লানত

সাব্বির জাদিদ

সে রাতের পূর্ণিমা ছিল অন্য রকম। আকাশ থেকে থোকায় থোকায় আলোর বন্যা যেন নেমে আসছিল মরুজমিনে। জোছনার ফকফকা উজ্জ্বলতায় কাফেলার পদচিহ্ন দূর থেকেও চোখে পড়ছিল স্পষ্ট। বেখেয়ালি এক নিশাচর পাখি দৃষ্টির শেষ সীমানায় উড়ছিল আপন মনে। জোছনা-প্লাবিত আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে আবু লাহাব— এবারের সফর নিশ্চয় শুভ হবে।

যে সফরের প্রতি খোদ দেবতাদের প্রচ্ছন্ন সায় ও সন্তুষ্টি থাকে, সেই সফর শুভ না হয়ে পারেই না। শাইবার উচ্চারিত বাক্যে চমকে ওঠে আবু লাহাব। আবু লাহাব যে বলে, শাইবার কান তার হৃদয়ের মতোই তীক্ষ্ণ, আরো একবার প্রমাণিত হলো তা। সে চমকিত ভাব চেহারা থেকে সরিয়ে সম্মতিসূচক দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয় শাইবার দিকে। গোঁফে ঢাকা ঠোঁটে খেজুর শাখার বাঁকা হাসি। রওনা হওয়ার আগের দিন সন্ধ্যায় হোবল দেবতার সান্নিধ্যে গিয়েছিল আবু লাহাব। প্রণাম ও সেজদা শেষে যাচাই করেছিল সফরের ভাগ্য। হোবলের কাছে সংরক্ষিত ভাগ্যনির্ধারক তির জানিয়ে দিয়েছিল— আবু লাহাবদের এ পর্বের সফর শুভ হতে চলেছে। শাইবার ইশারাটা ওই হোবল দেবতার দিকেই।

চারপাশে জোছনার মাখামাখি আলো, ঝোপ থেকে ভেসে আসা জংলি ফুলের সৌরভ আর নিশাচর পাখির উন্মত্ত ওড়াউড়ি— এসব তো শুভত্বেরই লক্ষণ। আবু লাহাবের ঠোঁটে অপার্থিব হাসি খেলে যায়। আয়েশি ঢঙে দাড়ি থেকে সফরের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে সে উতাইবার দিকে তাকায়। কালো পাগড়িতে ঢাকা উতাইবার বৃহৎ মস্তক উটের পদক্ষেপের তালে তালে মৃদু দুলছে। ছেলের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে যায় আবু লাহাবের বুক। তার এই ছেলে মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে যা করেছে, মক্কার কম লোকই করতে পেরেছে তা। মক্কায় ফিরে ছেলেকে তিনি পুরস্কৃত করবেন।

সামনে থেকে কাফেলার রাহবার চিৎকার করে— শামের বাজার এখনো তিন ক্রোশের পথ। উট জলদি হাঁকাও। অমনি সকলের মধ্যে চাঞ্চল্য তৈরি হয়। যেভাবেই হোক, সূর্যোদয়ের আগেই পৌঁছতে হবে গন্তব্যে। বাগদাদের এক বাণিজ্যবহর কাল সকালে শাম অতিক্রম করবে। আবু লাহাবদের কাফেলা যে কোনো মূল্যে বাগদাদি সওদাগরদের ধরতে চায়।

কাফেলার চাঞ্চল্য উতাইবার শরীর বা মন কোনোটাকেই স্পর্শ করে না। সে নির্জীব, নিশ্চল, বিষণ্ণ। তার কি প্রাক্তন স্ত্রী উম্মে কুলসুমের কথা মনে পড়ছে? আজকের উতাইবা এত বিষণ্ণ, এত নিশ্চল, এত নির্জীব, অথচ গত বছর সে যখন বাণিজ্য করতে বেরিয়েছিল, তার বুকের ভেতর ডানা ঝাপটাচ্ছিল এক জোড়া মায়াবী কবুতর। উম্মে কুলসুমের সাথে তার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল তখন। সেই সফরে বাগদত্তার জন্য বাবার অগোচরে ইয়াকুত পাথর বসানো একটি হার কিনেছিল সে। তার খুব ইচ্ছা করছিল— কোনো এক নারীর গলায় হারটি রেখে উম্মে কুলসুমের সৌন্দর্য কল্পনা করে। বাড়ি ফিরে হারটি সে ছোট বোনের হাতে দিয়ে বলেছিল, উম্মে কুলসুমের জন্য কিনেছি। দেখ তো কেমন!

