হযরত শাহ ওলিউল্লাহ রহ. এর জীবন ও কর্মের প্রতিটি দিক নিয়ে যে পর্যায়ের বিস্তারিত লিখতে মন চায়, তার সুযোগ হয়ে উঠে না। আর সময় ও সুযোগ নিয়ে যতটুকু লেখা যায়, তাতে মন ভরে না।
এমন লেখক কমই আছেন, যাদের লেখা ও রচনায় তাদের কালের ছাপ নেই, নেই সময় ও স্থানের চিত্র; অন্ততপক্ষে নেই তাদের সময়ের পাণ্ডিত্যপূর্ণ সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ ও বিশৃঙ্খল পরিবেশের উল্লেখ। কিন্তু শাহ সাহেবের রচনাগুলো ছিল যেন সময় ও স্থানের সীমাবদ্ধতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত─কালের প্রতি অভিযোগহীন ও দেশের পরিস্থিতি থেকে বিমুখ। বোঝাই যায় না─এই গ্রন্থগুলো এমন সময়ের, যখন দেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল শান্তি ও নিরাপত্তা। সারা দেশ নিমজ্জিত ছিল গৃহযুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সব ধরনের বিশৃঙ্খলায়। দিল্লির শাসন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা দেখছিল রাজত্বের স্বপ্ন। একদিকে শিখ, অন্যদিকে মারাঠা, তৃতীয় দিকে জাঠ ও চতুর্থ দিকে রোহিলা; দেশের সর্বত্র তোলপাড় সৃষ্টি করছিল। নাদের শাহ ও আমহদ শাহের মতো উচ্ছৃঙ্খল ও লোভী সেনাপতিরা খায়বারের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে যখন ইচ্ছা ধেয়ে আসত, আর স্রোতের মতো চলে যেত; মাঝখানে কতবার─আল্লাহই জানেন─দিল্লি লুট করা হলো আর কতবার গড়ে তোলার চেষ্টা হলো! কিন্তু দিল্লির ইলমের তাজ ওলিউল্লাহ রহ. এর স্থিতি ও প্রশান্তি ছিল এমন─সব কিছুই তার চোখের সামনে ঘটছিল, কিন্তু এর ফলে তার অন্তরে অস্থিরতা, চিন্তায় জট, কিংবা কলমে কোনো বিচ্যুতি ছিল না। তাঁর মুখে কালের প্রতি অভিযোগ ছিল না। কলমে ছিল না অতৃপ্তির প্রকাশ। মনে হয়─আত্মিক প্রশান্তির আসমানসম যে উচ্চতায় বা ধৈর্য্য ও সন্তুষ্টির যে চূড়ায় তিনি অবস্থান করছিলেন, সেখানে না পৃথিবীর অন্ধকার পৌঁছতে পারছিল, না স্থানকালের বৃত্ত তাকে বেষ্টন করতে সক্ষম হচ্ছিল।
এ থেকে উপলব্ধি করা যেতে পারে─প্রকৃত আহলে ইলমের শান ও মর্যাদা কত উঁচু, সন্তুষ্ট ও সমর্পিতদের স্থান ও অবস্থান কত উপরে! আল্লাহ তাআলা বলেন─‘জেনে রাখো, আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমেই অন্তর তৃপ্ত হয়।’
সঠিক ইলমের সঠিক প্রয়োগ ও খেদমতও ‘জিকরুল্লাহ’ তথা আল্লাহর স্মরণের আরেক রূপ। তাই এটাও যদি হৃদয়ে তৃপ্তি ও আত্মায় প্রশান্তি সৃষ্টি করে তাহলে বিচিত্র কিছু নয়। শাহ সাহেবের লেখা হাজার হাজার পৃষ্ঠা পড়ে দেখুন, আপনি বুঝতেও পারবেন না─এটা হিজরি বারতম শতাব্দীর অশান্ত সময়ের ফসল, যখন সবকিছুতে ছিল অসন্তোষ ও অস্থিরতার ঘনঘটা। কেবল জানা যাবে─এ হলো জ্ঞান ও প্রজ্ঞার এক সাগর, যা বয়ে চলছে উত্তালহীন, এমনকি সময় ও স্থানের ‘খড়কুটো’ থেকেও মুক্ত।
