‘আমাদের’ রেঙ্গা মাদরাসা
কু ঝিক ঝিক ট্রেন চলেছে। দীর্ঘ ভ্রমণে ক্লান্ত। ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়াটাকে উপভোগ করার অভিপ্রায়ে ঘুমঘুম চোখেও জানালা গলে দূর দিগন্তে তাকিয়ে আছি। খানিকটা সময় তারপরেই তো গন্তব্যে। ফজরের আজান হলো, অন্ধকারের চাদর ধীর লয়ে সরে যাচ্ছে। আলো-আঁধারিতে সবুজ মাঠ কেমন দূর থেকে দূরে দৌড়ে পালাচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো গতি কমে এসেছে। সামনে আরেকটা ট্রেনকে ক্রস করবে বলে আমাদের ট্রেনটা মন্থর। আমার পাশের যাত্রী আচমকা জানালার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল-এরা কী করছে? এটা কোথায়?
বুঝতে পারলাম আধো ঘুম আধো সজাগ অবস্থায় এমন দৃশ্য দেখার জন্য আমার সহযাত্রী হয়তো প্রস্তুত ছিলেন না। এমন আলো-আঁধারিতে শত শত সফেদ পাঞ্জাবি পরা লোক বিশাল শানবাঁধা ঘাটে অজু করছেন, কেউ দাঁড়িয়ে মিসওয়াক করছেন, আরেকটু পশ্চিমে আবছা আলোয় মসজিদের বারান্দায় কিছু লোক ফজরের সুন্নাত আদায়রত। কোথাও কোনো হল্লা নেই, শুনশান নীরব। পাহাড়, জঙ্গল, নদী-মাঠ পেরিয়ে এমন দৃশ্য দেখে আমার সহযাত্রীর একটা ঘোর তৈরি হয়েছে। তিনি ভাবছেন, এটা কোনা স্বাপ্নিক দৃশ্য নয়তো জিনের রাজ্য। আমিও কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে উঠলাম। ইতোমধ্যে মনে হলো তাকে এ সম্পর্কে কিছুটা বলব তখনই আমার সিটের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অতি সাধারণ এক প্রৌঢ় বলে উঠলেন ‘এটা আমাদের রেঙ্গা মাদরাসা’। অতঃপর তিনি মাদরাসার বিত্তান্ত বললেন, খুব আগ্রহ আর আনন্দ নিয়ে। তবে তাঁর উচ্চারিত ‘আমাদের’ শব্দটি মনে গেঁথে গেল।
আমিও তো এখানকার ফাজিল কিন্তু কখনোই এতোটা দৃঢ়তা আর গর্ব নিয়ে ‘আমাদের মাদরাসা’ বাক্যটা বলতে পারিনি। তাকে প্রশ্ন করলাম, আপনি কি এই মাদরাসায় পড়েছেন। তিনি বললেন, পড়েননি। এই গ্রামে আপনার ঘর? তাতেও নাবাচক উত্তর আসল। তিনি জানালেন, এই মাদরাসা থেকে পাঁচগ্রাম দূরে তাদের বাড়ি, একসময় তার বাবা ও চাচারা এখানে পড়তে আসতেন। এখানকার শিক্ষকরা পায়ে হেঁটে-ঘোড়ায় চড়ে তাদের মহল্লায় গিয়ে তাফসির করতেন।
একটা সাধারণ মানুষ তার বাড়ি থেকে দূরের একটা প্রতিষ্ঠানকে নিজের ভাবছে বিষয়টা আমার মনে একটা নাড়া দিয়ে গেল, মননে একটা টোকাও দিল—কওমি মাদরসা তো কওমের-ই। এই মাদরাসা তো একান্তই জনগণের। জনসাধারণের। ‘আমাদের’।
একটা বিস্তৃত গ্রামীণ জনপদ নিজেদের জীবনাচারের সাথে একটি প্রতিষ্ঠানকে এতটাই সম্পৃক্ত করে ফেলেছে যে, তাদের পরিচিতি, জ্ঞাতিত্ব ও সামাজিক আচারেও সেটি বিবেচ্য। এতটা আপন করে বাংলাদেশের কোন প্রতিষ্ঠানকে স্থানীয়রা ধারণ করে বলে মনে হয় না।
শত বছর পেরিয়ে
সিলেট থেকে মাইল দশেক দূরের অজপাড়া গাঁ। গ্রামের পূর্বপাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে উত্তরের শহর সিলেটে। এই রাস্তা দিয়ে সাদা সাহেবরা স্টিম ইঞ্জিনের গাড়ি করে এদিক ওদিক যান। মাঠের কৃষকরা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন, এসব অত্যাচারীরা বিদেয় হবে কবে? স্থানে স্থানে আলেম উলামারা জেগে উঠেছেন। মুটে-মজুর, কৃষক-তাঁতিদের নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন স্বাধীকার আন্দোলেনের নেতারা। এখানে ওখানে দাঙ্গার খবর মেলে। আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের শিক্ষিত হওয়ার কথাও বলেন কলকাতা, আসাম আর উত্তর প্রদেশ থেকে আসা বড় বড় মুসলিম নেতারা। কিন্তু কোথায় পড়াশোনা করবেন এসব প্রান্তিক মানুষেরা, শহরে গিয়ে নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে পড়ার সামর্থ্য তাদের নেই।