যে ক্বাসিদায় জেগে উঠতো পুরান ঢাকা

বাশিরুল আমিন

মাহে রমজান এলেই পুরান ঢাকার তরুণদের মধ্যে একটা উৎসবের আমেজ বয়ে যেত। পাড়ায় পাড়ায় ক্বাসিদার দল গঠন হতো। সালারে কাফেলার নেতৃত্বে গঠন করা হতো আট-দশজনের ছোট ছোট দল। নামি শায়েরের কাছ থেকে লিখে আনা হতো নতুন নতুন ক্বাসিদা। ক্বাসিদা গেয়ে রোজাদারদের জাগানো তরুণদের একটা বিশেষ দায়িত্ব ছিল। শুধু রোজাদারদের জাগানোই ক্বাসিদার দল গঠনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না, পাড়ায় পাড়ায় অনুষ্ঠিত হতো ক্বাসিদা প্রতিযোগিতাও। এসবের সাথে জড়িয়ে থাকতো পাড়া-মহল্লার শান-শওকতও। তাছাড়া তারাবির নামাজের পর থেকে সেহরি পর্যন্ত জেগে থাকার একটা উপলক্ষও ছিল এসব ক্বাসিদা, যা সবার মধ্যে উৎসবের আনন্দ বিলিয়ে দিতো।

হেকিম হেবিবুর রহমান তাঁর বিখ্যাতগ্রন্থ ঢাকা পাঁচাস বারাস পহলেতে উল্লেখ করেছেন—তারাবির নামাজের পর প্রবীণরা বাসায় ফিরলেও তরুণরা ফিরত না, তারা জেগে থাকত। বড় বড় বনেদি পরিবারগুলোর কাচারি ঘরে রাতে মানুষের জমায়েত হতো। সেখানে কাওয়ালি-ক্বাসিদা ইত্যাদির আয়োজন হতো। বিশিষ্ট শিল্পপতি আনোয়ার হোসেন তাঁর স্মৃতিকথা আমার আট দশক-এ দল গঠন করে রমজানে পাড়ায় পাড়ায় ক্বাসিদা গাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি জানান—রমজান মাস শুরুর আগেই ক্বাসিদার দল গঠন ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণের জন্য তোড়জোড় বেড়ে যেত। তারা নিজেরাও প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন।

কারো গলায় হারমোনিয়াম, কারো হাতে লন্ঠন আর কারো হাতে করতাল। সেহরির সময় হলে এভাবেই তরুণদের ছোট ছোট দল বের হতো তাদের সালারের নেতৃত্বে। দরাজ গলায় তারা গাইতেন—‘রোজাদারো দিলদারো, আল্লাহকে পিয়ারো/সের্গেই কা ওয়াক্ত হো গায়া হ্যায়, উঠিয়ে…’। কিংবা ‘ওঠ ওঠ মমিন সেহরির সময় নাই/ আমরা ক্বাসিদাওয়ালা/ যাই ডেকে যাই…।

ঢাকা জেলার লোক সংস্কৃতি গ্রন্থে আমিনুর রহমান সুলতান লিখেছেন—‘সেহরির সময় ঢাকাবাসী রাস্তার মোড়ে বা গলিতে দাঁড়িয়ে থাকত ক্বাসিদা দলকে দেখার জন্য। শিশু, নারী-পুরুষ সবাই এদের জন্য অপেক্ষা করত। ক্বাসিদা দলকে মিষ্টি, হালুয়া, খেজুর উপহার দেওয়া হতো। আবার অনেকে শিল্পীদের সেহরি করাতেন। অনেকেই আবার বাড়িতে শিল্পীদের নিয়ে ক্বাসিদা আসরের আয়োজন করতেন।’

ঈদের চাঁদ উঠলে ক্বাসিদার দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঈদের ক্বাসিদা শুনাতেন, তখন সারা মাস সেহরিতে জাগানোর জন্য তাদেরকে বিভিন্ন নজরানা দেওয়া হতো। অন্দর থেকে মহিলারা বিভিন্ন উপঢৌকন পাঠাতেন। পরে সেসব সালারে কাফেলা বা দলনেতা সবার মধ্যে ভাগ করে দিতেন।

