মুসলিম জ্ঞানচর্চায় ওয়াকফের ভূমিকা : পুনর্পাঠ ও প্রাসঙ্গিকতা (প্রথম পর্ব)
৭. ইসলামি তুরাসে লাইব্রেরি-ব্যবস্থাপনা এবং ওয়াকফ
৭.১ ইসলামি তুরাসে গ্রন্থাগার এবং বইপত্র ওয়াকফের রেওয়াজ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা—এর সাহায্যে জ্ঞানতাত্ত্বিক এতিহ্য সংরক্ষণ ও বিকাশে প্রবল বেগ সঞ্চারিত হয়। সভ্যতার প্রতিযোগিতায় ইসলাম প্রতিষ্ঠিত থাকে শির উঁচু করে। ইসলামের প্রকৃত জ্ঞানস্রোতকে সরলরেখায় প্রবাহিত করে, বিচ্যুতি ও অবৈধ সংযোজন থেকে হেফাজত করার মহাযজ্ঞে ওয়াকফ ছিল গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রণোদনা। বিভিন্ন জ্ঞান ও শাস্ত্রের সংকলন, গ্রন্থণা ও অনুশীলনের ধারা লিখনী ও মৌখিক সূত্রে বিন্যস্ত হতে থাকে।
হিজরির দ্বিতীয় শতকে বাগদাদের বাইতুল হিকমাহ লাইব্রেরি আব্বাসি শাসকদের বিশেষ খাতির-যত্নে গড়ে উঠে। বিশেষত এতে খলিফা মামুনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। মসুল শহরে ২৭০ হিজরী সালে ইবনে হামাদান আল-মসুলি দারুল ইলম নামে একটি গ্রন্থাগারের সূচনা করেন, তার যুগের উজির এবং প্রশাসকগণও অবশ্য তাতে ভুমিকা রেখেছিলেন। তবে প্রধান ব্যবস্থাপক ও নির্বাহী ছিলেন ইবনে হামাদান।[1] তারিখুল মওসিল : ১/১৯২ বসরা, বাগদাদ, কায়রো, শাম এবং ফিরোজাবাদ প্রভৃতি অঞ্চলে ওয়াকফকৃত সম্পদে গড়ে উঠা বহু গণপাঠাগার ছিল, জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকার সুবাদে ব্যাপকভাবে মানুষ জ্ঞান আহরণ করত। বাগদাদে খলিফা মুতাওয়াক্কিলের সময় মাকতাবাতুল ফাতাহ ছিল কেতাবের বিরাট সংগ্রহশালা।[2]মিন রাওয়াঈ হাযারাতিনা : ১৫৭ পৃ.
আব্বাসি খলিফা মুস্তানসির বিল্লাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মাদরাসায়ে মুস্তানসিরিয়ার মাকতাবা ৬৪০ হিজরি সনে খলিফা নিজে এর উদ্বোধন করেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে গুয়াতা হাওয়াদেসে জামেআহ গ্রন্থে এ মাকতাবা সম্পর্কে বলেন : “এ মাকতাবায় অনেক গুরত্বপূর্ণ কিতাবাদি ছিল। বিভিন্ন স্থান থেকে ১৬০ টি উট বোঝাই করে এর কিতাবাদি আনা হয়েছিল। খলিফার ব্যক্তিগত পাঠাগারের পরিচালক জিয়াউদ্দিন আহমদ কিতাবগুলো সুবিন্যস্ত করেছিলেন। এর পরিচালনার জন্য দায়িত্ব অর্পণ করা হয় অভিজ্ঞ দশজন ব্যক্তির উপর। তাদের একজন ছিলেন শামস ইবনে আলি কাতবি। এই গ্রন্থাগারটি মোগলদের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়।”
