ঔন করার দাবিটাই আসল। উপমহাদেশের তিন শক্তিশালী ‘স্কুল অফ থট’, মাদরাসাওয়ালারা যাকে বলে ‘মাকতাবায়ে ফিকর’—আহলে হাদিস, বেরলবি ও দেওবন্দি—এই তিন ধারাই নিজেদের অগ্রসূরি হিসেবে শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবিকে (রহ.) পেশ করে। সময়ের ফেরে দাবিদাওয়ার রাজনীতি হয়েছে, ‘প্রকৃত অনুসারী কে’—এ নিয়ে বচসা আছে, লেখা হয়েছে পৃষ্ঠার পরে পৃষ্ঠা, ফলে এখানে তৈরি হয়েছে আলাপ করার দুইটা অপশন :
- ‘আমার মা, আমার মা’ বলে দুই সন্তানের টানাটানি এটাই প্রমাণ করে—মা আসলে সবার।
- ‘আমার মা’ বললেই প্রমাণ হয় না সেই সন্তান মায়ের আদর্শের পুরোটা ধারণ করে।
আমরা এখানে প্রথম অপশন নিয়েই আলাপ করব, অর্থাৎ শাহ সাহেবকে যেহেতু সবাই নিজেদের অগ্রসূরি দাবি করে, তাই এটাকে কেন্দ্র করেই কথা হবে। আর এটাই সুবিধাজনক অবস্থান, কারণ দ্বিতীয় অপশন নিয়ে আলাপ করার মতো বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশ আমাদের সমাজে এখনও তৈরি হয়নি।
তো, আমাদের আলাপের বিষয় হলো ‘শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি (রহ.) কেন ফের আলোচনায়।’ এই নিয়ে দীর্ঘ আলাপ করা যাবে। এই আলাপে শাহ সাহেবের সংস্কার আন্দোলন (তাজদিদ), কোরআন তর্জমার প্রাসিঙ্গকতা, হাদিসচর্চার সিলসিলা জারি করার কারণ, ফিকহে মধ্যমপন্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, তাসাওউফে নতুন ‘লতিফা’ যুক্ত করা, শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর আহ্বান—ইত্যাকার নানা বিষয় আসতে পারে। একজন বহুশাস্ত্রবিশারদের (পলিম্যাথ) চিন্তাদর্শন তো মানুষ নানানভাবে আলোচনায় আনবেই। কিন্তু তাকে নিয়ে নতুন করে আলোচনা ওঠার অন্যতম প্রধান কারণ মনে করি তার সমাজচিন্তা। বিশেষ করে যেই সময় পুঁজিবাদ রাখঢাক ছাড়াই নিজেরে ‘খোদা’ দাবি করছে; এবং বৈশ্বিক আবহাওয়ার পরিবর্তন, সমকামিতার জায়েজীকরণ ও প্রত্যক্ষবাদীদের গায়েবি কথাবার্তা (!) বলার প্রবণতা আমাদের টক অব দ্য টাউন; তখন মায়ের কোলে ফেরার তাড়নার মতোই শাহ সাহেবের সমাজচিন্তা আবার সামনে আসা স্বাভাবিক।
এই কথা ওই কথা বলতে গিয়ে আমরা শেষমেশ যেই আলাপে থিতু হই, সেটাই আমাদের মৌলিক চিন্তা। দিনশেষে যেখানে গিয়ে ঠেকতে হয়, তাকে বেমালুম ভুলে আমরা আলাপ টানতে পারি না। ঠিক সেই পয়েন্টে কারও যদি বক্তব্য থাকে, তখন সাধারণত তাকে নিয়েই আলোচনা শুরু হয়। এবং তার বক্তব্যের গুরুত্ব নির্ণয় করতে হলে কারা কারা তাকে ‘ঔন’ করে সেটাও জোরেশোরে সামনে আনতে হয়। এই জায়গায় এসে আমরা শাহ সাহেব প্রসঙ্গে আজকের মূল আলাপ শুরু করতে পারি। কিন্তু, তারও আগে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আরেক দফা নজর দিতে হবে, নয়তো পরের আলাপ বুঝতে অসুবিধা হতে পারে।
পুঁজিবাদের বিকাশ ও বৈশ্বিক আবহাওয়ার পরিবর্তন
শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে গত দুইশ বছরে মানবসভ্যতায় অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসে। এই বিপ্লবকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখা হয়েছিল। কিন্তু একের পর এক যন্ত্রের আবিষ্কার পুঁজিবাদীদের হাতে সভ্যতার চাবি তুলে দেয়, অঘটনটা ঘটে এর পরেই। পুঁজিবাদ নিজের স্বার্থ লুকিয়ে কৃপণা বসুমতি থেকে খোঁড়াখুঁড়ি ছাড়াই নানান তদবিরে ধনদৌলত আদায় করতে থাকে। মেদিনীর মেদ নিংড়ে বের করে জীবাশ্ম জ্বালানি, আকাশকে অতিষ্ট করে তোলে কালো ধোঁয়ায়, নদীকে পরিণত করে ড্রেনে কিংবা মরুভূমিতে, এবং প্রাণপ্রকৃতিকে ফেলে হুমকির মুখে।
২০০৫ সালে UNEP কর্তৃক ‘দ্য মিলেনিয়াম ইকোসিস্টেম অ্যাসেসমেন্ট’ নামক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। এই গবেষণায় অংশ নেন বিশ্বের পঁচানব্বইটি দেশের তেরোশর বেশি বিজ্ঞানী। গবেষণায় উঠে এসেছে, ‘বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে পৃথিবীর ইকোসিস্টেমে মানব ইতিহাসের অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি পরিবর্তন ঘটেছে—যা আর কখনও ঘটেনি। এই পরিবর্তনগুলো হয়তো মানুষের কল্যাণ, সুখ-সমৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করেছে৷ কিন্তু পরিবেশে ডেকে এনেছে বিপর্যয়!’
