শিল্প-সাহিত্য চলে গেছে নষ্টদের অধিকারে—নাজিব কিলানি

জহুরুল ইসলাম

বই : বরেণ্য আরব সাহিত্যিকদের জবানে ইসলামি সাহিত্য

অনুবাদ ও সংকলন : জহুরুল ইসলাম

প্রচ্ছদ : কাজী যুবাইর মাহমুদ

প্রকাশনী : নাশাত পাবলিকেশন

পৃষ্ঠা : ৪৮


নাজিব কিলানি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সাহিত্য-সমালোচক। তিনি আধুনিক ইসলামি সাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তি। তার রচিত গ্রন্থ সত্তরের মতো। এর অধিকাংশই উপন্যাস, গল্প ও কাব্য-সংকলন। ইসলামি সাহিত্য নিয়ে রচিত তার বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থগুলো ইসলামি সাহিত্য-সমালোচনাধারায় চমৎকার ও শক্তিশালী সংযোজন। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত মিশরের খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক নাজিব মাহফুজ তাকে উপাধি দিয়েছেন ‘মুনাযিরুল আদাবিল ইসলামি’ বা ‘ইসলামি সাহিত্যতত্ত্ববিদ’।
ইসলামি সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধনে নাজিব কিলানির অবদান অনেক। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি অর্জন করেছেন ‘কায়রো আরবিভাষা একাডেমি পুরস্কার’, ‘জাতীয় শিল্পসাহিত্য পুরস্কার’, ‘শিক্ষামন্ত্রণালয় পুরস্কার’, ‘ড. তহা হুসাইন স্বর্ণপদক’ ও ‘কবি ইকবাল স্বর্ণপদক’। মিশরীয় বংশোদ্ভূত এই খ্যাতনামা সাহিত্যিক ১৯৯৫ সালে নিজ মাতৃভূমি কায়রোতে ইনতেকাল করেন।
ইসলামি সাহিত্যবিষয়ক চমৎকার এ-সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় ‘রাবেতাতুল আলামিল ইসলামি’র মুখপত্র ‘আল আদাবুল ইসলামি’তে।


আল আদাবুল ইসলামি : ইসলামি সাহিত্যের মূলনীতি কী? এর সীমারেখা কতটুকু?

নাজিব কিলানি : আসলে ইসলাম সাহিত্যের কোনো শৈল্পিক আকৃতি নির্ধারণ করে দেয়নি এবং নির্দিষ্ট শৈলীতেই সাহিত্য রচনা করতে হবে; এর বাইরে যাওয়া যাবে না- এমন বাধ্যবাধকতাও এখানে নেই। ইসলাম শুধু বিষয় বা চিন্তার উপাদানটুকু আমাদের ধরিয়ে দিয়েছে। এটাকে উপজীব্য করে যেকোনো আঙ্গিকে সাহিত্য রচনা করা যেতে পারে।

এখানে বোঝার বিষয়, ইসলামের দর্শন পৃথিবীর অন্যান্য মানবদর্শন থেকে ভিন্ন। যেমন ধরুন, কোনো কোনো দার্শনিকের মতে, মানুষ প্রকৃতিগতভাবে অন্যায়মুখী। তাই মিথ্যা, কপটতা, কাপুরুষতা- এগুলো তার মৌলিক স্বভাব। কোনো কোনো দার্শনিক বলেন, শিল্পের লক্ষ্য কেবল শিল্প। সে অন্য কোনো উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের মাধ্যম নয়। এরাই হল ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ বা ‘আর্ট ফর আর্ট’—স্লোগানের প্রবক্তা।
বিপরীতে একজন মুসলিম শিল্পীর থাকে স্বতন্ত্র চিন্তা-দর্শন এবং তা হয় জীবন ও জগদ্ব্যাপী। তার এ-ও বিশ্বাস থাকে যে, শিল্পের সঙ্গে এক মহান উদ্দেশ্য জড়িত। আর সে উদ্দেশ্য হচ্ছে- এমন মনন গঠন করা, যা হবে সত্য-সুন্দরের আলোয় উদ্ভাসিত।

