেরকে কারাগারের কোনো নির্মাণশৈলী কিংবা কারারক্ষীদের মুখাবয়বটুকুও দেখার সুযোগ না দেওয়া। সাথে সাথে এই সুরক্ষা-ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা যে, বন্দিরা যেন কোনভাবেই কারাগারের সীমানা বা বাহ্যিক পৃথিবী সম্পর্কে ধারণা পেতে না পারে।[4]প্রাগুক্ত
নিরাপত্তা ও সুরক্ষা-ব্যবস্থা
সম্প্রতি দেশটির পতিত স্বৈরাচার বাশার আল আসাদের বাবা হাফিজ আল আসাদ-এর সময় থেকেই সাধারণ জনগণকে গ্রেফতার করে বিভিন্ন গোপন কারাগারে আটকে রাখা হতো। সিরিয়া জুড়ে প্রায় একশটি গোপন বন্দিশালা ছিল। যার মধ্যে প্রায় ২৩ টি পূর্ণাঙ্গ কারাগার রয়েছে। যেখানে প্রায় ৩০ হাজার নিরপরাধ মানুষকে একসাথে বন্দি করে রাখা যেত। এসব কুখ্যাত কারাগার নিয়ন্ত্রণ করতো সিরিয়ার চারটি গোয়েন্দা পরিদপ্তর। এগুলো হলো—
১. এয়ারফোর্স ইন্টেলিজেন্স ডিভিশন
২. মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স ডিভিশন জেনারেল
৩. ইন্টেলিজেন্স ডিভিশন পলিটিক্যাল
৪. পলিটিক্যাল সিকিউরিটি ডিভিশন
এছাড়াও সাইদনায়া কারাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রধানত তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে, যা এর চূড়ান্ত সুরক্ষা নিশ্চিত করে। এগুলো হলো—
১. বাহ্যিক নিরাপত্তা (প্রথম স্তর):
প্রথম স্তরের দায়িত্বে থাকে সামরিক বাহিনীর ৩ নং ফোর্স। তারা কারাগারের বাইরের প্রাচীরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং বন্দিরা যাতে পালাতে না পারে, তার জন্য দৃষ্টি রাখে। যদি বাহির থেকে কেউ আক্রমণ করার চেষ্টা করে বা বন্দি পালানোর চেষ্টা করে, তারা তা থামাতে চেষ্টা করবে।
২. অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা (দ্বিতীয় স্তর):
দ্বিতীয় স্তরে ৩ নং ফোর্সের ২১ নম্বর ব্রিগেড দায়িত্ব পালন করে। তারা কারাগারের ভেতরের অংশের নিরাপত্তা এবং বন্দিদের ওপর নজরদারি রাখে। তারা বন্দিদের শৃঙ্খলা বজায় রাখে, যাতে কারাগারে কোনোরূপ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়। যদি কোনো বন্দি আচরণে সমস্যা তৈরি করে, তারা তা নিয়ন্ত্রণ করে।
৩. মাইনফিল্ড (তৃতীয় স্তর):
‘মাইনফিল্ড’ শব্দের বাংলা অর্থ হলো ‘মাইনক্ষেত্র’ বা ‘মাইন বিস্ফোরকক্ষেত্র’। এটি মূলত এমন কিছু এরিয়া, যেখানে মাইন (বিস্ফোরক দ্রব্য) পুঁতে রাখা হতো, যাতে ওই এলাকা দিয়ে কেউ চলাচল করলে তৎক্ষণাৎ বিস্ফোরণ ঘটে।
সাইদনায়া কারাগারটি দুই ধরনের মাইনফিল্ডে পরিবেষ্টিত—একটি ব্যক্তি-বিস্ফারক মাইন, অন্যটি ট্যাঙ্ক-বিস্ফারক মাইন। অর্থাৎ, প্রথমটি মানুষকে লক্ষ্য করে এবং দ্বিতীয়টি ভারী বাহন (যেমন ট্যাঙ্ক) লক্ষ্য করে। এই মাইনফিল্ডগুলি কারাগারের আশপাশকে নিরাপত্তার জন্য আরও শক্তিশালী করে তোলে, যাতে কেউ সহজে কারাগারের ভেতরে বা বাইরে যেতে না পারে।
এই তিন স্তর বাদে আরও একটি বিশেষ ইউনিট কারাগারের ভেতর এবং বাইরের যোগাযোগ মনিটর করে। তারা সমস্ত তারবিহীন এবং তারযুক্ত যোগাযোগ পরীক্ষা করে, যাতে কোনো অবৈধ বা গোপন যোগাযোগ তৈরী না হয়।
কারাগারের ভেতরে কোনো ধরনের নাগরিক, সাংবাদিক বা আন্তর্জাতিক সংগঠনের কোনো সদস্য প্রবেশের অনুমতি পেত না। একমাত্র সরকারি সামরিক বাহিনীই ছিল এই কারাগারের নিয়ন্ত্রক।
