মুসলিম পরিবারব্যবস্থায় আধুনিকতার প্রভাব

উৎসকথা : ইউরোপে মুক্তবুদ্ধির চর্চা শুরু হলো, নিরেট রাজনৈতিক স্বার্থেই ধর্মকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ইউরোপের মাটিতে (Industrial revolution) শিল্পবিপ্লব ঘটে গেল। মধ্যযুগের তাবৎ কপমুণ্ডকতা, অধর্ম ও অপশাসনের দায় চাপিয়ে দেয়া হলো খ্রিষ্টান যাকদের উপর। বাঁচবার আকুতি নিয়ে প্রবল প্রতাপশালী আধুনিক রাষ্ট্রের কাছে তারা নিজেদের গোটা অস্তিত্ব সঁপে দিল। যাজকদের ক্রুশকাঠে রচিত হলো আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত। এবং যাজকদের দায় স্বীকারের ঘটনা হয়ে দাঁড়াল আধুনিকতার বৈধতার দলিল। 

অতঃপর বুদ্ধি-স্বর্বস্ব আধুনিক সভ্যতা কলকারখানা নির্মাণ করল, পরিবেশ ও প্রকৃতির ধ্বংস ডেকে আনল। ধনী ও গরিবের মাঝে পাতালসম দুরত্ব তৈরি করল। মরণঘাতী অস্ত্র, বোমা-বারুদ ও নিউক্লিয়ার পাওয়ার—সব‌ই উন্নততর সভ্যতার দোহাই দিয়ে বানানো হলো। যার পারমাণবিক অস্ত্র যত বেশি তার প্রগতির নিশান তত উঁচু। কত মানুষ মরল, প্রাণ ঝরল, প্রকৃতির বিপর্যয় ঘটল, কেউ আর দায় নিল না। খেলাফত ও আমানতের ধারণা ধার্মিকদের মধ্যে যে দায়িত্ববোধের সৃষ্টি করে, তার অনুপস্থিতি হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেল আধুনিক বুদ্ধিবাদী সমাজ। সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাজনীতির গণহত্যা, প্রাণ-প্রকৃতির বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের দায় কেউ স্বীকার করছে না। বুদ্ধিচর্চায় আমানত ও আদালত নেই। দায়িত্বজ্ঞানশূন্য (আমানতহীন) সভ্যতার শ্বশ্বানে দাঁড়িয়ে তবু মানুষ জয়ের ভণিতা করছে, হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার পেছনে ছুটছে অজস্র আধুনিক মানুষ।

সবার অবচেতনে পশ্চিমা (ঔপনিবেশিক) আধুনিকতা মুসলিম সমাজকেও প্রভাবিত করছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতেই নয় কেবল, নারী-পুরুষ, বাবা-মা এবং বন্ধুত্বের মতো ব্যক্তিগত সম্পর্কের চিরাচরিত কাঠামোকেও বদলে দিচ্ছে। প্রভাবিত করছে আমাদের ভাবনা ও আচার-ব্যবহারকেও।

 

১. প্রভাব যেভাবে প্রভাবিত করে

সম-ভাবধারা সমর্থন, লালন ও প্রচারের ভেতরেই প্রভাব সীমিত নয়, বরং প্রভাব আরও বেশি তীব্র। এ জন্য আমি প্রথমেই প্রভাব বিষয়ে সংক্ষেপে বলি—মনে রাখবেন, আলো-বাতাসের চেয়েও সূক্ষ্মভাবে কাজ করে প্রভাব। যেমন ধরুন, গত সপ্তাহে আমি একটা বই পড়েছি, কিংবা লেকচার শুনেছি, দুয়েক মিনিটের ভিডিও ক্লিপ দেখেছি। পড়া-শোনা ও দেখার পর আমি হয়তো ভিন্ন কাজে মনোনিবেশ করেছি। কিন্তু সেখানে এমন কিছু শব্দ ছিল, কথা ছিল, দৃশ্য ছিল—যা আমি ভুলতে পারছি না। ওরা আমার সত্তার গভীরে এমনভাবে জেঁকে বসেছে, আমি নিজের থেকে ওদের আলাদা করতে পারছি না। সাথে সাথে আমি খেয়াল করলাম, দৃশ্য ও কথাগুলোর সাথে আমার পরিচয় হওয়ার পর আমার মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন ঘটছে। বহু বছর পর হয়তো বই-লেকচার-ভিডিওর কথা আমি ভুলে যাব, শব্দ ও দৃশ্যগুলো ঠিকঠাক মনে থাকবে না, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি আর আগের মতো থাকব না। সামান্য হলেও বদলে যাব। এটিই প্রভাবের সূক্ষ্মতম চরিত্র।

প্রভাবের মধ্যে একটা তীব্র ক্ষমতা আছে, মানুষের ভেতরের অন্ধকারকে যেমন পরম আলোয় উদ্ভাসিত করে, তেমনি একটা নির্মল ও কোমল মানুষের অন্তরাত্মাকে ক্রমশ বিদূষিত করে দেয়। হাদীসে এসেছে

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَا مِنْ مَوْلُودٍ إِلَّا يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ، ‌فَأَبَوَاهُ ‌يهوِّدانه، ‌وينصِّرانه

‘প্রতিটি শিশু ফিতরাত [ঈমানের স্বভাব] নিয়ে জন্মায়, অতঃপর তার বাবা-মা (এবং পরিবেশ-প্রতিপার্শ্ব) তাকে ইহুদি বানায় অথবা খ্রিস্টান।’ [বুখারী : ৬২২৬]

