মুসলিম জ্ঞানচর্চায় ওয়াকফের ভুমিকা : পুনর্পাঠ ও প্রাসঙ্গিকতা (শেষ পর্ব)

খালিদ মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ

মুসলিম জ্ঞানচর্চায় ওয়াকফের ভুমিকা : পুনর্পাঠ ও প্রাসঙ্গিকতা (দ্বিতীয় পর্ব)

৮. বাংলাদেশের ওয়াকফ-ব্যবস্থা : সংক্ষিপ্ত বয়ান

৮.১ সিরিয়া, মিসর ও তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মতো পাক-ভারত উপমহাদেশেও ওয়াকফের ব্যাপক প্রচলন ও এর সুফল সমাজে বহু অগ্রগতি সাধন করেছিল। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের পর ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ৫৫৪ বছরে প্রায় ১০১ জন বা ততোধিক শাসক বাংলা শাসন করেছিল।[1]আব্বাস আলী খান, বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস (ঢাকা : বাংলাদেশ ইসলামিক … Continue reading

এ সময়ে ওয়াকফ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে এ অঞ্চলে গরিব-মিসকিন, বিকলাঙ্গ, দুস্থ মানুষকে সাহায্য প্রদান, দারিদ্র বিমোচন ও শিক্ষা ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছিল। বাংলাপিডিয়ায় উল্লেখ আছে, “The Bengal region during Mughal period had a very rich tradition of ‘waqf’. Most of the Mosques, Madrasah and other socio-religious organizations and institutes used to be managed by the income of the ‘waqf’ estates. But the colonial powers that ruled it for about two hundred years destroyed this tradition along with other Muslim institutions.”[2]http://www.banglapedia.org/httpdocs/HT/W_0018.HTM

ইবনে বতুতার লেখায় দেখা যায়, মুহাম্মদ তুগলকের শাসনামলে বড় বড় সড়ক ও জনপথের বিশেষ বিশেষ স্থানে বিশ্রামাগার ছিল। যেসব স্থানে মুসাফিরখানা থাকত, মুসলিম অমুসলিম উভয়ের প্রতি লক্ষ রেখে এসব মুসাফিরখানা নির্মিত হতো। সুলতান সেকান্দর লুদি তৎকালীন রাজধানী আগ্রায় গরিব-মিসকিনদের একটি তালিকা তৈরি করে রেখেছিলেন। শীত-গ্রীষ্ম মৌসুমে বছরে দুবার দুই ঋতুতে গরিব-মিসকিনদের জামা-কাপড় দেয়া হতো। দেশের সামর্থ্যহীন পিতা-মাতার বিবাহযোগ্য সন্তানদের বিবাহের খরচও সরকারিভাবে দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। বাংলার সুলতানগণ বিদ্যাশিক্ষার প্রতি বেশি অনুরাগী ছিলেন এবং শিক্ষা প্রসারের জন্য তাঁরা সর্বতোভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। তাঁদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলিম জমিদার, লাখেরাজদার, আয়মাদার প্রভৃতি সম্ভ্রান্ত মুসলিম প্রধানগণ তাঁদের নিজ নিজ এলাকায় মসজিদ, মক্তব ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতেন এবং এসবের ব্যয়ভার বহনের জন্য প্রচুর ধন-সম্পদ ও জমাজমি দান করতেন।[3]আব্বাস আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪১ বাংলার প্রথম সুলতান মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি ছিলেন অত্যন্ত বিদ্যোৎসাহী। তিনি দিল্লির সম্রাট কুতুবুদ্দিন আইবেকের অনুকরণে দেশের বিভিন্ন স্থানে মসজিদ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি স্থাপন করেন। এ প্রসঙ্গে ড. মুখতার বলেন, শুধু রাজশাহী জেলার কসবা বাঘাতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য জনসেবামূলক কাজের জন্য প্রায় বিয়াল্লিশটি গ্রাম ওযাকফ করা হয়।

