রাবিয়া সাহিন ফুল্লরা’র এক গুচ্ছ কবিতা

রাবিয়া সাহিন ফুল্লরা

ফুলের মৌসুমে


~

আমাদের এত এত মিল 

তবু অমিলগুলাই কেবল চাড়া দিয়ে ওঠে।

লতালেঙ্গুরেরাও আম্রিকার মতন কেবল উনিকুনি খোঁজে।

বায় মুখে বসে থাকা সকাল আটটায়

ঝড়ের মুখে ক্লান্ত গাছগুলারে দেখে মনে হয়

এরাই আমার বাপ-ভাই।

খরপাতায় প্রজাপতি বসা এই ঝিমমারা রইদে

জুমার গোসল কোনদিন হলো না বলে

মিলাদের সুরে সুরে কেবল দুলেছি খানিক

ফুলের মৌসুমে

মাছি তাড়াতে গিয়ে

মানুষকে চেনার ভান করা যায় কেবল

চিনতে পারার তুমুল উত্তেজনায় হয়ত লেখা যায় দুয়েকটা পংক্তি

 দূরত্ব যত আপন লাগে তত মনে হয়,

মেহগনিফুলের মতন ঝরঝরে আজান 

যখন কানে বাজে

মসজিদে ঢুকতে না পারার মতন অসাধ্য হতে চাই নি আমি

পরিচয় লুকাতে না পারলে কারে দিব গালি?

 


জিওল মাছ


~

অন্ধকারে নড়তে থাকা পাতার মতন আম্মা—

যেন অনন্ত গর্ভকালে

দুনিয়ার সব চিন্তা মাথায় নিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন  হাওয়া।

অট্টিঅট্টি খেলার মতন সারাদিন ছক আঁকেন

আর শাড়িগুলা আলমারিতে তুলে তুলে রাখেন।

অথচ আব্বু যেন বইয়ের ভাঁজে নিজেরে গুঁজে রেখে

মাকড়সার খোসা হয়েও জালে আটকে বসে আছেন পৌরাণিক সুরভী মেখে।

যে গাছ যুগলগন্ধি ছিল তা কাটা হয়ে গেছে কত আগে।

শৈশব ধরে সব রাস্তা চলে গেছে নানুবাড়ি। 

এত বড় বাড়ি তবু একা—

বড়চাচী কলাগাছ হয়ে যেন দরদে—

এমনকি হাঁসের পালকে, মুরকার ডাকে  যেন ছড়ায়ে ছিটায়ে থাকেন আন্দাছান্দায়! 

মান্না সালওয়ার মতন সংসারের স্বাদ আর না পেলেও

পূর্বের অভিজ্ঞতায়

তবু কী যে রুটিনমাফিক ঘরের দরজা খুলে যায়!

দোয়াইঞ্জায় ঘুরতে থাকা বাতাসে যৌথজীবনের পর্দা নাচে।

মা-হারা ভেড়াটার ডাকে ডেঙ্গাআঙ্গি  কাঁপতে থাকলে লাগে যে,

প্রত্যেকের ভিতরেই আছে এক জিওল মাছ

 যেন ব্যাখ্যাতীত আলিফ লাম মীম!

 


রইদের আহাজারি


~

বৈশাখমায়্যা রইদের আহাজারি চোখেমুখে লেগে আছে যেন

যার দিকেই তাকাই—

পাখনা আলগা করা মুরকার মতন কপকপাচ্ছে সবাই।

জানি না কতদিন আর পানি টানবে হাজোরা খালায়!

পুকুরগুলা যেন লোদেহড়ে ছলছলায় হাঁসের ঠোঁটে।

দুইটা কলাপাখি শুকনা পাতার রঙে যেন মিশে আছে বিধবার বুকের পাড়ায়!

পাতা ঝরে গেলেও থামে নাই আগুনের পোড়ন।

যে ফুল অন্ধকারে ঝরি গেল

কিছু সুরভী কি তার রেখে দিল মন? 