ইসলামি শিল্প-সাহিত্যের ময়দান অনেক প্রশস্ত। এখানে সমকালীন ও বাস্তব বিষয়ের যেমন দখল আছে, তেমনি ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক উপাখ্যানও এখানে সাহিত্যের উপাদান হিসেবে স্বীকৃত। একইভাবে পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিমের সবই এর অন্তর্ভুক্ত এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে এর ব্যাপ্তি। এই সাহিত্যের সম্পর্ক মুসলমানদের সঙ্গে এবং পৃথিবীর আনাচেকানাচে থাকা প্রতিটি মানুষের সঙ্গে।

আল আদাবুল ইসলামি : আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমকালীন সাহিত্য ও চিন্তার যে জগৎ তৈরি হয়েছে, সে ব্যাপারে আপনার সার্বিক মূল্যায়ন জানতে চাই।

নাজিব কিলানি : সমকালীন বিশ্বসাহিত্যের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, সেখানে গল্প উপন্যাস নাটক কবিতা চলচ্চিত্র ও আর্টসহ শিল্পের যত শাখা আছে, সব নানা অনৈতিকতা, উপনিবেশিক ও বর্ণবাদী চিন্তায় পিষ্ট। সেসব সাহিত্যের সর্বত্রই ধ্বংস ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উন্মত্ত চিন্তার ছাপ প্রকট এবং সেগুলো প্রতিনিয়তই নির্মল জীবনের চিত্র উপেক্ষা করে চলেছে। পশ্চিমাবিশ্ব এই যে আদর্শিক ও চিন্তাগত দোদুল্যমানতার শিকার, এর জালে আটকে পড়া আমাদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। তবু আফসোসের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিকরা আজ পাশ্চাত্যের চিন্তায় প্রভাবিত হয়ে তাদের সাফাই গেয়ে বেড়াচ্ছে এবং কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই তাদের পথ অনুসরণ করছে।

আমাদের সাহিত্য তো আমাদের ঐতিহ্য ও বাস্তবতার কথা বলবে। আমাদের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার কথা বলবে। এখানে তো থাকবে আমাদের আত্মিক মূল্যবোধের কথা।

এখানে একটি বোঝার বিষয় আছে। বাইরে থেকে আমদানি করা নিত্যনতুন বিষয়ে গা ভাসিয়ে দেওয়ার নামই উন্নতি-অগ্রগতি নয়। এই বিচারহীন অনুসরণ অনেক সময় পিছিয়ে পড়ারও কারণ হয়। আমি এটা বলছি না যে, আমরা আমাদের দরজা-জানালা সব বন্ধ করে আঁধার প্রকোষ্ঠে বসে থাকব এবং বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সংকীর্ণ চিন্তার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকব। শিল্প-সাহিত্যে উন্নতির জন্য তো পৃথিবীর খোলাপাতা থেকে আমাদের উপাদান গ্রহণ করতে হবেই; তবে সেটুকু করতে গিয়ে মূল থেকে যেন আমরা সরে না যাই। আমাদের স্বকীয়তা, বৈশিষ্ট্য ও শাশ্বত মূল্যবোধ যেন হারিয়ে না ফেলি।

আল আদাবুল ইসলামি : অনেকে মনে করেন, শিল্প-সাহিত্যের চর্চা মানুষকে মূল থেকে সরিয়ে দেয়। আবার এটাও তো বাস্তব যে, মানোত্তীর্ণ সৃষ্টির জন্য কিছুটা স্বাধীনতাও প্রয়োজন। তো একজন ইসলামি সাহিত্যিকের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও রক্ষণশীলতা একই সময় ধারণ করে চলা কীভাবে সম্ভব বলে মনে করেন?

