সমসাময়িক পাশ্চাত্যবাদ : পশ্চিমা দু’টি ধারার তুলনামূলক পর্যালোচনা

আব্দুল করিম নোমানী

ভূমিকা

সমসাময়িক আরব/ইসলামি চিন্তাধারায় পাশ্চাত্যবাদী অধ্যয়নকে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত ধারার প্রেক্ষাপটে হাজির করা দরকার, যাতে আমাদের জ্ঞান বৈশ্বিক জ্ঞানের পরিমণ্ডলে প্রান্তিকায়িত ও বিস্মৃত না হয়। সে ক্ষেত্রে প্রচলিত ‘ভুল বোঝাবুঝি’ বা ‘একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি’ দূর করতে হবে, যা বর্তমান অনেক আরব/ইসলামি অধ্যয়নে বিদ্যমান। এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে বৈশ্বিক ও আরব-ইসলামি পরিসরে ‘পাশ্চাত্যবাদ’ পরিভাষার কার্যত প্রয়োগের বিভিন্নতা।

সুতরাং ‘ইস্তেগরাব’ শব্দের বর্ণমূল খুঁজে তার থেকে উৎসারিত শব্দ ও ক্রিয়াগুলোর তুলনামূলক বিবেচনা করে তাকে পারিভাষিক রূপদানের কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা এ পরিভাষার প্রয়োগ নিছক আরবিতে সীমাবব্ধ নয়, তদ্রূপ ‘পাশ্চাত্যবাদী এপ্রোচগুলো’ ‘নির্দিষ্ট আরবি জ্ঞানচর্চা’ নয়—যেমনটা অনেকে মনে করে থাকে। বরং তা ‘অক্সিডেন্টালিজম’-এর আরবি প্রতিশব্দ, যার পশ্চিমা প্রচলন আরবে ‘ইস্তেগরাব’-এর প্রচলনের অনেক আগে, যেমন পাশ্চাত্যে ‘ওরিয়েন্টালিজম’-এর প্রচলনের পর আরবে ‘ইস্তেশরাক’ শব্দের চলন ঘটেছিল।

পাশ্চাত্যবাদ একটি পরিভাষা। পরিভাষা শাব্দিক প্রয়োগের চেয়েও বিস্তৃত। পরিভাষা সজ্ঞায়ন হয় বিষয়বস্তু দ্বারা, ভাষাগত উদ্ভব দ্বারা নয়। সুতরাং আরবি ভাষাগত উদ্ভবের উৎস উল্লেখ করার মাধ্যমে তা তাৎপর্য লাভ করবে না, বা পূর্ব/পশ্চিম দ্বৈততা থেকে উদ্ভূত ভৌগোলিক মাত্রার দ্বারাও তার সংজ্ঞায়ন তাৎপর্যমণ্ডিত হবে না। সামগ্রিভাবে বললে পাশ্চাত্যবাদ এখন পর্যন্ত ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির পর্যায়ে রয়েছে, যা নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু ও সংহত পদ্ধতি নিয়ে এখনো সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।

বিশ্বব্যাপী একাডেমিক মহলে পাশ্চাত্যবাদ

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পাশ্চাত্যবাদের প্রচলন অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক পরিভাষা থেকে বিষয়বস্তুর বহুত্ব ও প্রয়োগের বৈচিত্র্য থেকে খুব সামান্যই আলাদা; তবে একজন অভিজ্ঞ গবেষক এ ক্ষেত্রে তার ইতিহাস পর্যালোচনা করে স্পষ্ট দুটি ধারা উপলব্ধি করতে পারেন। সে দুটো ধারাকে ‘ভিত্তিগত পাশ্চাত্যবাদ’ (Foundational Occidentalism) ও ‘প্রতিবর্তী পাশ্চাত্যবাদ’ (Reflexive Occidentalism) হিসেবে অভিহিত করা যায়।

 

