আপনি গাযার বর্তমান অবস্থাকে কীভাবে দেখেন?
রিক্ত–বিবর্ণ তবু আশা আর প্রাণশক্তিতে ভরপুর। ২০০৮ সাল থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত ইসরায়েল চার–চারটা মর্মান্তিক আক্রমণ চালিয়েছে। অবরোধ করে রেখেছে গাযার আকাশ–মাটি–সমুদ্র সব। পুরো পৃথিবী থেকে গাযাকে এমনভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে যে এই শহর ছেড়ে মানুষ না সহজে যেতে পারে, না এখানে আসতে পারে। এখানে আকাশে বিভিন্ন রকমের আলো জ্বলে। কখনো সূর্যের, কখনো চাঁদের আবার কখনো বা মৃত্যুবার্তা নিয়ে আসা বোমা–বারুদের। গাযার তরুণদের ঘুম ভাঙে নতুন দিনের খোঁজে, নিজেকে অন্তত নিজের কাছে প্রমাণ করার নতুন সুযোগের খোঁজে। অথচ এসবের কিছুই হয় না আর। কারণ ঘরে–দুয়ারে, রাস্তায় অথবা কখনো পার হতে না পারা সীমান্তে বসে বসে নিজেদের মধ্যে আলাপ করা ছাড়া তাদের আর কিছুই করার থাকে না।
এই শহরে আপনার সবচেয়ে বেদনাময় স্মৃতি কোনটি?
২০২১ সালের ১৩ মে মধ্যরাতে, নর্থ গাযার শেখ যায়েদ এলাকায় ইসরায়েল প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ করে। জায়গাটা আমার বাসা থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে। শুধু আমার কাছে না, অন্য সবার মতেও সেবারের বোমাহামলা ছিল সবচেয়ে প্রবল আর ভয়ংকর। আল তানানি–একটা গোটা পরিবার সেখানে শহিদ হয়েছিল। বাবা–মা আর তাদের চার ছেলেমেয়ে। বাচ্চাদের সবারই বয়স দশের নিচে ছিল। ঘটনার সময় আমি জানালায় দাঁড়ানো ছিলাম। আকাশে প্রচন্ড আলো জ্বলে ওঠে, সেই সাথে কান ফাটানো বোমার শব্দ। পরেরদিন আমি জায়গাটা দেখতে যাই। ঘরবাড়িগুলো চেনার উপায় ছিলো না। বারান্দা, বাচ্চাদের ঘর বা রান্নাঘর সব ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গেছে। মেঝে আর সিলিংয়ের ধ্বংসাবশেষের মাঝখানে চাপা পড়া একটা বাথটাব দেখতে পেলাম। সেদিন ওই জায়গার তোলা একটা ছবি আমি পরবর্তীতে আমার প্রথম কবিতার বইয়ে সংযুক্ত করেছি। খুব দুঃখ হয় মাস কয়েক পর, বাড়িঘর পুনর্নির্মাণকাজ শুরু হতে দেখে। সে কথা না বলে পারছি না। ব্যাপারটা একটু জটিল। আমার মনে হচ্ছিল, সবকিছু এই ভাঙাচোরা ধ্বংসস্তুপই থেকে যাক। সাক্ষী হয়ে থেকে যাক পৃথিবীবাসীর কাছে, সেই সব অপরাধীদের কাছে যাদের আদেশে আর যাদের ‘জি স্যার, জি স্যার’র কারণে এতগুলো মানুষ প্রাণ হারাল।
গাযায় এমন বিশেষ কী আছে যেটা কেউ তেমন খেয়াল করে না?
গাযার আশপাশের গ্রামাঞ্চল, বিশেষ করে বেইত লাহিয়ার উত্তর অংশ। স্ট্রবেরি–খেতের জন্য এই ছোট্ট শহরটি বেশ পরিচিত হলেও এটা যে ফিলিস্তিনের হাঁটার জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম সুন্দর একটা জায়গা, তা খুব কম মানুষই জানে।
এখানকার কোন কোন লেখকদের লেখা আমাদের পড়া উচিত?