তাছাড়া অন্ধকার প্রকোষ্ঠগুলোর মধ্যে ঢুকতে বিশেষ কোড বিশিষ্ট অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ইলেকট্রিক ডোর ব্যবহার করা হয়েছে। আসাদ বাহিনীর কারাগার রক্ষীরা পালিয়ে যাওয়ার কারণে সেই কোড আর উদ্ধার করা যায়নি। সিসি ক্যামেরার সাউন্ড সিস্টেমে মাটির নিচ থেকে অসংখ্য বন্দিদের কণ্ঠস্বর ভেসে আসলেও সেখানে পৌঁছতে পারছে না কোনো রেসকিউ টিম। কারাগারের পুরো সিস্টেম ভেঙে পড়ায় ভূগর্ভস্থ পানি এবং অক্সিজেন পুরোপুরি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।[5]সিরিয়ান দৈনিক আল ওয়াতান ; ১০ ডিসেম্বর, ২০১৪
বন্দিদের শ্রেণীবিভাগ ও শাস্তি
এই দুটি শ্রেণীর বন্দিদের সঙ্গে আচরণের ব্যবধান ছিল আকাশপাতাল। রাজনৈতিক বন্দীদের ক্ষেত্রে ছিল নৃশংস নির্যাতন এবং খাদ্য ও চিকিৎসাসহ সমস্ত মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চনা, অন্যদিকে সাধারণ অপরাধীদের কিছুটা শাস্তির সাথে চিকিৎসা বা খাবার প্রদান করা হতো। তবে, তাদের ভাগ্যও ছিল অন্ধকার, কারণ যেকোনো কঠিন শাস্তি বা মৃত্যু ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে সর্বক্ষণ।
সাইদনায়া কারাগারে দুটি মূল বিভাগ ছিল:
১. قسم أبيض – যাকে হোয়াইট সেকশন কিংবা হোয়াইট প্রিজন বা সাদা কারাগার বলা হয়।
২. قسم أحمر – যাকে রেড সেকশন কিংবা রেড প্রিজন বা লাল কারাগার বলা হয়।
মাটির ওপরের স্তরকে বলা হতো হোয়াইট প্রিজন বা সাদা কারাগার আর মাটির নিচের ৩ স্তরকে বলা হতো রেড প্রিজন বা লাল কারাগার। ভূগর্ভস্থ রেড প্রিজন বা লাল কারাগারের আয়াতন এতটাই বেশি যে, সিসিটিভি ফুটেজে শত শত কারাগার সেলের ভেতরে লাখো বন্দিকে দেখা যেতো। কিন্তু আসাদের পতনের পর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উদ্ধারকারী দল দীর্ঘ সময় চেষ্টা করেও ঠিক কোথায় কি আছে এবং সেখানে পৌঁছানোর পদ্ধতিই বা কি, সেটা বুঝে উঠতে পারছে না।
অনেকের মতে, প্রথম শ্রেণিভুক্ত বন্দিদের বেশিরভাগই শাসকগোষ্ঠীর অনুসারী ছিলেন, যারা দুর্নীতি, চুরি বা হত্যার মতো অপরাধে জড়িত ছিলেন। শাস্তি হিসেবে তাদের এই ভবনে বন্দি রাখা হতো। এছাড়াও—যারা সরকার পক্ষের সামরিক কিংবা বেসামরিক লোক। কোনো অপরাধের কারণে কিংবা স্বাধীন মতামত প্রকাশ, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, বা সন্দেহমূলকভাবে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগে বন্দি করা হয় কিংবা কাউকে সরকারবিরোধী হিসেবে সন্দেহ করা হলে, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করেও এখানে বন্দী করা হতো।
দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত বন্দিদের অধিকাংশই হলেন বিচারিক বন্দি। রাজনৈতিক বিরোধের কারণে আটককৃত জনগণ—যারা সরকারের বিরোধিতা করেছিল বা ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে অভিযুক্ত ছিল, তাদেরকে এই সেকশনে রাখা হতো। এছাড়াও যাদের ব্যাপারে মূলত সামরিক পেশার অন্তর্ভুক্ত থেকে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড—যেমন: হত্যা, চুরি, দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ, গোয়েন্দাগিরি কিংবা বাধ্যতামূলক সামরিক সেবা থেকে পলায়নের মতো অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া যেত তাদেরকে এই সেকশনে আটকে রাখা হতো।
এই দুটো সেক্টরই ছিল অত্যন্ত গোপন এবং কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টিত। রেড সেকশনের দরজাগুলো ছিল গোপন সংকেত এবং কোড দ্বারা সুরক্ষিত, যা কেবল আসাদ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাই জানতেন।[6]আল-জাজিরা ; ৯ ডিসেম্বর ২০২৪
নজিরবিহীন বিরোধী-মত দমন
