মেকানিজম

সালমান সাদিক

অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার চিন্তাফিকির ও আজকালের নানাবিধ সমস্যা নিয়ে ব্যাখ্য-বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমি স্বাভাবিক জীবন যাপনের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছি। কয়েকটা বিষয় আমার জীবনকে দিনদিন দুর্বিষহ ও অসাস্থ্যকর যাপনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রথমত আমি দীর্ঘদিন একাকি একটি ছোট্ট খুপরিতে বন্দি ছিলাম এবং প্রাত্যহিক শারীরিক নিপীড়নের শিকার হওয়া আমার জন্য রুটিনে পরিণত হয়েছিল, যদিও তিনবেলা খাবারের স্বাভাবিক নিয়ম সেই সময়ে ছিল না। বন্দি হওয়ার আগে আমার জীবনে কী কী ছিল, কেমন ছিল সে জীবন; তা আমার এখন খুব একটা স্মরণ নাই। একটি প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ের মতো বিক্ষুব্ধ জনতার বিপ্লব আমাকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিয়েছে, এটা সত্য। তবে আমি ওই সার্কাসের শেকলে বেঁধে রাখা হাতিটার মতোই মানসিক বন্দিত্ব থেকে এখনো বের হতে পারিনি।

মাঝেমধ্যেই আমি গভীর রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠি। আজগুবি সব দুঃস্বপ্ন দেখি ঘুমের ভিতর আর ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর এমন অস্থিরতা কাজ করতে থাকে যে, সারারাত আর ঘুমাতে পারি না। রাতে যখন আর ঘুম আসে না তখন নানাবিধ চিন্তা, বিভিন্ন ঘটনা আমার মাথায় ঘুরে বেড়ায়। সমাজে নীতি-নৈতিকতার অধঃপতন, রাজনৈতিক বিভিন্ন কার্যকলাপ আর মতাদর্শগত নানান দ্বন্দ্বে আমি রীতিমতো খেই হারিয়ে ফেলি। তবে আমি বন্দি থাকাকালীন শিখেছিলাম, কীভাবে একটা ছোট্ট জানালা দিয়ে সমস্ত কিছু পর্যবেক্ষণ করে বিশ্লেষণ দাঁড় করানো যায়। কিন্তু এই ব্যাপারটাও দিনদিন কেমন জানি উলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। 

এই ব্যাপারটা, অর্থাৎ আমার চিন্তা ও বিশ্লেষণের পদ্ধতিটা বিক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ হতে পারে এই ঘুম কম হওয়া। সারারাত জেগে জেগে এটা-সেটা ভাবতে গেলে একটা বিষয়ে আর ফোকাস রাখা যায় না। নানারকম বিষয় একসাথে মাথার ভিতর ঘুরতে ঘুরতে দলা পাকায় যায়। সর্বশেষ মনে হয় মহামারি নিয়ে একটা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছিলাম। যখন আমি এই বিশ্লেষণ প্রকল্পে ঢুকে যাই তখন থেকেই আমার নিজের প্রতি খেয়াল হারাতে থাকি। একের পর এক নিয়ম ভেঙে যায়। 

আমার মনে পড়ে একটা ইঁদুরের কথা। ইঁদুরটা ছিলো নার্সিসিস্ট। শুধুমাত্র তার খাবার, তার আরাম আয়েশ ও নিজস্ব জগৎকে সে সবকিছুর উপর প্রাধান্য দিত। তার সাথে আমার বেশ বড় একটা সময় কেটেছে। কখনো সে আমার কথা ভাবেনি, আমার দিকটা বিবেচনায় আনেনি। আমি না খেয়ে বা অর্ধেক খেয়ে রুটিটা তাকে দিয়েছি। সে কখনো ভাবেনি যে, আমি এইটুকুন খেয়ে বা একেবারেই না খেয়ে কীভাবে দিনটা পার করব। বা যে ছোট্ট খুপরিতে আমাকে থাকতে হয়েছে সেখানে এমন বিস্তর পরিসর ছিল না যে, আমি নিজে আমার দেহটা এপাশ ওপাশ করতে পারব বা সটান শুতে পারব। এতকিছুর পরেও আমি এই খুপরিতে ইঁদুরটাকে থাকতে দিয়েছি। কিন্তু সে কখনো বিবেচনা করেনি যে, এইটুকুন জায়গায় তাকে স্থান দিতে আমার পক্ষ থেকে কী পরিমাণ ত্যাগ করতে হয়েছে। এমনকি ইঁদুরটি মৃত্যুর সময়েও আমার কথা ভাবেনি। আমি জানি না সে ভেবেছে কি না। তবে সে মরে গেল এক স্যাঁতস্যাঁতে রাতে নির্জনে, এতটুকু আওয়াজও করেনি বা বেদম পেটুনির পর আমার ঘুম এতটাই গাঢ় ছিল যে, আমি বুঝতেই পারিনি যে, সে মারা যাচ্ছে। 