মনে রাখতে হবে, প্রভাবের দুই ধরনের প্রকাশ আছে—বৈশ্বিক ও স্থানিক। বৈশ্বিক প্রভাব একই সময়ে পরিবার, শহর এবং গোটা দেশের জীবনানুভূতিকে স্পর্শ করে। আর স্থানিক প্রভাব সীমিত থাকে তার বলয়ের মধ্যে। বিশ্বায়নের যুগে আমরা বৈশ্বিক প্রভাব-বলয়ে বাস করছি। ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা রাশিয়ার যেকোনো ঘটনা ও চিত্র খুব সহজেই আমাদের ব্যক্তিগত জীবনকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।

 

. ঔপনিবেশিক আধুনিকতা ও রূপান্তর-প্রক্রিয়া

২. ১ উপনিবেশের আলোচনা স্বভাবতই আধুনিকতার সাথে যুক্ত। উপনিবেশ প্রত্যক্ষভাবে শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও যেসব কারণে কার্যত শেষ হয়নি, তার অন্যতম কারণ আধুনিকতা। আধুনিকতার লীলাক্ষেত্র হিসেবে পশ্চিম বাদবাকি দুনিয়ার প্রগতির নিশানা বাতলে দিচ্ছে। পৃথিবীজুড়ে যেখানেই পশ্চিম তার উপনিবেশ বিস্তার করেছে, সেখানকার সাবেকি ও ঐতিহ্যবাহী সকল ব্যবস্থাপনা হয়তো বদলে দিয়েছে নতুবা বিকৃত করেছে। এককথায় যথাযথ কাঠামোতে রাখেনি। “রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে শুরু করে প্রত্যাহিক জীবনের ক্ষুদ্রতম সিদ্ধান্তের বৈধতার জন্যও আমাদের আধুনিক সংজ্ঞাগুলোর দ্বারস্থ হতে হয়।” (পার্থ, ২০০০ : ১৭৫) এমনকি তুরস্ক ও ইরানের মতো যেসব অঞ্চল সরাসরি উপনিবেশিত হয়নি, সেখানেও আধুনিকতা প্রভাব বিস্তার লাভ করেছে। মুসলিম সমাজের নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক, পরিবার পরিচালনা, সমাজ ব্যবস্থাপনা থেকে নিয়ে বৃহৎ পরিসরের কোনোকিছুই পশ্চিমা কাঠামোর বাইরে নেই। পুরুষের দায়িত্ব কী, নারী-অধিকার কাকে বলে এসব বিষয়ে ইসলামের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে পশ্চিমা আধুনিকতার বয়ানকে। এভাবে মুসলিম সমাজের প্রায় সকল ব্যবস্থাপনার ঔপনিবেশিক রূপান্তর ঘটে গেছে।

রূপান্তর কিন্তু একদিনে ঘটেনি, কয়েকটি পর্বে সম্পন্ন হয়েছে। ১৯৪৫ সালের পূর্ব পর্যন্ত এশিয়া ও আফ্রিকাকে পশ্চাৎপদ (backward) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তারপর অনুন্নত (underdeveloped) শব্দ দিয়ে পরিচিত করানো শুরু হলো ১৯৬০ পর্যন্ত। সবশেষে এশিয়া ও আফ্রিকাকে পরিচিত করবার জন্য বেছে নেওয়া হলো (উন্নয়নশীল) the developing country শব্দবন্ধকে।[1]Daniel Lerner, The Passi11g of the Traditio11al Society: Modernising the Middle East., New York, 964 এর মানে হচ্ছে, আপনি দীর্ঘ একশত বছরেও উন্নত ও অগ্রসর হতে পারেননি। এই উন্নত-অনুন্নতের মানদণ্ড কেবল অর্থনৈতিক বিচারেই নয়, বরং শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের বেলায়ও। পশ্চিম এখনও ধারণা করে প্রাচ্য ও মুসলিম সমাজ আদর্শিকভাবে পশ্চাৎপদ, তাদের পশ্চিমের আধুনিকতা অনুসরণ করে উন্নত হবার চেষ্টা করা দরকার। পশ্চিমের চিন্তা, মতামত ও সভ্যতাকে শ্রেষ্ঠ ভাবা দরকার।

২. ২ পশ্চিমের এসব বয়ান নানাভাবে প্রচারিত হয়েছে; সিনেমা, থিয়েটার, গল্প, কবিতা-সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সকল পথ-পদ্ধতির মাধ্যমে। ফলে আপনার পরিবারের সদস্য আপনার পাশে বসেই সেই বয়ানে প্রভাবিত হচ্ছে, হয়তো সিনেমা দেখে নতুবা ফেসবুক-ইউটিউবের মাধ্যমে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম কিংবা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিও কিন্তু পশ্চিমা বয়ানকে পুঁজি করেই চলছে। তুরস্কের নির্বাচনে প্রথম আলো যখন গার্ডিয়ান আর দি ইকোনোমিক্স নামের পশ্চিমা পত্রিকার ভাষায় কথা বলে তখন বুঝে নিতে হবে, আপনার দেশের প্রচার-পদ্ধতিও নানাভাবে পদাতিক-বাহিনীর ভুমিকায় অবতীর্ণ। গোটা মুসলিম জাহানের পরিস্থিতি একই। পশ্চিম তার নিজস্ব আধুনিকতাকে গোটা দুনিয়ার উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। প্রভু-টাইপ ভঙ্গি নিয়ে হাজির হয়েছে। সে একই সাথে জীব ও জড় পদার্থের গতিবিধি ও তাকদির লিখে দিচ্ছে। এ দেশের অধিকাংশ আধুনিকমনস্ক বুদ্ধিজীবী পশ্চিমা আধুনিকতার জাদুতে নিজস্ব বাস্তবতা ভুলে বসেছেন।