পৃথিবীর বুকে ২৫০ মিলিয়ন বছরে যে অনবায়নযোগ্য সম্পদ উৎপন্ন হয়েছে, মাত্র দুইশ বছরে তার বেশির ভাগই গ্রাস করে ফেলেছে মানুষ। নেতৃস্থানীয় জলবায়ুবিজ্ঞানীরা বলছেন বৈশ্বিক তাপমাত্রা যদি ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পায়—যাকে বলা হয় ‘টিপিং পয়েন্ট’—আর যদি আমরা আগের মতোই কাজ চালিয়ে যাই, তাহলে আবহাওয়া পরিবর্তনের বিপজ্জনক সীমানায় আমরা প্রবেশ করব। কোনো কোনো বিজ্ঞানী তো ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডকেই সম্ভাব্য ‘টিপিং পয়েন্ট’ মনে করেন। এই ঘটনা ঘটলে কেবল লক্ষ-কোটি মানুষ নয়, অসংখ্য প্রাণীও খরা, ক্ষুধা এবং বন্যার মুখোমুখি হবে। নিম্নবিত্তের মানুষের সবচেয়ে বেশি এর খেসারত বইতে হবে, কারণ শিল্পবিপ্লব থেকেই বায়ুমণ্ডলে কার্বনের মাত্রা তীব্রভাবে বেড়ে চলার সূত্রপাত হয়েছে।
জেন্ডার ডাইভারসিটি, কালচারাল হেজিমনি ও জুলুমের সাতরঙ
রেনেসাঁসের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয়রা পতঙ্গের মতো ভোগবাদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধর্ম ছিল তাদের জন্য বাধা, সৃষ্টিজগতের নতুন নতুন রহস্যের সমাধান হচ্ছিল আর তারা ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল। তারা সব সময় তক্কে তক্কে ছিল কীভাবে মানুষের জীবন ও জগৎ থেকে খোদাকে খারিজ করা যায়। এ কারণে যেখানেই খোদাবিরোধী কোনো তত্ত্ব পেয়েছে, সাথে সাথে তাকে লুফে নিয়েছে। তারা কেবল বস্তুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে চেয়েছে। তাদের সবকিছু বস্তুজগত ঘিরেই। এই জন্য তারা একসময় জোরগলায় বলে—‘যা দেখি না, তা মানিও না।’
ঘটনা যেদিকে গড়াবার সেদিকেই গড়ায়। মানুষ চূড়ান্ত মাত্রায় ভোগবাদী হয়ে উঠে। কিন্তু, মানুষের একটা স্বভাব আছে, যেই স্বভাব তাকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করেছে—মানুষ সব সময় নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। এটা ভালো ও মন্দ দুই ক্ষেত্রেই। কোনো মানুষ যদি দশজন গরিবকে খাওয়ায়, তার মনে যে তৃপ্তি জমে, এটাই তাকে বিশজন গরিবকে খাওয়ানোর পরিকল্পনার দিকে নিয়ে যায়। বিপরীতে কোনো মানুষ যদি কয়েকবার ধর্ষণ করে, সে এখান থেকে যে পৈশাচিক আনন্দ পায়, এটাই তাকে গণধর্ষণ কিংবা খুন করার দিকে টেনে নিয়ে যায়। ঠিক একইভাবে ভোগবাদী প্রবণতারও একটা সিলসিলা আছে, ভোগবাদ সব সময় নিজেকে ছাপিয়ে যেতে চায়।
আল মুকাদ্দিমার দ্বিতীয় অধ্যায়ে ইবনে খালদুন বলেন—‘নাগরিকগণ সর্বপ্রকার আমোদ-প্রমোদ, বিলাসব্যসন, পার্থিব উন্নতি লাভের আশা ও ভোগ করার স্পৃহা দ্বারা বেষ্টিত থাকে। এর ফলে জীবাত্মা অসৎচরিত্র ও অন্যায় প্রসঙ্গের মধ্যে কলুষিত হয়ে ওঠে। এভাবে তারা যতই তাতে নিমজ্জিত হয়, ততই সৎপথ ও ন্যায়পন্থা থেকে দূরে সরে যায়।…’
সমকামিতার মতো একটা অসামাজিক ও অমানবিক কাজে পশ্চিমারা জড়িয়ে পড়বে, এটা অনুমেয় ছিল। অতিরিক্ত ভোগসুখ যে মানুষকে ঔদ্ধত্য আর লাম্পট্যের দিকে নিয়ে যায়, এই ব্যাপারটা নিম গাছে আম না ধরার মতোই সত্য। এবং সমকামী মনোবৃত্তি যে ভোগবাদের নতিজা—এই কথা আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগেই প্লেটো বলে গেছেন। মোদ্দাকথা অসংযমী একটা জাতির মধ্যে নানা ধরনের আনইউজুয়াল প্রকলিভিটি দেখা দিতেই পারে। কিন্তু জেন্ডার ডাইভারসিটি কোন হালুয়া? তারা বলছে জেন্ডার এক জিনিস আর ‘লিঙ্গ’ আরেক জিনিস। লিঙ্গ হলো যেটা নিয়ে সে জন্মগ্রহণ করেছে, হতে পারে সেটা পুরুষের লিঙ্গ, কিন্তু বড় হয়ে সে যদি ‘মনে করে’ সে নারী, তাহলে সেটাই হবে তার জেন্ডার। মানে জেন্ডার মানুষের একটা গুণ, একটা পরিচয়। এই কারণে এর সংখ্যাও শতাধিক। ‘যা দেখি না, তা মানি না’—এই স্লোগানে কয়েকশ বছর গলা ফাটিয়ে পশ্চিমারা এখন বলছে—কোনো মানুষের যদি এক ফুট দীর্ঘ পুরুষাঙ্গও থাকে, তবু সে নারী, যদি সে মনে করে ‘আমি নারী’! কেন এই ট্রান্সফর্মেশন? বস্তুবাদ যে ভোগবাদের দিকে নিয়ে গেছিল, সেই ভোগবাদ এখন বস্তুর বাইরে গিয়ে গায়েবি কথাবার্তা শুরু করেছে। বড়ই তাজ্জবের ব্যাপার।
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু না, পশ্চিমারা একে তাদের ইন্ডিভিজুয়ালিজমের অবিচ্ছেদ্য অংশ বানিয়ে নেয়, এবং কারও এই মতবাদ গ্রহণ না করাকে তাদের আধিপত্যের জন্য হুমকি মনে করতে শুরু করে। পশ্চিম তার প্রাচ্যের গোলামদের আরেক দফা স্মরণ করিয়ে দেয়—আমি তোর মালিক, আমি রাতকে দিন বললে তা দিন, দিনকে রাত বললে তা রাত, পুরুষকে নারী বললে সে নারী, নারীকে পুরুষ বললে সে পুরুষ, এটাই তোর মানতে হবে, এর বাইরে টুঁ শব্দও করতে পারবি না। ‘জো হুকুম, মালিক’ বলেই গোলামেরা পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে টিভি-সিনেমার মধ্য দিয়ে জোরেশোরে মালিকের কথার প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে তো আগেই কব্জায় নিয়ে নিয়েছে, জুলুমের ওপর জুলুম চাপিয়ে কোমর ভেঙে দিয়েছে, এখন আর কোনো ছলেবলে নয়—সরাসরি তাদের রঙে রঙিন হতে বাধ্য করছে। অন্যদিকে আমরা ঈমানেও দুর্বল, দুনিয়াদারিতেও দুর্বল। ঠিক এইখানে এসে আমরা আটকে আছি। অবস্থা দাঁড়িয়েছে এমন :
لڑتے ہیں اور ہاتھ میں تلوار بھی نہیں
লড়তেও হচ্ছে আবার হাতে তলোয়ার নাই!