নাজিব কিলানি : দেখুন, মুক্তচিন্তা শুধুই একটা স্লোগানের নাম নয়; বরং এর জীবন্ত এক রূপ রয়েছে এবং বাস্তব জীবনে তা কার্যতই মেনে চলতে হয় ও চর্চা করতে হয়। আর স্বাধীনতা বলে আপনি যা বোঝাতে চাচ্ছেন, তাও শুধু লেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এরও প্রয়োগ আছে এবং সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে এটা বড় চালিকাশক্তি।
তবে এটা অসম্ভব নয় যে, পাশ্চাত্য কোনো একদিন প্রাচ্যের দিকে মুগ্ধতা ও মর্যাদার দৃষ্টি নিয়ে তাকাবে। পশ্চিমারা এতদিনে উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, ইসলামি সভ্যতার উত্তরাধিকার থেকে গ্রহণ না করলে কোনোদিন তারা মহৎ জীবনের ভিত্তি দাঁড় করাতে পারবে না। ফলে তারা এখান থেকে আঁজলা ভরে নিতে শুরু করেছে এবং এর রূপরেখা অনুসরণ করতে শুরু করেছে। তারা আমাদের ভাষা শিখেছে, এমনকি আমাদের জ্ঞানের শাস্ত্রগুলো অনুবাদ করেছে; বরং আমাদের জীবনশৈলীও তারা গ্রহণ করেছে। আমাদের কবিতা ও সঙ্গীত থেকেও তারা গ্রহণ করেছে। এর স্পষ্ট প্রমাণ মেলে মহাকবি দান্তের গ্রন্থ ‘দ্য ডিভাইন কমেডি’তে। সেখানে তিনি আমাদের কবি আবুল আলা মাআররির ‘রিসালাতুল গুফরান’র শৈলী নকল করেছেন।
বাস্তবতা হল, আমাদের সভ্যতা নিজেই এক শক্তিশালী উদারচিন্তার ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। যার ফলে এই সভ্যতা জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অনন্য প্রতিভাধর ব্যক্তিদের উপহার দিতে পেরেছে।
আর মুক্তচিন্তার প্রবক্তাদের দাওয়াতি মিশন মূলত মানুষকে তার সরল পথ থেকে বিচ্যুত করার প্রয়াস। তারা একে দর্শনও বলে। তাদের এ দর্শনের মূলকথা হল, সবধরনের আকিদা ও চিন্তার দায় থেকে মুক্তি নিতে হবে এবং সমস্ত মূল্যবোধ ঝেড়ে ফেলতে হবে।
আশ্চর্যের বিষয় হল, এইসব স্লোগানের বাজারজাতকারীরা বলে, এটা তাদের ‘নীতিগত অবস্থান’(!?)। কখনো তারা একে বলে অস্তিত্ববাদ। এই ‘মহৎ’ মতবাদের আবার নানা মূলনীতিও আছে তাদের কাছে।
এই নয়া মতবাদ ইউরোপে তো খুব চলে; কিন্তু দুঃখের কথা, চিন্তার দাসত্বে বন্দি এই প্রাচ্যও এখন কুড়িয়ে কুড়িয়ে এর মার্কেটিং শুরু করেছে এবং একে এক নতুন ‘দীন’ হিসেবে কবুল করতে চাচ্ছে। ফলে সে পতিত হতে চলেছে মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে। এটাই এখন আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক মরণদশা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিনের পাতায় চোখ রাখলে এই অধঃপতনের চিত্র স্পষ্টই দেখা যায়।
তবে আমি বলব, রক্ষণশীল ইসলামি সাহিত্যিক হবেন একজন স্বকীয় চিন্তা ও আকিদার মানুষ। তার হৃদয়ে থাকবে স্পন্দন। কর্মে থাকবে প্রেরণা। তিনি তার আকিদা ও বিশ্বাসের সামনে অন্য সবকিছু তুচ্ছজ্ঞান করবেন। চিন্তাযুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে তিনি জীবন-মৃত্যু ও জাগতিক ক্ষয়ক্ষতির হিসেব করবেন না। তিনি তার সত্য ও ন্যায়ের মাপকাঠি দিয়েই সব মাপবেন।

আল আদাবুল ইসলামি : চিন্তাযুদ্ধের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট পক্ষাবলম্বনকে কীভাবে দেখেন? নিরপেক্ষ না হয়ে তর্কের ময়দানে নামলে কি কাঙ্ক্ষিত ফল আসে? এ কারণে তো ইসলামপন্থিরা অনেক সমালোচিত। পত্র-পত্রিকায় তাদের বিরুদ্ধে মৌলবাদী, গোঁড়া, পশ্চাৎপদ- এসব অভিযোগই শুধু দেখা যায়!