২. ৩ আলজেরিয়া, লেবাননের মতো ফরাসি উপনিবেশের শিকার যেসব অঞ্চল সেখানকার পরিস্থিতি আরও বেশি কলুষিত। The Passing of the traditional Soceity শিরোনামের এক মাঠজরিপে দেখা গেছে সেখানের নারী বিশেষত তরুণীরা ঐতিহ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা স্বাধীনতা চায়, পারিবারের আগল ভেঙে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে চায়। তরুণীরা বলছিল, “আমরা যেখানেই যাই, কিছু না কিছু থাকেই যা আমেরিকান—বই, ম্যাগাজিন এবং ভালো ভালো স্কুল। এমনকি প্রতি শুক্রবারে আমাদের স্কুলে আমেরিকার লাইফস্টাইল নিয়ে সেমিনার হয়।” এক তরুণীর দেখা একটি সেরা মুভির কথা স্মরণ করে সে বলল, “এটি আমার খুব পছন্দ কারণ এতে দেখানো হয়েছে, একজন নারী একজন পুরুষের জীবনে প্রভাব বিস্তার করছে। আমেরিকায় বসবাস করবার খুব শখ আমার, কেননা সেখানে নারীরা স্বাধীন। যেখানে ইচ্ছা যেতে পারে, বাবা-মায়ের কাছে জবাবদিহিতা করতে হয় না তাদের। পশ্চিমা সিনেমা শিক্ষকের মতো, আামাদের লাইফস্টাইল শেখায়।” (Modernizing The Middle east)

 

৩. আধুনিক পরিবার ও ঐতিহ্যবাহী পরিবার : ব্যক্তিগত সম্পর্কের রদবদল

. ১ ঐতিহ্যবাহী পরিবারের কাঠামোগত রূপান্তর ঘটে গেছে। মুসলিমবিশ্বের পরিবারগুলো এখন আধুনিকতার যাবতীয় সিদ্ধান্ত ও চরিত্র কবুল করে নিয়েছে। উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, শিল্পায়ন ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নতির ফলে ঐতিহ্যবাহী পরিবারের অনেককিছুই বদলে গেছে। যৌথ ও একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গড়ে উঠেছে ‘নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি’—যেখানে মা-বাবার মাত্র একটিই সন্তান, খুব ভোরে মা-বাবা বেড়িয়ে যাচ্ছেন কর্মস্থলে, ফিরছেন রাতে। শিশুকে কার কাছে রেখে যাচ্ছেন? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাজের মেয়ের কাছে। ফলে শিশুর মানসিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। শারীরিক দিক থেকেও ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, সু-অভ্যাস গড়ে উঠছে না। শিশুরা মায়ের কোলকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ ও আরামদায়ক স্থান মনে করে। সেটি না পাওয়ায় শিশুর মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে এবং প্রক্ষোভমূলক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। বাংলা সাহিত্যে পুরোধা ব্যক্তিত্বরাও এটি স্বীকার করেছেন।[2]রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, “পুরুষের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিয়া … Continue reading)

প্রাক-ঔপনিবেশিক আমলে বাংলাদেশে সম্পর্কবোধের বুনিয়াদ গড়ে উঠত মূলত যৌথ পরিবার থেকে। শিশুরা বিচিত্র সম্পর্কের স্বাদ পেত, কেবল সংশ্লিষ্ট পরিবার থেকেই নয়, বরং সেই পরিবারের সঙ্গে নানা প্রয়োজনে সম্পৃক্ত লোকজনের থেকেও। ফলে তার ভবিষ্যৎ-জীবনের উত্থান-পতনে পারিবারিক প্রভাব অনেক বেশি কাজ করত।

৩. ২ সমাজজীবনে ব্যক্তিগত সম্পর্কের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও সংবেদনশীল ক্ষেত্র সম্ভবত নারী-পুরুষ সম্পর্ক। পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্ম, চিন্তাধারা, সংস্কৃতি, সমাজ ও সভ্যতায় নারী-পুরুষ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা আছে, নিজস্ব ব্যবস্থাপনা আছে। প্রাচ্যের সাথে পশ্চিমের, ইসলামের সাথে অপরাপর ধর্মের ব্যবস্থাপনাগত ভিন্নতা চোখে পড়ার মতো। আপনি সমাজ-সচেতন হয়ে থাকলে দেখবেন, শহরের রাস্তাঘাট, মার্কেট ও রেঁস্তোরায় মায়ের সঙ্গে একত্রে যাচ্ছে কন্যা। মা এবং মেয়ের হাঁটাচলা, কথাবার্তা, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং লাইফস্টাইলের মধ্যে আকাশ-কুসুম তফাত। প্রথমজন ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, অন্যজন আধুনিক। একজন বিশ্বায়নের সাথে সংযুক্ত হয়ে ভিন্ন দুনিয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, প্রভাবিত হয়েছে। অন্যজন তার দেশীয় এবং পরম্পরাগত (মুতাওয়ারাছ) অভিজ্ঞতাকেই আদর্শ হিসেবে মেনে নিয়েছে।

নারী-পুরুষ সম্পর্ককেও দুজন দেখছে দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে। এজন্য হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ. নারী-পুরুষ সম্পর্কের আধুনিকায়ন নিয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। বারবারা ম্যাটক্যাফ বেহেশতি জেওরের সামাজিক ভূমিকা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিষয়টি ভারসাম্যের সাথে বিশ্লেষণ করেছেন। উপনিবেশ-আক্রান্ত ভারত-উপমহাদেশে নিয়ত ক্ষয়িষ্ণু পরিবার ও নারী-পুরুষ সম্পর্কের ভেতর যে দোলায়মান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিতান্ত সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি ঐতিহ্যবাহী পরিবারের অতিশয় গোঁড়ামি এবং কুসংস্কারকে দমনের সঙ্গে সঙ্গে উদারনৈতিক চিন্তাকেও শয়তানি চিন্তা হিসেবে হাজির করেছেন। আলিগড়ের আধুনিকপন্থি ভূমিকাকে দেওবন্দের মধ্যপন্থা দিয়ে সমালোচনা করতে সক্ষম হয়েছেন।[3]Perfecting Women: Maulana Ashraf ʻAlī Thanawi’s Bihishti Zewar : a Partial translation with commentary.116