প্রথম প্রবণতা : ভিত্তিগত পাশ্চাত্যবাদ : কুজ ফ্যান ও ফার্নান্দো করোনেল

এ প্রবণতা অনুসারে পাশ্চাত্যবাদ সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন (Cultural Studies)-এর অন্তর্গত। একাডেমিকভাবে তা সাংস্কৃতিক তত্ত্ব (Cultural Theories), সামাজিক তত্ত্ব (Cultural Theories) বা উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্বের (Postcolonial Theory) কাঠামোতে প্রণীত। অনেকে তাকে উত্তর-আধুনিক সমালোচনাতত্ত্বের (Postmodernity Criticism) মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত করে। এ ক্ষেত্রে তার জ্ঞানতাত্ত্বিক কারণটি স্পষ্ট; কেননা পাশ্চাত্যবাদ প্রাথমিকভাবে পশ্চিমা চিন্তাধারার সমালোচনা, পশ্চিমা আধুনিকতার ভিত্তি-বিনির্মাণ এবং পশ্চিমা কেন্দ্রত্ববাদের বাইরে গিয়ে চিন্তার একটি কাঠামো নির্মাণের সহায়ক। পাশাপাশি এটি পশ্চিমা বুদ্ধিবৃত্তিক ও একাডেমিক প্রবণতার অংশও, যা গত শতকের ষাটের দশকে আকরণোত্তরবাদী (Post Structuralism) যুগের সমসময়ে গঠিত।

পাশ্চাত্যবাদে এ প্রবণতার অন্যতম ব্যক্তিত্ব হলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অধ্যয়ন ও উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্বের অধ্যাপক মরিশীয় বংশোদ্ভূত গবেষক কুজ ভ্যান (Couze Venn)। তার রচিত ‘Occidentalism : Modernity and Subjectivity’ গ্রন্থটি পশ্চিমা-পাশ্চাত্যবাদী চিন্তাধারার অন্যতম একটি উৎসগ্রন্থ, যা ২০০১ সালে প্রকাশিত হয়। কুজ ভ্যানের মতে পাশ্চাত্যবাদ হচ্ছে ‘নতুন পরিভাষা তৈরির প্রচেষ্টা’, যা ‘একটি ভিন্ন উত্তর-আধুনিক’ চিন্তা (a different postmodernity) বা ‘একটি আন্তর্জাতিক আধুনিকতা’র (A transnational modernity) উন্মোচক। এ ভিত্তিতে পাশ্চাত্যবাদ নির্দিষ্টভাবে ‘আধুনিকতার সমালোচনা’র উপর নির্ভর করে। যার অর্থ হচ্ছে, পাশ্চাত্যবাদ প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের দ্বৈত বিভাজনের কোনো অনুসন্ধান নয় এবং প্রাচ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা, আধিপত্য এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ও মনস্তাত্ত্বিক আগ্রাসনের নিছক স্বরূপ উদ্‌ঘাটনও নয়। বরং তা সমালোচনামূলক একটি প্রকল্প, যা আধুনিক যুগে কাঠামোবাদী (structuralist) ও প্রপঞ্চবাদী (phenomenological) সমালোচনার মাধ্যমে সূচিত হয়েছে এবং পরবর্তীতে উত্তর-আধুনিক যুগে বিনির্মাণ ও ব্যাখ্যামূলক পদ্ধতির মাধ্যমে গভীরতর পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।

এ দিক থেকে পাশ্চাত্যবাদ নতুন এক জ্ঞানতাত্ত্বিক যুগের উন্মোচন করেছে, যা একুশ শতকের শুরুতে পাশ্চাত্য চিন্তাধারার সমালোচনার মাধ্যমে শুরু হয়, যদিও বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তার তাত্ত্বিক ও ভিত্তিগত কাঠামো তৈরি হয়েছিল এবং উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে স্বল্পবিস্তর এ প্রবণতার উদ্ভব হয় জাপান, রাশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা ও পূর্ব ইউরোপের কিছু দেশে।