চমৎকার! ভাবীর গলায় দারুণ মানাবে। তুমি আমার জন্য কিছু আনোনি?

তোর বিয়ে ঠিক হোক, তখন পাবি। বোনের চিবুক ধরে আদর ছড়িয়ে দিয়ে সে আবার বলেছিল, একটু পরবি? মেয়েদের কণ্ঠার সৌন্দর্যে কোনো প্রভেদ নেই।

হারটি নিয়ে উতাইবার কল্পবিলাসের শেষ ছিল না। তার উচাটন মন ব্যাবসা থেকে অবসর নিয়েছিল। নিজেকে সে প্রায়ই আবিষ্কার করত উম্মে কুলসুমদের বাড়ির চত্বরে। কাবার আঙিনা তার আনমনা অস্তিত্ব দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। কখনো হোবল দেবতাও এই পূজারির ফিসফিস শুনত— কল্যাণ হবে তো এই বিয়েতে?

মক্কার আকাশে রামধনুর সাতরং ছড়ানো বিয়ের দিনটির বিবসতা ভুলতে পারে না উতাইবা। বসন্তের সেই সৌরভময় সন্ধ্যা, যে সন্ধ্যায় কবুল বলে সে কিশোরী উম্মে কুলসুমকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিল, সেই মুহূর্তটি বিচ্ছেদের পরও তার চোখের সামনে রঙিন স্বপ্ন এঁকে যায়। নিবিড়তর ভাবনায় তার বুকের ভেতর কামারের হাতুড়িপেটা পড়ে— বাবার প্ররোচণায় সে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি তো!

পথের ওপর নুয়ে পড়া বৃক্ষশাখা অতিক্রম করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় উতাইবার উট। উতাইবার আচানক মনে হয়, পূর্ণিমার ঝলমলে চাঁদখানা বৃক্ষশাখার ভেতর থেকে একখণ্ড পাথর হয়ে গড়িয়ে পড়ছে তার গায়ের ওপর। হঠাৎ সে চিৎকার করে বলে— আমি বাঘের গন্ধ পাচ্ছি! আমি বাঘের গন্ধ পাচ্ছি! তার পরপরই উতাইবার উট এমন অদ্ভুত ধ্বনি তোলে কণ্ঠে, অমন ভয়ংকর শব্দ মনুষ্যজন্মে কেউ কোনোদিন শোনেনি।

ছেলেবেলায় একবার কালাজ্বর হয়েছিল উতাইবার। মায়ের যত্নে পরাস্ত হলেও জ্বরের সেই তিতকুটে স্মৃতি এখনো কলিজা খুবলায় তার। বহু বছর পর কালাজ্বরের সেই উত্তাপ ও কম্পন যেন আবার ফিরে আসে উতাইবার শরীরে। তার উত্তপ্ত শরীর গড়িয়ে পড়বে পড়বে মুহূর্তে প্রশিক্ষিত উট মায়ের ওড়নার মতো কোমল হয়ে বসে পড়ে পথের ওপর। ঠিক তখন বৃক্ষসারির ওপাশ থেকে ভেসে আসা ‘হালুম’ কাফেলার সকলকে স্তম্ভিত করে দেয়। জারকার এই প্রশস্ত পথ কত চেনা মক্কাবাসীর। প্রতি বছর অন্তত একবার হলেও জারকার ধুলোয় টাখনু ভেজে তাদের। কিন্তু এই পথে বাঘের হালুম কস্মিনকালেও শোনেনি তারা। তাদের পূর্বপুরুষ কি শুনেছিল কখনো?