ইসলামি তুরাসে ওয়াকফ-ভিত্তিক পাঠাগার ব্যবস্থাপনার একটি চমৎকার দিক বলা যায় ‘মসজিদ-পাঠাগার’কে; লোকজন মসজিদে কুরআন কারিমের মুসহাফ এবং নানাবিধ ধর্মীয় কেতাবাদি ওয়াকফ করতেন। এই প্রচলন হাল আমলেও বাকি আছে। মুসল্লিগণ নামাজান্তে মসজিদকে ঘিরে গড়ে তোলা পাঠাগারে মনোনিবেশ করেন, ধর্মীয় বইপুস্তক নেড়েচেড়ে দেখেন, সমৃদ্ধ হোন দ্বীনি-ইলমে। বিশেষত দ্বীন সংশ্লিষ্ট গ্রন্থাদি-ই স্থান পায় এসব পাঠাগারে। সাধারণ জনতা থেকে আরম্ভ করে প্রশাসক, কাজি, আলেম এবং বিত্তশালী নির্বিশেষে সবাই কমবেশি প্রণোদনা দিত। তুরস্কের দিয়ারে বকর এলাকায় ‘জামে আমুদ লাইব্রেরি’ নামে মশহুর একটি গ্রন্থাগার আছে, মসজিদের সাথেই। বাগদাদের জামে আবু হানিফা লাইব্রেরির সূচনা হয়েছে হিজরীর ৫ম শতকে। কায়রোর জামে আযহার গ্রন্থাগার তো বেশ মশহুর। হিজরির ষষ্ঠ শতকে মসজিদে নববির পাশে গড়ে উঠে পাঠাগার।[3]আল-ওয়াকফ ওয়া বুনয়াতুল মাকতাবাতিল আরাবিয়া : ৪৮ পৃ. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘিরেও গড়ে উঠত বড় বড় লাইব্রেরি, যা ওয়াকফের অর্থায়নে সমৃদ্ধ সংগ্রহশালায় রুপ নিত।
ইসলামি তুরাসে বিমুগ্ধ ও বিমোহিত হবার বিচিত্র উপাদান আছে, আমরা তা জানি। কিন্তু আপনি অবাক হবেন যে, কবরস্থানের পাশেও তৎকালে গ্রন্থাগার গড়ে উঠেছিল। এসব তথ্য কেবল প্রাণ-চাঞ্চল্যই তৈরি করে না, নিজেদের সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতা ও ব্যর্থতাগুলোও সামনে নিয়ে আসে। নিরন্তর লৌহশলাকার মতো বিদ্ধ হতে থাকে বিবেচনাবোধে। হিজরির ২৫৯ সালে ওয়াকফ-সম্পত্তিতে গঠিত ‘ইবনে তুলুন হাসপাতাল পাঠাগার’ ছিল কায়রোতে, এখানে চিকিৎসাবিজ্ঞান-সহ বিভিন্ন বিশেষায়িত জ্ঞানশাখার প্রায় এক লাখের মতো বইপত্র ছিল।[4]তারিখুল বিমার সিতানাত ফিল ইসলাম : ৭১ পৃ.
এছাড়াও চতুর্থ হিজরিতে ‘বাদশাহ আদ্দুদ দাওলা’ হাসপাতালের পাশে একটি বড় পাঠাগার করেছিলেন। কায়রোর মানসুরিয়া হাসপাতাল পাঠাগারে বহু কেতাবপত্র ছিল, তবে গুরুত্ত্বপূর্ণ একটা নোক্তা হচ্ছে এই যে, প্রখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী আলেম ইবনে নাফিস মৃত্যুর সময় নিজের সকল বইপত্র এই পাঠাগারে ওয়াকফ করে গিয়েছিলেন।
যেসময়ে কেতাবের আকাশচুম্বী দাম ছিল, ইবনে বাশকাওয়াল লিখেছেন, তখনও সালামা বিন সাঈদ (মৃত্যু: ১০১৫ ঈসায়ী) প্রাচ্য থেকে ১৮টি বাহনে প্রচুর কিতাবপত্র বেঁধে স্পেনে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে নির্দিষ্ট একক কোনো শাস্ত্রের বই ছিল না, বরং বিষয় বৈচিত্রসহ সমৃদ্ধ সংগ্রহ ছিল।[5]আসসিলাহ ফি তারিখি আইম্মাতিল উন্দুলুস ওয়া উলামাউহুম ওয়া ফুকাহাউহুম ওয়া … Continue reading
৭.২ খানকাগুলোতেও দেখা যেত ওয়াকফের পাঠাগার। চতুর্থ হিজরিতে খানকা-সংশ্লিষ্ট পাঠাগারের প্রচলন তুলনামূলক বেশি ছিল। বাগদাদে রিবাত তাহেরি নামে একটি গ্রন্থাগার ছিল, আব্বাসি খলিফা নাসের লি দ্বীনিল্লাহ হিজরি ৫৮৯ সালে এর গোড়াপত্তন করেন।[6]আল কামেল ফিত তারিখ : ১২/ ১০৪ পৃ.
