মুহিম মাহফুজ এর কবিতা শরিফ

মুহিম মাহফুজ

পরম বেদনাবান

হৃদয় হইলো কাচের টুকরা-

তাকালেই নিজের চেহারা ভাইসা ওঠে
কিন্তু পৃথিবী- তার উপরে ছুঁইড়া মারে ধুলা
ধারালো খামছি দিয়া বসায়া দেয় নখের আঁচড়
আঁচড়ে আঁচড়ে কাচের উপর কলঙ্ক পইড়া গেলে
আমার চেহারা আমিই দেখতে পাই না।
পৃথিবীর পর্দা আমারে ঢাইকা দেয়।

কলঙ্কিত দিলের ভিতর আমি আটকা পইড়া যাই

আমি যেনো বন্ধ কূপে আটকে পড়া শিশু ইউসুফ
অন্ধ পিতা আমার গন্ধমাখা জামা হাতে কানতেছে
প্রাচীন দেয়াল থিকা আমার আওয়াজ ফিরা আসে
কেউ আমারে তুইলা নিতে আসে না।

নিজেরে না দেইখা আমি অস্থির হইতে থাকি
হৃদয়ের সেই ক্ষত চেহারায় উইঠা আসতে থাকে
আমি দুই হাতে বারবার মুখ মুছি
ভিজা কাপড়ে ঘইষা তুলতে চাই চেহারার দাগ
আমার হাত অসার হয়া আসে-দাগ মোছে না।
দিলের দুয়ার খুইলা আমি আমারে বাইর করতে পারি না।

আমি তখন আল্লাহ আল্লাহ বইলা কাইন্দা দেই
কান্নার পানি গালের উপর দিয়া গড়ায়া পরে।

আমি আরো জোরে কানতে থাকি
আরো কান্নার পানি ফোঁটায় ফোঁটায় পড়তে থাকে
আল্লাহর নামে আস্তে আস্তে হৃদয়ের কাচ সাদা হয়-
আটকে পড়া আমারে আমি সামান্য দেখতে পাই।

আমি তখন নবিজিরে মনে করি-
মুহাম্মাদ বলার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের প্রতিটি পশম কাঁইপাা ওঠে
পশমের গোড়া থিকা ফিনকি দিয়া আসতে থাকে কান্না
আমার হৃৎপিণ্ড ধরফর ধরফর করে
মক্কার মরুভূমির মতো আমার গলা শুকায়া আসে
কমজোর উচ্চারণে জিহ্বা ডাকতে থাকে- মুহাম্মাদ মুহাম্মাদ
আর মুখের ভেতর ছড়ায়া পড়তে থাকে মধু মধু মধু
চোখ দিয়া বৃষ্টির মতো পড়তে থাকে কলিজার কলকল পানি
অনবরত দুরুদ নিঃসীম নৈঃশব্দে আমার সঙ্গী হয়।

নবিজির নাম দিলের কলঙ্ক মুইছা দেয়।
আমার হৃদয় আরো সাদা হইতে থাকে

আমি একটু একটু কইরা আমারে দেখতে পাই
দিলের দুয়ার খুইলা যাইতে থাকে।
আটকে পড়া আমারে আমি বাইর কইরা আনি।

হৃদয়ের দাগ বিলকুল মুইছা গেলে
পৃথিবীর ফাঁদ আমি ধইরা ফেলতে পারি-

পৃথিবী এক নষ্ট জাদুর দেশ
হৃদয়ের কাছ থেকে আমি তারে দূরে রাখি
আমি তারে সন্দেহ করি নিঃশর্ত।

.

শুক্রবারের রোদেরা

গোল চত্বর থেকে আমরা ডান দিকে যাবো

যেখানে সন্ধ্যার পর মৃদুমন্দ অন্ধকার নেমে আসে

এবং তলোয়ারের মতো চকচকে দুপুর;

যখন আজানের আওয়াজ পাখির মতো উড়তে উড়তে উজ্জ্বল রোদ হয়ে যায়

আমরা তখন রাস্তা পার হয়ে ডান দিকে যাই।

পেছনে হাঁটতে হাঁটতে দেখি

আমাকে সামনে নিয়ে যাচ্ছেন একজন শুভ্রদাঁড়ির ফেরেশতা;

তার ধবধবে প্রবীণ আলখেল্লা নুরানী আগুনের মতো ধীরে ধীরে আমাকে এগিয়ে নেন মারকাজ মসজিদের দিকে।