কিন্তু আসলেই কি তলোয়ার নাই? আছে, এবং সেই তলোয়ারও যেনতেন নয়, একদম চকচকে শান দেওয়া দু’ধারি তলোয়ার। এক্ষণে আমরা সেই তলোয়ার সম্পর্কেই জানব।
পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্বের মোকাবেলায় শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি
সাদাচোখে আমাদের মনে হয় ব্রিটিশ ডাকুরা এই দেশে এসে নীলচাষ করে, মসলা রপ্তানি করে, খনিজ সম্পদের ব্যাবসা করে নিজেরা সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু আসলে এসব ছিল টুকটাক বেচাকিনি। ব্রিটিশদের সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা ছিল ‘মোনাফেক উৎপাদনের’ ব্যবসা। বাছাইকৃত উন্নতজাতের বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে এই দেশে তারা ‘মোনাফেক উৎপাদনের’ রমরমা ব্যাবসা শুরু করেছিল। এর মুনাফাও হয়েছে কয়েকশ কোটি গুণ। আজাদির ৭৬ বছর পরেও এখনও তাদের রাষ্ট্রনীতি, বাণিজ্যনীতি ও শিক্ষানীতি ঘরে ঘরে মুনাফেক তৈরি করে যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে দুনিয়ায় খাদ্য-শস্যের অভাব দেখা দিলেও কখনও ব্রিটিশদের গোলামের অভাব দেখা দিবে না। এই মোনাফেকদের দিনরাত মেহনত, মোজাহাদা ও কোরবানির ফলে আমাদের সমাজব্যবস্থার ভিত্তিমূলে জায়গা করে নিয়েছে পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্ব। মোকবেলা ছাড়া একে এখান থেকে সরানোর কোনো ‘সোলেমানি মন্ত্র’ আমাদের জানা নাই।
একটা সমাজের ‘জ্ঞানতত্ত্ব’ সম্পর্কে জানতে তাদের চিন্তাপদ্ধতি বোঝা জরুরি। এই জন্য ধরনা দিতে হবে তাদের দর্শনে। পাশ্চাত্য দর্শন নিয়ে প্রবন্ধকারের গভীর পাঠ নেই, পরের মুখে ঝাল খাওয়ার মতো কিছু অনুবাদ পড়া হয়েছে কেবল। তবে খোদাপ্রদত্ত বুদ্ধিবলে এতটুকু অন্তত বুঝেছি—বস্তুজগতের পর্দা ফাঁক করে ভেতরে উঁকি মারা পশ্চিমাদের স্বভাবে নাই। সোজা কথায় তারা বস্তুর যতটুকু দেখা যায় তার ওপরেই সিদ্ধান্ত নেয়, এবং এর বাইরে কোনো কিছুকে স্বীকার করতে রাজি হয় না। আপনি যদি কোনো পশ্চিমা ভদ্রলোককে গিয়াস উদ্দিন তাহেরীর এই ‘সামা’ শোনান—
মনের কথা খুইলা কইব আর কাউরে না শুনতে দিব
দয়াল বাবা ফয়েজিরে পাইলে তোরে না ছাড়িব
রাঙা চরণ মুইছা দিব আর কাউরে না দেখতে দিব
দয়াল বাবা ফয়েজি শাহরে পাইলে তোরে না ছাড়িব
ভদ্রলোক তাহেরী সাহেবকে সমকামী তো বলবেনই, সাথে ফুটফেটিশও বলবেন। ব্যাপারটা আমি হাসি-মজাকের জন্য বলিনি, পশ্চিমাদের চিন্তার প্যাটার্নটাই এমন। খুবই ভাসাভাসা। এই বক্তব্যের সত্যতা আপনি অনেক জায়গাতেই পাবেন।
বদিউজ্জামান সাইদ নুরসি বলেন :
মানুষ একমাত্র সত্যকেই চায় পরম আপন করে
তার চোখ খুঁজে ফিরে কেবল সত্যকেই
এই বৈশিষ্ট্যই মানুষকে করেছে আলাদা, তাকে বানিয়েছে মহান
আর তাই হোঁচট খেয়ে সে কখনও যদি পড়েও যায় মিথ্যার কলুষে
সে ভাবে এ-ই বুঝি সত্য, অজ্ঞাতে জড়িয়ে ধরে তাকে
পশ্চিমারাও সত্যের অনুসন্ধানে বেরিয়েছিল। কিন্তু সত্যের ‘সত্যতা’ নির্ধারণে মাপকাঠি বানায় ব্যক্তি আমিকেই। প্রোতাগোরাস বলেন, Man is the measure of all things. কিন্তু ব্যক্তি আমি জ্ঞাত নই বলেই তো সত্যের তালাশ করি। তাই ঘুরেফিরে ঘটনাটা এমন দাঁড়ায়—আমি সত্যকে জানি না, কিন্তু যাকে সত্য বলব সেটাই সত্য। সোজা কথায় অজ্ঞতাই হয়ে দাঁড়ায় সত্যের মাপকাঠি। পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্বের প্রধান দুই মাজহাব : বুদ্ধিবাদ (Rationalism) ও অভিজ্ঞতাবাদ (Empiricism)—দুইটারই মূল কথা হলো মানুষ মূলত জ্ঞানশূন্য, আর এলেম অর্জনের মধ্য দিয়ে আয়ত্তে আসে।
অভিজ্ঞতাবাদীরা ‘টাবুলা রাসা’-র কথা বলে। এর মানে সদ্যজাত শিশু দাগহীন শ্লেটের মতো, সে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জ্ঞান লাভ করে। অন্যদিকে বুদ্ধিবাদীরা বলে সব সত্যের উপর প্রশ্ন করা সম্ভব, কিন্তু ‘আমি’ সত্য কিনা এর উপর প্রশ্ন সম্ভব নয়। তাই ‘কগিটো, এরগো সুম’, অর্থাৎ আমি যেহেতু সত্যের সত্যতা নিয়ে চিন্তা করছি, কিন্তু সবকিছুই বিপরীত যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করা যায়, এক পর্যায়ে আমার অস্তিত্বের উপরেও প্রশ্ন আসে, কিন্তু এতসব চিন্তা যেহেতু আমিই করছি, তাই প্রথমে ধরে নিতে হবে আমি সত্য, এরপর বাকি আলাপ। এইভাবে ব্যক্তিই হয়ে যায় সত্য-মিথ্যার নির্ণায়ক। এবং দিনশেষে বুদ্ধিবাদ নিজেকেই নিজের দলিল মানে।