একলা এক বেড়ে উঠা গাছ যেন বিরানভূমিতে

পাতা নাড়ে হাওয়ায়—

পিরীতি পোষে মনে যেরকম পাখিরা চঞ্চল—

ঘুমের ভিতরেও যারা ডাকে,

চায়—

আরো আরো গাছে যেন ভরে ওঠে জঙ্গল!

 


প্রিন্টের শাড়ি


~

বিষ্টির পরে এতটাই নরম হয়ে আছে মন

যেন ধান রোয়া যাবে এখন….

তোমারে ডাকার মতন স্বর জেঁকে আছে চাতকের গলায়।

মেঘ মেঘ করা এইসব দিনে

তোমার ঘুম হয়ে থেকে যাই আমি

ঘুম নাই যার জানলায় মুখ—

জানি না জন্ডিস হইছে কি না

চুনগলা পানিতে কখনো বামনী এসে ঘষলো না ত গা।

কত রছম যে আছে গেরামে—

বুবুরে,

হলুদ পানি কি কখনো গা বেয়ে নামবে না পায়ে?

দেশী মুরকা যেরকম বাড়ির কিনারেকানারে খুঁটে খুঁটে  বিছরাইতে থাকে আদার, আমিও তারে—

যেন জীবনটাই এক শবে কদরের রাইত। 

যেন আঙুলের কড়ে কড়ে বেজোড় অংকের ভিতরেই আমরা চক্কর মারতেছি।

অন্ধকার গায়ে মেখে 

আড়াআড়ি পার হয়ে যাইতে যাইতে কখন যে  একটা ধাড়ি বোনা হয়ে যায়—

যা বিছায়ে ব্যাঙের মতন বসে থাকা যায় উঠানে

যেখানে পানি জমে না বরং ছামারা ছড়ায়ে ছিটায়ে গায়ে জড়ায়ে থাকে—

যেন বুবুর গায়ে থাকা প্রিন্টের শাড়ি।

 


হুদহুদ পাখি


~

তোমার লগে 

কথা কইতে নিলে

ভিতরে এমন 

বাতাস বাতাস করে

আমার ইমোশানগুলা

গোলাপি গোলাপি 

অর্মতলের ফুলের মতন 

ঝরঝরায়ে পড়ে…

ঘনজঙ্গলে 

সন্ধ্যার মতন তুমি

আমি হুদহুদ পাখি এক

মিথ না কী! 

বুয়াজিদের মনে 

যেন শোক হয়েই থাকি…

 


মেহেদীর রঙ


~

চোখেমুখে এমন অন্ধকার—

তবু অসংখ্য তারা যেন বুলেটের মতন ফুটে আছে গায়ে

যেন চানরাইত, চাঁদ না দেখেও ঈদ আসে যেমন—

ঈদ ভেবে ভেবে

আইসক্রিমের মতন গলতে থাকা উত্তাপে

একটু কি হাসবো আমি?

একটু কান্দন—?

রইদ আর বিষ্টির মিশেলে যে ঝড় আসে জৈষ্ঠে তেমন—

ছুটাছুটি আর

উড়তে থাকা ওড়না বারবার তুলতে থাকা মাথায়

খোঁপা খুলে কে যেন মমতায়

শ্যাম্পুর ঘ্রাণ ছড়ালো কাঁঠালতলায়…

আম্মার ফোন বাজতে বাজতে সানাই হয়ে গেলো!

নতুন কাপড়ের ভাঁজ খুলতে খুলতে দেখি,

এমন ছলছল একটা মুখ

যেন কোলে কোন শিশু শুয়ে আছে! 

দুয়ারে বসে কে যেন মোড়া বানায়

গাইশ্যা ছোলে দরুদের সুরে

কুটুম পাখির ডাকে

আমতা বানায়ে তুলে তুলে রাখে

অচ্ছুৎ স্নেহেও বইনেরা—পাতার মত এমন ঘন হয়ে থাকে কাছে

ও খোদা! দূরে গেলেও ওরা মিশে থাকে যেন—

যেমন মিশে থাকে নখে মেহেদীর রঙ…

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