বন্দিদের মধ্যে সাধারণ অপরাধীদের তুলনায় এমন সাহসী নাগরিকদের সংখ্যাই বেশি ছিল, যারা কথা বা কাজে কোনোভাবে আসাদ সরকারের বিরোধিতা করেছিলেন। আর বেছে বেছে আসাদ-বিরোধীদের উপরই চালানো হতো স্মরণকালের জঘন্যতম নিপীড়ন। এছাড়াও অধিকাংশ বন্দিদেরকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো, ফলে তাদের প্রতি সর্বপ্রকার মানবিক বিবেচনা একেবারে প্রত্যাহার করা হতো এবং তারা কঠোর নির্যাতনের শিকার হতো। এমনকি সন্দেহভাজন সরকার-বিরোধীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ এনে গ্রেফতার করা হতো, চালানো হতো পাশবিক নির্যাতন। এমনকি বিপ্লবীদেরকে চিকিৎসা দেওয়ার অভিযোগে চিকিৎসকদেরকেও ধরে এনে বন্দি করা হতো এই কারাগারে। বন্দিদেরকে বছরের-পর-বছর ধরে এ কারাগারে আটকে রেখে অকথ্য নির্যাতন করা হতো। মুক্তির পর বন্দিরা জানান, এমন নৃশংস অত্যাচার কোনো পশুকেও করা হয় না এবং কোনো পশুর পক্ষেও এ অত্যাচার সহ্য করা সম্ভব নয়।[7]আল ওয়াতান ; ১০ ডিসেম্বর, ২০১৪
‘মুআসকারুল মাউত’ : কারাগারের ভয়াবহতা
সাইদনায়া কারাগারকে সিরিয়ানরা ( معسكر الموت) ‘মুআসকারুল মাউত’ বা ‘মৃত্যুশিবির’ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ, এখানে বন্দিদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার জন্য পরিকল্পিত একটি কাঠামো তৈরি করা হয়েছিল। তিন স্তরের কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং শতাধিক সশস্ত্র প্রহরী কারাগারটিকে একটি অদৃশ্য ঘেরাটোপে আবদ্ধ করেছিল।
কারাগারটি সিরিয়ার রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ঠুরতার এক ভয়াবহ প্রতীক। ‘সাইদনায়া’ শব্দটি এখনো পর্যন্ত সিরীয়দের কাছে এমন এক আতঙ্কের নাম, যা হারানো প্রিয়জনদের স্মৃতি ও অমানবিক নিষ্ঠুরতার আঁচড়ে প্রতিটি হৃদয়ে অমোচনীয় দাগ রেখে গেছে। যেমনটি বর্ণনা করেছে ‘রাবিতাতু মু’তাকিলি ও মাফকুদি সিজন সাইদনায়া’ (رابطة معتقلي ومفقود سجن صيدنايا) নামক সংগঠন।
সংগঠনটি জানায়—২০১১ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ৩০,০০০ মানুষ সাইদনায়া কারাগারে বন্দি হয়েছিলেন, যার মধ্যে মাত্র ৬,০০০ জন মুক্তি পেয়েছেন, বাকি সবাই আজও নিখোঁজ। খুব কম সংখ্যক পরিবারই তাদের স্বজনদের মৃত্যুর খবর জানতে পারে। ভাগ্যক্রমে কোনো পরিবার প্রিয় স্বজনের মৃত্যুসনদটি হাতে পেলেও মৃতদেহ আনতে পারেন না কোনোদিন।[8]আল-জাজিরা ; ৯ ডিসেম্বর ২০২৪
নির্যাতনের পাশবিকতা
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জাতিসংঘকে সাইদনায়া কারাগারে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর বিষয়ে একটি স্বাধীন তদন্ত চালানোর আহ্বান জানায়। সাইদনায়া কারাগারের বন্দিরা চরম দুর্দশার শিকার। কারাগারের এক প্রাক্তন বন্দির বক্তব্য থেকে জানা যায়, বন্দিদেরকে কয়েকদিন পর্যন্ত পানি ও খাবার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়, ফলে তাদেরকে নিজেদের মলমূত্র পান করতে বাধ্য করা হয়। তাদের প্লাস্টিকের পাইপ, লোহার রড, লাঠি বা অন্য যন্ত্র দিয়ে বিরামহীনভাবে পালাক্রমে পেটানো হতো।
সাইদনায়া কারাগারে নির্যাতনের জন্য ব্যবহার করা হতো ‘বাসাতুর রীহ’ (بساط الريح) বা ‘উড়ন্ত কার্পেট’ নামে পরিচিত একটি যন্ত্র। এটি ভাঁজ করা যায় এমন একটি কাঠের পাটাতন, যেখানে বন্দিকে শুইয়ে হাত-পা বেঁধে তার মুখ ওপরে রাখা হতো। এরপর পাটাতনের এক একটি অংশ ভাঁজ করে এমনভাবে চাপ দেওয়া হতো যে, এটি বন্দির শরীরে নারকীয় যন্ত্রণার সৃষ্টি করতো।