আমি যেটা বুঝাতে চাচ্ছি, এই ইঁদুরটা সেই সময়ে আমাকে এই নসিহা দিল। মানে নিজেকে নিয়েই বাঁচো, কে কী করল, সমাজের কী হলো বা রাষ্ট্র কীভাবে কারে চুদে গেল; এসব নিয়ে ভেবে নিজেকে হারায়ো না। কিন্তু সেই খুপরির শিক্ষা আমার এখনকার জীবনে খুব একটা কাজে লাগছে না। প্রথমদিকে আমি শুধু ভিডিও গেমসের ভিতরে ডুবে থাকলেও যখন থেকে আমার সাথে আর দশজনের আলাপ হচ্ছে, যখন বাইরে আমি ওভারব্রিজের পিলারে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সম্বলিত পোস্টার দেখছি কিংবা শহরতলির সরকারি হাসপাতালে রোগীদের লাইনে দাঁড়িয়ে মহামারি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছি তখন থেকেই আমার ব্যক্তিকেন্দ্রিক জগতের নানা আয়োজন, নানা পরিকল্পনা ভেঙে যাচ্ছে।

আমার মনে পড়ে একসময় আমি ধ্বংস চাইতাম। কওমে লুতের উপর খোদার বিচারের প্রক্রিয়া আমাকে আন্দোলিত করেছে কখনো। কখনো আমি রেগে গেছি, শুধুমাত্র কুত্তাদের পিছনে রাষ্ট্রের একটা বিরাট রাজস্ব ব্যয়ের বাজেট দেখে। কিন্তু যখন চূড়ান্ত মুহূর্ত এলো—যদিও পুরো ব্যাপারটাই আমি পরে জেনেছি—সবকিছু যখন জ্বলতে থাকল এবং মানুষের পায়ের নিচে পিপড়াদের পিষ্ট হওয়ার মতো অনিবার্য মৃত্যু সমাসন্ন হলো তখন আসলে সবকিছু ঠিক ঠিক ঘটল, ধ্বংস হলো, মৃত্যু হলো অগুনতি প্রাণের, কিন্তু তথাপি কি সবকিছু নতুন করে শুরু হয়েছে!

আমি ভাবতে বাধ্য হয়েছি যে, ধ্বংস, প্রচণ্ড আক্রমণ, ক্ষোভ ও দ্রোহের পরেও আসলে সমস্ত কিছুর সমাধা সম্ভব নয়। আমার চিন্তা-চেতনায় তখন বৌদ্ধিক পরিবর্তন ঘটে। আমি ভাবি সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চরম ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনে যদি প্রতিটা ব্যক্তি অভ্যস্ত হয়ে যায় তাহলে অন্যায় ও জুলুমের প্রতি এক ধরনের ব্যঙ্গ দেখানো হয়। সেই জায়গা থেকে, অর্থাৎ উপেক্ষা ও ব্যঙ্গ থেকে মানুষের চিন্তাচেতনায় এইসবকিছু আর প্রভাব ফেলে না। 

পরে যখন ব্যাপারটা নিয়ে আমি কোনো এক গভীর রাতে ভাবতে থাকি তখন এই ভাবনাটা নিজেই আমাকে বেকুব বানায় দেয়। এই ভাবনা যেমন মানুষের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের সম্পূর্ণ বিপরীত তেমনিভাবেই সুফাস্তাইয়্যা চিন্তাচেতনার মতোই ব্যাপারটা সবকিছুকে রূপক ও কল্পনা বানায় দেয়। মানে, কেউ যদি তার উপর হওয়া অনাচারকে উপেক্ষা করে এবং এই মানসিকতা তৈয়ার করে যে, আমার চিন্তা-চেতনায় আমি ছাড়া আর কিছুর স্থান নাই; তাহলে কি সেই অনাচারটা বাস্তব অস্তিত্ব হারায়!

