ওয়াকফ সামাজিক উৎকর্ষের একটি ইসলামি ব্যবস্থাপনা, জীবন ও জগতের প্রায় সকল ক্ষেত্রের সাথে তার সংযোগ রয়েছে। সদকায়ে জারিয়া ও ইসলামি তাকাফুলের একটি রুপ। মুসলিম ইতিহাসের বিভিন্ন ধরনের ওয়াকফ ব্যবস্থার সাথে আমরা পরিচিত—লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা, রাস্তা নির্মাণ, কুপ, সেচব্যবস্থা, বাগান, সাকো, মসজিদ-মাদরাসা, হাসপাতালসহ বিভিন্ন সেবামূলক সক্রিয়তা ওয়াকফ-ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জারি হয়েছিল। এক সময় মুসলিম বিশ্বের ১০ থেকে ১৫ ভাগ সম্পদ ওয়াকফের অধীন চলে এসেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে কমিউনিস্টরা সোভিয়েত রাশিয়ার ক্ষমতা দখল করে সমস্ত সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ব করে ফেলে। ফলে ওয়াকফের অধীন যেসব স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, এতিমখানা, সরাইখানা ও হাসপাতাল পরিচালিত হতো তার সবই বন্ধ হয়ে যায়। আমরা বিদ্যমান প্রবন্ধে মুসলিম জ্ঞানচর্চায় ওয়াকফের ভূমিকা নিয়ে একটা সংক্ষিপ্ত বয়ান হাজির করব।
১. ওয়াকফ-ব্যবস্থা নিয়ে কয়েকটি জরুরি নোক্তা
১.১ মসজিদে কুবা এবং মসজিদের নববীর পর ইসলামি তুরাসে ওয়াকফের অন্যতম মৌলিক সূত্র হচ্ছে ওমর রাযি.-এর ঘটনা। কালক্রমে ওয়াকফ-ব্যবস্থা বিকশিত হতে থাকে। উমাইয়া শাসনামলে, হিশাম ইবনে আব্দুল মালিকের সময়ে ওয়াকফের জন্য স্বতন্ত্র দিওয়ান (বিভাগ) চালু করা হয়। দিগদিগন্তে বিস্তৃত হতে থাকে ওয়াকফের চর্চা ও প্রয়োগ। প্রথমদিকে সামাজিক পরিসরে কেবল মসজিদ ও মক্তব পরিগঠনে সীমিত থাকলেও একসময়ে ওয়াকফের অসিলায় চালু হয় বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রন্থাগার ও মাদরাসা। মুসলিম শাসনব্যবস্থার পরিধি যখন আরবের সীমা অতিক্রম করে তখন অনেক বিত্তবান মানুষ ব্যক্তি উদ্যোগে ওয়াকফ-ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলে। বিশেষত মিশরে যখন ইসলাম পৌঁছল, সেখানের অমুসলিমরাও লুফে নিল ওয়াকফকে। মুসলিম এবং কিবতীরা মিলে মিশরে বহু মসজিদ, মাদরাসা, বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতাল তৈরি করে। হিশাম ইবনে আব্দুল মালিকের সময় অবধি ওয়াকফ-ব্যবস্থাপনা মুতাওয়াল্লিদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। হিজরীর ১১৫ সালের দিকে তাওবা ইবনে নামিরকে কাজী মনোনিত করে মিশরে পাঠানোর পর তিনি ভাবলেন, এই বিরাট অঙ্কের ওয়াকফ-সম্পত্তির যদি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ না হয় যথেচ্ছা ব্যবহার হতে পারে। ফলে এসব সম্পদকে গরিব-মিসকিনদের জন্য সংরক্ষণের তাগিদে তিনি (দেওয়ান) ওয়াকফ-অধিদপ্তরের অধিনে আনলেন। হিজরীর বিংশ শতক অবধি ওয়াকফ মুসলিম সভ্যতার জ্ঞান, চিন্তা ও তারবিয়তের উৎকর্ষে অকল্পনীয় ভুমিকা পালন করেছে।[1]মাজাল্লাতু কুল্লিয়াতিত তারবিয়াহ, ২০২০ সন, ১৮৬ তম সংখ্যা