কারাগারে বন্দিদের স্বাস্থ্যসেবা বা ওষুধের সুযোগ থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত রাখা হতো। এছাড়া, যদি তারা অভিযোগ স্বীকার না করেন নারী বন্দিদের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা তাদের পরিবারের সামনে ধর্ষণের হুমকি দিতো। এমনকি পুরুষ ও নারী উভয়ের ক্ষেত্রে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির অসংখ্য ঘটনাও নথিভুক্ত করা হয়েছে। কারাগারের মধ্যেও বহু পিতৃ পরিচয়হীন শিশু পাওয়া যায়, যা আসাদ বাহিনীর কুকর্মের জীবন্ত ফসল।
সাইদনায়া কারাগারের বেঁচে ফেরা এক বন্দি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে জানিয়েছেন, বন্দিদেরকে দুটি অপশনের মধ্যে একটি অপশন বেছে নিতে বাধ্য করা হতো—হয় নিজের মৃত্যুদণ্ড, নয়তো নিজের কোনো নিকটাত্মীয় বা পরিচিত আসাদ-বিরোধী কাউকে হত্যা করা।[9]প্রাগুক্ত
গুরাফুল মিলহ (غرف الملح) বা ‘লবণঘর’
যেসকল কারাবন্দি নির্যাতনের শিকার হয়ে অথবা চিকিৎসার অভাবে মারা গিয়েছিলেন, বা কারাগারের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তাদের মৃতদেহগুলো ২০১১ সালের পর স্থাপিত বিশেষ এক কক্ষে রাখা হতো—যা গুরাফুল মিলহ (غرف الملح) বা ‘লবণঘর’ নামে পরিচিত।
এটি এমন এক কক্ষ, যার মেঝে প্রায় ২০ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার উচ্চতা পর্যন্ত লবণে ভরা থাকত। এটি বন্দিদের মানসিকভাবে নির্যাতনের জন্য ব্যবহৃত হতো। একইসঙ্গে, এই ঘরে নির্যাতন বা অনাহারের ফলে মৃত বন্দিদের লাশও রাখা হতো।
২০১৮ সালে একটি রিপোর্টে প্রকাশ পায়, বন্দীদের মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্যই মূলত কারাগারে বিশেষ ‘লবণঘর’ তৈরি করা হয়েছিল। অর্থাৎ, মৃতদেহগুলোকে লবণের মধ্যে এমনভাবে ডুবিয়ে রাখা হতো, যাতে সেগুলো পচে না যায় এবং পরবর্তীতে মর্গে স্থানান্তর করা যায়।
সেখানে মৃতদেহগুলো ৪৮ ঘণ্টার বেশি সময় রাখা হতো এবং প্রতিটি মৃতদেহের সামনে একটি নম্বর লেখা থাকত, তার উপর লবণ ছিটানো হতো।
এরপর বন্দিদের পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত একটি গাড়িতে করে লাশগুলো তাশরিন সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে লাশের অবস্থা পরীক্ষা করে একটি মৃত্যুসনদ ইস্যু করা হতো। পরে লাশগুলো সামরিক পুলিশের কারাগার শাখায় পাঠানো হতো এবং সেখান থেকে গণকবরে স্থানান্তর করা হতো।[10]আল আরাবিয়া ; ৮ ডিসেম্বর ২০২৪
লোমহর্ষক মৃত্যুদণ্ড-প্রক্রিয়া
২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কারাগারের পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত করুণ। বন্দিদের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছিল, কারণ সেখানে চলে নিরবচ্ছিন্ন হত্যাযজ্ঞ। সাইদনায়া কারাগারে বন্দিহত্যার অন্তত ৭২ টি পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়েছে। যা সুস্থ মানুষ কোনোদিন কল্পনাও করতে পারবে না। এই প্রক্রিয়ার বাইরেও বন্দিদেরকে রোগ-বালাইয়ের মধ্যে এমনভাবে ফেলে রাখা হতো যে, তাদের শরীরে পোকামাকড় হয়ে সেই পোকামাকড়ই তাদেরকে তিলে তিলে খেয়ে ফেলত।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টির এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়, ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে সিরিয়ান সেনাবাহিনী প্রায় ১৩ হাজার বন্দিকে ফাঁসির মাধ্যমে হত্যা করেছে।