উপরোক্ত বোঝাপড়ার ভিত্তিতে পাশ্চাত্যবাদ পশ্চিমা চিন্তাভাবনা বোঝার ও বিশ্লেষণ করার নিছক কোনো আরব বা প্রাচ্যীয় প্রকল্প নয়, বরং সামগ্রিকভাবে পাশ্চাত্যবাদ হচ্ছে ‘তৃতীয় সহস্রাব্দে পশ্চিমা চিন্তা সমালোচনার একটি প্রকল্প’ যাতে পাশ্চাত্যসহ বিভিন্ন ঘরানার চিন্তাবিদরা অবদান রাখে। এ প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে অ-পশ্চিমা ধারণাগুলোকে তার সঠিক জ্ঞানতাত্ত্বিক অবস্থানে পুনঃস্থাপন, বৈশ্বিক চিন্তায় তার প্রভাব নিরূপণ এবং বিশ্বব্যাপী আধুনিককায়নে তার গুরুত্ব অনুধাবন। এ ধারায় জন জেমস ক্লার্ক কর্তৃক রচিত ‘Oriental Enlightenment : The Encounter Between Asian and Western Thought’ গ্রন্থটি অন্যতম যেখানে তাওবাদ ও মধ্যমাকা ঘরানার মতো অনেক প্রাচ্যীয় ঘরানাকে উপরোক্ত দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা হয়েছে।

সর্বোপরি কুজ ভ্যানের মতে পাশ্চাত্যবাদ হচ্ছে, পোস্টমডার্নিস্ট সমালোচনাতত্ত্ব অনুসারে আধুনিক যুগে ইউরোপীয় নবজাগরণের বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা অধ্যয়ন, পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী ও কর্তৃত্ববাদী ইতিহাসের আত্মসমালোচনা এবং তাকে শ্রেষ্ঠত্ববাদ ও সার্বজনীনতার মিথ থেকে অবমুক্তকরণ। ফলে তা সমাজে আধিপত্যশীল আধুনিকতার যৌক্তিক স্থান নির্ধারণের পাশাপাশি বর্তমানকে পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে নির্দেশ করে, যা সময় ও জীবন-জগতের সাথে সামাজিক রূপ পরিগ্রহ করবে।

কুজ ভ্যান তত্ত্বায়নের যে ধারা উদ্ভাবন করেন, এ ক্ষেত্রে তারও অগ্রবর্তী ছিলেন ভেনেজুয়েলিয়ান এনথ্রপলোজিস্ট ফার্নান্দো করোনিল। তিনি পাশ্চাত্যবাদকে পশ্চিমা আধুনিকতার মূল্যবোধগত পার্থক্যের একটি প্রমাণ হিসাবে বিবেচনা করেন, একইভাবে যা আত্মগঠনের একটি প্রক্রিয়াও। ফলে তার মতে পাশ্চাত্যবাদের গঠন-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এমন একটি বিনির্মাণমূলক পদ্ধতি থেকে, যা পশ্চিমা কেন্দ্রত্ববাদ থেকে উদ্ভূত আধিপত্য, উপনিবেশ ও শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার স্বরূপ উন্মোচন করে। এতে পাশ্চাত্যবাদ হয় বিনির্মাণবাদী একটি পরিভাষা, যা উপরোক্ত লক্ষ্যকে সামনে রেখে আকরণোত্তর ও আধুনিকোত্তর যুগে পশ্চিমা চিন্তায় নব-উদ্ভাবিত বিশ্লেষণাত্মক দিকগুলোকে সামনে রেখে নতুন আত্মপাঠের প্রস্তাবনা হাজির করে। সে বিশ্লেষণাত্মক দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে দেরিদীয় ডিকনস্ট্রাকশন, ফুকোডিয়ান ডিসকোর্স অ্যানালাইসিস ও গ্যাদামেরিয়ান হারমেনিউটিকস।

