ভূমিকা
এগারো শতকের গোড়ার দিকে পৃথিবীতে সংঘটিত শেষ ধর্মযুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্ব পরাজিত হয়। সেই পরাজয়ের পর তাদের পক্ষে আর কোনোদিন প্রকৃত শান্তি ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র গঠন সম্ভব হয়নি। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তারা নিজেদের মধ্যেই বিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা আর রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে অস্থির সময় কাটিয়েছে।
তবে সময়ের দীর্ঘ স্রোত পেরিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে তারা অবশেষে একটি শান্তিপূর্ণ রূপরেখা তৈরি করতে সমর্থ হয়। এরই মধ্যে মুসলিম বিশ্ব নানা উত্থান-পতনের সাক্ষী হয়। বিভিন্ন সাম্রাজ্যের আবির্ভাব ও বিলুপ্তি এই সময়কে একদিকে বেদনার, আবার অন্যদিকে সংগ্রামের স্মারক করে তুলেছিল।
স্পেন বিজয় ও আন্দালুসের পতনের পর অনেকে ভেবেছিল, এবার হয়তো খ্রিষ্টান বিশ্ব পৃথিবীর শাসক হয়ে উঠবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। মুসলিম বিশ্বের শাফাভি বা মামলুক সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে গেলেও, পশ্চিমাদের সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে।
এরপর আবার নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। সেলজুক সাম্রাজ্যের অবসানকে পেছনে ফেলে অটোমান সাম্রাজ্যের গৌরবময় উত্থান হয়। মুসলিম জাতির রাষ্ট্রীয় দর্শন তখনও অভিন্ন ছিল—এমন এক দৃঢ় বিশ্বাসে পূর্ণ, যা যুগ যুগ ধরে তাদের ঐক্য ও শক্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। সেই রাষ্ট্রচিন্তা, যার নাম ছিল ‘রুবুবিয়াত’, শুধু মুসলিম বিশ্বের জন্য নয়, মানবজাতির জন্যও ছিল শান্তি ও প্রগতির পথনির্দেশ।
রুবুবি দর্শন
বারো শতকে গড়ে ওঠা অটোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ভিত্তিও ছিল রুবুবিয়াত। এই দর্শনের মর্মকথা ছিল ধর্মে ওয়াহদানিয়াত (একত্ববাদ) এবং রাষ্ট্রে রুবুবিয়াত (পালনবাদ)। তৎকালীন মুসলিম বিশ্ব এই অভিন্ন মতবাদকে গভীর ভালোবাসা ও আস্থার সঙ্গে ধারণ করত। তারা তাদের ইমান ও আমলের মধ্যে একত্ববাদের চর্চা করত এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় পালনবাদের নীতি অনুসরণ করত।
এই দর্শন শুধু একটি রাজনৈতিক কাঠামো নয়, বরং এটি ছিল মুসলিম সমাজের রুহানি ও ইমানি চেতনার এক অনন্য ভিত্তি। এর মাধ্যমেই তাদের রাষ্ট্রীয় চিন্তা মেটাফোরিক্যাল ও দার্শনিক গভীরতায় পৌঁছেছিল।
ফলস্বরূপ, মুসলিম জাতি যুগ যুগ ধরে একত্র ও অভিন্ন রইল। একটি সাম্রাজ্যের পতনের পর নতুন একটি সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটত, যেন ঐক্যের এই শৃঙ্খল কখনো ছিন্ন হয়নি। ইতিহাস বলছে, সম্ভবত এই রুবুবিয়াতের ওপর দৃঢ় বিশ্বাসই মুসলিম জাতিকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিশ্ব-ক্ষমতার শীর্ষে স্থায়ী থাকার শক্তি জুগিয়েছে।
তবে সময়ের পরিবর্তনে আঠারো শতকের মাঝামাঝি এবং ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকে মুসলিম সমাজে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে। ইমান, আমল এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামোয় উল্লেখযোগ্য রূপান্তর দেখা দেয়। ধীরে ধীরে শুরু হয় নতুন সমাজব্যবস্থার উদ্ভব, এবং সেইসঙ্গে বিকশিত হতে থাকে উসুলী মতবাদ, যা সেই সময়ের একটি নতুন চিন্তার ধারা ছিল।
মতবাদের বিকাশ
মুসলিম জাতির ইতিহাসে বিভিন্ন মতের পার্থক্য বরাবরই ছিল। তবে উসুলি আকিদা, যার মর্মে ছিল একত্ববাদ এবং পালনবাদের চেতনা, এই বিষয়ে সবাই ছিল একমত। কিন্তু আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে এসে রুবুবিয়াত ও ওয়াহদানিয়াতের আকিদায় মতবিরোধ দেখা দেয়।