কিন্তু তারপরও তিনি ছিলেন এমন কালের মানুষ─যখন ভারতবর্ষে ইসলামি সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ছিল। ছড়িয়ে পড়েছিল সংঘাত ও বিশৃঙ্খলা। সর্বত্র দায়মুক্তি ও বঞ্চনা ছিল স্পষ্ট। অভিজাতরা ছিল জাঁকজমক ও বিলাসিতায় মত্ত। সুফিগণ ছিলেন খানকার চার দেয়ালে আবদ্ধ। আলেমগণ ছিলেন উচ্চাভিলাষী ও দরবারি। রাজারা দীন ও দুনিয়ার সকল বিষয় থেকে মুক্ত হয়ে পূর্বপুরুষদের ধন-সম্পদ লুটিয়ে দিচ্ছিল নাচ-গানের আসরে আর চাকচিক্য ও সৌন্দর্যের মরীচিকার পেছনে। প্রজারা দুর্দশা আর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল; তাদের ধনভান্ডার শূন্য আর প্রলোভনের বাজার উত্তপ্ত। এই ছিল সেসময়ের করুণ দৃশ্য─গভীর প্রশান্তি ও স্থিতি সত্ত্বেও যা শাহ সাহেবের চোখের কোণে অশ্রু এনে দেয়। ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’র একটি অধ্যায়ের শেষে তিনি লিখেছেন :
“এই যুগে দেশের দুর্নীতি ও অস্থিরতার দুটি প্রধান কারণ হলো─এক. রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ঘাটতি। তা এভাবে, বিনা পরিশ্রমে কোষাগার থেকে অর্থ লাভ করা কিছু মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। তারা ছিল সৈনিক ও এক শ্রেণির আলেম, যাদের হক রয়েছে এই কোষাগার আয়ের মধ্যে বা যারা স্বয়ং বাদশাহ কর্তৃক পুরস্কৃত ও সম্মানিত, যেমন পেশাদার সুফি, কবি ও অন্যান্যদের মধ্যে যারা দেশের জন্য কোনো কাজ না করেই কোনো না কোনোভাবে সম্পদ লাভ করে থাকে। এই সমস্ত লোক তাদের ও অন্যদের আয়ের উৎস ও মাধ্যম কমিয়ে দেয়। বস্তুত তারা দেশের জন্য বোঝা। দ্বিতীয় কারণ হলো─চাষী, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীদের উপর ভারী কর আরোপ এবং তাদের সাথে এ ব্যাপারে কঠোরতা করা। অবস্থা দাঁড়িয়েছে এমন─যারা সরকারের আনুগত্য করে রাষ্ট্রীয় আদেশ অনুসরণ করছে, তারা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আর যারা একগুঁয়ে ও অবাধ্য তারা হয়ে উঠছে আরও বিদ্রোহী, তারা সরকারকে কর প্রদান করে না। অথচ দেশ ও রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও স্থায়িত্বের ভিত্তি হলো, জনসংখ্যা থেকে রাজস্ব, সেনাবাহিনী ও প্রয়োজন পরিমাণ কর্মকর্তা নিয়োগের উপর। এজন্য এ যুগের মানুষদের রাষ্ট্রব্যবস্থার এই রহস্য গভীরভাবে বুঝতে হবে।”
শাহ সাহেব এই কয়েক লাইনে যা বলে দিয়েছেন, তার উপর আজ পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা সম্ভব। তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাজনীতি ও অর্থনীতির যে সূক্ষ্ম বিষয়াদির উপর পড়েছিল, তা আজকের চিন্তাবিদরা বুঝতেও অক্ষম। সামন্ততন্ত্র পুরো দেশকে অভিজাতদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিল। কেন্দ্রের দুর্বলতা তাদের বাগডোর ঢিল করে দিয়েছিল। অভিজাতদের দাবি ছিল, তাদের পূর্বপুরুষরাও বিনা পরিশ্রমে সাম্রাজ্যের সম্পদ ও জমির অধিকারী হয়েছিল। যদিও তারা আর সাম্রাজ্যের কোনো কাজ করতে পারত না, তবুও তারা বাহ্যিক দাপট ও বিলাসিতার জীবনযাপন করত। সাম্রাজ্যের অর্থব্যবস্থা তাদের অযথা বিলাসিতা ও অপচয়ের কারণে দুর্বল হতে থাকে। জমিদাররা নিজেদের বলয় তৈরি করে দখল করতে থাকে সাম্রাজ্যের জমিজমা। এরপর যখন তারা পর্যাপ্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যেত, তখন সব ধরনের সরকারি দাবি প্রত্যাখ্যান করে লুটপাট চালাত। এমনকি সামরিক অভিযান ব্যতীত এই জমিদারদের কাছ থেকে বার্ষিক রাজস্ব সংগ্রহ করাও ছিল অসম্ভব। অতঃপর তাদের কাজও প্রতি বছর লড়াই-অভিযান চালিয়ে জমিদারদের থেকে রাজস্ব আদায় করা হয়ে দাঁড়ায়।