করোনাল কুজ ভ্যানের মতো মনে করে থাকেন যে, পাশ্চাত্যবাদের অন্যতম কর্তব্য হলো ‘পশ্চিমা আলোকায়ন’কে তার উপনিবেশবাদী ও শ্রেষ্ঠত্ববাদী কাঠামোর মধ্যে রেখে পাঠ করা। উপরন্তু তার মতে উপনিবেশোত্তর যুগে ‘বিশ্বায়ন’ ‘উন্মুক্তকরণ’ ‘নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার’ ‘মুক্ত বাজার’ ও ‘বৈশ্বিক বাণিজ্য’-এর মতো ধারণাগুলোকে উপনিবেশ যুগের ‘সভ্যকরণ’ ও ‘আলোকায়নে’র মতো পরিভাষার স্থানে প্রতিস্থাপন করে তার অসারতা সাবস্ত্য করা। এই প্রচেষ্টা পশ্চিমা আধিপত্যের আত্ম-সমালোচনার তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক একটি পদ্ধতি, করোনেল যাকে সমালোচনামূলক পাশ্চাত্যবাদ (Critical Occidentalism) বলে অভিহিত করেন।

কুজ ভ্যান ও করোনালের মতো প্রথম ধারার এই তাত্ত্বিকদের মতে পাশ্চাত্যবাদ আজ পাশ্চাত্যের ‘গণতন্ত্র’ ‘মানবাধিকার’ ‘ব্যক্তি-স্বাধীনতা’ ও ‘নারী-অধিকার’-এর মতো আরো অন্যান্য স্লোগানগুলো প্রতিরোধ করছে যেগুলো আপেক্ষিক, মতাদর্শগত ও স্ব-স্বার্থে নিয়োজিত এবং ‘অন্যে’র ক্ষেত্রে প্রয়োগহীন। যার ফলে বর্তমান পাশ্চাত্যের অবস্থান মধ্যযুগীয় ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের মতো। উভয়ের মাঝে পার্থক্য শুধু শব্দের। মধ্যযুগীয় ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ ‘ক্ষমা’ ‘সুসংবাদ দান’ আর ‘স্বর্গের টিকিট’ ফেরি করে বেড়াত আর আধুনিক পাশ্চাত্য ফেরি করছে ‘আলোকায়ন’ ও ‘সভ্যকরণে’র।

সবশেষে করোনেল এ ব্যাপারে জোর দেন যে, পাশ্চাত্যবাদ নতুন কোনো বিশ্লেষণাত্মক ধারা বা জ্ঞান-ব্যবস্থার আবর্তন করেনি। তার পদ্ধতিগুলো সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদ, বিনির্মাণবাদ, হারমেনিউটিক্স, সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক নৃতত্ত্বের মতো আরো পশ্চিমা জ্ঞানীয় ধারণা থেকে অনুবর্তিত। সুতরাং তা তত্ত্ব ও পদ্ধতিগত দিক থেকে স্বয়ং ‘পশ্চিমা পাশ্চাত্যবাদ’ (Western Occidentalism)।