১৯১৯ সাল। এগিয়ে এলেন মাওলানা আরকান আলী, দারুল উলুম দেওবন্দের নীতি আদর্শে গড়ে তুললেন একটি মাদরাসা। নাম হয় ‘রেঙ্গা মাদরাসা’। যা কেবলই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, সাধারণ মানুষের এক আস্থার জায়গাও বটে। শিশুরা পড়তে আসে, বড়রা আসেন পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা নিয়ে। অল্প দিনেই মাদরাসাটি রেঙ্গা এলাকার প্রতিষ্ঠান থেকে পুরো একটি মহকুমার প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠে, মহকুমা থেকে জেলা। জেলা থেকে বাংলাদেশের পুরো উত্তরপূর্ব অঞ্চলের অন্যতম বিদ্যাপীঠ।
চল্লিশের দশকে মাওলানা আরকান আলী রহ. এর প্রতিষ্ঠিত জামেয়া রেঙ্গার হাল ধরেন তার-ই সুপুত্র, দারুল উলুম দেওবন্দের ফারেগ ও মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানি রহ. এর একান্তজন—মাওলানা বদরুল আলম। হুসাইন আহমদ মাদানির হাতে গড়া ছাত্র মাওলানা বদরুল আলম কেবল মাদারাসার ভেতর-ই নিজেকে সীমাবদ্ধ করে রাখেননি। নিজেকে নিয়োজিত করেন নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে। কুসংস্কার আর অন্ধকারে নিমজ্জিত বিশাল এক জনগোষ্ঠীকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করেন আলোর পথে। আত্মশুদ্ধি, সমাজ সংস্কার, রাজনৈতিক দীক্ষা কোনো কিছুতেই তিনি পিছিয়ে ছিলেন না। ঘোড়ায় চড়ে গ্রামের পর গ্রাম চষে বেড়াতেন উম্মাহ ও জাতির কল্যাণার্থে। তিনি যেমন অল্প দিনে সবার শায়খে রেঙ্গা হয়ে উঠলেন, তাঁর মাদরাসাটিও হয়ে উঠল সবার নিজেদের মাদরাসা।
কয়েক দশক পেরিয়ে ‘জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গার’ সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণের মৌলভীবাজার, পশ্চিমের হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে। ধীরে ধীরে দেশব্যাপী। শিক্ষার্থীরা ভীড় জমান, তাদের আবদার একটাই—হাদিসের দরস নেবেন মাদানি রহ. এর খলিফা বদরুল আলম রহিমুল্লাহর কাছ থেকে। ১৯৬৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় দাওরায়ে হাদিসের দরস। শায়খুল হাদিসে হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় বিশিষ্ট হাদিসবিশারদ আল্লামা কমরুদ্দীর রহ. কে।
১৯৬৭-২০২৩ এরই মধ্যে কয়েক হাজার মুহাদ্দিস, মুফতি, মফাসসির ও নানা পেশাজীবী হাদিসের দরস সম্পন্ন করেছেন এই জামেয়া থেকে। নিজেদের মহিমান্বিত করেছেন এই প্রতিষ্ঠানের আলো-হাওয়ায়।
নৈস্বর্গের দিন-রাত
হাইওয়ে। হাইওয়ে পেরিয়ে কাশবনে ঘেরা সরু রেল লাইন। রেললাইনের খানিকটা সামনেই বিশাল পুকুর। পুকুর পেরিয়ে গাঢ় সবুজ মাঠ। এখানে ওখানে নিভৃতে কয়েকটা নারকেল গাছ। এমন খোলা হাওয়ায় মাঝে মাঝেই ঢেউ খেলে যায় পুকুরের নীল-স্বচ্ছ জলরাশি। হাঁটু সমান ঘাস মাঝেই মাঝেই দুলে ওঠে পুবালি বাতাসে। মাথা নাড়িয়ে যেন হেফজের সবক মুখস্থে ব্যস্ত নারিকেল বৃক্ষের দল।