ওয়াহাবি মতবাদের দ্রুত বিস্তার উসমানীয় সাম্রাজ্যের ভেতরে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করে। এতে আশআরি, মাতুরিদি এবং সুফি ধারার অনুসারীদের মধ্যে মতপার্থক্য গভীর হয়। অথচ সকলেরই ভিত্তি ছিল পালনবাদী দর্শন, যা বিশ্বাস করত যে আল্লাহ একমাত্র পালনকর্তা, আর পৃথিবীর মানুষ তাঁর প্রতিনিধি।
সেলজুক ও অটোমান শাসকদের সুফি পীর
মুসলিম রাষ্ট্রের সুলতানদের জীবনে একজন সুফি পীর বা দরবেশের উপস্থিতি ছিল এক বিশেষ অধ্যায়। সেলজুক ও অটোমান সাম্রাজ্যের প্রায় প্রতিটি সুলতানের একজন সুফি উপদেষ্টা ছিলেন। তাঁরা শুধু ধর্মীয় পথপ্রদর্শকই ছিলেন না, বরং রুবুবিয়াতের চর্চার মাধ্যমে সুলতানদের রাষ্ট্র পরিচালনায় সহায়তা করতেন।
সবচেয়ে আলোচিত উদাহরণ হলেন কনস্টান্টিনোপল বিজয়ী সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ। তাঁর পীর মাওলানা আকশামসুদ্দিন (রহ.) ছিলেন তাঁর আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির অন্যতম উৎস। মাওলানা আকশামসুদ্দিনের লেখনী, বিশেষত মাকামাতে আওলিয়া, আমাদের সামনে তুলে ধরে যে তিনি সুলতানকে একত্ববাদ ও পালনবাদের গভীর জ্ঞান দিয়েছিলেন।
এই শিক্ষার আলোকেই সুলতান মুহাম্মদ আল ফাতিহ কনস্টান্টিনোপল জয় করেন এবং ইস্তাম্বুল প্রতিষ্ঠা করেন। এটি শুধু একটি সামরিক বিজয় নয়, বরং একত্ববাদ ও পালনবাদের চেতনার এক অনন্য উদাহরণ। তবে পরবর্তী অটোমান শাসকরা এই দর্শন থেকে ধীরে ধীরে বিচ্যুত হতে শুরু করেন। তাঁরা নিজেদের পালনকর্তা মনে করতে শুরু করলে, সাম্রাজ্যের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়ে, এবং পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে।
সুলতান আবদুল হামিদ খান : রব্বানী দর্শনের এক নিবেদিত রক্ষক
উসমানীয় সাম্রাজ্যের শেষ সময়ে, যখন বিশ্বের পরাশক্তিগুলো একজোট হয়ে সুলতান আবদুল হামিদ খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করে, তখন হয়তো তাদের লক্ষ্য ছিল না শুধুমাত্র একজন শাসককে পরাজিত করা। তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের মূল ভিত্তি—রব্বানী দর্শন—ধ্বংস করা।
সুলতান আবদুল হামিদ খান ছিলেন এমন এক শাসক, যিনি একত্ববাদ এবং পালনবাদকে রাষ্ট্রের প্রাণকেন্দ্রে স্থাপন করেছিলেন। তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এতটাই অসাধারণ ছিল যে, জার্মানির বিখ্যাত রাজনীতিবিদ অটো ফন বিসমার্ক বলেছিলেন :
“পৃথিবীর সব রাজনীতির ৯০% সুলতান আবদুল হামিদের, ৫% আমার এবং বাকি ৫% বিশ্বের সব রাজনীতিবিদের।”
১৮৮৬ সালে সিংহাসনে বসার পর থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত সুলতান আবদুল হামিদ খান প্রতিকূল পরিবেশে ইসলামের খেলাফত রক্ষা করেছিলেন। তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষক ছিলেন শায়খ জাফর এফেন্দি (রহ.), যিনি পালনবাদ ও একত্ববাদ নিয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ আল-আনোয়ারুল কুদসিয়া রচনা করেন।
শায়খ জাফর এফেন্দি এই গ্রন্থে লিখেছিলেন:
“একজন মুসলমানের প্রথম কর্তব্য হলো একমাত্র পালনকর্তার প্রতি পূর্ণ আস্থা স্থাপন করা। এরপর তাঁর জীবন শরিয়তের বিধানের আলোকে পরিচালিত হবে। কিন্তু আজ আমরা এই বিশ্বাসকে দুর্বল করে মতভেদের অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছি।”
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী : রব্বানী দর্শনের আলোকবর্তিকা
সুলতান আবদুল হামিদ খানের সময়েই পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটে আরেকজন আবদুল হামিদের—মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এমন একসময়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন, যখন মুসলিম জাতি এক ভয়াবহ সংকটের মধ্যে ছিল। উসমানীয় খেলাফতের পতন ও মোগল সাম্রাজ্যের অবসানের কারণে মুসলিম বিশ্ব এক গভীর হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছিল।