প্রতিটি শুক্রবার আতরের গন্ধমাখা রুমালে মোড়ানো থাকে।

প্রতিটি শুক্রবার পুরোনো দালানের মতো সুগভীর নিমগ্ন থাকে।

আমরা রোদের ময়দান অতিক্রম করে শুক্রবারের বুকের ভেতরে ঢুকে পড়লে

প্রবীণ ফেরেশতা আমাকে নিয়ে বসান-

যেখানে অলৌকিক উচ্চতা নিয়ে মেহরাব অকম্পমান।

দ্বিতীয় কাতারের নীরবতা আমাকে আচ্ছন্ন করে দিলে

স্বপ্নের ভেতর থেকে আমি দেখি

আলোর রেহাল হাতে প্রবীণ ফেরেশতা আবৃত্তি করেন-

শাহরু রমাদন, আল্লাজি উনঝিলা ফিহিল কুরআন।

জুমার তাজাল্লি ঠিকরে পড়ে দাঁড়ানো খুতবা থেকে।

প্রতিটি রুকু

নিমজ্জিত সিজদা

এবং সুস্বাদু তাসবিহ আমি পান করি আকণ্ঠ

মুনাজাতে উচ্চারিত ‘আমিন’ ‘আমিন’ হাউসে কাউসারের মতো আমার ইফতারের তৃপ্তি।

ডান হাতে আমি জুতা সোজা করে দিলে

প্রবীণ ফেরেশতা স্নীগ্ধ নেমে আসেন।

গোল চতুর অতিক্রম করে আমরা হাঁটি।

শুক্রবারের পাখিরা আকাশে গান গায়।

শুক্রবারের রোদেরা বাতাসে গন্ধ ছড়াতে থাকে।

সেসব নেককার সময় শরীরে মেখে বিদায়ী সম্ভাষণ এলে

ধবধবে আলখেল্লা আমাকে বলেন, আসসালামু আলাইক।

.

নির্নামাজ সকালের নালিশ

ফজরের ফরজ আমাকে বড় লজ্জায় ফেলে দেয়

দুটি মাত্র রাকাতের শক্তির কাছে কেমন নরোম হয়ে নেমে আসে সূর্যের প্রতাপ।

মাঝে মধ্যে ফাল্গুনের নাতিষীতোষ্ণ বাতাসের আদর নিদ্রায় নিহত করে দিলে

শয্যার কবর থেকে আমি ধরফরিয়ে জেগে উঠে দেখি-

থেমে থেমে কার্নিশের বাসা থেকে ডাকছে ঘরচড়ুইয়ের গেরস্থ গৃহিনী;

শষ্যের সন্ধানে তার পুরুষ তখন চষে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর ক্ষেতখামার

আর আমি পৌরুষের পাপ তুলে ফেলতে বারবার মুখ মুছি;

চোখ কচলাই।

পাখিনীর কাছে শরমিন্দা হয়ে শুরু হওয়া এমন প্রতিটি সকালে মনে পড়ে আমার মায়ের হাত;

আমার নিজস্ব নারীর শাষণ।

জান্নাতবাসী জননীর মতো আমার স্ত্রী প্রতিদিন পাখিদের আগে জেগে ওঠে, আমাকে জাগায়।

এই বিষন্ন শহরের নিঃসঙ্গ রাত্রী শেষে

আমাকে কে জাগিয়ে তুলবে দিনরাত্রীর কালসন্ধিক্ষণে ?

ফেরেশতারা যখন ঐশ্বর্যের তশতরি নিয়ে

কাতার ধরে নেমে আসে মানুষের জাগরণে স্বাগত জানাতে!

নগরের ইট-পাথরের শরীর মানুষের লজ্জা লুকোনোর কোমল কৌশল এখনো রপ্ত করতে শেখেনি।

শুষে নিতে পুরুষের সমস্ত শরম নিজস্ব নারীরাই দিগন্তের শেষ ঠিকানা।

খসখসে দালানগুলো বেশরম পুরুশের মতো বেপর্দা দাঁড়িয়ে থাকে

তার পেটের ভেতর কম্পিত হাতে আমি সালাতের মুসাল্লা পাতি

জানলা দিয়ে রোদ এসে বিদ্রুপের ভঙ্গিতে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়

আমি পাতালে কপাল ঠেকিয়ে উবু হই, কাবু হই

নারী ও নামাজের জন্য দহনে হৃদয় দাহ্য হয়ে গেলে

নির্নামাজ সকালের নালিশ জানিয়ে বলি-

মাবুদ, নিদ্রা নারী ও নিবেদনে আমাদের ঘর আবাদ হোক।

আমাদের পিঠে ভেসে উঠুক নাজাতের রক্তিম মোহর।

.