দিমাশকের সামিসাতিয়া খানকার পাঠাগার গঠিত হয়েছিল হিজরি ষষ্ঠ শতকে। অনেক ওয়াকফকারীর বিচক্ষণতা ও রুচিশীলতা এতটাই প্রজ্ঞাপূর্ণ ছিল যে, তারা কবরের পাশেও পাঠাগার গড়ে তোলার নিয়ত করেন, যেন লোকজন কবর যিয়ারত ও বিশ্রামের সময় বইপাঠে নিরত হতে পারে। হিজরি ৫৭৪ সালে খলিফার মায়ের কবরের পাশে পাঠাগার গড়ে তোলা হয়েছিল, যাতে কয়েক শত বই ছিল। এছাড়াও দামেশকে ইবনে বাজুরির কবরের পাশে, কায়রোতে মানসুরিয়া কবরস্থান পাঠাগার এবং উগুলি কবরস্থান পাঠাগার বিশেষভাবে খ্যাতি লাভ করেছিল।[7]আল-ওয়াকফ ওয়া বুনয়াতুল মাকতাবাতিল আরাবিয়া : ১১৪ পৃ.
৭.৩ মু’জামুল বুলদান গ্রন্থে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইয়াকুত হামাবি বলেন : “খোরাসানের মারও শহরের জামে মসজিদে ছিল এক বিশাল মাকতাবা। তাতে ছিল অমূল্য সব গ্রন্থের বিপুল সমাহার। যদি তাতারিরা এ শহরে ধ্বংসযজ্ঞ না চালাত, তবে এই একটি মাকতাবার কারণে এই শহর সকলের ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতো। এই মাকতাবাগুলো যদি ধ্বংস না হতো, আমি আজীবন এ শহরে থেকে যেতাম। এই শহর সবদিক থেকেই ইলম অর্জনের উর্বর ভূমি। মানুষগুলো অমায়িক। দারুণ সৌহার্দ্যপূর্ণ। এখানের মাকতাবাগুলো যেন অমূল্য রত্নের বিরল খনি। আমি যখন এদেশ ছাড়ি, এখানে দশ দশটি মাকতাবা ছিল। তা মূল্যবান কিতাবে এতটাই সমৃদ্ধ ছিল যে, বিশ্বজুড়ে আমি তার কোন তুলনা খুঁজে পাইনি।”
তারপর হামাবি খোরাসানের মাকতাবা দশটির আলোচনা করেছেন। ১-২. জামে মসজিদে দুটি মাকতাবা ছিল। একটিকে আজিজিয়া অন্যটিকে কারিমিয়া বলা হত। আজিজিয়াতে প্রায় তেরো হাজার কিতাব ছিল। ৩. সুলতান মুস্তাওফি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় একটি ওয়াকফের মাকতাবা ছিল। ৪-৫. দুই সামআনির নামে দুটি মাকতাবা ছিল। ৬. আল মাদরাসাতুল আমিদিয়াতে ছিল একটি মাকতাবা। ৭. নিজামুল মুলক হাসান ইবনে ইসহাক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ছিল আরেকটি মাকতাবা। ৮. মাজদুল মালিক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ছিল ভিন্ন একটি মাকতাবা। ৯. আল খাযায়িনুল খাতুনিয়া নামের ছিল অন্য একটি মাকতাবা। ১০. মাদ্রাসায়ে সুফিয়ার খানকায় জমিরিয়া নামের একটি মাকতাবা ছিল।