 

. নারী-পুরুষ সম্পর্কের ভিত্তি : সেক্যুলার নৈতিকতার প্রভাব

. ১ নারী-পুরুষ সম্পর্কের প্রধান বুনিয়াদ হচ্ছে পারষ্পারিক সন্মান, বিশ্বাস ও নিখুঁত ভালোবাসা। ট্রাডিশনাল সমাজে এগুলো যতটা নিপুণভাবে ছিল, উপনিবেশ-পরবর্তী সমাজ থেকে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সাঈদ নূরসী এর জন্য দায়ী করেন নগ্নতা ও অশ্লীলতাকে।[4]নূরসী, রাসালায়ে নূর, ২৪তম লামাআ, ২৭৭ পৃষ্ঠা নগ্নতা ও অশ্লীলতাই পরষ্পরের আস্থা, সন্মান ও ভালোবাসায় চিড় ধরিয়েছে। কেননা সত্তাগতভাবেই মানুষ বৈবাহিক ও পারিবারিক সম্বন্ধকে নির্মল রাখতে চায়, পরস্পরকে একমাত্র সঙ্গী হিসেবে পেতে চায়, এবং বংশধারাকে রাখতে চায় কলুষমুক্ত, নগ্নতা ও অশ্লীলতা এসবের পেছনে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। মুসলিম সমাজে নারী-পুরুষ সম্পর্ককে নিছক দুনিয়াবি বিষয় হিসেবে দেখা হয় না। বরং এটি পরকালীন প্রত্যাশাও। সঙ্গীর সঙ্গ যদি পবিত্র ও নির্মল হয় তবে এ সম্পর্কের ফলাফল পরকালেও প্রতিফলিত হবে। দুজন জান্নাতে একত্রে বাস করবেন। পশ্চিমে অন্যান্য বিষয়ের মতো নারী-পুরুষ সম্পর্কেরও সেক্যুলারায়ণ ঘটেছে। রাষ্ট্রের মতো পরিবারব্যবস্থাপনাকেও কেবল ইহজাগতিক প্রয়োজন মনে করা হচ্ছে। ফলে সম্পর্ক স্থায়ী হওয়া না হওয়া নির্ভর করছে কেবলই ইহজাগতিক স্বার্থের উপর।

৪. ২ আধুনিক পরিবারের নারী-পুরুষ সম্পর্কে সেক্যুলার নৈতিকতার প্রভাব প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। পারিবারিক সম্পর্কের অন্তঃস্থে সেক্যুলার নৈতিকতা নিয়ত বিকাশমান; বিবাহ তাই হয়ে গেছে সামাজিক চুক্তি, বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে নিতান্ত হালকা জিনিস এবং বিয়েতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কই প্রধান মাপকাঠি হয়ে আছে। ত্বাহা আবদুর রহমানের মতে পরিবার এমন এক ব্যবস্থাপনা, যাতে সদস্যদের আন্তঃসম্পর্ক ধর্মের আখলাক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের পাশাপাশি সন্তান ও মা-বাবার পারস্পরিক রিশতা—এসব সম্পর্কের ভেতরে আখলাক দিতে পারে মানবিকতার স্নিগ্ধ সুবাস।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অজুহাতে অপরের অধিকার এবং নিজের কর্তব্যের প্রতি নারী-পুরুষ কেউই আর নজর দিচ্ছে না। মনে রাখতে হবে, পুরুষের অবস্থান তার নিজস্ব পরিসরে স্বতন্ত্র; তেমনি নারীও। এই আখলাকি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে কোনো ব্যক্তির একক, বিরল ও অপরিচিত সত্তা থাকে না; বরং সে নিয়ত উদ্যম ও জনঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে, যা একই সাথে তাকে ব্যক্তিত্বের গুণাগুণেও বরিত করে। এভাবে বহুমুখী চেহারার বদলে পরিবারব্যবস্থাও মোড় নেয় বিশেষ পরিসরের দিকে।

এখানে বড় জটিলতা হলো, পরিবারব্যবস্থা ধীরে ধীরে সম্পৃক্ত হচ্ছে পুঁজিবাদী এবং আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার সাথে এবং পুঁজিবাদের নিজস্ব নৈতিকতা পরিবারব্যবস্থার ভাঙা-গড়ার উপর প্রভাব ফেলছে। ফলে দেখা গেছে ব্যক্তিত্ব, সাফল্য ও সাধারণ নৈতিকতার বয়ান পুরোপুরি বদলে গেছে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বিষয়টি আত্মকেন্দ্রিকতায় রূপ নিয়েছে। ফলে পরিবারের আখলাকি সম্পর্ক ভেঙ্গে পড়েছে। প্রত্যেকে নিজের পারিবারিক দায়িত্ব থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে।[5]ত্বাহা, ২০০৬, ১০৪ পৃ.