নাজিব কিলানি : একজন শিক্ষিত মানুষ চিন্তা বা দলের ক্ষেত্রে যেকোনো মত গ্রহণ করতে পারেন। এটাকে আমি দোষের বলি না। আমার মূলত যেটাতে আপত্তি, তা হল- গৃহীত এই পক্ষ বা চিন্তাটাই যখন হয় ত্রুটিযুক্ত।
চিন্তাশীল মানুষমাত্রই পক্ষাবলম্বন করবেন এবং এটাই স্বাভাবিক। তবে কথা হল, কোনো একটা চিন্তার পক্ষে বা বিপক্ষে যাওয়ার আগে সেটা সম্পর্কে ভালো করে অবগত হওয়া উচিত। ইসলামবিদ্বেষী অনেক বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে আলাপচারিতার পর আমার অভিজ্ঞতা হল, তারা ইসলামের ম্যাসেজ ও মূলনীতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণাই রাখে না। তাদের অধিকাংশই ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান হাসিল করে ইসলামবিদ্বেষী মিশনারি অথবা প্রাচ্যবিদদের কাছ থেকে। ইসলামকে ভালো করে বোঝার জন্য গভীরভাবে পড়া বা গবেষণার খাটুনিটুকু তারা করতে চায় না।
তাই আমি বলি, চিন্তকের জন্য পক্ষাবলম্বন এবং স্বচিন্তা আঁকড়ে রাখা দোষের নয়- যদি তিনি পূর্ণ অবগত হয়ে বুঝে সচেতনভাবে তা গ্রহণ করেন। কিন্তু এই পক্ষ গ্রহণটা যখন হয় হিংস্রতা ও আক্রমণের প্রবণতা থেকে, তখন এটাকে নিন্দা করতেই হবে।
বস্তুত একশ্রেণির বিপথগামী বুদ্ধিজীবী ইসলামের প্রতি চৈন্তিক সন্ত্রাস লালন করে এবং তারা নিষ্ঠাবান ইসলামপন্থিদের মৌলবাদী পশ্চাৎপদ বলে গালমন্দ করে। তাদের এই প্রবণতা থেকেই আজকের শিল্প-সমালোচনার জগৎ বাস্তবতা ও মূলের প্রতি এক মারাত্মক সংহারী রূপ ধারণ করেছে। এই উপর্যুপরি সমালোচনার কারণে ইসলামপন্থিরা নিজেদের আবিষ্কার করতে শুরু করেছে এক বধ্যভূমিতে। শিল্প-সাহিত্যের ময়দান এখন নষ্টদের একচ্ছত্র অধিকারে চলে গেছে। সেখানে নানা রকম বাদ্যযন্ত্র নিয়ে তারা শিল্পের চর্চায় ‘ব্রত’। তাদের চর্চিত সেই চিন্তা ও শিল্পে ভালো করে কান পাতলে শোনা যায় শুধু চিৎকার আর বিষাদের হাহাকার।

আল আদাবুল ইসলামি : সাহিত্য ও সাহিত্য-সমালোচনার সঙ্গে একটা দীর্ঘ সময় কাটিয়ে ওঠার পর আপনার দৃষ্টিতে একজন সমসাময়িক সাহিত্যিকের মধ্যে কী কী যোগ্যতা ও গুণাবলি থাকা দরকার?