ইয়াকুত হামাবি এসব মাকতাবা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। জমিরিয়া প্রসঙ্গে বলেন, ‘এই মাকতাবা থেকে কিতাব নেওয়া সবচেয়ে সহজ ছিল। আমার ঘরে সবসময় এ মাকতাবার অন্তত দুই শত কিতাব থাকত। আমি এসব কিতাব মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করতাম। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য টুকে রাখতাম। আমি এসবে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম যে, পরিবার-পরিজনের কথা পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলাম। আমি আমার এ কিতাব (মু’জামুল বুলদান) এর অধিকাংশ তথ্য এখান থেকেই সংগ্রহ করেছি।’
এগুলো ব্যক্তি বা জনসাধারণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ওয়াকফের মাকতাবা। ইতিহাসের গ্রন্থাবলিতে সুলতান কর্তৃক নির্মিত মাদ্রাসাগুলোতে ওয়াকফের বিভিন্ন মাকতাবার আলোচনা এসেছে।
৭.৪ ওয়াকফকৃত গ্রন্থাগারগুলো সাধারণত অন্যান্য গ্রন্থালয়ের চেয়ে বেশি সমৃদ্ধ হতো। এর কারণও ছিল। একজন আলেমের যখন মৃত্যুর ক্ষণ ঘনিয়ে আসত, তখন তার সবচে বেশি পেরেশানি থাকত এসব কিতাব নিয়ে। হতে পারে এসব এমন ব্যক্তির হাতে পড়বে, যে কদর বুঝবে না। যথাযথ হক আদায় করবে না। তাই অনেকে মৃত্যুর আগেই কিতাবগুলো কোথাও ওয়াকফ করে দিতেন। কেউ আবার মৃত্যুর পূর্বে তা ওয়াকফের জন্য ওসিয়ত করে যেতেন। জীবনীভিত্তিক ইতিহাসের গ্রন্থাবলিতে এর অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। এর দ্বারা বুঝা যায়, ওয়াকফ করা তখন আলেমদের সাধারণ আচারে পরিণত হয়েছিল। এভাবে বিভিন্ন আলেমের জীবনভর সংগ্রহ যদি কোনো গ্রন্থাগারে একত্রিত হয়, তবে তার সমৃদ্ধির সাথে অন্যান্য গ্রন্থাগার কি কুলিয়ে পারে? নিম্নে জীবনীভিত্তিক ইতিহাসের গ্রন্থাবলি থেকে বিভিন্ন আলেমের ওয়াকফের ঘটনা তুলে ধরা হলো।
ক. হামাবি মু’জামুল বুলদান গ্রন্থে বলেন, প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে হিব্বান বাস্তি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি মৃত্যুর পূর্বে এক লোককে ওসিয়ত করে যান—মৃত্যুর পর সে যেন তার কিতাবগুলো দারুল কুতুবে পৌঁছে দেয়। যারা এগুলো থেকে অনুলিপি করতে চায়, তাদের জন্য যেন সুযোগ রাখা হয়।
খ. ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে জাযলাহ আত-তিব রহমতুল্লাহি আলাইহি মৃত্যুর পূর্বে তার কিতাবাদি ইমাম আবু হানিফা রহমতুল্লাহি আলাইহির মাজার সংলগ্ন মাকতাবায় ওয়াকফ করে দেন।
গ. প্রখ্যাত মুহাদ্দিস খতিবে বাগদাদি রহমতুল্লাহি আলাইহি মৃত্যুর সময় তার কিতাবাদি ওয়াকফ করে দেওয়ার ওসিয়ত করে যান।