সামনে এগিয়ে গেলেই মসজিদ। দক্ষিণ পাশে দীর্ঘ চারতল শিক্ষা ভবন, ডানপাশে মাঠ পেরিয়ে উত্তরে প্রশাসনিক ও আবাসিক ভবন। ২০০০ হাজার শিক্ষার্থীর একটা ক্যাম্পাস এতোটা নীরব-নিবিড় আর স্নিগ্ধ হতে পারে সেখানে না গেলে কেউ বুঝে উঠতে পারবে না। কোথাও কোন হই-চই নেই, জটলা নেই। পাঁচ বেলা নামাজের আগে সবাই জমায়েত হচ্ছে পুকুরঘাটে, মসজিদের বারান্দায়। কুশলাদি শেষ করে যে যার মতো আবারও নিজ নিজ গন্তব্যে।
জ্ঞান তাপসদের ডেরায়
দিন দিন পরীক্ষাকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে সব, প্রতিযোগিতার এক তীব্র লড়াই সবখানে। ইলমে নববির মেজাজও কি তাই? নিশ্চয় নয়। জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গা প্রবেশের পরই যে কথাটি আপনার হৃদয়ে গেঁথে দেয়া হবে তা হলো এটা জ্ঞান উৎপাদন ও চর্চার জায়গা। জ্ঞান প্রদর্শনী বা বাহাদুরির জায়গা নয়। সন্ধ্যার পর ছোট ছোট দল, উপদল পারস্পরিক মুযাকারা ও পর্যালোনায় ব্যস্ত। শিক্ষকদের হাকডাক নাই। কড়া নজরদারি নেই। তবু সবাই মগ্ন, বিভোর।
জামেয়ার অধিকাংশ শিক্ষকই বয়সের ভারে ন্যুব্জ, শুভ্র-সফেদ। কেউ হয়তো চার দশকেরও বেশি সময় ধরে ইলমে ফারায়েজ পড়াচ্ছেন, কারো হাদিস পড়ানোর বয়স অর্ধ শতাব্দী, তাফসির পড়াচ্ছেন কয়েক দশক। সদ্য প্রয়াত আল্লামা শিহাবুদ্দীন র. ফারেগ হওয়ার পর দিন থেকে মৃত্যুদিন পর্যন্ত প্রায় ছয় দশক ছিলেন এই জামেয়ার শায়খুল হাদিস। দারুণ এক পরম্পরা, একই মসনদে হাদিস পড়াচ্ছেন ছাত্র, ছাত্রের উস্তায আবার সেই উস্তাযের উস্তায। কারো কোনো তাড়া নেই। ক্লান্তি নেই, নেই অনুযোগ।
যদি মন টানে
আমরা যারা খুব অল্প বয়সে বাড়ি ছেড়েছি—ঘর থেকে বেরিয়ে দূর বহুদূরে নিজেদের শৈশবটা কাটিয়েছি আমাদের কাছে স্মৃতি বলতে দরসগাহ। স্বজন বলতে দারুল একামার
প্রিয় কোনো শিক্ষক আর প্রিয় স্থান মাদরাসার পুকুরঘাট কিংবা অজুখানা। আরও আট দশটা শিশুর মতো আমাদের শৈশবটা রংধনুর সাত রঙের মতো এতটা বর্ণিল ছিল না বটে, তবে আমাদের শৈশবে যে কয়টা রং ছিল সব-ই ছিল গাঢ়-গভীর। পিতার অপত্য স্নেহ আর মাতৃমমতা ছেড়ে আসা একটি শিশুর কাছে মাদরাসার প্রত্যেকটি আসবাব-ই একটা সময় আপন হয়ে ওঠে, প্রত্যেক সহাধ্যায়ীই হয়ে উঠে নিকট স্বজন। মাদরাসার হোস্টেলেই আমার শৈশব কৈশোর। এর বাইরে আমার বাল্যস্মৃতি নেই বললেই চলে। যেসব কারণে একটা কিশোরের স্মৃতি সুখকর ও গুরুত্ববহ হয়ে উঠতে পারে এর সব-ই ছিল সে মাদরাসার আঙিনায়। যখনই মন টানে ছুটে যাই সেই আঙিনায়।
(যদি মন টানে : সিলেট শহর থেকে বাসে, লেগুনা বা সিএনজিতে মেগালাবাজার, সেখান থেকে রিকশা বা অটোতে করে জামেয়া তাওয়াক্কুরিয়া রেঙ্গা।)
অসাধারণ… প্রিয় লেখক বাশিরুল আমিনের জন্য দোআ ও শুভ কামনা।
একটানে পড়ে ফেললাম। আপনার লেখা বলে। ভীষণ ভালো লাগলো।
কী এক মোহনীয় স্বাদ এই গদ্যে। কেবল হৃদয়ের তুলিতে সম্ভব এই স্থিরচিত্র আঁকা। এ যে লেখকের দ্বিতীয় মাতুলালয়!
অসাধারণ লেখনী ছিলো, মনমুগ্ধকর হয়ে পড়ছিলাম💝
মাশা-আল্লাহ”অসাধারণ লিখনী! আল্লাহ যেন লেখকের হায়াতে বারাক্বাহ দান করেন।
আমার বাড়ি দক্ষিণ সুরমার পরের উপজেলা ফেঞ্চুগঞ্জে। বাড়িতে আসতে-যেতে চোখে পড়ে নিয়মিত। যত দেখি, তত দেখার ইচ্ছে বাড়ে। নববী ইলমের সুসজ্জিত বাগান— দারুণ, দারুণ…
ভালো লাগল।