নাসির রাবাহ, ইউসরি আল ঘুল, মোহাম্মাদ নাসসের, নে’মা হাসান, হামিদ আশুর, আতিফ আবু সাইফ।
উনাদের মধ্যে বেশিরভাগই আরবিতে লেখেন। যদি তাদের কারো কোনো কাজ ইংরেজি অনুবাদ হয়েও থাকে, তার পরিমাণ খুবই সামান্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে, নাসির রাবাহ আর ইউসরি আল–ঘুলের অনুবাদগুলো পড়তে বলবো।
এ শহরে এমন কোনো স্থান আছে কি যেখানে প্রায়ই যাওয়া হয়?
সমুদ্রপাড় আর বেইত লাহিয়ার সেই গ্রাম। আর গাযা সিটির মধ্যে আল–জুনদি আল–মাজহুল পার্কে (অজ্ঞাতসেনা পার্ক) সময় কাটাতে ভালো লাগে। জায়গাটা বড়সড় ক্যাফের মতো। বাচ্চারাও পরিবারসহ আসে, খেলে। বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ করতে হলে আমি সেখানেই যেতাম। ট্যাক্সিঅলাদের প্যাঁপুঁ প্যাঁপুঁর মধ্যেও সেখানে কথা বলতে বলতে আরাম করে আইস্ক্রিম বা কফি খাওয়া যায়।
এখানে কি বিখ্যাত কোনো সাহিত্যচর্চা কেন্দ্র আছে?
গাযা উপত্যকার শরণার্থী শিবির কিছুটা ওরকম একটা জায়গা, যেখানে মানুষ নিজেদের জীবনের গল্প বলে, মহাকাব্য পাঠ করে। একসময় সামির মানসুর বইঘর নামেও একটা জায়গা ছিলো। ২০২১ সালের মে মাসে ইসরায়েলি বোমা হামলার কবলে পড়ে জায়গাটা। সৌভাগ্যক্রমে, কয়েকমাস পরেই এটা পুনর্নির্মাণ করা হয়। তৃতীয় আরেকটা জায়গা হচ্ছে, গাযার এডওয়ার্ড সাইদ পাবলিক লাইব্রেরি। ২০১৬ সালে আমি লাইব্রেরিটা দিই। এখানে বেশিরভাগ বই–ই বিদেশ থেকে আমার বন্ধুদের পাঠানো ইংরেজি ভাষার বই। শিশু ও তরুণেরা এখানে বই পড়তে আসে। জ্ঞানচর্চা ও বিকাশের পরিবেশে শামিল হয়।
আপনাকে মুগ্ধ করেছে এমন কোনো গুপ্তশহর কি এখানে আছে?
আমার মনে হয়, নাই। কারণ গাযা খুবই ছোট জায়গা। এতটুকুর মধ্যে আরেকটা শহর থাকা আসলে কঠিন ব্যাপার। আবার, প্রতিটা ইসরায়েলি বোমা হামলার পর গাযা যেন অন্য এক শহরে পরিণত হয়। গাযা ছেড়ে চলে যাওয়ার মাত্র পাঁচ বছর পরও কেউ ফিরে এলে অনেক রাস্তাঘাট, মহল্লাই আর চিনতে পারবে না। কারণ প্রতিটা বোমা হামলার পর পাড়া–মহল্লাগুলোকে পুনর্নির্মাণ করা হয় নতুন বিন্যাসে। পাড়া–মহল্লা তো বদলে যায়ই, মানুষও আর আগের মানুষটা থাকে না।
আপনাদের প্যাশন নিয়ে কিছু বলুন।
আমাদের আবেগ, অনুভূতি আর প্রেরণার জায়গা ওই সীমান্তের কাছে, যেখানে আমরা দাদাবাড়ির ওপর ঝুলে থাকা আকাশে নিত্যনতুন নকশা বানাই। আমাদের সেই দাদাবাড়ি ইসরায়েল ধ্বংস করে দিয়েছে ১৯৪৮ সালে। আমাদের প্যাশন ওই সমুদ্রপাড়, যেখানে আমরা দৃষ্টির পাল তুলে চলি কোনোদিন না দেখা, না পাওয়া গন্তব্যে। আর ওই ছোট ছোট পাহাড়ের চূড়ায়, যেখানে আমরা মেঘ ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন দেখি।
গাযা নিয়ে আপনার করা কাজগুলোর একটির নাম বলুন। এই কাজের পেছনে আপনাকে অনুপ্রেরিত করেছে কীসে?