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, প্রতি সপ্তাহে রাতের মাঝামাঝি সময়ে ২০ থেকে ৫০ জন বন্দিকে ফাঁসির কক্ষে নিয়ে যাওয়া হতো। ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, সিরিয়ান সরকার সাইদনায়া কারাগারে হাজার হাজার বন্দিকে পুড়িয়ে হত্যার মাধ্যমে তাদের মৃতদেহ ধ্বংস করে এবং যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ লুকানোর চেষ্টা করেছে।
তদন্তে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সিরিয়ান সরকার ১০ বছরের মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার বন্দিকে হত্যা করেছে—অথবা সরাসরি মৃত্যুদণ্ড দিয়ে কিংবা নির্যাতন করে হত্যা করেছে। এছাড়াও চিকিৎসার অভাবে এবং ক্ষুধার কারণেও মৃত্যু ঘটেছে বহু বন্দির।
প্রায়ই সরাসরি মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনা ঘটে, যা নির্দিষ্ট সময় অন্তর—সপ্তাহে দুই দিন অনুষ্ঠিত হতো। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বরাতে জানা যায় যে, বন্দিদের মৃত্যুদণ্ডের সিদ্ধান্ত জানানো হতো না; বরং তাদের সন্ধ্যায় স্থানান্তর করা হতো এবং পরদিন অথবা সেই দিনই তাদের ওপর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো।
মৃত্যুদণ্ডের সময় উপস্থিত থাকতেন নিরাপত্তা দফতরের প্রধান, কারাগারের পরিচালক, সামরিক প্রধান প্রসিকিউটর, দক্ষিণ অঞ্চলের সেনাপ্রধান, গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্মকর্তা, তদন্ত শাখার প্রধান এবং কারাগারের একজন চিকিৎসক, মাঝে মাঝে একজন ‘ধর্মীয় ব্যক্তি’ও উপস্থিত থাকতেন। এছাড়া উপস্থিত থাকতেন সামরিক আদালতের প্রধান—যিনি মৃত্যুদণ্ডের আদেশ প্রদান করতেন।
তদন্তে উঠে এসেছে, কারাগারে দুটি পৃথক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার কক্ষ ছিল—একটি ‘হোয়াইট সেকশন’-এ এবং অন্যটি ‘রেড সেকশন’-এ। মৃত্যুদণ্ডের পদ্ধতি ছিল ফাঁসি। আর প্রতিটি কক্ষে ছিল একাধিক ফাঁসির মঞ্চ। যে হত্যাকাণ্ডগুলি কারাগারে সপ্তাহে দুই দিন করা হতো, সেগুলোর মৃতদেহ ধীরে ধীরে স্থানান্তরিত করা হতো। তদন্তে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো, আর যারা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ছাড়াই নির্যাতন কিংবা চিকিৎসার অভাবে কারাগারেই মারা যেত—এই দুই শ্রেণীর মৃতদেহ স্থানান্তর করার ক্ষেত্রেও দুটি ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হতো।
এক. প্রথম পদ্ধতিতে যাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো, তাদের মৃত্যুদণ্ডের পর মৃতদেহগুলি সরাসরি ঐ নির্দিষ্ট গণকবরগুলিতে সামরিক গাড়িতে করে—যেগুলিকে (سيارة اللحمة ) বা “মাংসের গাড়ি” বলা হতো, অথবা পিক-আপ ট্রাকের মাধ্যমে নিয়ে আসা হতো।
সরকার একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুযায়ী এসব মৃতদেহ গণকবরে দাফন করত, যা তদন্তে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মৃতদেহগুলো ‘তাশরিন সামরিক হাসপাতালে’ মেডিকেল সার্ভিসেস প্রশাসনের মাধ্যমে স্থানান্তর করা হতো এবং কখনো কখনো সেগুলি ‘নাজহা’ এলাকায়—যা দামেস্কের দক্ষিণ-পশ্চিমে, দাফন করা হতো। কখনও-বা সেগুলি ‘কাতনা’ অঞ্চলে—যা দশম ডিভিশনের এবং গণরক্ষী বাহিনী-এর মোতায়েনকৃত স্থানীয় অঞ্চল, বা ‘কতিফা’ অঞ্চলে—যা তৃতীয় ডিভিশনের অধীনে ‘রেমি ফিল্ড’-এর পশ্চিমে অবস্থিত বধ্যভূমিতে দাফন করা হতো। এই তৃতীয় ডিভিশনটি কারাগারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করত।