১.২ মানুষের মানসিক ও আত্মিক পরিগঠন যেকোন সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ মাকসাদ, এটি ছাড়া সভ্যতা টিকতে পারে না। ইসলাম মুসলিম ব্যক্তিসত্তার গঠন ও পরিপালনে বিশেষ নজর দিয়েছে। ওয়াকফ-ব্যবস্থার মাধ্যমে বসরা, কুফা, বাগদাদ, দামেশক, আলেপ্প, কায়রো, তিউনিসিয়া, মরক্কো, কর্ডোভা, স্পেন, এশিয়া মাইনর এবং হিন্দুস্তান প্রভৃতি অঞ্চলে জ্ঞানের বিকাশ ঘটে। এসব অঞ্চলের জামেয়াগুলো বিশেষত, আজহার, ফুসতাত, জামে উমাবি, জামেয়া মুস্তানসিরিয়া এবং কায়রাওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে সর্বস্তরে জ্ঞানের বিকাশ ঘটানো হয়।
২. মুসলিম জ্ঞানচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা, বিকাশ ও অন্যান্য :
২.১ মুসলিম শাসনের পরিধি বিস্তারের সাথে সাথে দেখা গেল লোকজন জ্ঞানমুখী হচ্ছে, মসজিদে ছোটবড় হালকা হচ্ছে দরসের, বিশেষায়িত জ্ঞানের জন্য উস্তাদের শরণাপন্ন হচ্ছে ছাত্ররা। ঠিক তখনই মাদরাসা, মক্তব এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যাত্রা শুরু হয়। হিজরী চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম সমাজে মসজিদভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল। মসজিদেই জ্ঞানচর্চা জারি রাখা যেত। কিন্তু বেশকিছু সংকটের কারণে মসজিদভিত্তিক জ্ঞানচর্চা জারি রাখা সম্ভব হয়নি—প্রথমত, ইলমচর্চার হালকায় বিভিন্ন মাসআলা ও ইস্যু নিয়ে মতভিন্নতা হতো, মতভিন্নতার বাহাসে শব্দ-প্রয়োগে অনেক সময়ই সংযত থাকা মুশকিল হয়ে যেত; মসজিদের পরিবেশগত দিক বিবেচনা করে তাই পৃথক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার তাগিদ অনুভব করেন বিশেষজ্ঞরা। দ্বিতীয়ত, ফিকহি মাযহাব ও ভিন্নচিন্তার অজুহাতে আলাদা হালকা ও দরসের প্রথা আরম্ভ হলে, আশঙ্কা দেখা দিল, ভিন্নমতের কারণে ফের পৃথক পৃথক মসজিদ গড়ে উঠে কি না, তারচেয়ে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে পৃথক করে ফেলা। তৃতীয়ত, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক প্রয়োজনেও বিভিন্ন শিক্ষাপদ্ধতি চালু হতে লাগল, রাজনৈতিক নেতারা নিজস্ব চিন্তার বিদ্যাকানন হিসেবে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করলেন, ফলে খুব জরুরি হয়ে পড়ল মসজিদ থেকে মাদরাসাকে আলাদা করে ফেলা।
২.২ মুসলিম তুরাসে প্রাতিষ্ঠানিক কায়দায় প্রথম কোন শিক্ষাকেন্দ্রটি গড়ে উঠেছিল, তা নিয়ে বিচিত্র কথা থাকলেও নৈপুণ্যের দিক থেকে নেযামিয়া মাদরাসা ছিল অন্যতম। জালালুদ্দীন সুয়ুতি লিখেছেন, নিশাপুরের বাইহাকি মাদরাসা নেযামুল মুলকের জন্মের আগেই চালু হয়েছিল।[2]হুসনুল মাহাযারা, সুয়ুতী ২/ ১৯৮ পৃ. তবে শিক্ষাদীক্ষার ইতিহাসে নেযামিয়া মাদরাসা ছিল বৈপ্লবিক সূচনা। শিক্ষাখাতে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ ও প্রণোদনার ইতিহাসও নেযামুল মুলকের হাত ধরেই সূচিত হয়; এর আগে শিক্ষাখাত ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত হতো। নেযামুল মুলক প্রতিষ্ঠা লাভ করে হিজরীর ৪৫৩ সালে। পরবর্তীতে খলিফা, প্রশাসক, ব্যবসায়ী এবং আলেম শ্রেণির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মিছিলের মতো শুরু হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গঠন ও বিকাশ; কালক্রমে শহর তো বটেই প্রত্যন্ত অঞ্চলও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-শূন্য ছিল না।[3]আল ওয়াকফু ওয়া বুনয়াতুল মাকতাবাতিল আরাবিয়া, ইয়াহইয়া মাহমুদ সাআতি, ১৬ পৃ.