আমি দিশেহারা হয়ে ভাবি এই সমস্ত চিন্তার পরিবর্তন আমাকে আসলে কই নিয়ে যাচ্ছে। আমার বন্দি জীবনের আগে আমি কেমন ছিলাম বা তখনও কি আমি এমনই আত্মবিভ্রাটে দোদুল্যমান ছিলাম! আমার যদ্দূর মনে পড়ে—যদিও মনে পড়ার ব্যাপারটা একরকম ধারণাই—সেই সময়ে আমাকে আটক করার মূল কারণ ছিল কোনো আদর্শিক চিন্তায় আমার দৃঢ় অবস্থান এবং নীতি-নৈতিকতায় এতটাই তীব্র ছিলাম যে শেষ পর্যন্ত কোনোকিছু না পেয়ে তারা আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উপস্থাপন করে যে, আমি না কি তরোয়াল নিয়ে সংসদে আক্রমণের প্লান করছি।

তাহলে এখন আমার এই দোদুল্যমান অবস্থা কেন! আমি কেন কোনোকিছুতে স্থির হতে পারছি না! ব্যাপারটার দায় আমি আমার বিস্মৃতির উপর চাপিয়েছি। কিন্তু এর ফলে তো আমার করণীয় কিছু নাই হয়ে যায় না, যেহেতু ওই বৌদ্ধিক চিন্তা থেকে আমাকে সরে আসতে হয়েছে এবং একান্ত আমাকে নিয়ে জগৎ নির্মাণে আমি ব্যর্থ হয়েছি।

জীবনে নানাবিধ অনিয়ম ও মানসিক ভারসাম্যহীনতা আমাকে ভঙ্গুর ব্যক্তিতে পরিণত করেছে। না আমার শারীরিক সক্ষমতা আছে, না মানসিকভাবে আমি ঠিকঠাক আছি। আমি এমন একটা জায়গায় এসে উপস্থিত হয়েছি, যেখানে একটা ভেড়ার পালের ভেড়ার মতোই একজনের ইশারায় আমাকে ডানে বামে ঘুরতে হচ্ছে। কেউ যদি এসে বলে তোমার উপর তারা যে জুলুম করেছে রাষ্ট্র তার বিচার করবে, আমি আশাবাদী হই, রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা জেগে ওঠে। তারপরে কেউ এসে যদি বলে এই সরকার তো ওদের মতোই, যেমন ওরা একটা সেতুর জন্য একশটা লাশ ফেলে দিয়েছে তেমনি এরা-ও তো কয়েকটা কুত্তার জন্য তোমার আমার আয় করা টাকার উপর কর বসিয়েছে তখন আমি বীতশ্রদ্ধ হই, ঘৃণা ও ক্ষোভ নিয়ে ইন্টারনেটে খুঁজি রাষ্ট্রকে কর না দেওয়ার নানান উপায় ও একান্তই যদি কর দেওয়া লাগে তাহলে রাষ্ট্র থেকে তা ছিনিয়ে আনার নানান তরিকা। ইন্টারনেট তখন নানাবিধ মোরালিটির সবক দেয় এবং আমি এক অর্থহীন তর্কে জড়িয়ে পড়ি।

এখান থেকে আমাকে বেরিয়ে আসতে হবে, এটাই আমার একমাত্র পরিকল্পনা হয়ে ওঠে। নানারকম মজলিশ, হালাকা আর মানুষের সাথে আমি চলতে শুরু করি। নিজেকে ব্যস্ত করতে চাই। যেমন জীবিকার তাড়না, তেমনই অবসর থেকে নিজেকে মুক্ত করা; এ দুয়ের মধ্য দিয়ে আমি আমার মনস্তত্ত্বের উপর নিজের দখল প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হই। নানারকম মানুষ আমাকে বলেছে স্ট্রেস কমাতে সিগ্রেট খাও। অনেক সময় আমি দেখেছি নানারকম মানসিক চাপ ও শোকে মানুষ সিগ্রেট খাচ্ছে। আমিও খেলাম। কিন্তু এতে করে চাপ কমলো না। অদ্ভুত ব্যাপার হলো সিগ্রেট খেতে খেতে আমার নানাবিধ যাতনা আরো প্রগাঢ় হচ্ছে আর আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে। 

