রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষরা ছিলেন আরবীয়, এমনকি কুরাইশ বংশীয়—এমন বিতর্ক বাংলায় নতুন নয়। ছিলেন কি ছিলেন না—সেটা নিয়ে আলোচনা করবেন বংশবিদ্যাবিশারদগণ। তবে কুরাইশ বা আরব বংশীয় হওয়ার সঙ্গে আরবি ভাষা জানার প্রসঙ্গটি খানিকটা জড়িত। রবীন্দ্রনাথের আফ্রিকা কবিতা পড়তে গিয়ে আমরা তাই তার আরবি জ্ঞানবিষয়ক আলাপ তুলতে চাইলাম। রবীন্দ্রগবেষকগণ এই প্রশ্নের মীমাংসা নিয়ে হাজির হবেন নিশ্চয়।
আফ্রিকা কবিতা পাঠের মধ্যে দিয়ে একজন সাধারণ পাঠকের মনে ধারণা জন্মে, রবীন্দ্রনাথ আরবি জানতেন না। আরবি জানতেন বলেও এ যাবৎ কোনো বরীন্দ্রগবেষক দাবি করেননি। তার কোনো রচনা পাঠেও এই অনুমান তৈরি হয় না। বরং তার ভাষাতত্ত্ব ও শব্দতত্ত্ববিষয়ক প্রবন্ধ পাঠ করলে দেখা যায়, তিনি কতক আরবি শব্দকে ফারসি বলে অভিহিত করছেন। ফলে তার আরবি না জানার বিষয়টি একপ্রকার প্রতিষ্ঠিত।
কিন্তু কেন তার আরবি ভাষাজ্ঞান নিয়ে আমরা আপাত অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলাপ তুলতে যাচ্ছি? কারণ আফ্রিকার ইতিহাস ও সংস্কৃতির সাথে আরবি ভাষার যোগ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। অন্তত খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতক থেকে আফ্রিকায় আরবিভাষার ব্যবহার শুরু হওয়ার বিষয়টি লিখিতভাবে সংরক্ষিত ও স্বীকৃত। তারপর থেকে অদ্যাবধি আফ্রিকার প্রধান বা অন্যতম প্রধান ভাষা আরবি।
আফ্রিকায় আরবিভাষা প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশ করে আফ্রিকার বিশ্বায়ন ও উন্নয়ন। শিক্ষা, আবিষ্কার, তেজারত, তামাদ্দুনসহ প্রায় সব বিষয়ে আফ্রিকা সমানভাবে উন্নতি কারতে থাকে। আর প্রধানত আরবিভাষা হয়ে ওঠে এই রেঁনেসা ও উন্নয়নের মাধ্যম। আফ্রিকার জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা হতে থাকে আরবিভাষায়। বিশ্বের অপরাপর জনপদ ও ভাষার জ্ঞান অনূদিত হতে থাকে আরবিতে। বিশেষত আফ্রিকার ইতিহাস ও বিশ্বের ইতিহাস রচিত হতে থাকে আরবিভাষায়। খ্রিস্টীয় ষোলো বা সতেরো শতক পর্যন্ত এই ধারা প্রায় অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। কিন্তু ইউরোপীয় উপনিবেশ আফ্রিকায় ঘাঁটি গাড়লে এশিয়ার মতো আফ্রিকায়ও নিজস্ব ঐতিহ্য হুমকির মুখে পড়ে। রাষ্ট্রীয় ও উচ্চবিত্তের ভাষা বদলে সেখানে ইংরেজি ও ফরাশির আধিপত্য তৈরি হয়। মূলত ঔপনিবেশিক আমল থেকে আফ্রিকায় শুরু হয় ইংরেজি ও ফরাশির যুগ। বলা বাহুল্য, উপনিবেশের আগ পর্যন্ত আফ্রিকা ছিলো মুসলিমশাসিত। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে উপমহাদেশের মতো মুসলিম যুগের সমাপ্তি এবং খ্রিষ্টীয় যুগের সূচনা হয়।