নাজিব কিলানি : প্রথম বিষয় তো হল, ব্যক্তিমাত্রই নিজস্ব যোগ্যতা, ব্যক্তিগত ঝোঁক, স্বভাবগত প্রতিভার অধিকারী হয়ে থাকেন এবং যেকোনো কাজ বা পেশায় সিদ্ধির জন্য এগুলোই প্রধান নিয়ামক।
এরপর যে বিষয়টি আসে তা হচ্ছে, আমরা সে প্রতিভার পরিচর্যা ও বিকাশে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারলাম এবং কার্যকরী ফল পাওয়ার জন্য সেটিকে কতটুকু উপযোগী করতে পারলাম। এগুলোই মূলত প্রধানতম বিষয়। এর বাইরে শুধু সাহিত্যের কথা আলাদাভাবে বললে সেখানেও তো কিছু শর্ত রয়েছে। যেমন-
এক. সাহিত্যিককে সবার আগে ভাষা জানতে হবে। কারণ, সাহিত্যিক তার চিন্তাকে শরীর দেওয়ার জন্য ভাষাকেই মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করবেন। এজন্য ভাষাকে তার মূলনীতিসহ জানা এবং ভাষাজগতের সঙ্গে পূর্ণ সম্পর্ক তৈরীর মাধ্যমেই সাহিত্যিকের পক্ষে সাহিত্যের ময়দানে সুদৃঢ় অবস্থান গড়ার শক্তি তৈরি হবে।
দুই. যেহেতু লেখক-সাহিত্যিক হচ্ছেন কালের দর্পণ; তাই সমসাময়িক জীবন-জগৎ ও কৃষ্টি-কালচারে তাকে সম্যক অবগত হতে হবে। তার সংস্কৃতির জ্ঞান ও চর্চা যদি সংকীর্ণ পরিসরের হয়, তবে কখনোই তিনি নির্ভুল চিন্তা বা বিষয়ের বাস্তব পর্যবেক্ষণ ও প্রকাশে সক্ষম হবেন না।
তিন. বড় বড় লেখক-সাহিত্যিকের বিচিত্র অভিজ্ঞতা সম্পর্কেও ধারণা থাকতে হবে। মূলত এটাই তার সাহিত্য-সাধনার পথে প্রথম দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করবে। এমনকি সাহিত্য-বিষয়ক একাডেমিক লেখাপড়ার চেয়েও এটার প্রয়োজন বেশি। গদ্যশৈলী, কবিতার ছন্দ, অন্ত্যমিলের জ্ঞান ইত্যাদি হাসিলের চেয়ে এটার স্থান আগে।
চার. আরেকটি জরুরি বিষয় হল, সাহিত্যিককে মহৎ চিন্তা ও লক্ষ্যের অধিকারী হতে হবে। আর চিন্তার ক্ষেত্রটা স্পষ্ট না থাকলে তা সম্ভব নয়। সাহিত্যিক নিজে নির্দিষ্ট কোনো দর্শনের অনুসারী না হলে কখনোই কোনো লক্ষ্য ঠিক করতে পারবেন না। কারণ, সাহিত্য নিছক কিছু চটকদার শব্দ-বাক্যের নাম নয়। সাহিত্য তখনই বাস্তবসম্মত হবে যখন তাতে তিন বিষয়ের সমন্বয় ঘটবে—
ক) ভাবনা-জগতে আন্দোলন তৈরি করবে ও বোধশক্তি শানিত করবে।
খ) অনুভূতিতে নাড়া দিয়ে তাকে উদ্দীপ্ত করবে।
গ) কোনো কর্মসাধনে পাঠককে আগ্রহী করবে তুলবে।
এই বিষয়গুলোর সমন্বয় ঘটলেই সাহিত্যের বাস্তবিক মূল্যবোধ তৈরি হবে আর সাহিত্যিক তখন হবেন মহৎ কিছুর বার্তাবাহক। এখানেই মূলত ইতিহাস থেকে কোনো লেখকের হারিয়ে যাওয়া অথবা যুগ যুগ ধরে টিকে থাকার রহস্য নিহিত এবং এখানে চিন্তা করলেই পাওয়া যাবে কেন ইতিহাস ওইসব লেখকের রচনাসমগ্রের উপর বিস্তৃতির পর্দা টেনে দিয়েছে, যেসব রচনার ছাপা ও কাগজমূল্য বাদ দিলে দুই মলাটের মধ্যে আর কিছুই থাকে না।

আল আদাবুল ইসলামি : নাজিব কিলানি! আপনি তো একজন যশস্বী গল্পকার। তো গল্প-লেখকরা গল্পের চিন্তা কীভাবে ও কোত্থেকে সংগ্রহ করে? আপনি কি গল্পের মধ্যে জীবনমুখী কোনো বাস্তব চিন্তার উপস্থিতি জরুরি মনে করেন?