আমি ওই সময়ে নানাবিধ সঙ্গীতের মজলিশে হাশিশের আমন্ত্রণ পাই। অনেকেই বলে এটা মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। কিন্তু ব্যাপারটা আমার কাছে উদ্ভট লাগল, যে কিছু পাতা পুড়ালেই যদি মানসিক প্রশান্তি আসে তাহলে এটাকে কেন সর্বোতভাবে ছড়ায় দেওয়া হচ্ছে না! এটা যদিও একটা গড়পড়তা ভাবনা, তাই আমিও হাশিশ নিলাম এবং পরবর্তীতে আরো নানান কীর্তিকলাপে অংশ নিলাম। কিন্তু এগুলি আমাকে বিরাট একটা ময়দানে এদিক থেকে ওদিক নিলো। 

এ সমস্ত মজলিশে সঙ্গীতের পাশাপাশি নানা তাত্ত্বিক আলাপের প্রচলন ছিলত। কেউ বলল আত্মিক প্রশান্তির জন্য ধ্যানের প্রয়োজন আছে। তখন আরেকজন বলল, ধ্যান হইল এটা যে তুমি রিশকা চালাইতেছো, তুমি ইট মারতেছো যখন তোমারে বুলেট মারা হইতেছে। আরেকজন সমাজতাত্ত্বিক সুফি বলে উঠল, সঙ্গীত, লোকঐতিহ্য এগুলি হইলো মানসিক প্রশান্তি ও স্থিতি তৈয়ার করে। সমাজে যখন একের ধারণা কায়েম হইবো, যখন সকলে মিল্যা একক একটা শক্তি হইবো তখন সমস্যাগুলির সমাধান হইবো। 

এগুলি আলাপ উঠলেই নানান তর্ক উঠে। এসব অনর্থক তর্কে আমিও জড়ায়ে যাই। মানসিক প্রশান্তি বলি আর মানসিক ভারসাম্যই বলি; দুইটাই আমার বাধাগ্রস্ত হয় এ সমস্ত মজলিশে। যখন রাত করে বাসায় ফিরি আর ঘুম আসে না নানান চিন্তা ধোয়ার মত মিলেমিশে মিলিয়ে যায় আর আসে, আমি কিছুই ধরতে পারি না, বুঝতেও পারি না। কিন্তু মেজাজ গরম থাকে, স্নায়ু চঞ্চল থাকে, ফলে অনিদ্রা আমার সাস্থ্যের উপর দখল লাভ করে।

এরকম নতুন নতুন সব অভিজ্ঞতা আমার অভ্যাসকে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করতে থাকে। আমি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাই এবং নানান অনর্থক কাজে এমন কিছু খুঁজি যেটা আমি হারিয়েছি। এমনই এক সকালে দীর্ঘদিন বাদে ফজরের পর আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি। আমার গতরাতে ঘুম হয়নি ফলে শরীরটা ভীষণ হালকা লাগছিল। আমি দেখলাম কয়েকজন রিক্সাওয়ালা ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী চায়ের ভিতর রুটি ভিজিয়ে খাচ্ছে। আমি সেখানে গেলাম সিগ্রেট খেতে। 

তারা আলাপ করছিলত দেশ নিয়ে এবং নানা দলের নানা রাজনীতি ও নীত-নৈতিকতা নিয়ে। মজার বিষয় তাদের এইসব আলাপে ওই সমস্ত বুদ্ধিজীবীদের মতন দিশেহারা হুলুস্থুল নাই। তারা বলছে, ওই খানকি চোদায় তো গোয়া মাইরা দিল! সবাই ব্যাপারটা নিয়ে হাসল এবং চায়ের সাথে রুটি ভিজিয়ে খেতে থাকল। ব্যাপারটা অদ্ভুত, কারণ যখন কোনো খানকি চোদা কারো গোয়া মেরে দেয় তখন বুদ্ধিজীবীরা নানান তরিকায় সেই গোয়া মারার ফজিলত নিয়ে প্যাচাল পাড়তে শুরু করে। কিন্তু এখানে সেইসব ফজিলত নাই। বাস্তব যে ব্যাপারটা, মানে গোয়া যে মারছে শুধু এটাই আছে। আর তাদের কথা বা ভঙ্গি থেকে বুঝা যাচ্ছে এটা ঠিক না বেঠিক। এর ফলে কোনো দ্বিধা নাই।