তখন থেকে আফ্রিকার ইতিহাস লেখা হতে থাকে ইংরেজ ও ফরাশিদের হাতে। শাসক যখন শাসিতের ইতিহাস লেখে, বলা ভালো, অত্যাচারীর হাতে যখন নিপীড়িতের ইতিহাস লেখা হয়, তখন ইতিহাসের বয়ান তৈরি হয় জালেমের হুকুমে। ভারত ও বাংলার ইতিহাস পাঠের ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা, আফ্রিকায় তার কোনো ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয় না। ফলে বাংলা ও ভারতের প্রাচীন ইতিহাস জানার জন্য আমাদের যেমন ফারসির দ্বারস্থ হতে হয় এবং ফারসি ছাড়া ভিন্ন কোনো গত্যন্তর থাকে না, আফ্রিকার প্রাগৈতিহাসিক ও প্রকৃত ইতিহাসের প্রাচীন বিবরণ জানার জন্যও আরবির কোনো বিকল্প নেই।
সহজেই অনুমান করা যায়, রবীন্দ্রনাথের আফ্রিকা বিষয়ক ইতিহাসজ্ঞানের একমাত্র সোর্স ছিলো ইংরেজি, ইউরোপীয় ইতিহাস। আরবি জানা থাকলে এবং আরবি মাধ্যম থেকে আফ্রিকার ইতিহাস পাঠের সুযোগ থাকলে হয়তো রবীন্দ্রনাথের আফ্রিকা কবিতার বয়ান ও বক্তব্য ভিন্ন বা বিপরীত হতো। কেন?
আফ্রিকা কবিতায় রবীন্দ্রনাথ আফ্রিকাকে একটি পশ্চাদপদ, নির্যাতিত এবং বঞ্চিত জনপদ ও জাতিসত্তার ভূমি হিসেবে চিত্রিত করেন। আফ্রিকার দাস-বাণিজ্যের জন্য দায়ী করেন শাদা চামড়ার ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীদের বা দাসব্যবসায়ীদের। ইতিহাসের এই অংশটুকু যেহেতেু আধুনিক কালের, ফলে এক্ষেত্রে অসত্যতা পরিলিক্ষিত হয় না। কিন্তু যখন তিনি কবিতায় আফ্রিকার ইতিহাস বলতে গিয়ে আদিম আফ্রিকা থেকে হঠাৎ ঔপনিবেশিক আফ্রিকায় চলে আসেন, তখন মধ্যবর্তী সময়ের ইতিহাস গুমড়ে কেঁদে ওঠে, কথা বলতে চায়। এবং এখানেই রবীন্দ্রনাথ ইউরোপীয় জ্ঞানতাত্ত্বিক সাম্রাজ্যবাদের শিকারে পরিণত হন। আফ্রিকার দুর্দশার জন্য যে ইউরোপকে কবি কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন, সে ইউরোপের দাঁড় করানো ইতিহাসই কবিকে আফ্রিকার ইতিহাসের জ্ঞান বিতরণ করে। ইউরোপ কি আফ্রিকায় শুধু অর্থনৈতিক আগ্রাসন চালিয়েছে? শুধু আফ্রিকানদের দাস বানিয়ে বন্দি করেছে? শাদা চামড়ার দাসব্যবসায়ীরা কি আফ্রিকার তৎকালীন শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলো ধ্বংস করেনি? আফ্রিকার ইতিহাসের গৌরবজনক অধ্যায়কে অন্ধকারাচ্ছন্ন বা অন্ধকার যুগ বলে চিত্রিত করেনি? যেভাবে কলঙ্কিত করেছে মুসলিম ভারত ও বাংলার ইতিহাসকে। ইউরোপের হাতে লেখা আফ্রিকার ইতিহাস আফ্রিকাকে আদৌ সত্যিকারভাবে তুলে ধরবে? গোটা বিশ্বে ইউরোপ এই নজির কোথাও স্থাপন করতে পারেনি। এশিয়া ও মুসলিম স্পেনের মতো আফ্রিকার জ্ঞান-বিজ্ঞান কি ইউরোপ আত্তীকরণ করেনি? পুনঃরচনার মধ্য দিয়ে বর্বর আফ্রিকার সভ্য ত্রাণকর্তা এবং অন্ধকার আফ্রিকার আলোর ত্রাতা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেনি? জালিম ইউরোপের হাতে যখন মাজলুম আফ্রিকার ইতিহাস রচিত হয়, সেখানে আফ্রিকার স্বর্ণযুগের ইতিহাস থাকে না। স্বর্ণের ঔজ্জ্বল্য সেখানে হয়ে যায় অন্ধকারের কলঙ্ক। সোনালি যুগকে আখ্যায়িত করা হয় অন্ধকার যুগ হিসেব।