দুই. দ্বিতীয় পদ্ধতিটি ছিল সেই মৃতদেহগুলির জন্য—যারা নির্যাতনের শিকার হয়ে অথবা চিকিৎসার অভাবে মারা গিয়েছিলেন, বা কারাগারের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এই মৃতদেহগুলো ২০১১ সালের পর স্থাপিত বিশেষ কক্ষে রাখা হতো, যা “লবণঘর” নামে পরিচিত। সেখানে মৃতদেহগুলো ৪৮ ঘণ্টার বেশি সময় রাখা হতো এবং প্রতিটি মৃতদেহের সামনে একটি নম্বর লেখা থাকত, আর লাশের লবণ উপর ছিটানো হতো। পরে, মৃতদেহগুলো স্থানান্তরের জন্য ব্যবহৃত একটি বিশেষ গাড়িতে করে নিয়ে আসা হতো ‘তশরিন সামরিক হাসপাতালে’—যেখানে মৃতদেহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হতো এবং মৃত্যুর সনদ কখনো প্রদান করা হতো কখনো হতো না। এরপর সেগুলো সামরিক বাহিনীর কারাগারে স্থানান্তরিত হতো। বন্দিদের মৃতদেহগুলি দাফনের জন্য ‘নাজহা’, ‘কাতনা’ বা ‘কতিফা’ অঞ্চলে পাঠানো হতো। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সাধারণত প্রভাতের প্রথম প্রহরে সম্পন্ন হতো।
তদন্তে উঠে এসেছে, এই বিভাজন অনুযায়ী এক শ্রেণির বন্দিদেরকে নিয়মতান্ত্রিক নিষ্ঠুর নির্যাতন করা হতো, তাদের খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হতো। বিপরীতে অন্য শ্রেণির বন্দিদেরকে তুলনামূলকভাবে নির্যাতন কম করা হতো এবং তাদেরকে পর্যাপ্ত খাদ্য এবং মৌলিক চিকিৎসা-সেবার সুযোগ দেওয়া হতো।
দুই শ্রেণীর জন্য ভিন্ন দুই রকম আচরণের এই বিভাজন বন্দিদের মাঝেও গভীর পার্থক্য ও বিভেদরেখা সৃষ্টি করে। এই পার্থক্য কেবল বন্দিদের জীবনযাত্রার মধ্যেই নয়, বরং তাদের প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতাও স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।[11]আল ওয়াতান ; ১০ ডিসেম্বর, ২০১৪
মৃতদেহ গুম-প্রক্রিয়া
সাইদনায়া কারাগারের যেই জায়গায় অসংখ্য ফাঁসির রশি পাওয়া গেছে, তার পাশেই মিলেছে ভারী লোহার হাইড্রোলিক যন্ত্র। নিরপরাধ মানুষদের ফাঁসি দেওয়ার পর এই যন্ত্রের মধ্যে লাশগুলোকে চাপা দিয়ে চ্যাপ্টা করা হতো, এরপর সে লাশগুলো বস্তায় ভরে সাগরে ফেলে দিত।
২০১১ সাল থেকে আসাদ সরকার তাদের প্রকৃত বিরোধীদের (রাজনৈতিক কর্মী, প্রতিবাদকারী, সাংবাদিক, আইনজীবী, ডাক্তার, এবং মানবিক সহায়তা কর্মী) বিশাল আকারে গুম করেছে, যা একটি ব্যাপক অভিযানের অংশ। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর মতে যা চরম মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য ।
সিরিয়ান গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিভিন্ন শাখা, সামরিক পুলিশ এবং সেইসব হাসপাতালের চিকিৎসক ও প্রশাসনিক কর্মীদের থেকে জানা যায়, যেখানে বন্দিরা চিকিৎসা নিত, সেখানেই তাদের গুম এবং শারীরিকভাবে নির্মূল করার প্রক্রিয়া চালানো হতো।[12]আল জাজিরা ; ১১ ডিসেম্বর,২০২৪
গুম-খুনের পরিসংখ্যান