পুঁজিবাদ আপনার প্রয়োজনের চেয়ে চাহিদার প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করবে, বাণিজ্যের নয়া নয়া রূপ-কাঠামো সৃষ্টির জন্য। বর্তমানে এই বিষয়টি পরিবারব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করছে। একটি পরিবারে ‘চাহিদা’ আর ‘প্রয়োজন’-কে আলাদা করে ভাবতে পারছে না অনেকেই। চাহিদাকে প্রয়োজন মনে করে অমিল ও ঝগড়ার ফলে ভেঙে যাচ্ছে অনেক সম্পর্ক। এক্ষেত্রে পরিবারকে কানাআত [অল্পেতুষ্টি] এর উপর পরিচালিত করতে ব্যর্থ হলে আমরা পশ্চিমা আধুনিকতার খাদে পড়ে যাব।

 

. পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : সন্তান ও পিতামাতার তরবিয়তি সম্পর্ক

. ১ আধুনিক দুনিয়ায় ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র বিষয়ের জন্যও প্রাতিষ্ঠানিক সক্রিয়তা গড়ে উঠছে, একান্ত ব্যক্তিগত দায়িত্ব নিজে পালন না করে সোপর্দ করা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানকে। সুবিধার সাথে সাথে এতে বহু অ-সুবিধারও সৃষ্টি হচ্ছে। কার্যত এতে প্রতিষ্ঠান কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজ তার উৎপদনশীলতা হারিয়ে ফেলছে। ‘হুজুর এত মাদরাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দ্বীনি তালিমের সুযোগ সুবিধা থাকার পরও নতুন প্রজন্ম নষ্ট হচ্ছে কেন?’ এই প্রশ্নের জবাবে তাবলিগের মুরুব্বি হযরতজি এনামুল হাসানের রহ. এর দীর্ঘ বক্তব্য হুবহু তুলে ধরছি, তাতে আপনি বুঝতে পারবেন, কীভাবে প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও দায়িত্ব পালনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ড. আনওয়ারুল করীম সাহেব উপরোক্ত প্রশ্নের পর বললেন, ‘সাহাবা-তাবেইদের যুগে মাদারাসা কম ছিল তবুও সে প্রজন্ম ছিল ভালো, কী কারণ?’ হযরতজী বললেন, ‘না! তখন মাদারাসা বেশি ছিল, এখন কমে গেছে। এখন তো তুমি ছয়/সাত বছর বয়সে সন্তানকে মাদরাসায় পাঠাও, ভর্তি করাও। সে একটিমাত্র মাদরাসায় পড়ে। যতক্ষণ মাদরাসায় থাকে ততক্ষণ শুধু মাদরাসা। আর আগে সন্তান যেদিন ভূমিষ্ঠ হতো সেদিন থেকে প্রতিটি মুহূর্তই হতো তার মাদরাসা। প্রতিটি কোলই ছিল তার জন্য একেকটি মাদরাসা। মায়ের কোলে আছে তো এক মাদরাসায় আছে। বোনের কোলে আছে তো আরেক মাদরাসায় আছে। ভাই কোলে নিয়েছে তো সে মাদরাসাতেই আছে । তখন সন্তান দুনিয়াতে আসার পর যার কোলে যাক, যেদিকে তাকাক, যার হাতে যাক, যেদিকে বের হোক—সবখানে মাদরাসা আর মাদরাসা। অর্থাৎ সে যেখানেই যাবে যার কাছেই থাকবে তাকে সে দ্বীনদার পাবে, দ্বীনী পরিবেশ পাবে। যে বোনের কোলে আছে, সে বোন মিথ্যা বলে না, কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করে না। ভাইয়ের কোলে গেল, তো ভাই-ও ভদ্র ছেলে, নামাজি, কারো গিবত-শেকায়েত করে না। বাবা এসেছেন, তার কোলে গেল, তিনিও ভালো, তার ইনকাম হালাল, দুনিয়ার পিছে পড়ে নামাজ ছাড়েন না। ধন-সম্পদ গড়ার জন্য হারামে লিপ্ত হন না। তার মানে, সন্তান যার কোলে যাচ্ছে, যার কাছে যাচ্ছে —মাদরাসায় যাচ্ছে। আর এখন? কোথায় সেই মাদরাসা?’

সন্তান যেখানে যাবে যার কোলে থাকবে, সেখানেই যদি আগের মতো মাদরাসা হতো, তাহলে তো ভালো ছিল। কিন্তু তা যদি না হয়, অন্তত প্রত্যেক সন্তানের প্রথম কোলটি যেন হয় মাদরাসা। যিনি এ সন্তানকে ধারণ করছেন, বহন করছেন দশ মাস দশ দিন, তাঁর আখলাক যদি ভালো হয়, তাঁর মধ্যে যদি দ্বীন-ঈমান থাকে, নামাজ থাকে, কুরআন থাকে, ভালো ব্যবহার থাকে, তবে সন্তানের উপর এর প্রভাব পড়বেই। প্রত্যেক নারীকে বুঝতে হবে, আপনার ব্যক্তি-সত্তাই আপনার সন্তানের মাদরাসা। আপনিই আপনার সন্তানের প্রথম মাদরাসা। আপনি ভালো সন্তান ভালো, আপনি খারাপ সন্তান খারাপ।[6]মাওলানা আব্দুল মালেক, মার্চ’ ১৬, মাসিক আল কাউসার

 

৬. প্রেমের ধারণা : মুসলিম সমাজে আধুনিকতার প্রভাব

৬. ১ প্রেম কাকে বলে, এবং প্রেমের সারসত্য কী—এ নিয়ে সেক্যুলার নৈতিকতায় বড় ধরনের ভুল-বোঝাবুঝি আছে—প্রথমত, সেক্যুলার নৈতিকতায় দৈহিক মিলন আর রুহানি-প্রেমকে এক করে দেখা হয়। দ্বিতীয়ত, ইলাহি প্রেম আর মানবিক প্রেমকে সমান্তরালে বিচার করা হয়। আল্লাহর প্রতি মানুষের প্রেম আনুগত্যের মধ্য দিয়ে সত্যায়িত হবে, আনুগত্য ছাড়া প্রেম-প্রকাশ যথার্থ হবে না। আর মানুষের প্রতি মানুষের প্রেম সেবা, দায়িত্ব ও অনুগ্রহের ভেতর দিয়ে প্রকাশ পাবে। উভয়ের মাঝে বিস্তর ফারাক। ইলাহি প্রেম মানুষকে পঞ্চন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধতা থেকে রুহের দিগন্তে পৌঁছে দেয়। বিপরীতে মানুষের প্রতি মানুষের প্রেম দেহবৃত্তকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। অথচ সেক্যুলার চিন্তক মানুষের প্রতি মানুষের প্রেমকে খোদার প্রেমের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছে। আল্লাহর প্রতি মানুষের প্রেম আর মানুষের প্রতি আল্লাহর প্রেমকে এক করে দেখা হচ্ছে। নারী-পুরুষের অবৈধ প্রেমকেও খোদায়ি প্রেমের নিশানা হিসেবে দেখা হচ্ছে। অথচ একটি স্রষ্টার প্রেম অন্যটি তাঁর সৃষ্টির। স্রষ্টার প্রেমের যে পূর্ণতা ও গভীরতা তা কিন্তু সৃষ্টির প্রেমে নেই।