দ্বিতীয় ধারা : প্রতিবর্তী পাশ্চাত্যবাদ : আভিশাই মার্গালিথ ও ইয়ান বুরুমা

এই ধারার অনুসারীরা-যারা বিভিন্ন ঘরানার-প্রায়শই প্রথম ধারার অনুসারীদের অনুসৃত তাত্ত্বিক ধারাগুলো উপেক্ষা করে পাশ্চাত্যবাদের ধারণাকে অতিসাধারণীকরণ করার বা প্রতিবর্তী একটা রূপ দাড় করানোর চেষ্টা করে। এই অন্ধপ্রচেষ্টায় তারা ‘একদিক থেকে পশ্চিমা একাডেমিয়ায় সমীক্ষিত আধুনিকতার এবং অন্যদিকে তাতে একাডেমিক অনাগ্রহে’র দিকটি প্রতিফলিত করে পাশ্চাত্যবাদের অস্পষ্টতাকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করে। জোনাথন স্পেন্সার, জহির বাবর ও জেমস ক্যারিয়ারের মতো এ ধারার কতিপয় অনুসারী পাশ্চাত্যবাদকে সংজ্ঞায়ন করেন ‘পশ্চিমা সাংস্কৃতিক উপাদান ও মূল্যবোধ গ্রহণকারী অ-পশ্চিমা সামাজিক পন্থা’-হিসেবে। সুতরাং পাশ্চাত্যবিদ (Occidentalist) হবেন পশ্চিমা সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ গ্রহণকারী এবং পশ্চিমা যৌক্তিকতার রক্ষক–যদিও কিছু ক্ষেত্র তার বিপরীত মত পোষণ করবে এবং সমালোচনাও করবে। বস্তুত এটা পাশ্চাত্যবাদ ধারণার ইচ্ছাকৃত রদবদল, যা শব্দটির প্রয়োগযোগ্যতায় পরিবর্তন তৈরি করার চেষ্টা করছে। পক্ষান্তরে অন্যান্য গবেষক মনে করেন যে, পাশ্চাত্যবাদ জাতীয়তাবাদী বা আদর্শবাদী পরিভাষা ছাড়া আর কিছুই নয়, কারণ তা ‘একটি সামষ্টিক পরিচয়ের প্রণয়ন’ করে। আর সে মতে পাশ্চাত্যবাদ অ-পশ্চিমা মানুষের জাতীয় আদর্শের প্রতিফলন হয়ে ওঠে। তাদের অনুমান অনুসারে এটাই গত দুই দশকে পশ্চিমা চিন্তাধারার বিপরীতে একাধিক পাশ্চাত্যবাদের (multiple Occidentalisme) জন্ম দিয়েছে। যেমন আরব, ল্যাটিন, রাশিয়ান, চীন ও জাপানি। অতএব তাদের মতে পাশ্চাত্যবাদ ‘জাতীয় আদর্শবাদ’ ছাড়া আর কিছুই নয়।

পাশ্চাত্যবাদের ধারণাগত পরিবর্তন এবং তাকে সৃজনশীল বিষয়বস্তু থেকে অবমুক্ত করার বড় একটি প্রচেষ্টা হচ্ছে তাকে ‘প্রতি-প্রাচ্যবাদ’ বা পশ্চিমা আধিপত্যের বিপরীতে ‘মানসিক প্রতিক্রয়া’ হিসেবে বর্ণনা করা। উপরন্তু এই ধারার অনুসারীরা পাশ্চাত্যবাদকে একটি ‘আক্রমনাত্মক ও সংঘাতমূলক প্রকল্পে রূপান্তরিত করতে চায়, যা পশ্চিমের ধ্বংস কামনা করে’ যার প্রতিনিধিত্ব করছ ‘মৌলবাদী ইসলামি আন্দোলন এবং তার আদর্শে পরিচালিত রাষ্ট্রগুলো।’

এ ধারার প্রধান তাত্ত্বিক হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক এবং আমেরিকার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের ইতিহাসের অধ্যাপক আভিশাই মার্গালিথ (Avishai Margalit), যিনি ইসরায়েলি নাগরিক। এ ধারাকে সামনে রেখে তিনি অনেক গবেষণাপত্র ও বই প্রকাশ করেছেন, এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ডাচ প্রফেসর ইয়ান বুরুমার (Ian Buruma) সাথে তার যৌথ বই ‘Occidentalism : The West in the Eyes of Enemies’ যা ২০০৫ সালে প্রকাশিত।