২.৩ শিক্ষাদীক্ষা ও প্রতিষ্ঠানিক উন্নয়নে মামলুকী শাসনামলের সুখ্যাতি ঐতিহাসিকদের নজর কেড়েছে। মামলুকী আমলের খলিফা, প্রশাসক, বিত্তশালী নির্বিশেষে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল সেসবের কিছু তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল—প্রথমত, অনেক প্রতিষ্ঠানের সূচনা হয়েছিল নিছক তাকওয়া, নিষ্ঠা এবং ইলমে দ্বীন প্রচারের তাগিদ থেকে। দ্বিতীয়ত, প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাকেই তারা যথেষ্ট মনে করেননি, বরং এজন্য তৈরি করেছিল টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও উপযোগী নেযাম (ব্যবস্থাপনা)। মামলুকী শাসকদের তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠা প্রতিষ্ঠান শিক্ষাবিস্তারের পাশাপাশি মামলুকী রাষ্ট্রের বুদ্ধিবৃত্তিক সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করতো। ইবনে খালদুন লিখেছেন, মামলুক শাসকগণ ইলমের প্রস্রবণ অব্যাহত রাখার জন্য মাদরাসা প্রতিষ্ঠার প্রতি খুবই যত্নবান ছিলেন। তারা অবশ্য এ কৌশল পূর্ববর্তী শাসকগণ থেকেই গ্রহণ করেছিলেন। মাদরাসার জন্য তারা নিজেরাই ভবন নির্মাণ করে দিতেন। ছাত্রদের ব্যয়ভার বহন করার জন্য জমি ওয়াকফ করে রাখতেন। তাদের অনুসরণে সমাজের সম্পদশালী লোকজনও এ জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করতে উদ্যোগী হতো।
মামলুকদের ওয়াকফকৃত ভূমি মোটাদাগে তিন ধরনের হতো : এক. কিছু ওয়াকফকৃত ভূমির উপার্জন মসজিদ-মাদরাসা-খানকা ইত্যাদির জন্য ব্যবহৃত হতো। এর দায়িত্ব দেওয়ানি বিভাগের কিছু আমলাদের দেওয়া হতো। তবে এদের প্রধান থাকতেন সুলতান নিজেই। দুই. কিছু ওয়াকফকৃত ভূমির উপার্জন হারামাইনের খেদমত, গোলাম আজাদ ও দান-সদকা ইত্যাদির জন্য ব্যবহৃত হতো। এর দায়িত্বও সরকারি আমলাদের হাতে-ই ন্যস্ত থাকত। তবে এর প্রধান হতেন সে সময়ের প্রধান বিচারপতি। তিন. কিছু ভূমি ব্যক্তি উদ্যোগে ওয়াকফ করা হতো। এর দায়িত্বে ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনই থাকত। অনেকে অবশ্য দায়িত্ব প্রশাসক বরাবরও সোপর্দ করত। এজাতীয় ওয়াকফকৃত ভূমির উপার্জনও মাদরাসা মসজিদ খানকা ইত্যাদির কাজে ব্যবহৃত হতো।
সুলতানদের পক্ষ থেকে ওয়াকফের রীতি পূর্ব থেকেই ছিল। তবে মামলুকদের যুগে ওয়াকফের সিংহভাগ উপার্জন মাদরাসা খাতে ব্যয় হতো। এজন্য মামলুক শাসনামলে মাদরাসা ব্যবস্থায় ওয়াকফের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এসব ওয়াকফকৃত ভূমির উপার্জন ইসলামী আইনের নীতিমালার আলোকেই ব্যয় করা হতো।
৩. জ্ঞানচর্চায় মক্তব ব্যবস্থা : ওয়াকফের ভূমিকা