আমি আশ্চর্য হলাম এবং তাদের কার্যক্রম, তাদের আলাপ ইত্যাদি খুব খেয়াল করতে থাকলাম। দেখলাম, তারা সবাই সারাদিন পরিশ্রম করছে। তাদের সাস্থ্য, দেহের গড়ন এতটাই নিরেট ও গাঢ় যে এখানে কোনো দুর্বলতা নাই। তারা তাদের দেহের দুই থেকে তিন গুণ ওজন টেনে চলেছে একাধারে। প্রতিটি টান, প্রতিটি প্যাডেল তাদের থেকে এমনভাবে সমস্ত কিছু নিংড়ে বের করছে যে, এরপর দেহে আর কোনো খেয়ালের সুযোগ থাকে না। খেয়াল মানে সমস্ত মানসিক ও চিত্তগত জটিলতা থেকে তাদের মুক্তি মিলছে যেন!

আমি আরো কয়েকটা বিষয় যোগবিয়োগ করতে থাকি। যেমন সমাজতাত্ত্বিক সুফি আর অন্যান্য বুদ্ধিজীবী ও নানান কিসিমের মানুষ; যারা প্রশান্তি খুঁজে বেড়ায় ধ্যান নেশা আর অনর্থক আলাপের সিলসিলায়। দেখলাম এই সমস্ত ব্যাপারগুলি শুধুমাত্র খেয়ালি দিকগুলিকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। যারা এই সমস্ত খেয়ালি কাজেই লিপ্ত তাদের কোনো কায়িক পরিশ্রম নাই, জীবিকা বলি বা শোগল বলি; আসলে তাদের এমন কিছুই নাই যা তাদের দেহ ও মনের সমস্ত বিষ নিংড়ে বের করে আনবে। ফলে আমি যতই তাদের সাথে মিশি না কেন, না আমার অভ্যাসে কোনো উন্নতি আসবে আর না আমি আমার সমস্ত কিছুতে দৃঢ়তা ও প্রগাঢ় স্থিতি পাব। 

আমার মনে এই ব্যাপারে ঈমান আসতে থাকে যে, যদি আমি পরিশ্রম করি, ঘাম ঝরাই আর আমার শরীরকে এমনভাবে দৃঢ় ও মজবুত করে তুলতে পারি তাহলে আমার মানসিক অবস্থা ও অভ্যাসের আমূল পরিবর্তন সম্ভব। শুধুমাত্র ঘরের কোণে বসে গেমস খেলা, নেশা সঙ্গীত ও দর্শন চর্চা কখনোই মানসিক স্থিতি আনবে না। সুতরাং আমার দেহকে এতটাই দৃঢ় করে গড়ে তোলা দরকার, যার ফলে তা আমার ভিতরের সমস্তকিছু এমনভাবে গড়তে সহায়তা করবে যে, কোনো আঘাত, কোনো প্রভাব বা মত ও পন্থা আমাকে আর অস্থির করবে না। কোনো ঘটনা বা বিশ্লেষণ আমাকে টলাবে না। আমি তখন হব একটা মজবুত পর্বত, যাকে হয়তো ভেঙে ফেলা যায়, কিন্তু তার অবস্থান থেকে সরানো সম্ভব হয় না। 

আমি ধিরে ধিরে সমস্ত অভ্যাস ও মজলিশ ত্যাগ করতে থাকি। আমি এখন ফজরের পর রিক্সা নিয়ে বের হই। সারাদিন রিক্সা চালাই। আমার আহারে দারুণ পরিবর্তন এসেছে। আমি এখন প্রতিবেলায় দুইজন মানুষের সমান খাই আর শরীরটা এমন লাগে যেন এটা হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে। এমন অবস্থায় আসতে আসতে প্রায় দুই থেকে তিন মাস পার হয়ে গেছে। এখন কোনো কিছু আমাকে বিচলিত করে না। যখন প্রশ্ন আসে রাষ্ট্র যদি আবার জুলুমের হাত প্রশস্ত করে তাহলে কী হবে? আমি আমার মনে এমন বল অনুভব করি যে, আসুক না কোন মাদারচোদ এই দুই হাতের মুঠির সামনে কে দাঁড়াতে পারবে!