এতে তারা পাশ্চাত্যবাদকে পাশ্চাত্য-বিরোধী (Anti-Westernism) বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করেন। সুতরাং পাশ্চাত্যবিদ ‘পশ্চিমা আধুনিকতা, সমাজ-সভ্যতা ও মূল্যবোধের ঘোরতর বিরোধী’। এ ভিত্তিতে সহজ ভাষায় বললে পাশ্চাত্যবাদ হচ্ছে ‘পাশ্চাত্য-বিরোধিতা’। এভাবে মার্গালিথ ‘মৌলবাদী ইসলামি আন্দোলন’ ‘মুক্তি আন্দোলন’ ‘বিশ্বায়ন-বিরোধী আন্দোলন’ ও ‘সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন’কে ‘পাশ্চাত্যবাদী আন্দোলন’ হিসেবে পরিগণিত করেন। ইয়ান বুরুমা একই অর্থ নিশ্চিত করেন। উপরন্তু তিনি বলেন, পাশ্চাত্যবাদ হচ্ছে নিজের ঐতিহ্যিক মূল্যবোধের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, আধ্যাত্মিকতার সংরক্ষণ, জাতীয় শিক্ষার দীক্ষাগ্রহণ এবং নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মের যথোচিত অনুসরণ, যার প্রতি বর্তমান পশ্চিমা বিশ্ব মুখাপেক্ষী হয়ে আছে।

আভিশাই মার্গালিট উপরোক্ত ‘প্রতিবর্তী’ পাশ্চাত্যবাদের ‘সঠিক’ স্বরূপ সুস্পষ্ট করেন। আর সেটা হচ্ছে ‘পশ্চিমা চিন্তাধারার পশ্চিমা সমালোচনা’ এছাড়া বাকিসব ‘পাশ্চাত্য-বিরোধী পাশ্চাত্যবাদ’। তার মতে পাশ্চাত্যবাদের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও পদ্ধতিগত সকল উপকরণ প্রধানত পাশ্চাত্য-প্রদত্ত; তারপর সেটা পুরো বিশ্বে স্থানান্তরিত হয়েছে। তাই পশ্চিমা সভ্যতার বাইরে গিয়ে পাশ্চাত্যবাদের কোনো অর্থ থাকতে পারে না।

মার্গালিথ মনে করে থাকেন ‘সঠিক’ পাশ্চাত্যবাদ একটি পশ্চিমা প্রকল্প, যা পশ্চিমা চিন্তাধারার প্রথম দিককার পশ্চিমা সমালোচনামূলক আন্দোলন থেকে গঠিত। এটা প্রাচ্যবাদের পাশ্চাত্য প্রতিশব্দ, তার অনুমান অনুসারে যা উনিশ ও বিশ শতকের ‘বিপ্লবী পশ্চিমা চিন্তাবিদদের’ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় পাশ্চাত্যের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শূন্যতার ব্যাপক একটি প্রেক্ষাপটে। তখন পশ্চিমা চিন্তাধারার সমালোচনা এবং প্রাচ্যের আধ্যাত্মিক ঘরানা থেকে প্রেরণা সঞ্চারণের একটি প্রবণতা আসে দার্শনিকদের মাঝে, যেমনটা হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ ও গ্যাদামারের হারমেনিউটিক্সে প্রত্যক্ষ করা যায়।

এর বিপরীতে ‘অ-পশ্চিমা পাশ্চাত্যবাদ’ বা ‘পাশ্চাত্যের প্রাচ্যীয় সমালোচনা’–মার্গালিথের বর্ণনামতে নিছক রাজনৈতিক ইসলামি মতাদর্শিক (Islamic Political Ideology) প্রকল্প ছাড়া আর কিছুই নয়, পাকিস্তানে যার তাত্ত্বিক রূপ দিয়েছেন আবুল আলা মওদুদি, ইরানে সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ তালকানি এবং মিসরে সাইয়্যেদ কুতুব। তার দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে ইসলামি এই পাশ্চাত্যবাদ পশ্চিমকে দেখে একটি ‘নতুন জাহেলিয়াতে’র স্বরূপ হিসেবে। সে ভিত্তিতে লক্ষ্য হচ্ছে ‘জাহিলিয়্যাতগ্রস্থ পাশ্চাত্যে শুধু ইসলামের প্রচারই যথেষ্ট নয়, বরং তার মূল্যবোধগুলো মিটিয়ে দেওয়াও প্রয়োজন।’ মার্গালিথ মনে করেন, ‘এ এক বিপজ্জনক খেলা যা কতিপয় আরব চিন্তাবিদ দ্বারা ভ্রান্ত বুদ্ধিবৃত্তিক আবরণে প্রকাশ পেয়েছে, তার ঝুঁকি অচিরেই বিশ্ববাসীর সামনে উন্মুক্ত হবে।’ তিনি এটাকে বিভ্রম হিসেবেও পরিগণিত করেন, কেননা মুসলমানরা পাশ্চাত্যকে ধ্বংস করার শক্তি রাখে না। ফলে এ পাশ্চাত্যবাদ নিছক ‘হীনমন্যতার বহিঃপ্রকাশ, যা প্রাচ্যের সমাজগুলো অনুভব করে থাকে’। ফলে তা ‘বিপজ্জনক রাজনৈতিক সমস্যা’ ছাড়া আর কিছুই নয়।