৩.১ ইসলামি তুরাসে মক্তবব্যবস্থার প্রচলন জ্ঞান-বিকাশে গুরুত্ত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে। সাধারণত মসজিদের পাশে কুরআন তেলাওয়াত, লিখন-পঠন, ভাষাজ্ঞান, ইতিহাস ও গণিত শিক্ষার প্রাথমিক গঠন সম্পন্ন হতো মক্তব ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই।[4]মিন রাওয়াঈ হাযারাতিনা, ১২৯ পৃ. মক্তব ব্যবস্থার প্রাথমিক গঠন হয়েছিল সাহাবাদের যুগেই। ওমর রাযি. রাস্তাঘাটে লোকজন নিয়োজিত রাখতেন, পথিকদের কেউ মূর্খ বা নিরক্ষর থাকলে তাদের মক্তবে নিয়ে এসে দরকারি শিক্ষা দেওয়া হতো। ওমর রাযি. সংশ্লিষ্ট ঘটনাটির শক্ত কোবং ভিত্তি হাদিস এবং ক্ল্যাসিক্যাল ইতিহাস-গ্রন্থে না থাকলেও পরবর্তী লেখকদের অনেকে এনেছেন।[5]আত-তারবিয়াতু ওয়াত তা‘লিম ফিল উন্দুলুস, ১৬০ পৃ. তবে মক্তবব্যবস্থা ওমর রাযি. এর শাসনামল থেকেই চালু হয়। এরপর মুসলিম সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে মক্তবব্যবস্থা। গিয়াছ ইবনে আবি শুবাইব বলেন, রাসুলের সা. সাহাবী সুফিয়ান ইবনে ওহাব একবার কিরান শহরে আসলেন, আমরা মক্তবে ছিলাম, তিনি সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করলেন, মাথার পাগড়ির পেছনের অংশ তিনি সম্মুখভাগে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন।[6]মাআলিমুল ঈমান, ১/১২০
ইবনে হাওকাল লিখেছেন, রোমের আশপাশে প্রায় ৩০০ মক্তব চালু ছিল। কিছু কিছু মক্তবের আয়তন ও পরিধি এতো বিস্তৃত ছিল যে, কয়েক হাজার ছাত্রকে ধারণ করতে পারত। হিজরীর তৃতীয় শতকে আরও কিছু মক্তবব্যবস্থার হদিস মেলে ইতিহাসে। আবুল কাসেম বলখীর পরিচালিত মক্তবে প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতেন।[7]মিন রওয়াঈ হাযারাতিনা, ১২৯
এসব মক্তবে ছেলেমেয়ে সবাই তালিম গ্রহণ করত। মক্তব-ব্যবস্থার অর্থায়নে দেশের খলিফা, প্রশাসক এবং কাজীদের ভুমিকা ছিল। তবে অধিকাংশ প্রণোদনা আসত ধনীদের ওয়াকফকৃত সম্পত্তি থেকে; উস্তাদ ও ছাত্রদের সার্বিক প্রয়োজন পূরণে বিত্তশালীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাই নানাদিগন্তে মক্তব-ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল।[8]তারিখে ইবনে আসাকির, ১/ ৩০৮ এমনকি কখনো কখনো ছাত্রদের জন্য লোকজন ফলফলাদি, সাবান-সুগন্ধি নিয়ে যেতেন, তাদের প্রতি ভক্তি ও অনুপ্রেরণা তৈরির তাগিদে। ১৯২৩ সালে ফিলিস্তিনে বাইতুল মাকদিসের পাশে মরহুম আমিন আল-হুসাইনীর তত্ত্বাবধানে মক্তব প্রতিষ্ঠা লাভ করে, ওয়াকফের এই মক্তবে মুসলিম শিশুদের পড়াশোনার সুযোগ করে দেয়।[9]বাহসুল ওয়াকফ জামিয়াতুন নাজাহ, ৫ পৃ.