পশ্চিমে মূলধারার দর্শন হলো এই বুদ্ধিবাদ। আর বুদ্ধিবাদ নিজের প্রয়োজনে আশ্রয় নেয় গাণিতিক সত্যের। গণিতের এখানে কাজ কী? ব্যাপারটাকে খোলাসা করে বলি। মুসলমানরা ইউনানি দর্শন থেকে ব্যাপকভাবে ফায়দা নিয়েছে, কিন্তু তাদের ঔন করে না। ইউরোপীয়রা দর্শনের তালিম নিয়েছে মুসলমানদের থেকে, কিন্তু তারা ঔন করে ইউনানিদের। এই জন্যই তারা জ্ঞানচর্চার শুরুয়াতকে নাম দিয়েছে ‘রেনেসাঁস’ বা পুনর্জাগরণ। ইউনানে প্রশ্ন তৈয়ার হয়েছিল—কীভাবে সত্যকে পাওয়া যায়, এর উত্তরে তারা গণিতকে হাজির করেছিল, কারণ গণিত স্থান-কালের ঊর্ধ্বেও অপরিবর্তিত থাকে। কিন্তু মুসলমানরা সত্যের তালাশ করতে গিয়ে গণিতে ঠেকে নাই, বরং তার হাতে আগে থেকেই ‘সত্য’ ধরা ছিল, গণিতের সাহায্য নিয়েছিল তারা সত্যকে জোরালো করার প্রয়োজনেই—হযরত ইবরাহিমের (আ.) খোদার দরবারে মৃত পাখিকে জ্যান্ত করে দেখাবার অনুরোধের মতো। পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্বের সবচেয়ে দুর্বল পয়েন্ট, অন্যভাবে দেখলে সবচেয়ে শক্তিশালী পয়েন্ট হলো এই গণিত। কারণ গণিতের ভিত্তিই হলো ‘ধরে নেওয়ার’ ওপর, এখন ধরে নেওয়া জিনিসকে যুক্তি দিয়ে সত্য প্রমাণ করা কোনো ব্যাপারই না, উল্টে-পাল্টে নানাভাবেই সম্ভব। (এ কারণে গণিতের উপর প্রশ্ন করলে গোটা পাশ্চাত্য দর্শনই হুমকির মুখে পড়ে। আল্লামা ইকবাল তার ‘ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন’ কেতাবে এই জায়গায় আঘাত হেনেছিলেন।)
আমরা যদি শাহ সাহেবের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ কেতাব ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’ খুলি, একদম খুতবাতেই তিনি জ্ঞানতত্ত্বের আলাপ এনেছেন। তিনি বলছেন :
الحمد لله الذي فطر الأنام على مِلَّة الإسلام والاهتداء، وﺟﺒﻠﻬﻢ ﻋﻠﻰ اﻟﻤﻠﺔ اﻟﺤﻨﻴﻔﺔ اﻟﺴﻤﺤﺔ اﻟﺴﻬﻠﺔ اﻟﺒﻴﻀﺎء، ﺛﻢ إﻧﻬﻢ ﻏﺸﻴﻬﻢ اﻟﺠﻬﻞ
‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি ইসলাম ও হেদায়েতকে মানুষের স্বভাবজাত করে দিয়েছেন, এবং তাদের প্রকৃতিতে দিয়েছেন অদ্বিতীয় খোদায় বিশ্বাস, সহজতা, সরলতা ও শুভ্র আলোকময় দীন। এরপর অজ্ঞতা দিয়ে তা ঢেকে দিয়েছেন।’
এর মানে অজ্ঞতা হলো কেবলই একটি খোসা, এর আড়ালে আছে সত্য। এবং সত্য ব্যক্তির সত্যায়িত করার উপর নির্ভর নয়, বরং নিজ থেকেই সত্য, ব্যক্তির তাকে খুঁজে বার করতে হয়। তবে তাকে পাওয়া যায় রুহানি চোখে।
ফারাকটা খুবই স্পষ্ট—পশ্চিমাদের মতে মানুষ কোনোকিছুকে সত্যায়িত করলে তা সত্য হয়, যেহেতু সত্যের মাপকাঠি সে নিজেই। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে সত্য নিজ থেকেই আছে, মানুষের সেই সত্যকে অন্তঃচক্ষু দিয়ে আবিষ্কার করতে হয়।
এবার আসি গণিতের প্রশ্নে। আমরা গণিতকে সত্যের অন্যতম একটি উৎস মানি, এবং অবশ্যই তা দ্বিতীয় ক্যাটাগরির। যদি হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা দেখি, একদম প্রথম পরিচ্ছেদে ‘সৃষ্টিতত্ত্ব’ নিয়ে আলাপ পাব। শাহ সাহেব সৃষ্টবস্তুকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন :
(১) শূন্য থেকে সৃষ্ট। (এখানে ‘বিগব্যাং’ তত্ত্ব দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু এই শক্তিটা এমন এক শক্তি—এটা কেবল আল্লাহর হাতে আছে। শূন্য থেকে সৃষ্টি করার ক্ষমতা আল্লাহ আর কাউকে দেননি।)
(২) সৃষ্টি থেকে সৃষ্ট। (পদার্থের গুণাগুণের ভিত্তিতে এটা সম্ভব হয়। এই গুণকে ‘এনার্জি’ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়।)
(৩) কার্যকারণের ভিত্তিতে সৃষ্ট। (প্রতিটি পদার্থই বিভিন্ন ‘কারণ’ সৃষ্টি করে, সেই কারণ আবার কার্য সৃষ্টি করে। এভাবে প্রকৃতির মধ্যে নতুন নতুন সৃষ্টি আসে।)
এখানে একটা নোকতা দিয়ে রাখি, পাশ্চাত্য দর্শনের আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে তারা তৃতীয় ভাগে, মানে কার্যকারণে আটকে ছিল প্রায় দুই হাজার বছর। এরপর দ্বিতীয় ভাগে উন্নীত হয়, বিশ শতকে এসে তারা প্রথম ভাগে হাজির হয়।
যাই হোক, প্রথম পরিচ্ছদের বিষয়বস্তু আমাদের আলোচনার সাথে খুব একটা প্রাসঙ্গিক না। কিন্তু পরের অধ্যায়গুলোতে যেতে হলে আমাদের কনসিকোয়েন্স বুঝতে হবে। সৃষ্টিতত্ত্বের আলাপের পরেই শাহ সাহেব ‘আলমে মেসাল’ ও ‘মালায়ে আলা’-এর আলাপে শিফট করেছেন।