প্রেম সম্পর্কে আধুনিক সমাজের ভুল বোঝাবুঝির মুলে রয়েছে ত্রিত্ববাদের বিশ্বাস; ত্রিত্ববাদ (Trinity) হলো স্রষ্টা সম্পর্কে খ্রিস্টীয় ধর্মবিশ্বাস, ত্রিত্ববাদ বলতে এক ঈশ্বরের মধ্যে পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার মিলনকেই বোঝায়।[7]ত্রিত্বের প্রত্যেক সদস্যই হচ্ছেন ঈশ্বর। পিতা হচ্ছেন ঈশ্বর (যোহন ৬:২৭; রোমীয় … Continue reading ত্রিত্ববাদে মনে করা হয় ঈসা মসিহের মধ্যে মানবীয় এবং ইলাহি স্বভাবের সমন্বয় করা হয়েছে, আদিপাপ মোচনের জন্য। ঈসার মধ্যে দ্বৈত-সত্তার মিলন ঘটেছে ফলে তিনি একইসাথে মানুষ এবং খোদা। ঈসাকে ভালোবাসা আর খোদাকে ভালোবাসা মূলত একই। এভাবে মানুষ ও খোদার সম্পর্ক সাদৃশ্যের (তাশবিহ) দিকে এগিয়েছে, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউনানি ঐতিহ্যের বহু-ঈশ্বরবাদী ধ্যানধারণা। এজন্য দেখবেন মাওলানা রুমির এলাহি-প্রেমের শায়েরিকে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে মানুষের প্রতি মানুষের প্রেমের আখ্যান দিয়ে। এলিফ শাফাকের ‘দি ফোর্টি রুলস অব লাভ’ বইয়ে উভয় প্রেমের আবহকে সমান্তরালে হাজির করা হয়েছে, যা মূলত প্রেমের খ্রিষ্টীয় এবং আধুনিক ব্যাখ্যা। সঙ্গত কারণেই আশরাফ আলী থানভী বলেন, “প্রেম করা একটি ঘৃণ্য খ্রিষ্টানি প্রথা; সমসাময়িক মুসলমান যাকে আধুনিকতা বলে ভ্রম করে।”

৬. ২ সাঈদ নূরসী নারী-পুরুষের বৈধ সম্পর্কের ব্যাপারে বলেন, এই বন্ধুত্ব ও নিঃশর্ত প্রেম কেবল দুনিয়াতেই সীমিত নয়, বরং চিরায়ত। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবধি প্রেমের সমীরণ বইবে, পরকালেও থাকবে তার প্রতিফল। তিনি নারী-পুরুষের সম্পর্ককে ইহকাল ও পরকালের ভালোবাসা হিসেবে দেখান। কিন্তু আধুনিক ভাবধারায় নারী-পুরুষের সম্পর্ক কেবল দুনিয়াতেই সীমিত যেহেতু তাদের অনেকেই আখেরাতকে এনকার করে। এছাড়া পশ্চিমা আধুনিকতায় প্রেমকে দায়িত্ব ও কর্তব্যের শর্ত দিয়ে বিন্যস্ত করা হয় না, এজন্য বিবাহপূর্ব প্রেমে দায়িত্ব-কর্তব্য না নিয়েও যা খুশি তাই করা যায়। অন্যদিকে ইসলামি সমাজে দায়িত্ব-কর্তব্যহীন প্রেম-ভালোবাসা অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হয়, কেননা এটি অসংযত, অশৃঙ্খল। এজন্য বারবারা ম্যাটক্যাফ বলেন, “থানভী যে ব্যক্তির ছবি আঁকেন—সে সংহত শৃঙ্খলাবোধের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেই নারী স্বল্পবাক এবং সংযত পরিচ্ছেদে পরিপাটি। সে অপরের সঙ্গে অতিরিক্ত বিনিময় না করে বরং স্বল্পতম লেনদেনে বিশ্বাসী।”