৩.২ মুসলিম তুরাসে জ্ঞানচর্চা ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশে মক্তব-ব্যবস্থার ব্যাপক ভুমিকা বোঝার সবচেয়ে সহজ মেছাল হচ্ছে, প্রতিটি গ্রামে, প্রতিটি মসজিদেই ছিল মক্তব। একটি শিশুর ভবিষ্যৎ সক্রিয়তা কী হবে, কোন ধরনের প্রভাব ও চর্চা আগামীতে জারি রাখবেন, তা নির্ভর করে তার প্রাথমিক-গঠনের উপর। মক্তব একটি সভ্যতার প্রাথমিক-গঠনকে নিশ্চিত করে। ফলে যে সমাজের প্রাথমিক-শিক্ষা যত নিপুণ তাদের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা ততটাই সুগঠিত। এজন্য দেখবেন, ইসলামি তুরাসে হিজরীর সপ্তম শতকের জ্ঞানচর্চা ও ইলমের বিকাশ অন্য যেকোন সময় থেকে বিশেষ গতিতে প্রবাহিত হয়েছিল, তার একটি কারণ কিন্তু মক্তব-ব্যবস্থাও।
৪. ইসলামি তুরাসে ওয়াকফভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান :
৪.১ অনেক গবেষকের দাবি, মুসলিম ইতিহাসের প্রায় সবগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল ওয়াকফ-সম্পত্তিতে। এমনকি ওয়াকফ-সিস্টেম না থাকলে অনেক মুসলিম অঞ্চলে কোন প্রতিষ্ঠান-ই গড়ে উঠত না।[10]আল–আওকাফ ওয়াল হায়াতুল ইজতিমাইয়া ফিল মিসর, ২৪০ পৃ. হিজরীর সপ্তম শতকে জ্ঞানচর্চায় ওয়াকফের ব্যাপক ভুমিকা পরিলক্ষিত হয়, মুহাম্মদ কিরদ আলি লিখেছেন, এই শতকে ওয়াকফ সম্পত্তিতে গড়ে উঠে তিনটি মেডিকেল প্রতিষ্ঠান, একটি প্রকৌশলী ইনস্টিটিউট এবং ইসলামি জ্ঞানচর্চার জন্য রাজধানীতে বড় একটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা হয়।[11]মুহাম্মদ কিরদ আলি, খুতাতুশ শাম ৩/৪৪ পৃ. ইযযুদ্দিন ইবনে শাদ্দাদ তার আল-আ‘লাকুল খাতিরা ফি যিকরি উমারায়িশ শাম ওয়াল জাজিরা কেতাবে একটি পরিসংখ্যানে মেডিকেল প্রতিষ্ঠান সহ মোট ৯২ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করেছেন, যেগুলো ওয়াকফের উপর গড়ে উঠেছিল।
৪.২ হিজরীর চতুর্থ শতকের পর বেশকিছু প্রতিষ্ঠান ইতিহাসে গৌরবদীপ্ত অবদান রেখেছিল, যেগুলোর সাথে ওয়াকফের সম্পর্ক ছিল। যেমন, ৪র্থ হিজরীতে নিশাপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মাদরাসায়ে বাইহাকিয়া। নেযামুল মুলকের হাতে স্থাপিত মাদরাসা নেযামিয়া বাগদাদের অন্যতম মশহুর একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। এটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে ৪৫৭ হিজরীতে। সিরিয়ার হালাবে (আলেপ্প) ৫৬৯ হিজরী সনে নুরুদ্দীন যানকি রাহি. এর তত্তাবধানে গড়ে উঠে মাদরাসা নূরিয়া। দিমাশকের আদেলিয়া মাদরাসাও যানকির হাতে গড়ে উঠলেও পরবর্তীতে বাদশাহ সাইফুদ্দীনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। আদেলিয়ার নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছিল ৫৭৮ হি. সালে। কায়রোর ফাজেলিয়া মাদরাসা কাজী ফজল ৫৯৬ হিজরীতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এটিও চলতো ওয়াকফ-সম্পত্তিতে। বিশেষত দিমাশকের দারুল হাদীস, যেখানে ইমাম নববী, ইবনুস সালাহ, সুবকী রহি.-দের মতো বড় বড় মুহাদ্দিস শিক্ষালাভ করেন।[12]মিন রাওয়াঈ হাযারাতিনা, ১৩০ এসব প্রতিষ্ঠানের মুতাওয়াল্লিরা শিক্ষার্থীদের পোষাক, খাদ্য-পানীয় এবং জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করতে রীতিমতো প্রতিযোগিতা করতেন। প্রায় সকল ছাত্র-ই ফুল-ফান্ডেড স্কলারশিপের মাধ্যমে পড়াশোনা করতেন। কিছু ওয়াকফকারী কেতাবাদিও সরবরাহ করতেন।[13]জাওয়াহেরুল উকুদ, ১/৩৪২
৫. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে ওয়াকফের সম্পর্ক :
৫.১ ইলমচর্চাকে সার্বিকভাবে বেগবান করার জন্য ইসলামি তুরাসের শিক্ষাব্যবস্থাকে ওয়াকফ-কেন্দ্রিক করা হয়েছিল। একজন ছাত্র কেবল পড়াশোনার খাতিরেই না, বরং আবাসন ও জীবনযাপনের পরিপূরক হিসেবেও ওয়াকফ-সম্পত্তি থেকে জরুরি প্রণোদনা পেতে, যেন তালবে ইলম বস্তুজগতের ব্যস্ততা থেকে সম্পূর্ণ ফারেগ হয়ে জ্ঞানচর্চা করতে পারেন। শিক্ষকদের বেতনাদির ব্যবস্থাও ওয়াকফ-সম্পত্তি থেকেই হতো, ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা, পাঠদান এবং আনুষাঙ্গিক দায়িত্ব পালনে একধরনের প্রতিযোগিতা বিরাজ করত। ফলে দেখবেন, অনেক ওলী-আউলিয়া ওয়াকফ-পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে খেদমত করেছেন। ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান থেকে উপার্জিত অর্থকে তারা মনে করতেন সর্বত্তোম আয়। এভাবে ওয়াকফের সুবাদে তৈরি হতো ইলমি-আবহ; বড় বড় ইমামগণ এ আবহে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন স্বাচ্ছন্দে। ইমাম ইবনে তাইমিয়ার বাবা আব্দুল হালীম দারুল হাদীস আস-সুকরিয়াতে বাস করতেন। হাফেজ মিযযি থাকতেন দারুল হাদীস আশ-শাকিশকিয়াতে।[14]বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসীর পৃ. ৯/১২৭