‘আলমে মেসাল’-এর বিষয়টা শাহ সাহেব বিভিন্ন হাদিসের ভিত্তিতে প্রমাণ করেছেন। ‘আলমে মেসাল’ হলো আমাদের এই জগতের মতোই আরেকটা জগৎ, প্যারালাল ইউনিভার্স, সেখানে মানুষের দোষ-গুণ ও কর্ম বিভিন্ন আকৃতি নিয়ে আছে। আর ‘মালায়ে আলা’ হলো ফেরেশতাদের একটি পরিষদ, তারা প্রাণীজগতের মননে ‘ইচ্ছা’ এবং সৃষ্টিজগতে কার্যকারণের সৃষ্টি করেন। ‘আলমে মেসাল’ ও ‘মালায়ে আলা’-এর আলোচনা থেকে আমাদের সামনে এটা স্পষ্ট হয়ে যায়—এই জগৎ-সংসারে আমরা যা কিছু দেখি, সবই হলো একটা ‘পর্দা’। এই পর্দার আড়ালে আছে আল্লাহর কুদরতি হাত। এই কারণেই বস্তুজগত নিয়ে যতই তত্ত্ব কপচাই-না কেন, আমরা কখনও এর মধ্যে চূড়ান্ত সত্য পাব না, কারণ এখানে চূড়ান্ত সত্যের উপস্থিতিই নাই, চূড়ান্ত সত্য তো লুকিয়ে আছে পর্দার আড়ালে—যার দেখা পাওয়া যায় কেবল ‘ঈমানের চক্ষু’-তে।
২০১৩ পরবর্তী এক দশকে বাংলাদেশের বইবাজারে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন এসেছে। পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্বকে মোকাবেলা করে এই সময়ে অনেক বই লেখা হয়েছে, যদিও আকছার বইয়ের মান আহামরি নয় এবং তাদের জ্ঞানতত্ত্বকে ধারণ করেই লেখা, তবু তার ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা প্রমাণ করে সাধারণ মানুষ একে ‘আসায়ে মুসা’ হিশেবে নিচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ এখন ‘গাণিতিক সত্যে’ নাজেহাল। যেহেতু পুরো ব্যবস্থাই এর ওপর, তাই জোর গলায় কিছু বলছে না, কিন্তু মনে মনে খুব করে চায় পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্বের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সকল প্রতিষ্ঠান মিসমার হয়ে যাক। সোজা কথায়—ফুক্কা কুল্লা নিজাম। ঠিক এই পয়েন্টে এসে, মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী হাতিয়ার খুঁজতে খুঁজতে, তরুণ প্রজন্ম শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবির (রহ.) দ্বারস্থ হয়েছে। যদিও শাহ সাহেবকে চর্চা করা ‘মূলে ফিরে যাওয়া’ বৈ অন্যকিছু নয়, তবু একে ‘বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের’ অংশ বলতে হয়। কারণ মানুষ প্রথমত ‘জাহেরের’ ওপর নির্ভর, ‘বাতেনকে’ সহজে মেনে নেওয়ার পাত্র সে নয়। অথচ শাহ সাহেবের জ্ঞানতত্ত্ব দাঁড়িয়ে আছে ‘বাতেনের’ ওপর। এই জন্য এখানে আমাদের কাজ করার অনেক ক্ষেত্র আছে, এবং ভোগবাদের প্রভাবে দিনদিন সেই ক্ষেত্র আরও বিস্তৃত হচ্ছে।
সমস্যা ও তার সমাধানে প্রাথমিক কাজ : বিমূর্ত খোদায় একিন আনা কিন্তু সহজ কাজ নয়। কোরআনে মূর্তিময় দেবতার আলোচনা করে আল্লাহ বলেছেন—মাথা খাটিয়ে দেখো, মূর্তি কী আদৌ খোদা হতে পারে কিনা। হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার পঞ্চম পরিচ্ছদে শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি ‘দায়িত্ব তত্ত্ব’ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সুরা আহযাবের ৭২ নম্বর আয়াত উল্লেখ করেছেন, এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মানুষের দুটো ‘মৌলিক স্বভাব’-এর কথা বলেছেন—জালেম ও জাহেল। এর ব্যাখ্যায় শাহ সাহেব বলেন, ‘মানুষের ইনসাফ করার ক্ষমতা আছে, তবু সে জুলুম করে, এবং তার আকল (মস্তিষ্ক) খাটানোর যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তা কাজে না লাগিয়ে জাহালত নিয়ে পড়ে থাকে।’ এর ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি—অক্ষরবাদী কিংবা মূর্তিপূজারী হওয়া একদমই স্বাভাবিক, এর জন্য কিছুই করা লাগে না, কেবল মস্তিষ্কের ব্যবহারটা বাদ দিলেই হয়। মওলানা ওয়াহিদুদ্দিন খান তার এক লেখায় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে অক্ষরবাদ গৃহীত হওয়ার কারণ হিশেবে সেকুলারিজমকে দায়ী করেছেন। আসলে মূল হলো পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্ব, সেকুলারিজমও তার অংশ। আর আমরা আগেই বলে এসেছি পশ্চিমাদের চিন্তার প্যাটার্নই হলে গভীরে না যাওয়া। তো, যেই সমাজে পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্বের ভিত্তিতে পড়ানো হয়, সেখানে শাহ সাহেবের আধিভৌতিক তত্ত্ব—আলমে মেসাল কিংবা মালায়ে আলার ধারণা খুব একটা সহজে গৃহীত হবে না। এর জন্য মেহনত ও ইন্তেজার লাগবে। কোনো জাতির জন্য কয়েকশ বছরের জ্ঞানসাধনা ছাড়া বিমূর্তকে স্বীকার করা সম্ভব না। বিমূর্ত শিল্প যে ‘শিল্প’, পশ্চিমারাও এর স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ শতকে এসে। তাই চেষ্টার সাথে একটু তো অপেক্ষা করা লাগবেই।