প্রথম গর্জনের পর নেমে আসা স্তব্ধতা একটু পুরনো হয় দ্বিতীয় গর্জনের অপেক্ষায়। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সময়ের হিসাবের ভেতর দ্বিতীয় গর্জন অস্তিত্ব না পেলে কেউ কেউ ভাবে কানের ভুল। কেউবা আবার বর্তমানের বিপন্নতা পেরিয়ে পৌঁছে যায় ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কাছে—অনিরাপদ পথ, মক্কাবাসীর ব্যাবসার কী হবে!

শাইবা তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চিৎকার করে— এটা মনের বাঘ। আবু লাহাবের পুত্র আমাদের ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। উট হাঁকাও।

ততক্ষণে বাঘের শঙ্কা কেটে গেছে আবু লাহাবেরও। হয়তো এটা মনের বাঘই। তবে বাঘের শঙ্কা কাটলেও নতুন এক শঙ্কা রোমশ জিহ্বা মেলে সামনে দাঁড়ায়। বনের বাঘই যদি না হবে, তবে উতাইবার উট কেন থমকে আছে! আর উতাইবার মতো সাহসী ছেলে, তার চেহারায় কেন জীবননাশের বিপন্নতা! উম্মে কুলসুমকে তালাক দেয়ার পর ছেলের খারাপ মন ভালো করবার তৎপরতায় মায়ের পরামর্শে এই সফরে উতাইবাকে সঙ্গে এনেছে আবু লাহাব। ওর না আসার ভেতরেই কি কল্যাণ ছিল? হায় হোবল, একটিবার যদি ইশারা করতে অশুভত্বের!

আবু লাহাব নিজের উট থেকে নেমে ছুটে আসে পুত্রের উটের কাছে, যে উট উতাইবাকে পিঠে রেখেই বসে পড়েছে জারকার পথে।

উতাইবা! উতাইবা!

বাবা ডেকে চলে পুত্রকে। কিন্তু বাবার সম্বোধন কানে পশে না উতাইবার। সে তখন জিনে পাওয়া রোগীর মতো বিড়বিড় করছে— ওটা মুহাম্মাদের বাঘ! মুহাম্মাদ আমার পেছনে বাঘটাকে লেলিয়ে দিয়েছে। মুহাম্মাদ আমাকে খেয়ে ফেলবে। তোমরা আমাকে মক্কায় নিয়ে চলো।

আবু লাহাব পুত্রকে উট থেকে নামায়। পানির মশকের মুখ বাড়িয়ে ধরে পুত্রের ঠোঁটের কাছে। দূরের সেই নিশাচর পাখিটি এবার পরিভ্রমণ করে কাফেলার মাথার ওপর। মাঝে মাঝে মুখ নামিয়ে দেখে কাফেলার গতিবিধি। শাইবা ‘সামনে বাড়ো’ বললেও আবু লাহাবের পুত্রের দুর্দিনে কাফেলা স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। ধীরে ধীরে তারাও জড়ো হয় উতাইবার উটকে ঘিরে। অঘোষিত ফরমানে সকলে সিদ্ধান্ত নেয়— এ রাত জারকার ঝাউগাছের নিচে যাপন করবে তারা। বাগদাদি সওদাগারদের মোলাকাতের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাদের নিরাপত্তা।

উতাইবাকে নিয়ে যাদের আগ্রহ কম, সফরের ক্লান্তিতে তারা দ্রুত তাঁবু টাঙিয়ে ফেলে। আর যারা আবু লাহাবের ঘনিষ্ঠ, উতাইবাকে তারা সাহস জোগায়— অযথাই ভয় পাচ্ছ তুমি ইবনে আবি লাহাব। এখানে বাঘ আসবে কোত্থেকে!