একইভাবে যদি কোনো পরিবারে বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ পূর্ণতার অধিকারী কোনো ব্যক্তি থাকত আর তার সন্তুষ্টির জন্য বাদশাহকে নিয়মিত ভাতা নির্ধারণ করতে হতো, তখন তাকেও করহীন জমি প্রদান করা হতো, যা চলতে থাকত প্রজন্মের পর প্রজন্ম। অথচ বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ পূর্ণতা থেকে বঞ্চিত তার পরবর্তীরা ছিল রাষ্ট্রীয় অর্থব্যবস্থার উপর বোঝা─বরং তাদের কর্ম ও উপার্জনহীন অস্তিত্বটাই ছিল দেশ ও জাতির জন্য হুমকি ও লজ্জার।
একই অবস্থা ছিল সুলতান ও অভিজাতদের ধন-সম্পদের ক্ষেত্রে, যা তারা ব্যয় করত চাটুকার কবি, বানোয়াট গল্পকার, মিথ্যা অভিনেতা ও শিল্পীদের পেছনে। অথচ সাম্রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল যে বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর, অর্থের অভাবে ভেঙে পড়ছিল সেগুলো!
এই অন্যায় ও অন্যায্য ব্যবস্থার ফলাফল দাঁড়াল─বাদশাহগণের যেহেতু যা কিছুই হোক, নিজেদের কার্যক্রম চালাতেই হতো, তাই তারা বিদ্রোহী জমিদার ও অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীকে ছেড়ে দিয়ে দরিদ্র কৃষক এবং যারা ছিল তাদের আদেশের অনুগামী, তাদের উপর চাপিয়ে দিল সাম্রাজ্যের সমস্ত ভার। সমস্ত রাজস্ব আদায় করা হতো তাদের থেকে─যার কারণে দেশের পরিস্থিতির অবনতি ঘটছিল আরও দ্রুত। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির এই অস্থিতিশীলতা ধ্বংস ছাড়া আর কি?
এই একটি দিকের আলোচনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়─শাহ সাহেবের রাজনীতি ও অর্থনীতির দৃষ্টি ছিল কত গভীর!
হিন্দুস্তানে ইসলামি শাসনব্যবস্থা পতনের কারণ সম্পর্কে ধারাবাহিক লেখা চলমান থাকুক ইনশাআল্লাহ।
এরকম ঠুনকো লেখা দিয়ে যোগাযোগ ভর্তি করে রাখার ইচ্ছে থাকলে এটা বন্ধ করে দেওয়ায় ভালো। ভারতে মুসলিম শাসনের অবসান কেন হলো এই বিষয়ে গুগলে সার্চ দিয়ে এর চাইতে সমৃদ্ধ রচনা লেখা সম্ভব। এক জায়গায় লিখেছে শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.) এর চিন্তা নাকি আজকালকার চিন্তকরা বুঝতে অক্ষম! তাইলে যিনি এই প্রবন্ধ লিখেছেন, তিনি বুঝলেন কীভাবে?
আমি শাহ সাহেবের রচনা তেমন পড়িনি। মুসলিম শাসকদের অধঃপতন ও স্বেচ্ছাচারীতার তার অবস্থান কী ছিল জানি না। তিনি শাসকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদেরকে সতর্ক করেছিলেন কিনা সেটা প্রশ্ন জাগছে আমার।
আপনি নিজেই স্বীকার করলেন, শাহ সাহেবের লেখা তেমন পড়েন নাই৷ যিনি লিখছেন লেখাটা সেই নদবী শাহ সাবরে পড়ছেন৷ তাইলে আপনি তার মতো করে বুঝবেন না—এটাই স্বাভাবিক৷
যে প্রশ্ন জাগছে আপনার মনে তার উত্তরের জন্য শাহ সাবরে পড়ুন৷ এই লেখা যে আপনার মনে অন্তত একটা প্রশ্ন জাগাতে পারছে সেটা এই লেখার সাফল্য৷ এবং যোগাযোগেরও৷ গুগল যেটা পারবে না৷
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ৷