আমি রিক্সা চালাই এবং পড়াশোনা করতে থাকি। এমন একটা সময়ে আমি উপনীত হই যখন আমার সামনে আমার স্মৃতিগুলি নতুনরূপে ফিরে ফিরে আসতে চায়। কিন্তু সেগুলিকে আবার কে যেন জোর করে আড়াল করে ফেলে। যেন আমার মস্তিষ্কের ভিতর কেউ এমন কোনো এলগরিদম বা মেকানিজম সেট করে দিয়েছে, যেটা আমাকে আমার পুরাতন পরিচয়ের কাছে যেতে দিচ্ছে না। 

নানাবিধ চেষ্টা তদবির আমাকে নতুনভাবে গড়ে তুলেছে। এখন আমি চাইলেই বসতে পারি আবার চাইলে দাঁড়াতেও পারি। কিন্তু আমি বসিও না আবার দাঁড়াইও না। আমার মনে হয় আমি এটা চাই না বা চাইতে পারছি না। আমি নিজে যে মেকানিজম নতুন করে গড়ে তুলেছি, প্রতিটা প্যাডেল, দুই থেকে তিনগুণ ওজন বয়ে নিয়ে যাওয়া এসবকিছু যেটাকে গড়ে তুলেছে তার সামনে আরেকটা মেকানিজম। এগুলি পুরাতন, যা চায় না নতুন কিছু তাকে চ্যালেঞ্জ করুক। এটা আমি বুঝতে পারি এখন।

আমি এক সন্ধ্যায় ঘন বর্ষায় চা খাচ্ছিলাম একজন রাজনীতিবিদ ও একজন সমাজতাত্ত্বিক দাবি করা সুফির সাথে। তারা আমাকে বুঝাতে চাচ্ছে, তারা সবকিছু বুঝে গেছে। তারা বাস্তবতাটা ধরে ফেলেছে আর যার ফলে তারা চাইলে এটা পরিবর্তন করতে পারবে। আমি তাদেরকে বললাম আনফাংশনাল এই মেকানিজমের কথা। বাস্তবতা যে বড়ই কঠিন ও অদ্ভুত এটা তারা বুঝতে রাজি না। আমিও বলতে থাকি যে, হ্যাঁ এটা আমি মেনে নেইনি অবশ্যই নাহলে দেখ তোমাদের থেকে তিনগুণ সক্ষমতা এখন আমার আছে। কিন্তু এটা এমন একটা মেকানিজম যেটা দুটা লোহাকে এমনভাবে জুড়ে দিবে যে, একটা আরেকটায় বাড়ি দিতে থাকবে কিন্তু না তারা জোড়া লাগবে, না তারা ভেঙে যাবে। 

ঘন বর্ষায় চায়ে এক চুমুক দিতে দিতেই আবার কাপে সেই পরিমাণ পানি ভরে যাচ্ছে। এভাবে অনেকক্ষণ চা খাই আর আলাপ করি। দীর্ঘদিন পর এই আলাপ করতে ভালোই লাগছে। এমন সময়ে এই সরু বেঞ্চটায় এসে দুইজন বসে। একজন অতিরিক্ত মোটা হওয়ায় আরেকজন তাকে বলছে, ভাই বসতে অসুবিধা হচ্ছে না তো? সে বলে, হেহ হে ভাই আমরা হইলাম এমন; বসতে কইলে বসি দাঁড়াইতে কইলে দাঁড়াই আমগো কোনো প্রবলেম নাই। হেহ হে দাড়ি নাই বইলা কি আমরা মোসলমান না!

রাজনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিক দাবি করা সেই সুফি তখনো বাস্তবতা পরিবর্তনের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে আর আমি ভাবছি এই মোটা লোকটার কথাটাই কি সমস্ত কিছুর মীমাংসা করে দেয় না! মানে এটাই তো সেই মেকানিজম, যার ফলে তোমার দেহ যত দৃঢ় হোক আর তা তোমার মনকে এই পরিমাণ মজবুতই করুক না কেন, যে তুমি পুরা একটা রাষ্ট্রকে দুই মুঠির সামনে আসার চ্যালেঞ্জ করতে পারছো; কী এসে যায়?

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