পুঁজিবাদের মোকাবেলায় শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি
কাছের বন্ধুকে সাথে নিয়ে কোথাও যাচ্ছেন, হঠাৎ দেখলেন পরির মতো ফুটফুটে আর অপরূপ সুন্দর একটি মেয়েকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আপনার বন্ধু জিজ্ঞেস করল, এমন সুন্দর মেয়েটা আবার কী অপরাধ করেছে! আপনি ঠাট্টা করে বললেন, হয়তো হাজারও নওজোয়ানের মন চুরি করার অপরাধে! কিন্তু প্রকৃত খবর শোনার পর আপনার চক্ষু চড়ক গাছ—এই অপরূপ সুন্দরী কিনা একজন সাইকোপ্যাথ, সে বাচ্চাদের খুন করার পর তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশ রান্না করে খেত! এই সুন্দরী মেয়েটা হলো পুঁজিবাদ। আপনি যাকে ‘নাস্তিক্যবাদী’ কমিউনিজমের চেয়ে উত্তম ভাবেন, আর মনে করেন ইসলামের সাথে এর তেমন কোনো ফারাক নাই—ওই বেসিক কিছু জায়গা ছাড়া।
পুঁজিবাদের চোখে ‘ইসলাম’ হলো একটা মাল। পুঁজিবাদ ইসলামকে তখনই খাতিরদারি করবে, যখন এর থেকে মুনাফা লাভ করা যাবে। আর যখন মুনাফা নাই, একদিকে ছুঁড়ে ফেলবে। এবং যে ভোগবাদী সমাজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, এর পুরোটাই দাঁড়িয়ে আছে পুঁজিবাদের ওপর। শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবির (রহ.) কাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র ছিল ভোগবাদী সমাজব্যবস্থার পতন।
শাহ সাহেবের দর্শন মোতাবেক নবি-রসুলদের কাজ ছিল দুটো :
- এক আল্লাহর এবাদতে দাওয়াত দেওয়া।
- ভোগবাদী সমাজ নির্মূল করে রব্বানি আদর্শে সমাজ গড়া।
হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার ‘ইকামাতুল ইরতিফাকাত ওয়া ইসলাহুর রুসুম’ পরিচ্ছেদে তিনি লিখেন : ‘মুহাম্মদ রসুলুল্লাহর (স.) নবুয়ত প্রাপ্তির সময় পৃথিবীর অবস্থা ছিল এমন—মানুষ আরাম-আয়েশ, মৌজ-মাস্তি আর সীমাতিক্রমী রাজকীয় ভোগবিলাসের রোগে আক্রান্ত ছিল। (যা রাষ্ট্র ও জাতির অর্থনৈতিক ন্যায্যতা ধ্বংস করে ফেলেছিল।) এই রোগ পারস্য, রোম ও অন্যান্য সাম্রাজ্যে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। আল্লাহ তায়ালা তখন রসুলের মনে এই বার্তা (ইলকা) দিলেন—এই রোগের কেবল চিকিৎসা নয়, যেই বিষাক্ত জিনিস থেকে এর উৎপত্তি, তাকে সমূলে ধ্বংস করে ফেলো। আল্লাহর রসুল (স.) সেই জিনিসগুলো নিয়ে চিন্তা-ফিকির করেন, যেগুলোর কারণে এর জন্ম। তারপর এক এক করে চিহ্নিত করে সবগুলোকে নিষিদ্ধ করেন।’
একই পরিচ্ছেদে তিনি বলেন : ‘যদি কোনো সমাজ ক্রমবর্ধমান উন্নত হতে থাকে, তাহলে সেখানকার কারিগরি ও যান্ত্রিক বিকাশ চূড়ান্ত শিখরে উঠে। যদি ঠিক সেই সময় শাসকশ্রেণি আরাম-আয়েশ ও গর্ব-অহমিকায় জীবনযাপন করতে শুরু করে, তাহলে এর প্রভাবে সাধারণ নাগরিকদের ওপর এতবেশি চাপ পড়ে যে সমাজের এক শ্রেণি পশুর মতো জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। মানুষের স্বাভাবিক জীবনের সব আদর্শ ওই সময় অর্থহীন হয়ে যায়, যখন কোনো জালেম সমাজে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যতা সৃষ্টি করে জনজীবন অতিষ্ঠ করে তোলে, আর মানুষ গরু-গাধার মতো স্রেফ রুটি-রুজির জন্য সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে যায়। যখন মানুষের ওপর এহেন মুসিবত আসে, তখন আল্লাহ সেই মুসিবত থেকে উদ্ধার করতে কোনো না কোনো উপায় বের করে দেন। তিনি তার নৈকট্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মনে বার্তা পাঠান, অর্থাৎ আল্লাহ বিপ্লবের উপকরণ তৈরি করে দেন, যেন মাথা থেকে অবৈধ বেইনসাফ শাসকের বোঝা সরাতে পারেন। কায়সার ও কিসরা (প্রথমটি রোম সম্রাট ও দ্বিতীয়টি পারস্য সম্রাটের উপাধী, তবে এখানে উদ্দেশ্য ‘পূর্ব-পশ্চিমের সকল রাজ-রাজড়া।’) এই ধরনের আরাম-আয়েশ ও জুলুমের নীতি অনুসরণ করেছিল, এই রোগ থেকে মানবজাতিকে উদ্ধার করতে উম্মিদের (যাদের মধ্যে রোম-পারস্যের মতো সমাজব্যবস্থা তৈরি হয়নি।) মধ্যে আল্লাহর রসুলকে (স.) পাঠান। ফেরাউনের ডুবে মরা, কায়সার (সিজার) ও কিসরা (খসরু)-এর ধ্বংস এই মূলনীতির ওপরেই হয়েছিল, তাদের পতন ছিল নবুওয়তের জন্য একটি আবশ্যকীয় নিদর্শন।’