৬. ৩ মুসলিম সমাজে প্রেম ও নারী-পুরুষ সম্পর্কের জন্য বিবাহ জরুরি শর্ত। বাঙালি সমাজে উপনিবেশের আগেও শিল্প-সাহিত্যে সচরাচর এই নীতির পরিপন্থি দেখা যেত না। সেসময়ে গল্পের পটভূমি তৈরি করা হতো পারিবারিক জীবনের সম্পর্ক ও প্রেম-কাহিনিকে ঘিরে। বিশিষ্ট লেখিকা নূরুন্নেসার সংকলনের ভুমিকায় একজন লিখেছে, “সমাজের চোখে অবৈধ প্রেম, বাসনা ইত্যাদি নূরুন্নেসার গল্পের বিষয়বস্তু ছিল না। তিনি মুলত পারিবারিক পটে প্রেমের চিত্রায়ণ করেছেন। এবং এদিক থেকে তাঁর লেখা যথার্থ অর্থে সমাজের প্রতিবিম্ব। (মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম, ভূমিকা, নূরুন্নেসা গ্রন্থাবলী)।[8]বাঙ্গালী মুসলিম নারীর আধুনিকায়ন, ৮২ পৃ. উপনিবেশের সময় থেকে পশ্চিমা-সাহিত্যের প্রভাবে নানাভাবে বদলাতে থাকে বাংলা-সাহিত্যের পট ও চরিত্র। ফলে দেখবেন, উপন্যাসগুলোতে প্রেমের পট এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে পারিবারিক জীবনের অভিজ্ঞতা খুব কমই ফুটে ওঠে। প্রেমের গল্পগুলো প্রেম থেকে শুরু হয়ে চিরন্তন বিচ্ছেদে সমাপ্ত হচ্ছে নতুবা প্রণয়ের পরিণয় হচ্ছে ঠিক কিন্তু বিবাহিত-জীবনের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাকে তুলে ধরা হচ্ছে না। ফলে সমাজে তরুণীরা যে প্রেম শিখছে তা তাদের অস্থির করে তুলছে। বৈবাহিক জীবনে প্রেমের প্রয়োগ ঘটছে না। ভেঙে যাচ্ছে প্রেমঘটিত বিবাহ। “আগে প্রেম ও পরে বিবাহকে যারা সমস্ত দাম্পত্যসমস্যার সমাধান জ্ঞান করতেন, তারা এখন ঠেকে শিখেছেন যে, কোর্টশিপ করে বিয়েও ফুল-প্রুফ নয়, যেমন নয় ইন্টারভিউ দিয়ে কর্মচারী নিয়োগ।”[9]যাযবর, দৃষ্টিপাত, পৃষ্ঠা : ৩০

মোদ্দাকথা, মুসলিম সমাজে বৈবাহিক জীবনে প্রেমের বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। এ সমাজের যাবতীয় চর্চা হতে হবে সেই লক্ষ্যকে ঘিরেই। নতুবা পশ্চিমা সমাজের অসংযত ব্যবস্থাপনা মুসলিম যুবকদের ভেতর থেকে নিষ্ফল ও নিস্তেজ করে দেবে। কর্মচাঞ্চল্য নষ্ট হয়ে যাবে। এর একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ হতে পারে দ্রুত-বিবাহের ব্যবস্থা।

সুতরাং বাল্য-বিবাহের সংজ্ঞা ও ধারণা বদলাতে হবে। বাল্য-বিবাহের সীমারেখা আমাদের সমাজবাস্তবতার আলোকে বিন্যস্ত করতে হবে। প্রথমত, বাল্যবিবাহ (প্রচলিত অর্থে)—কে বাংলাদেশের জন্য আমি সমস্যাজনক মনে করি না। বরং এটিই বাস্তবতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে সঠিক। বাল্যবিবাহের পেছনে দায় ও সমস্যা হিসেবে অশিক্ষিত সমাজকে চিহ্নিত করা একটি অনাধুনিক সিদ্ধান্ত। যারা মনে করেন, শিক্ষা ও সচেতনতা বাড়লে বাল্যবিবাহ থাকবে না। তাদের আমি অন্যভাবে বিচার করতে বলব। এদেশের শিক্ষা-উন্নয়নের অসফলতার পেছনে বড় অংশে দায় অর্থনৈতিক দুরবস্থার। অধিকাংশ অভিভাবক পয়সার অভাবে সন্তানকে স্কুল বা মাদরাসায় উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে না। এই বাস্তবতা নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য হিসেবে আমি বুঝি। এবং এই ক্রাইসিস আমরা প্রজন্মান্তরে বহন করে আসছি অপরাজনীতির দূষণ হিসেবেও। ফলে স্বয়ং শিক্ষিত ও সচেতন হবার প্রকল্প‌ই থেমে আছে অর্থনীতির পাকে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের লোকজন অসচেতনতার কারণে বাল্যবিবাহ দেয় বলে আমি মনে করি না। দুয়েকজন দিতে পারে, বাকি অধিকাংশ বাবা-মা আর্থিক দৈন্যদশার কারণে অল্প বয়সে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়। এবং ঘটনাগুলো মেয়েদের ক্ষেত্রে ঘটে তুলনামূলক বেশি। আমি বাংলাদেশের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলের নিবাসী হিসেবে অহরহ বাল্যবিবাহ ঘটতে দেখেছি, যারা সন্তানকে পঞ্চম শ্রেণির পর শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়ে পাঠানোর সাহস করতে পারে না; শিক্ষা ছাড়া সচেতনতাও গড়ে তোলা যায় না অনেকক্ষেত্রে। মাদরাসার ব্যয়ভার‌ও বেড়েছে আগের তুলনায়।

তৃতীয়ত, এদেশে বাল্যবিবাহ জটিল বাস্তবতা। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের যাবতীয় আয়োজন আদতে আত্মঘাতী এবং অনাধুনিক সিদ্ধান্ত। যেই পরিবারের সন্তানেরা পঞ্চম শ্রেণির পর বিদ্যালয়ে যেতে পারে না, পরিবারে তাকে বসিয়ে রেখে কী কাজ! অথচ তার মধ্যে যৌনতাড়না ও চাহিদা শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে। একজন ছেলে বা মেয়ে মাত্র ১০ বছর বয়সে পঞ্চম শ্রেণি সমাপ্ত করে, অপরদিকে বিবাহের জন্য নির্ধারিত বয়স ১৮। পরিবারের মেয়েদের এই আট বছরের ভরণপোষণ দিতে হিমশিম খেতে দেখেছি বহু পরিবারকে।