৮.২ কসবা বাঘার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেসব ছাত্র লেখা পড়া করত তাদের যাবতীয় ব্যয়ভার (বাসস্থান, খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছেদ, বই-পুস্তক, খাতা-কলম, কাগজ-পত্র ও প্রসাধনী ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বহন করা হতো।[4]আব্বাস আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪১, A. R. Mallik, Br. Policy & the Muslims in Bengali, p. 150 ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন বলেন, মুর্শিদকুলি খাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বীরভূমের আসাদুল্লাহ নামক জনৈক জমিদার তাঁর আয়ের অর্ধাংশ জ্ঞানী-গুণীদের ভরণপোষণ এবং অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করতেন। এরূপ বহু নজির রয়েছে যে, সেকালে বিত্তশালী ও ভূস্বামীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের সমুদয় ব্যয়ভার একব্যক্তি বহন করতেন সরাসরিভাবে কিংবা দান, ওয়াকফ বা ট্রাস্টের মাধ্যমে। ঔপনিবেশিক শাসনামলে এ উপমহাদেশে মুসলিম শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অন্যান্য ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ওয়াকফ সম্পত্তি এক অনন্য অবদান রেখেছিল। কিন্তু ইংরেজরা গোটা হিমালয়ান উপমহাদেশের শাসন ক্ষমতা যখন মুসলমানদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল তখন প্রথম ইংরেজদের করতলগত হয় বাংলাই। এ সময় গোটা সুবে-বাংলায় ৮০ হাজার মক্তব ছিল। ওয়াকফ, লা-খেরাজ, আয়েমা, মদদ-মায়াশ প্রভৃতি সম্পত্তির আয়-উন্নতি দ্বারাই মসজিদ, মাদরাসা ইত্যাদি ধর্মীয় কার্যাদি সম্পন্ন হতো। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে এক কালা-কানুনের আওতায় ইংরেজ সরকার ওয়াকফ সম্পত্তি দখল করে নেয়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পঙ্গু করার পর ইংরেজরা চিন্তা করল মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিকাশের পথকেও রুদ্ধ করতে হবে। মূলত কালা-কানুনের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তি দখলের পেছনে এ ষড়যন্ত্র কাজ করেছিল। তাই ইংরেজ আমলে যেসব ওয়াকফ সম্পত্তি ছিল সেগুলোর অধিকাংশই এখন আর অবশিষ্ট নেই।

৮.৩ ইংরেজদের বিজয়ের পর শত শত প্রাচীন মুসলিম ঐতিহ্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ফলে লাখেরাজ ভূসম্পত্তির দ্বারা মুসলমানদের যে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছিল তাও বন্ধ হয়ে গেল।[5]W. W. Hul Hunter, The Indian Mussalmans, Bangladesh Edition, 1975, P. 167 পরবর্তীতে ভারত সরকারও মুসলমানদের ওয়াকফ সম্পত্তিসমূহের ক্ষেত্রে একই আচরণ করেছে। কোনো আইন প্রচলিত না থাকায় ওয়াকফ সম্পত্তি ও তার উপস্বত্ব যথেচ্ছা ব্যবহৃত হতো। তদানীন্তন মুসলিম ওলামা, আইনবিদ, রাজনীতিবিদ ও অন্যান্য সুধীবৃন্দের উদ্যোগে ওয়াকফের সংরক্ষণ ও তার উপস্বত্বের সুষ্ঠু ব্যয়ের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য একটি আইন জারি করার দাবি উত্থাপিত হয়। এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তদানীন্তন প্রিভি কাউন্সিল কর্তৃক ১৯১৩ সালে ‘ওয়াকফ ভেলিডেটিং অ্যাক্ট’ নামে এক আইন জারি করে। প্রকৃতপক্ষে তখন থেকে এ উপমহাদেশে ওয়াকফ আইনগতভাবে স্বীকৃতি লাভ করে। এ আইনের কার্যকারিতার জন্য ১৯৩৪ সালে ‘বঙ্গীয় ওয়াকফ অ্যাক্ট’ নামে এক আইন জারি করে ওয়াকফকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়। ওয়াকফ প্রশাসনকে আরো গতিশীল ও যুগোপযোগী করার জন্য ১৯৬২ সালে ওয়াকফ অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এ প্রসঙ্গে জনাব মোখতার আহমদ বলেন, “The people of this country saw the emergence of waqf law in different stages initiated by the British for the first time in 1894 through the declaration of the Privy Council waqf alal aulad or family awqaf as invalid which was subsequently repealed and replaced by ‘The Mussalman Waqf Validating Act in 1913’ followed latter on by ‘The Mussalman Wakf Act, 1923’, ‘The Bengal Waqf Act, 1934’, and finally ‘The East Pakistan Waqf Ordinance, 1962’. ‘The East Pakistan Waqf Ordinance, 1962 is the cornerstone of waqf management in Bangladesh barring some minor amendments made in it by the Waqf Ordinance 1988 and Waqf Ordinance 1998.”