এখানে আরেকটা বিষয় বলে রাখা ভালো—কোনো সমাজে যখন পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে, তার নিয়ন্ত্রণে থাকে একদল ভোগবাদী জালেম, তখন সেই সমাজের ‘মজলুমেরা’ জালেম হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। জালেম ইংরেজি শিক্ষিত হয়ে মাতাব্বরি করে, মজলুম ভাবে—আমিও ইংরেজি পড়লে মাতব্বর হতে পারব। জালেম অ্যাপলের আইফোন ব্যবহার করে, মজলুম ভাবে—এই ফোনেই বোধকরি সুখ। জালেম পিৎজা খায়, বড় বড় আলুসহ কাচ্চি খায়, বারবিকিউ করে, মজলুম ভাবে—এগুলাই মনে হয় জান্নাতের খাবার। মজলুমেরা যখন জালেমের রঙ ধারণ করতে শুরু করে, সেই সমাজ থেকে ‘আখলাক’ মুছে যেতে থাকে, মানুষ ধীরে ধীরে কুকুর-শূকরের রূপান্তরকামী হয়ে যায়।
শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি (রহ.) যে ভোগবাদের নির্মূলকে নবুওয়তি কাজের অংশ বানিয়েছিলেন, পশ্চিমা আগ্রাসনে বিপর্যস্ত আমরা এখন বুঝি—তার এই তত্ত্ব ছিল অনেক দূরদর্শী। আজকের দুনিয়ায় পশ্চিমাদের কালচারাল হেজিমনির বিরুদ্ধে কিছু করতে হলে আমাদের এই দিকটাতেই সবার আগে নজর দিতে হবে। ভোগবাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতে হবে।
অর্থনৈতিক ভারসাম্য ও শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি
আমরা আগে জানোয়ার, পরে মানুষ। এই যে আমাদের দৌড়ঝাঁপ—একটা মোটা অঙ্কের বেতনের চাকরি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, রূপে-গুণে কোনো অনন্যা নারীর ভালোবাসা পাওয়ার তামান্না, কিংবা ক্ষমতার বাগডোর হাতে পাওয়ার আশা, এই সবই আমাদের জানোয়ারসুলভ স্বভাবের অংশ। আরও সহজ করে বললে, আমাদের যেসব গুণ অন্যান্য জানোয়ারের মতো, অথবা বুদ্ধিমত্তার বদৌলতে সেই গুণে ‘শৈল্পিকতার’ প্রলেপ দিয়েছি, তার সবই মানুষ হওয়ার আগের স্তর। মানুষ হতে হলে আমাদের যেতে হবে এর পরের স্তরে। অর্থাৎ আমরা যখন জাগতিক সব ঝায়-ঝামেলা পেরিয়ে আত্মার বিকাশ ঘটাতে নিরত হবো, মানবাত্মা যখন পরমাত্মার সন্ধানে নিমগ্ন হবে, তখনই আমরা মানুষ হওয়ার মনজিলে প্রথম কদম ফেলব।
কিন্তু আমরা যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে আছি, এর মধ্যে মানুষ হওয়া কী সম্ভব? শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি (রহ.) আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ও রুহানি উন্নতি না হওয়ার কারণ এভাবে ব্যক্ত করেছেন :
‘এমন একটি দেশের কথা কল্পনা করুন যেখানে স্বৈরতন্ত্র নেই, শাসকশ্রেণির রাজকীয় শানশওকত আর মৌজ-মাস্তিতে জীবনযাপনের কোনো সুযোগ নাই, প্রত্যেক নাগরিক অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন এবং ট্যাক্সের বোঝায় কোমর বাঁকা হওয়ার কারণ নাই। এমন দেশের নাগরিকদের জন্যই কেবল সম্ভব ধর্ম ও জাতির স্বার্থে কাজ করা, চারিত্রিক ও রুহানি উন্নতি হাসিল করা। কিন্তু তাদের ঘাড়ের ওপর যদি স্বৈরতন্ত্র, সরকারের এবাদত আর সামন্তবাদের ভূত চেপে বসে, তাহলে তাদের অনুভূতি আর সাধারণ চিন্তাশক্তিও ভোঁতা হয়ে যায়, এবং তারা মানুষ হিসেবে প্রাপ্য সম্মান ও উচ্চতর অবস্থান থেকে ছিটকে চতুষ্পদ জানোয়ারের মতো জীবন যাপনে বাধ্য হয়—যাদের রাতদিন কেবল দুই লোকমা ভাতে পেট শান্ত করার চিন্তায় কাটে, তারপরেও ওই জাহান্নাম কখনও ঠান্ডা হয় না।’
হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার ‘আস সিয়াসাতুল মিল্লিয়াহ’ পরিচ্ছেদে তিনি লিখেন, ‘মানুষের স্বাভাবিক জীবনের সব ছন্দ ওই সময় বরবাদ হয়ে যায়, যখন কোনো জালেম অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যতা সৃষ্টি করে জনজীবন অতিষ্ঠ করে তোলে, আর মানুষ গরু-গাধার মতো স্রেফ দুই লুকমা খাবারের জন্য সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটে।…’