ঘ. মুহাম্মদ ইবনুল বান্ধি রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ পরিমাণ কিতাব সংগ্রহ করেছিলেন, সমসাময়িক অন্য কেউ সে পরিমাণ সংগ্রহ করতে সমর্থ হননি। তিনি তার সকল কিতাব দামেস্কের সামিসাথি খানকার গ্রন্থাগারে ওয়াকফ করেন।
ঙ. ইমাম আবুল মাআলি আর-রাশিদি তার কিতাবাদি আল জামিউল মানিঈর গ্রন্থাগারে ওয়াকফ করেন।
চ. আল্লামা হামাবি মু’জামুল বুলদান গ্রন্থে বলেন, রশিদ উদ্দিন ওয়াতওয়াত এক কিতাবে লিখেছেন, আমি আমার হালাল উপার্জনে হাজারখানেক বই ক্রয় করি। এবং তার সবকয়টি মুসলমানদের উপকারার্থে ওয়াকফ করি।
ছ. ইমাম ইবনে কাসির রহমতুল্লাহি আলাইহি আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে বলেন, খলিফা মুস্তানসির বিল্লাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায়ে মুস্তানসিরিয়ার গ্রন্থাগারে খলিফা এ পরিমাণ কিতাব ওয়াকফ করেছিলেন যে, পৃথিবীতে এর জুড়ি মেলা ভার।
৭. ৫ সতেরো শতকের একজন প্রখ্যাত ফকিহ ও মুহাদ্দিসের পরিচালনায় গড়ে উঠা কেতাব-ওয়াকফ ব্যবস্থাপনা নিয়ে সংক্ষেপে কয়েকটি নোক্তা দেই—
ক. তিনি হচ্ছেন আবুল হাসান আল-গাফিকি, ৫৭১ হিজরির ৫ম রমজানে তিনি স্পেনে জন্মগ্রহন করেন। ইয়াকুব আল-মানসুরের শাসনামলে তিনি বেড়ে উঠেন একটি ইলমি পরিবেশে, শৈশবেই তিনি দেখেছেন দরসগাহ, কেতাবের খাজানা এবং প্রখ্যাত আলেমদের; ফলে অল্প বয়স থেকেই তিনি বিভিন্ন জ্ঞানশাখার সাথে পরিচিত হন। ছাত্রত্ব হাসিল করেন বহু আলেম থেকে। কুরআন, হাদিস, কেরাত, নাহু, আরবি ভাষা ও ফিকহ ইত্যাদি বিষয়ে তিনি দক্ষতা অর্জন করতে থাকেন। স্পেন ও মরক্কোর বহু আলেম আবুল হাসান আল-গাফিকির শিষ্যত্বে বেড়ে উঠেছেন—তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ইবনে যোবায়ের।
খ. সাবতা শহর (সেউতা হল উত্তর আফ্রিকার উপকূল এবং জিব্রাল্টার প্রণালিতে অবস্থিত একটি স্পেনীয় শহর) ঘিরে যে জ্ঞান-ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছিল হিজরি ষষ্ঠ শতকে, তা আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়েছে হাল আমলে। এই যুগে, সেউতা শহরে ওয়াকফভিত্তিক গ্রন্থাগার ও বইপত্রের উত্থান আরম্ভ হয় মূলত শায়খ আবুল হাসান আল-গাফিকির হাত ধরে। তিনি সেউতা শহরে বড় বড় গ্রন্থাগার ও জ্ঞানচর্চা-কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। মুহাম্মাদ আল-মানুনির প্রদত্ত তথ্যমতে পশ্চিমে সর্বপ্রথম গ্রন্থাগার গড়ে তোলেন আবুল হাসান আল-গাফিকি। তার সফলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, তিনি কেবল গ্রন্থাগার করেই দমে যাননি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে গ্রন্থাগারের সজীবতা সৃষ্টি করেছেন, এমন কিছু শিষ্য তৈরি করেছেন যারা প্রতিনিয়ত গ্রন্থাগারকে ইলম ও চিন্তার বিকাশে সক্রিয় রেখেছেন। সুতরাং বোঝা যায় গ্রন্থাগারের সাথে সাথে একটা জ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম গড়ে তুলতেও সচেষ্ট ছিলেন তিনি। তার গ্রন্থাগার সংগঠন এতটাই সফলতা হাসিল করে যে, মানুষের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়ে যায়, কে কতো বেশি পরিমাণে এবং দুর্লভ দুর্লভ কিতাব সংগ্রহ করতে পারে। ফলে মানুষ এই দাবি করতে খুবই গর্ববোধ করতো যে, অমুক কিতাব আমি ছাড়া আর কারো কাছে নেই। এমনকি শাসকদের ঘরেও গ্রন্থাগার গড়ে উঠেছিল।
গ. তখন সাধারণত দুই তরিকায় ওয়াকফভিত্তিক গ্রন্থাগার গড়ে উঠত—প্রথমত, সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রচেষ্টায়, গোটা গ্রন্থাগারকে ওয়াকফ করে দেওয়া। আবুল হাসান আল-গাফিকি যেমন করেছেন। দ্বিতীয়ত, বিত্তশালী কিংবা অন্যান্য লোকজন থেকে অল্প অল্প করে সুবিশাল গ্রন্থাগার গড়ে তোলা। ১৩৯৭ ইসায়ি সনে ইবনে খালদুন তার ‘ইবার’ কেতাব ওয়াকফ করেছিলেন জামে কারাভিনের গ্রন্থাগারে। তবে এই সময়ের ওয়াকফ-নির্ভর গ্রন্থাগারগুলো অধিকাংশ ছিল মাদরাসাকেন্দ্রিক। কিছু কিছু মাদরাসার মাকতাবায় বিপুল পরিমাণ কেতাব জমা হয়েছিল। ফাস অঞ্চলে অবস্থিত ইলমে কালাম মাদরাসার মোট কেতাবের মূল্য দাঁড়িয়েছিল চার হাজার মিসকাল পরিমাণ।[8]আল ওয়াকফুল ইলমি ফিল গারব বাইনা জিদ্দাতিল ফিকরাতি ওয়া রিয়াদাতিত তাজরিবা : … Continue reading
শেষ পর্ব পড়বেন আগামী সংখ্যায়…
তথ্যসূত্র:
↑1 | তারিখুল মওসিল : ১/১৯২ |
---|---|
↑2 | মিন রাওয়াঈ হাযারাতিনা : ১৫৭ পৃ. |
↑3 | আল-ওয়াকফ ওয়া বুনয়াতুল মাকতাবাতিল আরাবিয়া : ৪৮ পৃ. |
↑4 | তারিখুল বিমার সিতানাত ফিল ইসলাম : ৭১ পৃ. |
↑5 | আসসিলাহ ফি তারিখি আইম্মাতিল উন্দুলুস ওয়া উলামাউহুম ওয়া ফুকাহাউহুম ওয়া উদাবাউহুম, ইবনে বাশকাওয়াল : ১/ ১৩ পৃ. |
↑6 | আল কামেল ফিত তারিখ : ১২/ ১০৪ পৃ. |
↑7 | আল-ওয়াকফ ওয়া বুনয়াতুল মাকতাবাতিল আরাবিয়া : ১১৪ পৃ. |
↑8 | আল ওয়াকফুল ইলমি ফিল গারব বাইনা জিদ্দাতিল ফিকরাতি ওয়া রিয়াদাতিত তাজরিবা : খাজানাতু আবুল হাসান উনমুজাযান, ড. আহমাদ আস-সাদিকি : ২, ৪, ৬ পৃ. |
মাশাআল্লাহ। উস্তাদ, অসাধারণ লেখনী।