পাশ্চাত্যবাদের এই প্রতিবর্তী রূপায়ন ইজরাইলি আভিশাই মার্গালিথের মতো শুধু ‘ইসলামি পাশ্চাত্যবাদে’র ক্ষেত্রেই নয়, বরং চীনা ও জাপানিজ পাশ্চাত্যবাদের ক্ষেত্রে আমেরিকান দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারাও প্রতিফলিত হয়েছে। এখানে আমরা চীনা পাশ্চাত্যবাদ নিয়ে আমেরিকান প্রতিবর্তু দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করব ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির কালচারাল স্টাডিজ অধ্যাপক জিয়াওমেই চেন রচিত ‘occidentalism : a theory of counter-discourse in post-mao china’ বইয়ের আলোকে। সেখানে তিনি পাশ্চাত্যবাদের দু’টি ধারা উল্লেখ করেন:

১. অফিসিয়াল পাশ্চাত্যবাদ : যা পশ্চিমা চিন্তাধারা ও পশ্চিমা মূল্যবোধের প্রতি নিছক শত্রুতামূলক দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করে উদ্ভূত। এর উদ্ভব গত শতকের চল্লিশের দশকে এবং তা চীনে মাওবাদী যুগজুড়ে অব্যাহত ছিল। এ ধারা মার্গালিথের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে খুব বেশি দূরে নয়।

২. অ্যান্টি-অফিসিয়াল পাশ্চাত্যবাদ : যা অনেক চীনা চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক দ্বারা অনুসৃত হয়। এ ধারা অভ্যন্তরীণ সরকারি আধিপত্য প্রতিরোধে পাশ্চাত্যের উদারপন্থি মতাদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত। জিয়াওমেই চেনের মতে এ ধারার উদ্ভব গত শতকের বিশের দশকে, যখন নতুন সংস্কৃতি আন্দোলনের উত্থান ঘটে। কতিপয় চীনা চিন্তাবিদ চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের (১৯৬৮-১৯৭৬) পর পাশ্চাত্যবাদের এ ধারা গ্রহণ করার চেষ্টা করেছিলেন, যা বিখ্যাত চীনা ডকুমেন্টারি সিরিজ হি শ্যাং (He Shang)-এ বিশেষভাবে স্পষ্ট করে দেখানো হয়। তখন চীনা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং পশ্চিমা আধুনিক সংস্কৃতির মধ্যে এক ধরনের সংঘর্ষই প্রতিফলিত হয়েছিল।

‘গ্লোবাল হিস্টরি অব মডার্ন হিস্টরিওগ্রাফি’ গ্রন্থে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে, এডওয়ার্ড ওয়াং বলেন, চীনা বংশোদ্ভূত চীন বিষয়ক অধ্যয়নে বিশেষজ্ঞরা পাশ্চাত্যবাদী এপ্রোচে সবচেয়ে সক্রিয়। তার মতে এর কারণ হলো গত শতকে ঝড়ো পরিবর্তন আসার পরও চীন সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষায় অধিকতর সক্ষম ছিল। তার অনুমান অনুসারে, অতীত সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য অনুসন্ধানে চীনা অভিজ্ঞতা জাপানি অভিজ্ঞতা থেকে আলাদা নয়।