ইংরেজি সোর্স থেকে সেই ইতিহাস পড়ে বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ যখন আফ্রিকা কবিতায় আফ্রিকার ইতিহাস তুলে ধরেন, তখন তিনিও ইউরোপের জ্ঞানতাত্ত্বিক সন্ত্রাসের দ্বারা আক্রান্ত হন। ইউরোপসৃষ্ট ইতিহাসের সত্যায়ন করার মধ্য দিয়ে আফ্রিকার ইতিহাস তথা আফ্রিকার বিপক্ষে বা শত্রুপক্ষে গিয়ে দাড়ান বিশ্বকবি। রবীন্দ্রনাথ লেখেন :
হায় ছায়াবৃতা,
কালো ঘোমটার নীচে
অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ
উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।
এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে
নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে,
এল মানুষ-ধরার দল
গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।
বরীন্দ্রনাথ জানতেন না, ইউরোপ আসার আগে আফ্রিকা মোটেও সভ্যতার আলোবর্জিত কালো ঘোমটায় আবৃত ছিলো না, আফ্রিকার মানবরূপ মোটেও অপরিচিত ছিলো না, এমনকি আফ্রিকা পৃথিবীর ইতিহাসে উপেক্ষিতও ছিল না। এ সকল বৈশিষ্ট আফ্রিকায় বিরাজিত ছিলো ঈসায়ি সপ্তম শতাব্দীর আগে। সপ্তম থেকে ষষ্ঠদশ খিস্টীয় শতাব্দী পর্যন্ত আফ্রিকার ইতিহাস ছিল সমৃদ্ধির, গৌরবের, জ্ঞানের, বিজ্ঞানের, ইউরোপের সাথে সমানে সমানে বাণিজ্যের।
কিন্তু ইউরোপ আফ্রিকার এই সুবর্ণ যুগকে কালো কালি দিয়ে আড়াল করেছে। আদিম আফ্রিকার ইতিহাসকে ঔপনিবেশিক আমল পর্যন্ত টেনে প্রলম্বিত করেছে এবং নিজেরা হয়েছে আফ্রিকায় সভ্যতার আলো বিতরণকারী দাতা ও ত্রাতা। রবীন্দ্রনাথ ইতিহাসের এই কালপঞ্জিগত বয়ান কবিতায় তুলে ধরে এক ঐতিহাসিক গলতি করে ফেললেন অজ্ঞানতায়। কারণ আফ্রিকার স্বর্ণযুগের ইতিহাস সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত ছিলেন না। কারণ সেসব লিখিত হয়েছিলো প্রধানত আরবিভাষায়। ইউরোপীয়রা আফ্রিকার স্বর্ণ, হিরা, মানুষ, হাতির দাঁত, হরিণের শিং, বাদাম, তুলা, বাঘের চামড়া ইত্যাদির সাথে সেসব পাণ্ডুলিপিও হস্তগত করেছে। এবং এখনও আফ্রিকার অতীতসমৃদ্ধ অঞ্চল থেকে কোটি কোটি ইউরো-ডলার খরচ করে তা সংগ্রহ করে যাচ্ছে। কারণটি এক কথায় চমৎকার করে বলেছে আমেরিকার কংগ্রেস লাইবেরি :
Libraries in Timbuktu continue the tradition of the families who established them by preserving and making available these valuable works, which until recently were unknown outside Mali. Scholars in the fields of Islamic studies and African studies are awed by the wealth of information that these manuscripts provide. Indeed, the use of these works by scholars will likely result in rewriting Islamic, West African, and world history.
আফ্রিকার সেসব পাণ্ডুলিপির পাঠোধ্যার করতে পারলে পৃথিবীর ইতিহাস হয়তো নতুন করে লেখা হবে। তখন রবীন্দ্রনাথের আফ্রিকা কবিতা কি সংশোধিত হবে না অসত্যাশ্রিত বলে পরিত্যাজ্য?