৫.২ ইসলামি তুরাসে কয়েক ধরনের ওয়াকফ-সম্পত্তি জ্ঞানচর্চায় ভুমিকা পালন করেছিল : ক. শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য ভূমি ওয়াকফ। খ. শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে ঘরবাড়ি, আবাসন ও ভবন ওয়াকফ। গ. দোকানপাট ও আবাদি-জমি ওয়াকফ করা হতো ছাত্ররা যেন সেখান থেকে নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে পারে। ঘ. ওয়াকফকারীরা কেতাবপত্র, খাতা-কলম, খাদ্য এবং পোষাক-পরিচ্ছদ সরবরাহ করতেন। ঙ. শারিরীক সুস্থতার জন্য ওষুধের ব্যবস্থা এমনকি চ. শিক্ষপ্রতিষ্ঠানের বাহন হিসেবে যে পশু ছিল, ঘোড়া বা গাধা, তার প্রতিপালনের জন্যও খাদ্য-সরবরাহের রেওয়াজ ছিল। ছ. গোসলখানা ওয়াকফ করা হতো; মুস্তানসেরিয়া মাদরাসায় ‘হাম্মামি’ বলা হতো সেসব লোককে যারা ছাত্রদের পরিচ্ছন্নতা ও পরিপাটির সেবায় নিয়োজিত ছিলেন।
৫.৩ খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক দামেশকের উমাইয়া মসজিদে অঢেল অর্থ ব্যয় করেছেন এবং অসংখ্য মানুষ এর নির্মাণ কাজে অংশ নিয়েছেন। এরপর গুরুত্বপূর্ণ ওয়াকফ প্রতিষ্ঠান ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসালয়।[15]ড. মোস্তফা আস্–সিবায়ী, (অনু: আকরাম ফারুক), ইসলামে জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমের … Continue reading
এ সম্পর্কে আব্দুল মালিক আহমদ সায়িদ বলেন, “Consequently, the Muslim society depended essentially on awqaf to provide all level of education; cultural services, such as liberaries and lecture facilities; Scientific research in all material and religious sciences and health care. It is reported that under Islamic rule the Islam of sicily had 300 elementary schools all built by awqaf and payment of teachers and school by suplies provided for by waqf revenues.”[16]Abdul Malik Ahmad Sayed`Role of Awqaf in Islamic History” in Hassan Abdullah Al-Amin, ed, Idarat wa tathmir mumtalakat al awqaf, Jeddah, IRTI, 1989, p. 231
মুসলিম বিশ্বের বড় বড় শহর ও রাজধানীসমূহ যেমন আল কুদুস, দামেশক, বাগদাদ, কায়রো এবং নিশাপুরে শত শত হাইস্কুল এবং দশটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঐসব বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিজ্ঞানসম্মত এবং শৃঙ্খলার সাথে চিকিৎসাবিদ্যা, রসায়ন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব পড়ানো হতো। এর মধ্যে ফিজের ফারাবিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রোর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাগদাদেও মুসতানসিরিয়ার নিযামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ওয়াকফ সম্পদ থেকে। এদের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার উন্নত ধারা সম্পর্কে আব্দুল মালিক আহমদ সায়িদ বলেছেন, “the awqaf estates provided these Universities with buldings in addition to teaching materials, scientific books, Salaries for teachers and stipends for students. Some Universites even have students dormitories for both single and married students. Awqaf also built scientific libraries
and supplied them with hundreds of thousands of volumes. Pyment for liberaries employees, supervisors and scribes were provided from the huge revenues collected from orchards and rentable buildings made to awqaf for the benefit of these liberaries.”