৮.৪ ১৯৫০ সালে জমিদারি দখল ও প্রজাস্বত্ব আইন প্রবর্তনের ফলে বহু ওয়াকফ এস্টেটের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গিয়েছে। তৎকালীন ইংরেজ সরকারের কাছে ওয়াকফ সম্পত্তির কল্যাণকারিতার তেমন গুরুত্ব না থাকায় অনেক সম্পত্তির বিপুল ক্ষতি সাধিত হয়েছে। জেলা প্রশাসকগণ কোনো অ্যানুয়িটি নির্ধারণ না করেই অনিয়মিতভাবে ওয়াকফ এস্টেট কর্তৃত্বাধীনে নিয়েছেন। শরী‘আতের বিধানের কোনোরূপ তোয়াক্কা না করেই বিভিন্ন সরকারের আমলে উন্নয়নমূলক কাজের নামেও বহু ওয়াকফ সম্পত্তি যথেচ্ছাভাবে হুকুম দখল করা হয়েছে। এছাড়া ওয়াকফ সম্পত্তি ওয়াকফ অধ্যাদেশের ৫৬ ধারা মতে ওয়াকফ প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া হস্তান্তর করার বিধান নেই। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওয়াকফদাতার মৃত্যুর পর তার বংশধররা বিনা অনুমতিতে সম্পত্তি হস্তান্তর করে এবং তা সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে বিনা বাধায় রেজিষ্ট্রি হয়। এসব কারণে হাজী মুহাম্মদ মুহসিন ওয়াকফ এস্টেট, নোয়খালী ভুলোয়া এস্টেট, লাকসামের পশ্চিম গাঁ নবাবদের ওয়াকফ এস্টেটসহ উত্তর বঙ্গ ও রাজশাহী অঞ্চলের বহু বড় বড় ওয়াকফ এস্টেটের আজ কোনো হদীস নেই। উল্লেখ্য ভারতের হুগলি জেলার সৈয়দপুরের জমিদার হাজী মুহাম্মদ মহসিন ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে হুগলির ইমামবাড়ার ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যয় সংকুলানের উদ্দেশ্যে তাঁর সমুদয় ভূসম্পত্তির আয় ওয়াকফ করেন। বাংলাপিডিয়ায় এ ভাবে উল্লেখ আছে,  “The most notable public waqf is the Mohsin Fund. Haji Muhammad Mohsin of Hughli, India and a zamindar of Saidpur estate, endowed in 1806 the whole of his estate income to the maintenance of religious and educational establishments of the Imambarah, Hugli.” (1.http://www.banglapedia.org/httpdocs/HT/W_0018.HTM)

তাঁর পরিবারের এক সদস্য এই ওয়াকফের আইনগত বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা করেন। ফলে ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে সরকার ১৯ নং আদেশ বলে এই সম্পত্তি ক্রোক করে এবং সদও দেওয়ানি আদালতে মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তা সরকারি অধিকারেই থাকে। মামলাটি প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত যায় এবং ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে প্রিভি কাউন্সিল পরলোকগত ওয়াকফকারী হাজী মহসিনের পক্ষে রায় দেয়। এক সময় হাজী মুহাম্মদ মুহসিন ফান্ডের টাকায় এদেশে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এবং বহু মানুষ এ ফান্ডের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছে। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময় এ ফান্ডের এক বিরাট অংশ এদেশের ভাগেও পড়েছিল।

কিন্তু বর্তমানে তা কোথায় কিভাবে আছে সেটি রীতিমতো অনুসন্ধানের বিষয়। এ ভাবে বিভিন্ন ঘাতপ্রতিঘাত ও উত্থান-পতন অতিক্রম করেই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ওয়াকফ একটি অনন্য মানবকল্যাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে এদেশের মানুষের জীবন যাত্রার সাথে মিশে আছে।

৯. ওয়াকফ : প্রাসঙ্গিকতা মূল্যায়ন

৯.১ বাংলাদেশেও বহু ওয়াকফ-সম্পত্তি রয়েছে—১৯৮৬ সালের জরিপ অনুসারে বাংলাদেশে প্রায় ১.৫০৫৯৩টি ওয়াকফ এস্টেট রয়েছে। এই বিপুল সংখ্যক ওয়াকফের মধ্যে রেজিষ্ট্রিকৃত ওয়াকফ এস্টেট ৯৭০৪৬টি, মৌখিকভাবে এবং দলিলপত্রে স্বীকৃত ৪৫৬০৭টি এবং ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় চলে আসছে ৭৯৪০টি।[6]Mohammad azharul islam, A waqf experience of Bangladesh in south Asia,  page.3

ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে এতিমখানা, মক্তব, মাদরাসা, হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ এবং মসজিদ প্রভৃতি। ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা, কদম মোবারক এতিমখানা, ইসলামীয়া চক্ষু হাসপাতাল, হামদর্দ ল্যাবরেটরীজ এবং শাহ আলী মাজার ওয়াকফ এস্টেট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

৯.২ ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ওয়াকফ সংক্রান্ত সমস্যা ও সমাধানসমূহ সরেজমিনে অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা করে রিপোর্ট তৈরির জন্য একটি ‘ওয়াকফ স্টাডি কমিটি’ গঠন করা হয়েছিল। ১৯৮২ সালে কমিটি এ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট সরকারের নিকট পেশ করেছিল। সে রিপোর্ট ও সুপারিশটি বাস্তবায়ন করা হলে ওয়াকফ সংক্রান্ত অনেক জটিলতাই দূর হয়ে যেত। কিন্তু তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। সরকারি উদ্যোগে এ সংক্রান্ত একটি কমিটি গঠন করে পুনরায় কাজ আরম্ভ করা খুবই জরুরি। ওয়াকফের মূল লক্ষ্যকে সামনে রেখে নতুনভাবে এ সংক্রান্ত নিয়ম-বিধি ঢেলে সাজানো হলে এটি আমাদের সমাজ জীবনে এক বৈপ্লবিক কল্যাণধারার সূচনা করবে। বিশেষ করে দারিদ্র্য বিমোচন, ইসলামি আদর্শ বিস্তার, যুগজিজ্ঞাসার চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় জ্ঞান-গবেষণা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, এবং নিজস্ব সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ বিকাশে ব্যাপক ও স্থায়ী অবদান রাখতে সক্ষম হবে। দেশবাসীর ঈমান-আকিদা, নৈতিক জীবনবোধ, নিজস্ব সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের উন্নতি ও বিকাশের স্বার্থে আত্মসাৎকৃত ও হারিয়ে যাওয়া ওয়াকফ এস্টেটসমূহ পুনরুদ্ধার করতে হবে। এ লক্ষ্যে ওয়াকফ প্রশাসনের কাঠামোগত দুর্বলতা দূর করা একান্ত প্রয়োজন। এটি একমাত্র বলিষ্ঠ কোনো ধর্ম মন্ত্রণালয় অথবা পৃথক ওয়াকফ মন্ত্রণালয়ই করতে পারে। অন্যান্য মুসলিম দেশেও ওয়াকফ বিষয়ক আলাদা মন্ত্রণালয় রয়েছে।[7]সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, ১ম খন্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৫-২৪৬

৯.৩ ওয়াকফ প্রশাসনের কাঠামোগত দুর্বলতা দূর করার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন একটি নতুন ওয়াকফ অ্যাক্ট প্রণয়ন করা। ওয়াকফের মূল লক্ষ্য অক্ষুণ্ন রেখে ব্যাপকভাবে এ সংক্রান্ত নিয়মবিধি সংস্কার করা হলে তা আমাদের সমাজ জীবনে প্রভূত কল্যাণধারার সূচনা করবে। বিশেষ করে এদেশে দারিদ্র্য বিমোচন, ইসলামি আদর্শ বিস্তার, যুগ-জিজ্ঞাসার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইসলামি জ্ঞান-গবেষণা, নিজস্ব সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ বিকাশে ব্যাপক অবদান রাখতে সক্ষম হবে। ওয়াকফ এস্টেটের বর্ধিত আয় দিয়ে ওয়াকফদাতার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নসহ লিল্লাহখাতে যথা মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ নির্মাণ, সংস্কার এবং সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে। এছাড়া দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদানসহ বিনামূল্যে লেখা-পড়া ও থাকা খাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

৯.৪ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ওয়াকফ প্রদান এবং এ সম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের মতো মৌলিক তথা দারিদ্র্য বিমোচনের যে অভূতপূর্ব সম্ভবনা রয়েছে তা জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার করা দরকার। এ উদ্দেশ্যে ওয়াকফ প্রশাসন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ইসলামি ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এবং ওআইসি, আইডিবি ও ওয়ামীসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং ক্রোড়পত্র প্রকাশের মাধ্যমে মানুষের নিকট ওয়াকফের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করতে পারে। বিদ্যমান ওয়াকফ সম্পদের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন ও শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রগতির উদ্দেশ্যে সুপরিকল্পিত জরিপ ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