আল আকসায়

ইতিহাস সাক্ষী, কোনো কালেই আমরা সংখ্যায় আস্থা রাখিনি

আমাদের বিশ্বাস ছিল এমন এক শক্তির ওপর,

সংখ্যা যে শক্তির সংকল্পের অধীন এক মরিচীকা মাত্র

আমরা সংখ্যার শক্তি অতিক্রম করেছি বদরে

আমরা জেনেছি, কত ক্ষুদ্র সংখ্যা বৃহৎ সংখ্যাকে পরাজিত করেছে আল্লাহর ইচ্ছায়

সংখ্যার আধিক্যে নয়, আমরা এককে আস্থাবান

বিশ্ব জগতের প্রতিটি বস্তু ও ব্যক্তিকে, জীব ও জড়কে সাক্ষী রেখে আমরা ঘোষণা করেছি-

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ

আমরা এমন এক শক্তির কাছে সমর্পণ করেছি আমাদের সমস্ত সত্ত- যার কোন সংখ্যা নেই, শরিক নেই

তিনিই সকল সংখ্যার যোগাত্মক বা বিয়োগাত্মক শরিকানার স্রষ্টা, তিনি অসংখ্যেয়

আমরা তাই ক্ষুদ্র সংখ্যা নিয়ে আক্রমণে উদ্ধত হই গাজায়

আমাদের সংখ্যার স্বল্পতাই সীমাহীন শক্তি হয়ে

অসংখ্য শত্রুকে কুপোকাত করে তেল আবিবে, ওয়াশিংটনে, ব্রিটেনে, প্যারিসে, বার্লিনে…

কুদসের নামে কসম করে আমাদের প্রতিটি শিশু পৃথিবীতে পা রাখে

আমরা বাঁচার জন্য জন্ম নিতে শিখবো কেনো?

শহীদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, এ কোন নতুন কথা নয়

সন্তানের জন্য আমরা রেখে যাই শাহাদাতের উত্তরাধিকার

আল্লাহর সঙ্গে আমাদের সওদা হয়ে গেছে

সমকালের বিনিময়ে আমরা কিনেছি অনন্ত মহাকাল

যেখানে সমাপ্ত করেছিলেন হজরত ওমর

আমরা তারপর থেকে শুরু করতে চাই

যে মিম্বারে দাঁড়িয়ে খুতবা দিয়েছিলেন আইয়ুবী

আমরা তার সামনে নতজানু বসতে চাই

আমরা জিয়ারত করতে চাই ইহুদিদের হাতে শহিদ হওয়া

চার হাজার নবীদের নুরানি কবর, আমাদের পিতারা যেখানে ঘুমিয়ে আছে

সেখানে যেতে আমরা কোনো বাঁধাকে পরোয়া করি না

তাদের কবর থেকে এখনো গড়িয়ে পড়ছে রক্তের সুগদ্ধ

আতরের বদলে সে গন্ধ কাফনে মেখে আমরা চাই-

আমাদের জানাজা হোক আল-আকসার জাইতুন চত্বরে।

.

যেনো বাংলায় জন্মাই

এই যে আমার সন্ত্রস্ত ভিটেবাড়ি

তিন দিকে ঘন ঝোপঝার- শ্বাপদসংকূল

সামনে আমার তৃষ্ণার নুন দেয়া নীল জল- আমার মুক্তির সীমানা

এই যে আমার নান্দনিক কুঁড়েঘর-খুনসুটির শহর ঢাকা

কোলেপিঠে করে বেঁচে থাকা আমাদের ভাইবোন

কাঁথার সিলির মতো এঁটে থাকা প্রতিটি জীবন

পৃথিবীর আর কোথায় কে আমাকে দেবে অমন সুখের সংসার?

তৃপ্তির ঢেঁকুর কোথায় তুলব আমি জননী মৃত্তিকা তোমার আঁচল ফেলে?

কোথায় পাব এমন নিখাদ খাঁটি সবুজ?

আমার অমন প্রাণের পতাকার মান কে বুঝতে পারে?

ঝাঁট দেওয়া উঠোনের কোণে ঝরাপাতা জমেছে জমুক

শর্ষে ফুলের অমন মায়াবী আগুন ফেলে

দোয়েলের কবিতা উপেক্ষা করে সাত জন্মে আমি কোথাও পারি না যেতে

শৈশবের কোমল কাদা আর ঝাকার কুমড়ো ফুলের সরল বারণ-

আমি কোথাও যাব না। আমাকে দেবে না যেতে গাঙপাড়ের মাছরাঙা, সিঁদুরমাখা পলাশ আর প্রতিবাদী কৃষ্ণচূড়া।

তাই প্রতিটি ভোরের কাছে প্রার্থনা আমার

জানুক মাটির প্রতিটি কণিকা

বটের পাতায় জড়িয়ে শরীর কয়েদির কাতারে দাঁড়িয়ে বলি-

যদি আবার জীবন পাই

যেন বাংলায় জন্মাই

 

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