আমার কবিতার বই ‘থিংস য়ু মে ফাইন্ড হিডেন ইন মাই ইয়ার’ এ একটা কবিতা আছে ‘শ্রাপনেল লুকিং ফর লাফটার’ নামে। এই কবিতাটা আমি লিখেছি ২০২১ সালে, ইসরায়েলের সেই ভয়ংকর এগারো দিনব্যাপী চালানো বোমাহামলার সময়ে। মে মাসের ১৩ তারিখ রাত ১ টা ১০–এ, ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান এক নতুন ধরনের বোমা নিক্ষেপ করে গাযার বিভিন্ন এলাকা ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করে। প্লেন থেকে সেই সব বোমা ফেলার শব্দ আমরা শুনতে পেতাম। প্রতিটা মানুষ তার কাছের মানুষদের চোখের দিকে এমনভাবে তাকাত যেন তাদের দৃষ্টি বলছে বিদায়, নিজের খেয়াল রেখো। ওই একইদিনেই আল–তানানি পরিবারকে হত্যা করা হয়।
আমার কবিতার কিছু অংশ এখানে তুলে দিলাম—
বোমার আঘাতে উড়ে গেছে ঘরদোর। চারদিকে মৃতদেহ;
শিশুরা, তাদের বাবা–মা, প্রিয় খেলনা, টিভি অভিনেতা,
গল্প–উপন্যাসের চরিত্ররা, কবিতার লোকেরা,
আমি, তুমি, সে। কোনো সর্বনাম আর বাকি নেই।
শিশুরা যে পরের বছর বিভিন্ন প্রকার পদ শিখবে, সর্বনাম সম্পর্কে
জানবে, সে উপায়ও নেই।
অন্ধকার আকাশ ছেয়ে গেছে শ্রাপনেলে,
ভাঙা দেয়াল আর রক্তাক্ত ছবির ফ্রেমের পেছনে
কোনো পরিবার হাসছে না কি, খুঁজছে তারা।
লেভির প্রশ্নটাই করি, গাযার বাইরে কি আসলেই কোনো বাহির আছে?
দুর্ভাগ্যই বলতে হয়, গাযার তরুণ প্রজন্মের বেশিরভাগই কখনো গাযা ছেড়ে কোথাও যায়নি, এমনকি ফিলিস্তিনি সীমানার অংশ পশ্চিম তীরেও না। বাইরের পৃথিবী দেখতে কীরকম হয়, গাযাবাসী তা কল্পনাও করতে পারে না। তাদেরকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় পৃথিবী কত বড়, বোকা বোকা একটা উত্তর দিবে গাযাবাসী : কী জানি, একশটা গাযার সমান হবে হয়তো?
এখানে আমার নিজেকেই মাঝেমাঝে বহিরাগত মনে হয়। কারণ আমার স্বপ্ন সেই ইয়াফা শহরে ফিরে যাওয়া, যেখান থেকে ১৯৪৮ সালে আমার দাদা–দাদুকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। ইয়াফাকেই আমার নিজের শহর বলে মনে হয়। কিন্তু তার মানে এই না যে আমি গাযায় থাকতে চাই না। গাযা আমার কাছে সেই ভূমি, যেখানে শাখা–প্রশাখা মেলেছে আমার চিন্তা, চেতন ও জ্ঞানের মহিরুহ। আমার হৃদয় চিরকাল এই শহরের শূন্যতা অনুভব করবে, এমনকি এখানে থাকা অবস্থায়ও।
মোসাব আবু তোহা গাযার অধিবাসী, ফিলিস্তনি কবি, ছোটগল্পকার ও প্রাবন্ধিক। তিনি Things You May Find Hidden in My Ear: Poems from Gaza নামের একটি কবিতার বইয়ের লেখক, যেটি ন্যাশনাল বুক ক্রিটিক্স সার্কেল এওয়ার্ড ইন পোয়েট্রির তালিকায় মনোনয়ন পেয়েছে এবং ২০২২ প্যালেস্টাইন বুক এওয়ার্ড পুরস্কার জিতেছে। তিনি এডওয়ার্ড সাইদ লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা। ২০১৯ থেকে ২০২০ সালে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ভিজিটিং–পোয়েট এবং আবাসিক লাইব্রেরিয়ান হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।
অসাধারণ, নির্মল অনুবাদ