৯.৫ আমাদের দেশে এক সময় ওয়াকফ সিস্টেম ব্যাপকভাবে চালু ছিল। কিন্তু বর্তমানে পূর্ব থেকে চলে আসা কিছু ওয়াকফ বাদে নতুন করে ওয়াকফ কম হচ্ছে। এর কারণ আমাদের সমাজ থেকে ওয়াকফের গুরুত্ব আজ অনেকটা হারিয়ে গেছে। আমাদেরকে সমাজের দুস্থ, অসহায় ও বিত্তহীন মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কার্যকর অবদান রাখার জন্য ওয়াকফের গুরুত্ব সমাজে ফিরিয়ে আনতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন নতুন এক ওয়াকফ আন্দোলন। বিশ্বব্যাপীই তা আরম্ভ হওয়া প্রয়োজন, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে এবং বাংলাদেশে।

৯.৬ এক সময় আমাদের দেশে জমিদারি প্রথা চালু ছিল। অনেকেই শত শত বিঘা জমির মালিক ছিল। সেখান থেকে এক বা একাধিক বিঘা জমি পরকালের কল্যাণের জন্য আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করেও দিত তারা। এই চিত্র এখন আর দৃশ্যমান নয়; বরং এটি সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়ে এখন মানুষ ব্যাবসা-বাণিজ্য ও শিল্প কলকারখানা স্থাপন করে কোটিপতি বা শত শত ও হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হচ্ছে। তাই যারা কোটিপতি বা দশ বিশটা শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক তারা নগদ অর্থ অথবা এক বা একাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান ওয়াকফ করে দিতে পারেন। ইচ্ছা করলে এ উদ্দেশ্যে এক একজন এক একটি ফাউন্ডেশনও গঠন করতে পারেন। এর আয় দ্বারা সমাজের দুস্থ অসহায় মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাবে। কোনো খাতে অর্থ ব্যয় করা হবে তা ওয়াকিফ (ওয়াকফকারী ব্যক্তি) নির্ধারণ করে দেবেন। কোনো এক ব্যক্তি কর্তৃক এর অর্থ অপচয় ও অপব্যবহারের কোন সুযোগ রাখা যাবে না; বরং একটি কমিটি দ্বারা এটি পরিচালিত হবে। এখানে মডার্ন কর্পোরেট ধরনের ম্যানেজমেন্ট ব্যবহার করতে হবে। যাকে ফাউন্ডেশন বা ট্রাস্ট বলা যায়। এ জন্য সরকারের আইন থাকবে, তবে পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। এভাবে যদি পাঁচশ, এক হাজার বা ততোধিক ওয়াকফ-ফাউন্ডেশন দেশব্যাপী গড়ে উঠে, তবে সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তা কাঙ্ক্ষিত সাফল্য এনে দেবে। পূর্ব থেকে চলে আসা ওয়াকফ-সমূহের কার্যকর ভূমিকার পাশাপাশি নতুন এরূপ ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান দ্বারাই বর্তমান সময়ে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ অবদান রাখা সম্ভব হবে। এ জন্য জাতির অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, চিন্তাবিদ, গবেষক ও আলেমগণকে এগিয়ে আসতে হবে এবং দারিদ্র বিমোচনের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে হবে। বিত্তশালীদের মন ও মননে সৃষ্টি করতে হবে ওয়াকফের দীর্ঘ পথ পরিক্রমার মানবিক চেতনা ও সমাজ উন্নয়ন জাগৃতি।

 

সমাপ্ত

তথ্যসূত্র:

তথ্যসূত্র:
1 আব্বাস আলী খান, বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস (ঢাকা : বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার,২০০২), পৃ.১৩-২৪
2 http://www.banglapedia.org/httpdocs/HT/W_0018.HTM
3 আব্বাস আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪১
4 আব্বাস আলী খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪১, A. R. Mallik, Br. Policy & the Muslims in Bengali, p. 150
5 W. W. Hul Hunter, The Indian Mussalmans, Bangladesh Edition, 1975, P. 167
6 Mohammad azharul islam, A waqf experience of Bangladesh in south Asia,  page.3
7 সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, ১ম খন্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৫-২৪৬

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