অথচ হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারি অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের মৌলিক অংশ। এ বিষয়ে আল্লাহ ও তার রসুলের (স.) পক্ষ থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা আছে, যা কোনো মুসলমানের এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। শ্রমিকের পাওনা প্রসঙ্গে আল্লাহর রসুল (স.) বলেন, ‘শ্রমিকেরা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং যার ভাইকে তার অধীনস্থ করেছেন সে যেন তাকে তা-ই খাওয়ায় যা সে খায়, সেই কাপড় পরিধান করায়, যা সে পরিধান করে। তাকে সামর্থ্যের অধিক কোনো কাজের দায়িত্ব দেবে না। যদি এমনটা করতেই হয়, তাহলে মালিক যেন তাকে সাহায্য করে।’ (বুখারি শরিফ, হাদিস নং ৫৬১৭) শ্রমিককে যদি ঠিকঠাকমতো পাওনা না দেওয়া হয়, তার পরিণতি কী হতে পারে, আল্লাহর রসুল (স.) সেই সতর্কবাণীও দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যে জাতির দুর্বল লোকেরা জোর-জবরদস্তি ছাড়া তাদের পাওনা আদায় করতে পারে না, সেই জাতি কখনও পবিত্র হতে পারে না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ২৪২৬)
শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি (রহ.) তাই অর্থনৈতিক মুক্তির প্রয়োজনে কিছু মূলনীতি তৈরি করেন। মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধির (রহ.) বরাতে তা নিচে উল্লেখ করছি :
এক. সম্পদের মূল হলো শ্রম। কৃষক ও শ্রমিকের মূলধন হলো শ্রমশক্তি, আর অর্থের সাথে সেই শ্রমশক্তির পারস্পরিক বিনিময় হলো নগরসভ্যতার মূল উপাদান। যতক্ষণ মানুষ রাষ্ট্র ও জাতির জন্য কাজ করবে না, রাষ্ট্রের সম্পদে তার কোনো হিস্সা নাই।
দুই. সমাজ থেকে জুয়া, জালিয়াতি ও ভোগবাদ নির্মূল করতে হবে। কারণ এসব জিনিস সমাজে সম্পদের যথাযথ বণ্টনকে বাধাগ্রস্ত করে। শ্রমিকের কষ্টের কামাই তখন গুটিকয়েক পুঁজিপতির পকেটে গিয়ে জমা হয়।
তিন. যেসব কৃষক ও শ্রমিক কায়িকশ্রম দেন এবং জাতির উন্নয়নে যারা মেধাশ্রম দেন—রাষ্ট্রীয় সম্পদের প্রকৃত হকদার তারাই। যে রাষ্ট্রব্যবস্থায় শ্রমশক্তিকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় না, ওই রাষ্ট্রের কোনো ভবিষ্যৎ নাই।
চার. যে রাষ্ট্রব্যবস্থায় শ্রমিককে যথাযথ শ্রমমূল্য দেওয়া হয় না এবং কৃষক-শ্রমিকের ওপর অতিরিক্ত খাজনা/আয়কর আরোপ করা হয়—এমন রাষ্ট্রের সরকার জনতার দুশমন, তার ভাঙ্গন অনিবার্য।
পাঁচ. মজুরির প্রশ্নে কেবল শ্রমিকের ‘হাসিমুখ’ গ্রহণযোগ্য নয়, বরং তার মজুরির সাথে ব্যাবসায়িক মুনাফাও যোগ করা হবে।
ছয়. কাজের সময় নির্ধারিত হবে। শ্রমিকরা যেন আত্মিক ও মানসিক বিকাশের সময় পায় এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে যেন চিন্তা করতে পারে—এই পরিমাণ সময় দিতে হবে।
এখানে একটা বিষয় না বললেই নয়—শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবির (রহ.) অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলন কার্ল মার্কসের আন্দোলন থেকে আকাশ-পাতাল ফারাক ছিল। হাদিসে আছে, ‘সবকিছু নিয়তের ওপর নির্ভর।’ (মেশকাত, হাদিস নং ১) কার্ল মার্কসের নিয়ত ছিল মানুষকে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্ত করা, তারপর অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সাম্য প্রতিষ্ঠার পর কী হবে, এই ব্যাপারটা তার মতবাদে অনুপস্থিত। তার উদ্দেশ্য সাম্য প্রতিষ্ঠা করা, তিনি মনে করতেন এটা করলেই মানুষ মুক্ত হবে। কিন্তু মুক্ত হওয়ার পর কী হবে? এটা স্পষ্ট নয়। অথচ এই জায়গায় শাহ সাহেবের অর্থনৈতিক দর্শন একেবারে স্পষ্ট। তার চোখে মানুষের পরম উদ্দেশ্য আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ, জানোয়ার স্তর থেকে উন্নত হয়ে আল্লাহর খলিফা হওয়া। আর অর্থনৈতিক অন্যায্যতা যেহেতু এই উদ্দেশ্য পূরণে একটি বাধা, তাই একে দূর করতে হবে। যখন মানুষ জৈবিক চাহিদা থেকে নিশ্চিন্ত হবে, তার কাছে ভাত-কাপড়ের ফিকির করার বাইরেও সময় থাকবে, তখনই গিয়ে মস্তিষ্কজাত কাজে মনোনিবেশ করার ফুরসত পাবে। এবং এবাদতে আরও নিবিষ্ট হতে পারবে। আর এটাই শাহ সাহেবের উদ্দেশ্য। কার্ল মার্কসের চোখে যেটা উদ্দেশ্য, শাহ সাহেবের চোখে সেটা হলো একটা মাধ্যম। দুজনের চিন্তার মৌলিক পার্থক্য এখানেই।
সবশেষে বলতে হয়—শাহ সাহেব আবার প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠা আমাদের জন্য আশীর্বাদ। আমরা যদি তাকে যথাযথভাবে চর্চা করতে পারি, আশা করি এই সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনে আংশিক হলেও প্রভাব ফেলতে পারব। আল্লাহই একমাত্র সহায়তাকারী।