মশকের পানি বক্ষ শীতল করলে ধাতস্থ হয় উতাইবা। নিজে নিজেই উটের পিঠ থেকে নেমে চারপাশে নজর বোলায় সে। চাঁদটাকে এবার মনে হয় অগ্নিগহ্বর। ওই গহ্বরের ভেতর পড়িমড়ি ঢুকছে পৃথিবীর সব মাতাল পতঙ্গ। নিজেকে নেশাতুর পতঙ্গ মনে হয় উতাইবার। যার শুধু ঝলসে যাওয়াই বাকি। ধীরে ধীরে সব মনে পড়ে তার। সেই না বলা কথা অথবা লানত, যা সে গর্ভধারিণী মায়ের কাছ থেকেও আড়াল করেছে, ঝাউবনের পাতার সরসর শব্দের ভেতর থেকে পূর্ণ বাক্য হয়ে ভেসে আসে তা। মুহাম্মাদ নতুন ধর্মমত প্রচারে ব্রতী হলে যে কয়জন তার সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করেছে, বাবা আবু লাহাব তাদের একজন। শত নিপীড়নের পরও মানুষটা আপন প্রতিজ্ঞা থেকে সরে না এলে আবু লাহাব ছেলের উদ্দেশে এক অদ্ভুত ফরমান জারি করে— উম্মে কুলসুমকে তালাক দিতে হবে। কারণ— মুহাম্মাদের নবি দাবির সত্যতা নিয়ে ধোঁয়াশা থাকতে পারে, কিন্তু তিনি যে একজন স্নেহময়ী বাবা, এ বিষয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই। এই স্নেহময়ী বাবার কোমল কলিজায় বিষের ছোবল বসাবার মোক্ষম উপায় একটাই— উম্মে কুলসুমকে পরিত্যাগ করা।

বাবার নবিবিদ্বেষের সহযোগী হওয়া ছাড়া তখন দ্বিতীয় কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিল না উতাইবার। উম্মে কুলসুম! হায় উম্মে কুলসুম! যাকে সে ভালোবেসেছিল প্রাণেরও অধিক, সেই ভালোবাসার মাঝখানে কাঁটার প্রাচীর তুলে দেয় ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার। উম্মে কুলসুম তখনো পিতৃগৃহ ছেড়ে শ্বশুরালয়ে গমন করেনি। এক সকালে কপালে দপদপে শিরা ভাসিয়ে শ্বশুরবাড়ি উপস্থিত হয় উতাইবা। চিৎকার করে জানিয়ে দেয় স্ত্রী পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত। না, এই তালাকের জন্য উম্মে কুলসুমের কোনো দায় নেই। উম্মে কুলসুম বড় ভালো মেয়ে। দায় তার বাবা মুহাম্মাদের। পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যবিরোধীর সঙ্গে আবু লাহাবের পরিবারের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না।

তালাক শব্দ উচ্চারিত হওয়ার পর ভেতর বাড়ি থেকে একটি আর্তনাদ ভেসে আসতে শুনেছিল কি না, আজ আর তা মনে পড়ে না উতাইবার। তবে সে যখন ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে সদ্য প্রাক্তন হয়ে ওঠা শ্বশুরের গলার চাদর টেনে ধরে বলেছিল, উম্মে কুলসুম না, তালাকের শাস্তিটা তোমার জন্য রেখে গেলাম, মুহাম্মাদ; তখন এই প্রাক্তন শ্বশুর তার কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে যা উচ্চারণ করেছিল, এবং যা সে গর্ভধারিণী মায়ের সাথেও ভাগাভাগি করেনি, এতদিন বাদে শাম থেকে তিন ক্রোশ দূরের এই জারকার ঝাউবনের পাশে যখন চারদিকে বাঘের শরীরের গন্ধ, যখন মাথার ওপর উড়ছে অদ্ভুদর্শী নিশাচর পাখি, যখন তার প্রিয় উটটি সামনে বাড়তে অস্বীকৃতি জানিয়ে বসে পড়েছে একটি মৃত বৃক্ষের মতো, তখন ঝাউবনের সরসরের ভেতর থেকে ভেসে আসা মুহাম্মাদের সেই ফিসফিস উচ্চারণ উতাইবার শরীর মৃত মাছের মতো ঠান্ডা বানিয়ে দেয় : হে আল্লাহ, তোমার বাঘের মধ্য থেকে একটি বাঘ উতাইবার জন্য নিযুক্ত করো।

আচানক উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশে বাঘ খুঁজতে লেগে যায় উতাইবা এবং বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে— ওটা মুহাম্মাদের বাঘ! ওটা মুহাম্মাদের বাঘ!