সম্প্রতি বাশার আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকেই প্রকাশ্যে আসতে থাকে আসাদ পরিবারের একের পর এক নিষ্ঠুরতার ভয়াবহ চিত্র। অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে হাজার হাজার মানুষ যাদের অনেকেই ১০-২০ বছর কিংবা ৩০-৪০ বছর যাবৎ সূর্যের মুখ দেখেনি। কুখ্যাত বাশার আল আসাদ আর তার বাবা আরেক কুখ্যাত স্বৈরশাসক হাফিজ আল আসাদের শাসনামলে এই সকল মানুষকে এই কারাগারে বন্দি করা হয়েছে। সত্তরের দশক থেকে প্রায় ৫৪ বছর ধরে যাকেই বিরোধীপক্ষ বলে মনে করা হয়েছে, তাকেই আসাদ পরিবার এই কারাগারে বন্দি করেছে অথবা তারা অজ্ঞাত কোথাও হারিয়ে গেছেন। যাদের অনেকের সন্ধান আজও মেলেনি।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, শুধু ২০১১ থেকে ২০১৫ এর মধ্যেই সাইদনায়া কারাগারে ১৩ হাজারেরও এর বেশি মানুষকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। এখান থেকে বেঁচে ফেরা, নির্যাতনের শিকার, এবং বন্দি-পরিবার নিয়ে গঠিত সংগঠন এটি এম এস পি ২০২২ সালে এক প্রতিবেদনে জানায়, গৃহযুদ্ধ শুরুর পর সাইদনায়া এক মৃত্যু শিবিরে পরিণত হয়েছে। ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এখানে ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যাদের অনেককে হত্যা করা হয়েছে। অনেকে নির্যাতনের কারণে, চিকিৎসাহীনতার অভাবে কিংবা অনাহারে মারা গেছেন। আর ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে অন্তত ৫০০ জনকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয় সাইদনায়া কারাগারে। সিরিয়ার কারাগারগুলো ছিল বাশার আল আসাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার এক জবরদস্ত খুঁটি। ২০১৩ সালে কিছু ছবি প্রকাশ্যে আসে, যার ব্যাখ্যায় কারাগারের ব্যাপক নির্যাতনের অকাট্য প্রমাণ দেখায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সিরিয়ান মানবাধিকার নেটওয়ার্ক বলছে, বিদ্রোহীরা আসার আগে নৃশংস এই কারাগারগুলোতে প্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার মানুষ বন্দি ছিল। অবজারভেটরি টিম বলছেন, শুধু ২০২৪ সালেই কারাগারে নির্যাতনসহ স্বাস্থ্য সেবা না পেয়ে ৬৮ জন বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যুর তথ্য পেয়েছে তারা। জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলি জানায়, সিরিয়ায় গুম করা হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা ১,৩০,০০০ জনেরও বেশি। যাদের মধ্যে এখনও অনেকের ভাগ্য অনিশ্চিত, তারা জীবিত না মৃত, তা জানা যায়নি। তবে স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থাগুলি দাবি করছে যে, আসাদের কারাগারগুলোতে সর্বমোট প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ আটক ছিল, যাদের মধ্যে অনেকেই নির্যাতনের কারণে প্রাণ হারিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসেব অনুযায়ী ২০ হাজারেরও অধিক নারীদের উদ্ধার করা হয়েছে, যাদেরকে দিনের পর দিন ধর্ষণের ফলে কারাগারেই জন্ম নিয়েছে শত শত অবৈধ সন্তান।[13]প্রাগুক্ত
‘মুজাহিদদের কারাগার’
সাইদনায়া কারাগারের ইতিহাস একাধিক রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সামরিক প্রেক্ষাপটের একটি জটিল সমীকরণ। এখানে বন্দিদের সাধারণত তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত রাজনৈতিক অভিযোগের ভিত্তিতে আলাদা আলাদা বিভাগে রাখা হতো, যা সশস্ত্র সংগ্রামের, রাজনৈতিক বিশ্বাসের, কিংবা জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের উপর নির্ভর করতো। এই কারাগারে বন্দি ছিল মুসলিম ব্রাদারহুড, ইসলামিক মুক্তি পার্টি (হিযবুত-তাহরির), এবং ত্রিপোলির তাওহিদী আন্দোলনের সদস্যরা। এদের রাজনৈতিক মতামত এবং তাদের কর্মকাণ্ড সিরিয়ার শাসক দলের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হতো।