এই তিন তাত্ত্বিক তথা আভিশাই মার্গালিট, ইয়ান বুরুমা ও জিয়াওমেই চেন পাশ্চাত্যবাদের বিশ্বব্যাপী একাডেমিক অধ্যয়নে দ্বিতীয় ধারার প্রতিনিধিত্বকারীদের অন্যতম। আমরা তাদের সাথে অন্যান্য চিন্তাবিদদের যোগ করতে পারি যারা এ ধারাকে সমর্থন করেছে বা তাকে বিস্তৃত করেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন জেমস কেটলার (James Ketelaar), যিনি ‘কৌশলগত পাশ্চাত্যবাদ’ (Strategic Occidentalism) ধারণার প্রবর্তক, তার মতে যা অন্যের ধর্মের ‘অন্যত্ব’ তৈরি করে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিকভাবে নিজস্ব ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রসারের প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন, জাপানের বৌদ্ধ ধর্ম এবং তার সাথে জাপানে বা জাপানের বাইরে খ্রিস্টান ধর্মের সম্পর্ক।

রিও তাকেশি (Rio Takeuchi) পাশ্চাত্যবাদকে সাধারণভাবে পশ্চিমা আধিপত্য-বিরোধী একটি পরিভাষা হিসেবে গণ্য করেন, যা এশিয়ান মূল্যবোধ থেকে আলাদা। নাজার হারমাস তার ‘The [European] Other in Medieval Arabic Literature and Culture : Ninth-Twelfth Century AD’ গ্রন্থে একই মত পোষণ করেন। ব্রায়ান টার্নার (Bryan Turner) তার ‘Orientalism, postmodernism, and globalism’ গ্রন্থে পাশ্চাত্যবাদকে পশ্চিমা আধুনিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম হিসাবে বিবেচনা করেন। অন্যদিক মাল্টেম আহিস্কার (Meltem Ahiska) মতে পশ্চিমারা কীভাবে তাদের ভাবমূর্তি উপস্থাপন করে তা বোঝার অ-পশ্চিমা প্রচেষ্টা হচ্ছে পাশ্চাত্যবাদ। কেননা বিশ্বের পাশ্চাত্যবাদী এপ্রোচগুলোর বেশিরভাগই পশ্চিমা সম্প্রসারণ এবং তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে আবির্ভূত। এ ক্ষেত্রে অ-পশ্চিমাদের জন্য কেবল একটি জাতীয় সাংস্কৃতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠাই নয়, বরং পশ্চিমা আধুনিকীকরণ অনুকরণেরও প্রয়োজন। এতে দুটো দিক থাকে, প্রথমত আধুনিকতার রূপায়নে পশ্চিমা পথ-পদ্ধতি সম্পর্কে অবগতি। দ্বিতীয়ত, নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি উপায়ে আধুনিকতার রূপদানের উপায়-অনুসন্ধান। মাল্টেম আহিস্কার এ ধারণার অর্থ হচ্ছে, পাশ্চাত্যবাদ পশ্চিমা আধুনিকতার গতিপথ অনুসন্ধানের নিছক একটি প্রক্রিয়া এবং অ-পশ্চিমারা সে গতিপথ ব্যতীত আধুনিকীকরণের নতুন কোনো পন্থা উদ্ভবান করতে পারে না।

সর্বোপরি দ্বিতীয় ধারা অনুসারে ‘পাশ্চাত্য যেভাবে প্রাচ্যবাদের মাধ্যমে প্রাচ্যের একটি স্থিরচিত্র নির্ধারণ করেছে, তদ্রূপ প্রাচ্যও পাশ্চাত্যের জন্য তেমনই স্থিরচিত্র নির্ধারণ করবে, যার নাম পাশ্চাত্যবাদ। বস্তুত তা ‘প্রতি-প্রাচ্যবাদ’ ছাড়া আর কিছুই নয়।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