সফরসঙ্গীরা এবার সত্যি সত্যি বিরক্ত হয় উতাইবার ওপর। এমন জোয়ান ছেলের এমন মতিভ্রম তারা আশা করেনি। ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে যায় উতাইবার চারপাশ। জারকার ঝাউতলায় পটাপট তাঁবু পড়তে শুরু করে। রাত গভীর হচ্ছে। পুবের ঝলমলে চাঁদ মাথার উপর উঠে আসছে। কাফেলার এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ বিশ্রাম।

উতাইবা বাবার কাছে মিনতি জানায়— আমার ভয় করছে, বাবা। মনে হচ্ছে ঝাউগাছের ওপাশ থেকে হালুম করে বাঘ বেরিয়ে আসবে। চাকরদের বলো, আমার তাঁবুটা যেন সকল তাঁবুর মাঝে টাঙানো হয়।

আবু লাহাবের কপালের দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে। এরইমধ্যে কী এমন ঘটল যে তার সাহসী ছেলেটা শিশুদের মতো ভয় পাচ্ছে! সত্যিই কি বনের ওপাশে বাঘ আছে?

এত ভয় উতাইবার অথচ কাফেলার মধ্যমণী হয়ে তাঁবুর বিছানায় পিঠ ছোঁয়াতেই সে তলিয়ে যায় গভীর ঘুমে। আবু লাহাব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে— একটি মনোরম ঘুমই পারে ছেলেকে সুস্থ করতে। দেবতা হোবলের নাম জপতে জপতে সে শুয়ে পড়ে পাশের তাঁবুতে। রাত যখন গভীর হয়, যখন তাঁবুগুলো থেকে ঘুমন্ত মানুষের ভারী নিঃশ্বাস বই অন্য কিছু শোনা যায় না, যখন মাখন মাখানো রুটির মতো ঝলমলে চাঁদটা মেঘের আড়ালে হারিয়ে যায়, যখন উদ্‌ভ্রান্ত নিশাচর পাখিটি দ্রুত ডানা ঝাপটাতে থাকে, ঠিক তখনই ঝাউবনের ওপাশ থেকে বেরিয়ে আসে একটি রক্তমাংসের বাঘ। মাংসাশী ক্ষুধার্ত বাঘ, তার যে কোনো মানবশরীর পেলেই চলে, অথচ গুপ্তচরের মতো সন্তর্পণে কাকে যেন সে খুঁজতে থাকে। গুণে গুণে প্রত্যেকটা তাঁবুতে সে প্রবেশ করে, দাঁত দিয়ে মুখের ওপর থেকে চাদর সরায়, কাঙ্ক্ষিত শিকার না পেয়ে সে অন্য তাঁবু লক্ষ্য বানায়। যখন সে উতাইবার তাঁবুতে প্রবেশ করে, তার চোখ নক্ষত্রের মতো জ্বলে ওঠে। জিহ্বা বের করে সে চেটে নেয় তিরের ফলার মতো ধারালো গোঁফ-সহ ঠোঁট। দুই কদম এগিয়ে সে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখে নেয় পেছনের নিরাপত্তা। তারপর খুব আলগোছে, যেভাবে ঘুমন্ত শিশুর মুখ থেকে আলগা হয় মাতৃস্তন, উতাইবার মাথাটা তার শরীর থেকে আলাদা করে ফেলে। কসাইয়ের দোকান থেকে উচ্ছিষ্ট হাড্ডি মুখে নিয়ে কুকুর যেভাবে ত্যাগ করে লোকালয়, ঠিক একই ভঙ্গিতে উতাইবার মাথাটা মুখে নিয়ে সে হারিয়ে যায় ঝাউবনের আড়ালে।

সেই ভোরে সূর্যের আগে ঘুম ভাঙে না কারো। তাঁবুর ফোঁকর দিয়ে সূর্যের কিরণ আবু লাহাবের মুখের ওপর পড়লে তার ঘুম ভেঙে যায় এবং বাঘের ভয়-বিশিষ্ট রাতটা নিরাপদে কেটেছে দেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। লম্বা একটা হাই ছাড়তে গিয়ে তার মনে পড়ে ছেলে উতাইবার কথা। যে সূর্য মুখের ওপর কিরণ ছড়িয়ে তার ঘুম ভাঙিয়েছে, সেই সূর্য এতক্ষণে নিশ্চয় উতাইবার মুখেও কিরণ রেখেছে। আড়মোড়া ভেঙে উতাইবা উতাইবা ডাকতে ডাকতে সে ছেলের তাঁবুতে প্রবেশ করে। সে দেখে, সূর্যের মনোরম আলো পুত্রের বালিশের ওপর ফুলের মতো ফুটে আছে, কিন্তু বালিশে উতাইবার মাথা নেই। স্তম্ভিত বাবা ছেলের শরীর থেকে চাদর সরিয়ে দেখে—মাথা নেই তার ধড়েও।