ক্বাসিদা শব্দটির উৎপত্তি আরবি থেকে। যে কোনো আরবি গীতি কবিতাকেই ক্বাসিদা বলা হয়। হয়রত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময়ের আগে থেকেই আরবে নানা ধরনের ক্বাসিদার প্রচলন ছিল। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে রচিত বিখ্যাত ক্বাসিদায়ে বুরদার কথা কমবেশি সবারই জানা। তবে মোগল আমলে প্রশংসামূলক বিশেষ কবিতাকেই সাধারণত ক্বাসিদার সম্মান দেওয়া হতো। আমাদের অঞ্চলে ক্বাসিদা সংস্কৃতির আগমন ঘটে মোগলদের হাত ধরেই। তারা ফার্সিতেই ক্বাসিদা রচনা করতেন। নবাবদের আমলে এসে উর্দুতেও ক্বাসিদা রচনা শুরু হয়। বলা চলে, পুরান ঢাকায় রমজানকেন্দ্রিক যে ক্বাসিদা সংস্কৃতির প্রসার লাভ করে এর পেছনে বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ঢাকার নবাবরা। ‘ঢাকা কোষ’ গ্রন্থটি এমন-ই সাক্ষ্য দেয়। কারণ নবাব আহসানউল্লাহ নিজেও ক্বাসিদা রচনা করতেন। ‘কুল্লিয়াতে শাহিন’ নামে তাঁর একটি ক্বাসিদা সংকলনও ছিল।

তবে ক্বাসিদার জনপ্রিয় যে উর্দু ধারা সেটার ব্যাপক চর্চা শুরু হয় বিশ শতকের শুরুর দিকে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের ঢাকা : স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে—‘১৯৪৭-এর পর উর্দুভাষী মোহাজেররা ঢাকায় এসে ক্বাসিদায় নতুন মাত্রা যোগ করেন…।’

দেশভাগের পরবর্তী সময়ের ক্বাসিদাগুলো ছিল মূলত উর্দু, হিন্দি ও পুরান ঢাকার মিশ্রভাষায়। সত্তুরের দশক থেকে বাংলা ক্বাসিদাও ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে ক্বাসিদায় সুরারোপের ক্ষেত্রে প্রাচীন কালের রাগ দরবারি কানাড়া, নটভৈরব কিংবা ভৈঁরো খুব জনপ্রিয় ছিল। হিন্দি সিনেমার গানের অনুকরণে কিংবা বিখ্যাত গজলের অনুকরণেও অনেক ক্বাসিদা রচিত হয়েছে। এসব ক্বাসিদার শাস্ত্রীয় কোনো স্থান না থাকলেও মান ধরে রাখতে বা প্রতিযোগিতার বিচারকার্যের সুবিধার্থে কিছু বিষয়কে মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হতো। সেগুলো হলো—ক. মিইয়ারে কালাম বা কথা ও বাক্যের মান, খ. তালাফ্ফুজ বা উচ্চারণভঙ্গি গ. তারান্নুম বা সুর ও লয়। এর বাইরেও ক্বাসিদা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে ‘আদাবে মেহফিল’ বা আসরের আদব কায়দাকেও ক্বাসিদার একটা অনুসঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এ বিষয়গুলি নির্মাতা অনার্য মুর্শিদ তাঁর এওয়ার্ড বিজয়ী প্রামাণ্যচিত্র ‘ক্বাসিদা অব ঢাকা’-তে দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

রমজানের সময়কালকে ভাগ করে তিন ধরনের ক্বাসিদার চর্চা হতো— 

ক. চানরাতি বা আমাদি ক্বাসিদা : পবিত্র মাহে রমজানকে স্বাগত জানিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হতো এসব ক্বাসিদায়। সেই সাথে আল্লাহর রহমতের বর্ণনা, তাঁর গুণকীর্তন ও রাসুলের প্রশংসা করা হতো। চানরাতি আমাদের একটি উদাহারণ হতে পারে শাহ মুহাম্মদ সমীর হোসেন কাওয়ালের কথা ও সুরে—‘খোশ নাসিবি আমাদের জীবনে/মাহে রমজান আবার এসেছে/ রোজাদারদের জন্য এই মাসে/সব বেহেস্তি দরওয়াজা খুলেছে…’

