যুগের হিসেবে চার-চারটি যুগ পেরিয়ে জীবনের অবস্থানটা এখনো নির্ণয় করে উঠতে পারিনি। অঙ্ক কষে, দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে, অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশের ব্যাবহারেও অস্পষ্ট জীবনের অবস্থান। পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই জীবনে একবার জ্বর এলে বুঝলাম এখনো পঁচিশেই অবস্থান করছি। খাটে শুয়ে মাথার কাছে জানালাটা খুলে দিয়ে শরীরের অর্ধেকটা কাঁথায় ঢেকে দিয়ে চোখ বুজে জ্বর উপভোগ করার অবসারটুকু নেই। প্যারাসিটামল খাও তারপর ছুট লাগাও। ছুটতেই থাকো। অফিস, দায়দায়িত্ব, জীবনের অবিরাম রুটিন। জ্বর তোমার কমবে সকাল-দুপুর-সন্ধ্যার বাতাসে। তারপর একদিন বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়লে মোড়ের ফার্মেসি থেকে তিনটা অ্যান্টিবায়োটিক কিনে ক্লান্ত শরীরে যখন ঘরে ফিরছি তখন খেয়াল করলাম চিরাচরিত নিয়ম-রীতি মেনে চলা ক্লান্তিহীন সূর্যটাকে যেন কিছুটা দুর্বল দেখাচ্ছে। হতে পারে আমার ক্লান্ত দৃষ্টির ভ্রম। তবুও যতটুকু মনে পড়ে দেখলাম জীর্ণ-রিক্ত-শুষ্ক আঁকা-বাঁকা পাতাবিহীন এক গাছের উপর দিয়ে সূর্যটা যাওয়ার সময় একপলক স্থির হলো। কি কথা হলো তাদের মধ্যে তা শুনতে পাইনি। তবে বুঝতে পারলাম সূর্যটা হয়তো এই ভেবে স্থির হলো যে, “গাছটা একটু বেশি আলো গ্রহণ করুক আমার থেকে। কাল আবার যখন আসবো তখন বয়সটা একদিন বেড়ে যাবে তার। একটু বেশি আলো পেলে যদি নিজেকে সবুজ পাতায় সজ্জিত করতে পারে তাতে ক্ষতি কি!”
মটরের শব্দে চিন্তায় ছেদ পড়তেই দেখলাম তেজে দীপ্ত সূর্য আজ অন্ধকারের ভয়ে তাড়াতাড়ি দিগন্তের ওইপারে লুকিয়ে পড়েছে। এই বুঝি সন্ধ্যা নামলো! রাতের সিংহাসনে ভয়ের অধিষ্ঠান। কিসের ভয়? ভূত-প্রেত, শয়তান, না কি বার্ধক্যের? না কি চেপে বসা ক্লান্তির দীর্ঘশ্বাসের? ধীরে ধীরে কালো নেকাবে ঢেকে যায় পুরো এলাকা। কাঁপা হাতে কোরোসিনের প্রদীপ জ্বালাই। রাত বাড়তে থাকে। প্যারাসিটামলের সাথে অ্যান্টিবায়োটিক নিই। কাঁথায় মুড়ে নিই পুরো শরীর। তলিয়ে যাই গভীর ঘুমে। স্বপ্ন দেখি। ভয়ংকর স্বপ্ন। ভয়ের স্বপ্ন। আঠারো ইঞ্চির ষ্ফটিকের মতো স্বচ্ছ ধারালো ছুরি দিয়ে এফোর ওফোর করে দিয়েছি কারো গলা। প্রথমে খেয়াল করিনি। মৃত দেহটা আমার পায়ের কাছে ঢলে পড়তেই দেখলাম অতিপরিচিত এক মুখ। মহিম। আমার বন্ধু। নিজের প্রতি। নিজের কাজের প্রতি সৎ থাকতে গিয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তির হাতে প্রাণটাই খুইয়ে ফেললো! ময়নাতদন্ত থেকে জেনেছিলাম ছুরি দিয়ে আঠাশবার আঘাত করা হয়েছি্লো ওর শরীরে। মহিমের স্থির চোখে অনেকগুলো প্রশ্ন দেখতে পেলাম। যার কোনোটারই জবাব আমার কাছে নেই।