 

৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
13 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Masum Billah Hamim
Masum Billah Hamim
1 year ago

যোগাযোগে এসেই শুরুতে খুঁজেছি ‘সাব্বির জাদিদ’ সাবের লেখা। সূচিপত্রে আগেই দেখেছিলাম উনার লেখা লানতের ব্যাপারটা। শুরুর দিকেই এটা পেয়ে গেলাম আর টপাটপ পড়ে নিলাম। পিতামহ বইটাও এমন টপাটপ গিলেছিলাম মনে পড়ছে এখন। ইতিহাস কোনোকালেই টানেনি আমাকে। অথচ ইতিহাস থেকেই লেখকের এইসব রচনা কী ভীষণ আঁকড়ে ধরে আমাকে। নির্বিঘ্নে, আনন্দচিত্তে পড়তে পারি। শেষমেশ ইতিহাসও জানা হয় কিছুমিছু। একদম মন্দ না। এমন লেখা আরো চাই।

মুহাম্মাদ হেদায়াতুল্লাহ
মুহাম্মাদ হেদায়াতুল্লাহ
Reply to  Masum Billah Hamim
1 year ago

অতি অসাধারণ একটা লেখা৷ যোগাযোগের সাথে সম্পৃক্ত সকলের কল্যাণ কামনা করছি৷ যোগাযোগ অব্যাহত থাকুক হাজার হাজার বছর৷

ফাতিমা পারভীন
ফাতিমা পারভীন
Reply to  Masum Billah Hamim
1 year ago

এক কথায় অসাধারণ মরুভূমির প্রকৃতির বর্ননা মন ছুয়ে গেল।

Mahmud
Mahmud
1 year ago

প্রিয় লেখকের লেখাটিই প্রথম পড়লাম ৷ কী চমৎকার!

Golam Rabbany
Golam Rabbany
1 year ago

ভালো লাগলো। সহজ। সুন্দর।

আমীরুল ইসলাম ফুআদ
আমীরুল ইসলাম ফুআদ
1 year ago

ভালো লাগলো গল্পটা।

কমল উদ্দিন
কমল উদ্দিন
1 year ago

গল্পটা অনেক ভালো লেগেছে। লেখকের লেখার সাথে প্রথম পরিচয় ঘটল। ❤️

Hassan khan
Hassan khan
1 year ago

মা’শা আল্লাহ, অনেক সুন্দর। ইতিহাসকে সাহিত্যের আঙ্গিনায় প্রতিভাত করার জন্য।

নকীব আব্দুল্লাহ
নকীব আব্দুল্লাহ
1 year ago

ভালো লাগলো।

Aman
Aman
1 year ago

বাহিরে এখন বৃষ্টি পড়ছে। টিনের ওপর শ্ব শ্ব শব্দ আর লেখা থেকে যেন তেমনি শ্ব শ্ব শব্দ করে ঝরে পড়ছিল প্রতিটি লাইন।

এক অনবদ্য গল্প পড়লাম।

নিশাচর পাখি
নিশাচর পাখি
1 year ago

বাইরে বৃষ্টিময় আকাশ। রাত বাজে সারে বারোটা। এখনো ঘরের দরজা খোলা। শীত শীত লাগছে শরীরে। এরই মধ্যে পড়ে শেষ করলাম গল্পটি। অসাধারণ লিখনী। মুগ্ধতায় ভরপুর।

Zaber Arefin
Zaber Arefin
1 year ago

অসাধারণ

নাঈমুল হাসান তানযীম
নাঈমুল হাসান তানযীম
1 year ago

সাব্বির জাদিদ ভাইয়ের গল্প মানেই ভিন্ন কিছু। মুখিয়ে থাকি পড়ার জন্য সবসময়। শুভেচ্ছা ভাইকে। 🤍

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