প্রথম রমজান থেকে দশম রমজান পর্যন্ত চলত আমাদি ক্বাসিদা। তবে কোনো কোনো গবেষক বলেছেন চানরাতি বা আমাদি ক্বাসিদা গাওয়া হতো পাঁচ রমজান পর্যন্ত।

খ. খোশ আমদিদ : এ ধরনের ক্বাসিদা গাওয়া হতো পাঁচ বা দশ রমজান থেকে নিয়ে পনেরো বা বিশ রমজান পর্যন্ত। এসব ক্বাসিদার অধিকাংশই স্তুতি ও প্রশংসামূলক ছিল। এ ধরনের ক্বাসিদায় থাক রোজার ফজিলত, রোজা রাখার সওয়াব ও উৎসাহমূলক পঙ্‌ক্তি। এসব ক্বাসিদার অন্য আরেকটি নাম ছিল ‘সদা’। খোশ আমদিদ বাংলা ক্বাসিদাগুলো এমন ছিল—‘এলোরে দেখো ঐ মাহে রমজান/জাগোরে মুসলমান/ জাগো মুসলিম, জাগোরে মুসলমান/এলো মাহে রমজান…’।

গ. আল বিদা : রমজানের শেষ দশকের জন্য নির্ধারিত ক্বাসিদা আল বিদা। রমজান চলে যাওয়ার আফসোস ও বিদায়ী সুর বেজে উঠত ক্বাসিদা গায়কদের কণ্ঠে। এসব ক্বাসিদায় যাকাত ফিতরা ও দান খয়রাত করার কথাও থাকত। তারা গাইতেন—তিরিশ রোজা কায়েম করো/পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ো/দান খয়রাত ফিতরা যাকাত/দাও বিলিয়ে মুসলমান’।

একুশ রমজান থেকে একেক পাড়ায় একেক দিন আয়োজন হতো ক্বাসিদা প্রতিযোগিতার। বিভিন্ন পঞ্চায়েত বা সামাজিক সংগঠন এসব প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। এসব প্রতিযোগিতায় টাকাপয়সা তেমন একটা দেওয়া হতো না তবে মেডেল থাকতো। মূলত এক মহল্লার ক্বাসিদার দলের সাথেই অন্য মহল্লার ক্বাসিদার দলে প্রতিযোগিতাটা হতো। আর বিজয়ীরা সারা বছরের জন্য পেতেন সম্মান গর্ব করার মতো একটা উপলক্ষ্য।

ক্বাসিদা কেবল ঘুম ভাঙানিয়া ডাক ছিল না। ক্বাসিদায় ছিল তরুণদের জেগে থাকার আনন্দ, গভীর রাতে অন্দরের ফাঁক গলে কৌতূহলী কিশোরীর চাহনি, বাবা-মার আপত্তি সত্ত্বেও জেগে উঠা উৎসুক শিশুর আনন্দ। ক্বাসিদার মাধ্যমে রমজানের ঢাকাকে জাগিয়ে রাখতেন গায়করা। আনন্দ বিলিয়ে দিতেন অলিতেগলিতে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আশীর্বাদে সেহরিতে ডাকার জন্য এখন হয়তো আর ক্বাসিদার প্রয়োজন নেই, যুবকদেরও জেগে থাকার জন্য আছে নানা অনুসঙ্গ। কিন্তু সেই আনন্দ বিহ্বলতার দিনগুলো আমরা হারিয়ে এসেছি; যা আর ফিরবে না কোনোদিন।

 

সূত্র :

১. ঢাকা : পাঁচাস বারাস পহলে, হেকিম হেবিবুর রহমান

২. ঢাকা : স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন

৩. উৎসবের ঢাকা, সাদ উর রহমান

৪. ঢাকা জেলার লোক সংস্কৃতি, আমিনুর রহমান সুলতান

৫. অনার্য মুর্শিদের প্রামাণ্যচিত্র ক্বাসিদা অব ঢাকা

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
আতাউল্লাহ মাহমুদ
আতাউল্লাহ মাহমুদ
9 months ago

মন মুগ্ধকর

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