এই সংকটকালে রব্বানী দর্শনের পুনর্জাগরণ ঘটাতে ভূমিকা রাখেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.)। তাঁর দেখানো পথেই বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক আলোকিত চিন্তাবিদ ও নেতা উদ্ভাসিত হন। তাঁদের মধ্য থেকেই মওলানা ভাসানী রব্বানী দর্শনের মর্মবাণী শিখে নেন।
একজন আধ্যাত্মিক নেতা ও সংগ্রামী রাজনীতিক
মওলানা ভাসানী ছিলেন একজন পীর, সুফি, এবং আদর্শ রাজনীতিবিদ। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে কৃষকদের অধিকার আদায়, ভারতভাগের আন্দোলন, এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এতটাই অনন্য ছিল যে, অনেকের মতে অটো ফন বিসমার্ক যদি তাঁকে জানতেন, তাহলে হয়তো বলতেন,
“পৃথিবীর রাজনীতির ৯০% ভাগ দুই হামিদের।”
মওলানা ভাসানীর মূল লক্ষ্য ছিল রব্বানী দর্শনের আলোকে একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করা। তিনি সমাজতন্ত্রকে ব্যবহার করেছিলেন নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য, তবে তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল একত্ববাদ ও পালনবাদ।
জীবনের শেষ সময়ে
জীবনের শেষ প্রান্তেও মওলানা ভাসানী মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যের ডাক দিয়ে গেছেন। ১৯৭৬ সালের ১৬ নভেম্বর হজে যাওয়ার প্রস্তুতিকালে তিনি একটি বিদায়ী খুতবা লিখেন। সেখানে তিনি মুসলিম বিশ্বের জন্য রব্বানী দর্শনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
তিনি লিখেছিলেন :
“গত দুই শতাব্দীর শোষণ, নির্যাতন, অত্যাচার ও উৎপীড়নের কালোরাত্রি পাড়ি দিয়া আজ আমরা এক নূতন দিনের সুবেহ সাদেক প্রত্যক্ষ করিতেছি। এখন আমরা আর ইহুদি, হুনুদী ও নাসারাদের শাসিত পর মুখাপেক্ষী সম্প্রদায় নই।
মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তি যদিও তাওহিদ, তথাপি ইসলামের শত্রুদের ষড়যন্ত্রে ১৯১৭ সনে খেলাফতের বিলুপ্তির পর খেলাফতের ভৌগোলিক ভিত্তিতে বিশ্বে যে ৪৬টি স্বাধীন সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্রের উদ্ভব হইয়াছে তাহাদের সীমারেখার ভিতর অবস্থিত আল্লাহ প্রদত্ত তেল ও খনিজ সম্পদের বদৌলতে বর্তমান দুনিয়ার সম্পদের সিংহ ভাগ আজ মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে। এই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রুবুবিয়াত প্রতিষ্ঠা করার জন্য তৃতীয় বিশ্বের নেতৃত্ব মুসলমানদিগকেই নিতে হইবে।
তাই মুসলিম জাহানকে নতুন দায়িত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হইয়া মানুষে মানুষে সবরকম অসাম্য ও অনৈক্যের দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর চূর্ণ বিচূর্ণ করিয়া সকল রকম শোষণ শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটাইয়া সারা দুনিয়াতে শান্তি স্থাপনের জন্য রাব্বুল রুবুবিয়াতের আদর্শে প্রকৃত সাম্যবাদ কায়েম করিতে হইবে।” (সংক্ষিপ্ত খুতবা, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী)
উপসংহার
মওলানা ভাসানী ছিলেন এমন একজন আলোকিত মানুষ, যিনি তাঁর জীবনকে মানবতার সেবা ও ইসলামের আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর রেখে যাওয়া চিন্তা ও আদর্শ আগামী প্রজন্মের জন্য চিরন্তন দিকনির্দেশনা হয়ে থাকবে। তিনি ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর পরলোকগমন করেন। তাঁর কর্ম ও দর্শন আজও আমাদের পথ দেখায় এবং ভবিষ্যতেও দেখাবে।
আয়হায়, আবদুল হামিদ খান সম্পর্কে এর আগে ঠিক উল্টোটা জানতাম। পালনবাদ শব্দটা শুনে কেমন হাস্যকর মনে হতো কিন্তু লেখাটি পড়ার পর পালনবাদ সম্পর্কে জানার আগ্রহ বেড়ে গেছে। ধন্যবাদ সুনান ভাইকে ♥️
অসাধারণ লিখেছেন সুনান ভাই। মাহফুজ ‘পালনবাদ’ সম্পর্কে বলার পর কতই-না হাসাহাসি করেছি। তারপরও পালনবাদ সম্পকে জানার জন্য আমার আগ্রহ জমে ছিলো। কিছু ঘাটাঘাটিও করেছি তেমন কোন তত্ত্ব পাইনি। আপনার এইটা মারাত্বক ছিল কিন্তু পালনবাদের সাথে যে আমাদের নেতা ভাষানী যে পীর ছিল তা কখনোই জানতাম না। সুন্দর লিখনি তবে পালনবাদ সম্পকে আলাদাভাবে লেখার অনুরোধ থাকলো।