চতুর্থত, বাংলাদেশে বাল্যবিবাহবিরোধী প্রচারণা শুরু হয়েছে সমাজের এলিট ক্লাস থেকে। যাদের যথেষ্ট পয়সা আছে। সন্তানকে উচ্চশিক্ষিত করবার সক্ষমতা আছে। এবং এই এলিট ক্লাস দেশের ১০% হবে বড়জোড়। সুতরাং ১০ শতাংশ মানুষের বিলাসিতার জন্য গোটা দেশের মানুষকে এমন অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত করা অনাধুনিক সিদ্ধান্ত।

সুতরাং দেশের বাস্তবতার দিকে তাকিয়ে বাল্যবিবাহ বৈধতা পেতে পারে। বাকি বিবাহ-পরবর্তী অন্যান্য যেসব দৈহিক, মানসিক ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির সম্ভাবনা দেখানো হচ্ছে, তার জন্য যতটুকু সচেতনতা তৈরি করা দরকার সেজন্য ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, আলেম ও ইমামদের ভূমিকা বেশি জরুরি এক্ষেত্রে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মীরাও তাদের প্রয়োজনীয় ভুমিকা পালন করবেন। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের স্বার্থে সচেতনতা তৈরির যে প্রস্তাব তা এটির তুলনায় অনেক জটিল এবং অ-বাস্তব প্রায়, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতার পূর্ব পর্যন্ত।

মনে রাখতে হবে, ইসলামে প্রেম-ভালোবাসা অত্যন্ত নিপুণভাবে কর্তব্য ও দায়িত্বের সাথে শর্তযুক্ত। নারী-পুরুষের সম্পর্ক ও ভালোবাসার উপর দাঁড়িয়ে আছে মুসলিম পরিবার, সমাজ ও জাতি। সুতরাং, এই ভালোবাসায় যদি খুঁত থাকে, গোটা জাতি একটি স্থায়ী দুরবস্থার মধ্যে নিপতিত হবে। তাই নারী-পুরুষ সম্পর্ককে ঔপনিবেশিক আধুনিকতার প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে, বিন্যস্ত করতে হবে ইসলামি বোঝাপড়ায়।

তথ্যসূত্র:

তথ্যসূত্র:
1 Daniel Lerner, The Passi11g of the Traditio11al Society: Modernising the Middle East., New York, 964
2 রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, “পুরুষের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিয়া অর্থোপার্জন স্ত্রীলোকের কার্য নহে। যদি দুর্ভাগ্যক্রমে কোনো স্ত্রীলোককে বাধ্য হইয়া স্বয়ং উপার্জনে প্রবৃত্ত হইতে হয় তবে তাঁহাকে দোষ দেওয়া বা বাধা দেওয়া উচিত হয় না স্বীকার করি— “কিন্তু সংসার রক্ষা করিতে হইলে সাধারণ স্ত্রীলোককে স্ত্রী এবং জননী হইতেই হইবে। সর্বদেশে এবং সর্বকালেই স্ত্রীলোক যে পুরুষের সমান শিক্ষা লাভে বঞ্চিত হইয়াছেন অবশ্যই তাহার একটা প্রাকৃতিক কারণ আছে। মানুষের প্রথম শিক্ষা বিদ্যালয়ে নহে, বহির্জগতে, কর্মক্ষেত্রে। গর্ভধারণ এবং সন্তানপালনে অবশ্য নিযুক্ত হইয়া স্ত্রীলোক চিরকাল এবং সর্বত্র সেই শিক্ষায় বহুল পরিমাণে বঞ্চিত হইয়াছে। তাহা ছাড়া এই জননীকর্তব্যের উপযোগী হইবার অনুরোধে তাঁহাদের শারীরিক প্রকৃতিও ভিন্নতাপ্রাপ্ত হইয়াছে। এই ভিন্নতাই যে স্ত্রী-পুরুষের বর্তমান অবস্থাপার্থক্যের মূল প্রাকৃতিক কারণ তাহাতে আর সন্দেহ নাই। যাহা হউক, এক্ষণে সভ্য সমাজের অবস্থা অনেক পরিমাণে নূতন আকার ধারণ করিয়াছে।” (সাময়িক সাহিত্য সমালোচনা- ৩, আশ্বিন, ১২৯৮, হিন্দু জাতির রসায়ন
3 Perfecting Women: Maulana Ashraf ʻAlī Thanawi’s Bihishti Zewar : a Partial translation with commentary.116
4 নূরসী, রাসালায়ে নূর, ২৪তম লামাআ, ২৭৭ পৃষ্ঠা
5 ত্বাহা, ২০০৬, ১০৪ পৃ.
6 মাওলানা আব্দুল মালেক, মার্চ’ ১৬, মাসিক আল কাউসার
7 ত্রিত্বের প্রত্যেক সদস্যই হচ্ছেন ঈশ্বর। পিতা হচ্ছেন ঈশ্বর (যোহন ৬:২৭; রোমীয় ১:৭; ১ পিতর ১:২)। পুত্র হচ্ছেন ঈশ্বর (যোহন ১:১, ১৪; রোমীয় ৯:৫; কলসীয় ২:৯; ইব্রীয় ১:৮; ১ যোহন ৫:২০) এবং পবিত্র আত্মা হচ্ছেন ঈশ্বর (প্রেরিত ৫:৩-৪; ১ করিন্থীয় ৩:১৬)।
8 বাঙ্গালী মুসলিম নারীর আধুনিকায়ন, ৮২ পৃ.
9 যাযবর, দৃষ্টিপাত, পৃষ্ঠা : ৩০

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
জাকির হোসেন খন্দকার
জাকির হোসেন খন্দকার
1 year ago

মা শা আল্লাহ । চমৎকার বিশ্লেষণ। পড়ার চেষ্টা করি যোগাযোগ। খালিদ মোহাম্মাদ সাইফুল্লাহ চমৎকার লিখেছেন।

Last edited 1 year ago by জাকির হোসেন খন্দকার
test
test

sotthi

Last edited 9 months ago by test

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