আমি হেঁটে চলেছি আমার পূর্ব-পুরুষের পদচিহ্ন ধরে। তাদের পদছাপ কোথাও স্বর্ণালী কোথাও বা রক্তাভ, কোথাও হয়ে গেছে বিস্মৃত। পরিচিত পদচিহ্ন ধরে সেইসব বিস্মৃত ইতিহাস খুঁজে ফেরাই আমার ব্রত। চর্চিত নাম ও ইতিহাসের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়া গল্পগুলো বের করে আনাই আমার কাজ।
এবার আমি যাবো বাংলার ভূইঁয়াদের অন্যতম নেতা মুসা খাঁর কবর জিয়ারতে, এবং তৎসংলগ্ন মসজিদে। মুসা খাঁকে বুঝতে হলে আমাদের প্রথমে জানতে হবে বারো ভূঁইয়া ব্যাপারটা কী…
মোঘল সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীরের সময়কালে বাংলায় যারা মোঘলবিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তাদের বলা হয় বারো ভূঁইয়া। বারো ভূঁইয়াগণ কোন রাজপরিবারের বংশধর ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন জমিদার বা জমির মালিক এবং দেশপ্রেমিক। অদম্য সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে তাঁরা দীর্ঘ তিন যুগ ধরে মোঘল আগ্রাসন প্রতিহত করেছিলেন। ১৬১২ সালের পর মোঘল সেনাপতি ইসলাম খান তাঁদেরকে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করেন। মুসা খাঁর বাবা ছিলেন ভাটি অঞ্চলের অধিপতি স্বাধীন বারো ভূঁইয়ার প্রধান মসনদ-ই-আলা ঈসা খাঁ। বাবার মৃত্যুর পর তিনি মসনদে বসেছিলেন। বাবার মতোই মোঘলদের সাথে লড়াই করেন মুসা খাঁ। তবে চৌকস মোঘল সেনাপতি ইসলাম খানের সাথে আর পেরে উঠেননি।
মুসা খাঁ ইসলাম খানের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হন, এবং বন্দী হন। তবে ইসলাম খান মুসা খাঁর প্রতি সদয় আচরণ করেছিলেন। ১৬২৩ সালে মৃত্যুবরণ করা মুসা খাঁ সমাহিত হন বাগ-ই-মুসা খাঁ’তে। হাকিম হাবিবুর রহমানের মতে তার কবরের পাশে যে মসজিদটি আছে সেটি মুসা খাঁর তৈরি। তবে আহমেদ হাসান দানীর মতে মসজিদটি তৈরি করেছিলেন মুসা খাঁর পৌত্র দিওয়ান মুনাওয়ার খান।
সেইদিনের বাগ-এ-মুসা খাঁ আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল প্রাঙ্গন । একদিন ক্লাস শেষ করে একা একা হাঁটতে হাঁটতে গেলাম মুসা খাঁর কবর খুঁজতে। গুগল ম্যাপ ধরে এগোতে হচ্ছিল বলে নিজেই লজ্জা পেলাম। নিজের ক্যাম্পাসে ইতিহাসের অন্যতম এক চরিত্রের কবর, কিন্তু সেটা খুঁজতে আমাকে আশ্রয় নিতে হচ্ছে গুগলের…কার্জন হলের পেছনে শহীদুল্লাহ হলের উত্তর-পশ্চিম কোণে যে পুরনো মসজিদটা আছে সেটাই যে মুসা খানের মসজিদ সেটা আমি জানতাম না। আসা যাওয়ার পথে অনেকবারই মসজিদটা দেখেছি। আরো সোজা করে বললে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবরের পেছনেই এই মসজিদটা। রাস্তা থেকে যখন দেখেছি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবরের দিকেই চোখ গিয়েছে। মসজিদটা সেভাবে দেখা হয়নি।
রাস্তা থেকে মুসা খাঁর মসজিদটার পেছন দিকটা দেখা যায়। মসজিদের সম্মুখভাগে সমাহিত মসনদ-ই-আলা মুসা খাঁ। কবরের সামনে দিয়ে বার কয়েক হেঁটে গেলেও চোখে পড়লো না প্রথমে। পরে দেখলাম উঁচু বেদির মতো একটা স্থান। চক দিয়ে সেখানে কেউ একজন লিখে রেখেছে মুসা খার কবর।
বারো ভূইঁয়ার প্রতাপশালী মুসা খাঁর কবর এমন অযত্নে পড়ে আছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে… বুকটা হু হু করে উঠলো। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সূরা ফাতিহা পড়ার সময় খেয়াল করলাম একটু দূরে বসে থাকা দুটো কুকুর আমার দিকে বিস্ময়ভরে তাকিয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে এমন দৃশ্যের সাথে তারা পরিচিত না। এখানে কেউ আসে না। এসে এমন দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে না।

মুসা খাঁ’র কবরের সামনে লেখক
হাকিম হাবিবুর রহমান তার ‘আসুদেগানে ঢাকা’ বইয়ে এই জায়গাটি সম্পর্কে বলেছেন, বাগানটিকে মুসলমানদের বাগান বলা হতো। বাগ-ই-মুসা বা মুসলমানদের বাগান যেটাই বলি না কেন সময়ের বিবর্তনে আজ সেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। এই বাগ অহর্নিশ গুঞ্জরিত থাকে শিক্ষার্থীদের পদচারণায়, আড্ডায়। একাকী শুয়ে থাকা মুসা খাঁ কী এসব টের পান? পরক্ষণেই মনে হলো মুসা খাঁর কবর যে এখনও আছে, টিকে আছে, অস্তিত্ব আছে এটাই তো অনেক। সম্ভবত তার বানানো মসজিদটার কারণে কবরটা টিকে গেছে।
ঠিক এভাবেই অযত্নে পড়ে ছিল মুসা খাঁর বাবা ঈসা খাঁর কবর। ঢাকার অদূরে গাজীপুরে অবহেলায় পড়ে থাকা ঈসা খাঁর কবরের দিকে গত কয়েক বছর আগে নজর দিয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। লক্ষ টাকা ব্যায়ে নির্মিত হয়েছে সমাধি স্তম্ভ। পিতার কবরের মতো মুসা খাঁনের কবরেও কী জুটবে এমন কিছু? লক্ষ টাকার সমাধি স্তম্ভ না হোক একটি স্মৃতিফলক তো আশা করাই যেতে পারে…
মুসা খাঁ কে ছিলেন, মুসা খাঁর কবর কোথায়… এসব তথ্য ইতিহাসের গ্রন্থগুলোতে তো আছেই, আজকাল গুগল করলেও এসব তথ্য পাওয়া যায়। দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠের মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য এসব তথ্য ঠোঁটের আগায় রাখেন। সেদিকে হাঁটতে না পারলেও পূর্বপুরুষের পদচিহ্ন ধরে হাঁটতে পারছি, তাতেই আমি খুশি।