নাজিব কিলানি : একটি সফল গল্প লিখতে হলে অবশ্যই গল্পের চিন্তা ও বার্তা জীবনসংশ্লিষ্ট হতে হবে এবং জীবনকে ঘিরেই গল্পের ভেতরের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, সংলাপ, বর্ণনা, গঠন আবর্তিত হতে হবে। তবে স্বাভাবিকভাবে গল্পের শৈল্পিক কাঠামো থেকে চিন্তাকে আলাদা করা কঠিন কর্ম।

আমার মতে, লেখকের সংস্কৃতিবোধটা অর্জিত হয় তার জীবনের অভিজ্ঞতা, তার বিচিত্র পাঠ এবং প্রকৃতি, মানুষ, সামাজিক মূল্যবোধ ও নানা রকম ঘটনা-অঘটনার মধ্য দিয়ে। একজন সফল লেখক এসব কিছুর মধ্যে সংমিশ্রণ করেন এবং এগুলো নিজের মধ্যে ধারণ করেন। এরপর এমন নতুন কিছু উদ্ভাবন করেন, যা হয় যথার্থ ও গ্রহণীয়। এজন্য গল্পের চিন্তাটা কখনো হয় তার নিজস্ব, আবার কখনো অন্যের ঘটনা, জীবন-অভিজ্ঞতা অথবা সামাজিক উপাদান থেকে প্রাপ্ত চিন্তাকে তিনি গল্পে ফুটিয়ে তোলেন। আর এটাও তো বাস্তব যে, অতীত ও বর্তমানে আমাদের ঐতিহাসিক, দার্শনিক ও ধর্মীয় উত্তরাধিকারে যে পরিমাণ চিন্তার উপকরণ জমা হয়েছে, তাও নেহাত কম নয়।

এখানে মূলকথা হল, গদ্যের ভেতরের চিন্তাটা বাস্তবতার চাহিদা অনুযায়ী হওয়া দরকার। এমন হলেই তো জীবনের চাকা সামনের দিকে ঘুরবে। এভাবেই মানুষের মনজগতে আন্দোলন তৈরি করা যাবে এবং মানুষকে ইতিবাচক ও মহৎ জীবনের প্রতি আগ্রহী করে তোলা সম্ভব হবে।

সাহিত্যে চিন্তার জায়গাটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই চিন্তানির্মাণের কাজ যখন কোনো দুর্বল অক্ষম শিল্পীর হাতে হয় তখন শিল্পের হয় বেহাল দশা। এজন্য আমরা বিভিন্ন সাহিত্যসঙ্ঘের ব্যাপারে শুনেছি যে, তারা অনেক লেখকের গায়ে ‘ফালতু শিল্পী’র তকমা লাগিয়ে দিয়েছে। ফলে প্রেসে পড়ে থাকা তাদের লাখ লাখ কপি বইয়ের উপর মাকড়সা বাসা বাধছে এবং নানামুখী প্রচার-প্রচারণা ও সহজলভ্যতা সত্ত্বেও সেসব সাহিত্যকর্ম পাঠকপ্রিয়তার মুখ দেখছে না।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
জুনাইদ বিন আজিজ
জুনাইদ বিন আজিজ
1 year ago

আরবসাহিত্যিকদের সাক্ষাৎকারের দিকটা আমাদের দেশে তেমন একটা চর্চা হতে দেখা যায় না। অথচ তাদের থেকে নেওয়ার মতো কত উন্নত চিন্তা আছে। এই সাক্ষাৎকারটা পড়ে খুবই ভালো লাগলো। এ রকম কাজ আরও হোক।

Last edited 1 year ago by জুনাইদ বিন আজিজ
মুহাম্মদ উমর ফারুক
মুহাম্মদ উমর ফারুক
7 months ago

বইয়ে এই সাক্ষাৎকার পড়েছি দুইবার। সেই কতদিন পরে আবার পড়লাম। চমৎকার।

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