এছাড়া কারাগারে এমন লেবানিজ বন্দিরাও ছিল, যারা আসাদ সরকারের বিরোধিতাকারী বিভিন্ন দল থেকে এসেছিলেন। তাদের সঙ্গে বন্দি করা হয়েছিল এমন কিছু ফিলিস্তিনিকে, যারা সিরিয়ার বিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। এছাড়া, কিছু কমিউনিস্ট এবং বিভিন্ন কুর্দি দলের সদস্যও এখানে বন্দি ছিলেন, যারা নিজেদের পরিচয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাসে স্বাধীনতা ও পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করতেন। এমনকি কিছু সিরিয়ান সামরিক সদস্যকেও এই কারাগারে বন্দি করা হয়, যারা দেশের সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন।
২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের পর সাইদনায়া কারাগারের চিত্র আরও বদলে যায়। ইরাকে যুদ্ধ শেষে ফিরে আসা আরব স্বেচ্ছাসেবক এবং আল-কায়েদার মুজাহিদ ভাইদের বন্দি করা শুরু হয়, যার ফলে কারাগারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। এখানে এমন কিছু অখ্যাত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইসলামি সংগঠনের মুজাহিদ সদস্যরাও বন্দি ছিল, যারা নিজেদের বিশ্বাসের পক্ষে মরণপণ সংগ্রাম করছিল। এছাড়া, লেবাননের নাহর-আল-বারেদ শরণার্থী শিবিরের যুদ্ধ থেকে আসা অনেক মুজাহিদও এখানে বন্দি ছিল। এভাবে ক্রমেই কারাগারটি (سجن للجهاديين) ‘মুজাহিদদের কারাগার’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে, কারণ ইরাক থেকে ফিরে আসা জিহাদিদের সংখ্যা অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে। এখানকার বন্দিরা কেবল আসাদ সরকারের বিরুদ্ধেই নয়, বরং গোটা অঞ্চল জুড়ে চলমান রাজনৈতিক ও সামরিক সংঘাতের অংশ হয়ে ওঠে। যার ফলে সাইদনায়া কারাগার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই একটি বিশেষ রাজনৈতিক ও সামরিক গুরুত্ব অর্জন করে।[14]আল হুররা ; ৯ ডিসেম্বর ২০২৪
পরিশেষে বলব—সাইদনায়া নিছক একটি কারাগার নয়, বরং পাশবিক জুলুম, নির্যাতন আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক মানব-কসাইখানা। এ যেন আধুনিক যুগেও মধ্যযুগীয় বর্বরতার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। এখানকার বন্দিদের কষ্ট ও আর্তনাদ আমাদের মানবতার বিবেককে নাড়া দেয়। এই অন্ধকার অধ্যায় বন্ধ করা এখন সময়ের দাবি—যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এটি কেবল ইতিহাসের একটি করুণ অধ্যায় হয়ে থাকে। নিপীড়িত বন্দিদের রক্তের বিনিময়ে সাইদনায়ার দেয়ালগুলো যেন সিরিয়াবাসীর মুক্তি আর ন্যায়বিচারের প্রতীক হয়ে উঠে।
তথ্যসূত্র:
↑1 | যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-হুররাহ ; ৮ ডিসেম্বর ২০২৪ |
---|---|
↑2 | সৌদি আরবভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল আরাবিয়্যাহ: ৯ ডিসেম্বর, ২০২৪ |
↑3 | আল জাজিরা; ৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ |
↑4, ↑9, ↑13 | প্রাগুক্ত |
↑5 | সিরিয়ান দৈনিক আল ওয়াতান ; ১০ ডিসেম্বর, ২০১৪ |
↑6, ↑8 | আল-জাজিরা ; ৯ ডিসেম্বর ২০২৪ |
↑7, ↑11 | আল ওয়াতান ; ১০ ডিসেম্বর, ২০১৪ |
↑10 | আল আরাবিয়া ; ৮ ডিসেম্বর ২০২৪ |
↑12 | আল জাজিরা ; ১১ ডিসেম্বর,২০২৪ |
↑14 | আল হুররা ; ৯ ডিসেম্বর ২০২৪ |
চমৎকার লিখেছো প্রিয়।সত্যি তোমার লেখা পড়ে আমি মুগ্ধ হই।ঈর্ষাকাতর হই প্রচুর।নিয়তির কাছে হার মেনে মনোনিবেশ করি দৈনন্দিনের কর্মে।অসংখ্য শুভকামনা তোমার জন্যে।
ইতি—
আশরাফুল হাসান
কানাইঘাট,সিলেট।