হঠাৎ ওর শরীরটা নড়ে উঠলো। একসময় উঠে দাড়ালো। এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। তারপর পেছন ফিরে বললো, “যাবি আমার সাথে? তোদের এই পোকায় খাওয়া পঁচা-গলা সমাজের থেকে আমি ওখানে খুব ভালো আছি। আরে এত চিন্তা কিসের? যে সমাজ আমাকেই দাম দেয়নি। সেখানে তুই নিজের অবস্থান খুজে বেড়াচ্ছিস! দেখ কেমন আমাকে ভুলে গেছে সবাই। এমনকি তুই পর্যন্ত আমাকে ভুলে গেলি। গতকাল আমার জন্মদিন ছিলো। একবারো আমাকে স্মরণ করিসনি তুই। আরে কাঁদছিস কেন? কী বোকা রে তুই! মানুষ তো এমনই, সব ভুলে যায়। একদিন তোকেও ভুলে যাবে সবাই। তখন দেখবি, তোর ওই সত্য, আদর্শ, সব কিছুই পঁচে গেছে। তোকে একবার বলেছিলাম যে, মানুষ কতটা ঘৃণ্য, কুৎসিত, অহংকারী, ভয়ংকর কঠিন স্বভাবের হতে পারে কল্পনাও করতে পারবি না। তুই আমার সাথে তর্কে জড়িয়েছিলি। আজ তোর চারপাশের সমাজকে দেখার পরও তর্ক করবি আমার সাথে? আয়নায় শেষ কবে দেখেছিস? চুলে সফেদ রং ধরেছে। আর কতদিন। চল, যাই। নতুন শার্ট পরে সমাজে ফিরিস না আর। নিজের জন্য বাঁচ। তুই তো একসময় বলতিস, ‘আমি সত্যের সন্ধান করি, লুকিয়ে রাখি না।’ এখন দেখ, সত্যই তোকে লুকিয়ে ফেলেছে।” শেষ কথাটা বলেই দরজা দিয়ে বেড়িয়ে গেলো মহিম। গলার ক্ষতটা দিয়ে এখনো বেয়ে বেয়ে রক্ত পড়ছে। চিৎকার করে উঠলাম আমি। ছুটে যেতে চাইলাম দরজার দিকে। মহিমকে থামানো উচিত। খাট থেকে উঠতে পারলাম না। চারদিকে শুধু অন্ধকার দেখছি। ঘুম কখন ভেঙে গেলো? এতক্ষণ তাহলে জেগেই ছিলাম?
ভয় হতে শুরু করলো। উঠে পড়ি খাট থেকে। অন্ধকারের হৃদপিণ্ডে ঠেসে দেই প্রদীপের জ্বলন্ত শিখা। করুণ আর্তনাদে ফেঁটে পড়ে সে। দূর থেকে ভেসে আসছে রাগ মালকোষের সুর। এত করুণ, গম্ভীর সুর সবকিছু যেন থামিয়ে দিতে চায়। এই সুর আমাকে মালেকার কথা মনে করিয়ে দেয়। মন খারাপ হলেই বাজাতো রাগ মালকোষ। ওস্তাদ রশিদ খাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলো মালেকা। একদিন ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “ শুনেছি রাগ মালকোষ গভীর রাতের রাগ। তুই তো যখন তখন বাজাস।”
“মালেকা যখন রাগ মালকোষ বাজায় তখন সবসময় গভীর রাত।” স্মিত হেসে উত্তর করেছিলো মালেকা।
আমি ওকে আবার জিজ্ঞেস করেছিলাম “কিন্তু এই গান, এই রাগ কি সত্য বদলাতে পারে মালেকা।”
“সত্য বদলাতে পারে কিনা জানি না, তবে কষ্ট লুকিয়ে রাখতে পারে।”
“কিন্তু আমি তো সত্যের সন্ধান করি, লুকানোর নয়।”
“সব সত্য কি সবসময় বলা যায়? মাঝে মাঝে লুকিয়েও রাখতে হয়।”
কথা বলতে বলতে মালেকা গম্ভীর হয়ে পড়তো। তখন একা থাকতে পছন্দ করতো।
রাগ মালকোষের সুর আর শোনা যায় না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি চারটা বাজতে চলেছে। খোলা জানালা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া এসে কাঁপিয়ে দিলো প্রদীপের শিখা। অনুভব করলাম গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তবে জ্বরটা একদম নেই। মাথাটা হালকা লাগছে।
কাঁথাটা কোমর অব্দি টেনে আবার শুয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো পৌনে আটটার দিকে। জ্বরটা আবার এসেছে। তবে আগের তুলনায় কম। কিন্তু তাতে কি। শুয়ে থাকা চলবে না। কাজে ফিরতে হবে। আমার ছুটে চলা যে নিরন্তর। জ্বর কমবে সকাল-দুপুর-সন্ধ্যার বাতাসে। এদিকে অফিসের সময় থেকে আধা-ঘণ্টা লেট। তড়িঘড়ি করে নতুন শার্টটা গায়ে জড়িয়ে নেমে পড়লাম ঘর থেকে। বুক পকেটে রইলো একটা করে প্যারাসিটামল আর এন্টিবায়োটিক। মোড়ের দোকান থেকে খেয়ে নেবো রুটি আর চায়ের সাথে ।
জীবন আবার শুরু। হয়তো ছুটে চলার মধ্যেই নিহিত জীবনের অবস্থান। কিংবা এই অস্থিরতাই জীবনের আসল ঠিকানা।