এ সম্পর্কে মুস্তফা আল যারকাহ্ বলেছেন, “In order to facililate lending books to scholars and researchers, they ruled that it is not permessible to ask book borrowiers to provide collateral, even if the waqf founder made such a provision in the waqf ducoment. It is thus ruled that such a condition by the founder is invalid.” আব্দুল মালিক আহমদ সায়িদ আরও বলেছেন, “Islamic history has witenssed specialized awqaf for scientific research in medicine, pharmacology and other sciences. The awqaf that provided for education were probably responsible for the independence of mind that was common among scholars, keeping them free of the rulers. These awqaf turned Muslim scholas in to popular leaders and out spoken representatives of the society in any confrontation with the authority.”
৬. হালামালের মুসলিম জ্ঞানচর্চায় ওয়াকফের নমুনা
৬.১ বর্তমানেও নানাদেশে রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তি উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা-প্রতিষ্ঠান এবং মাদরাসা-ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। দুবাইয়ের প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান কুল্লিয়াতুদ দিরাসাত আল-ইসলামিয়া ওয়াল আরাবিয়া ব্যক্তিগত ওয়াকফের অবদান। আলপ্পের শু‘বানিয়া এবং কালতাভিয়া সহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান আছে ওয়াকফের; এখান থেকে অনেক জ্ঞানী ও বোদ্ধা লোক পড়াশোনা সম্পন্ন করেছেন। নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামে ১৯৯৮ সালে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল ওয়াকফ-সম্পত্তিতেই। এভাবে লক্ষ করলে দেখবেন বিশ্বের নানা জায়গায় নিষ্ঠাবান ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান; তাদের মনে ছিল ইখলাস, উম্মাহর জাগরণের প্রত্যাশা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি।[17]মাজাল্লাতুশ শরিয়া ওয়াল কানুন, ২২তম সংখ্যা ২০০৫ নভেম্বর
৬.২ আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চা প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই নির্ভরশীল ছিল ওয়াকফের উপর। ১৯১৩ ঈসায়ী সালে রানি ফাতেমা ঈসমাইল আজহারের জন্য প্রায় ৩০০ হেক্টর জমি ওয়াকফ করেন। এছাড়াও রানি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রণোদনা দিতেন। মুহাম্মদ আলীর শাসনামলে আজহারের ওয়াকফ-সম্পত্তির অধিকার রাষ্ট্রের হাতে স্থানান্তরিত হবার পর থেকে আজহার রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে চলে। ১৯৬৩ সালে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে এটি পাকাপোক্ত হয়।
মুসলিম জ্ঞানচর্চায় ওয়াকফের ভূমিকা : পুনর্পাঠ ও প্রাসঙ্গিকতা (দ্বিতীয় পর্ব)
তথ্যসূত্র:
↑1 | মাজাল্লাতু কুল্লিয়াতিত তারবিয়াহ, ২০২০ সন, ১৮৬ তম সংখ্যা |
---|---|
↑2 | হুসনুল মাহাযারা, সুয়ুতী ২/ ১৯৮ পৃ. |
↑3 | আল ওয়াকফু ওয়া বুনয়াতুল মাকতাবাতিল আরাবিয়া, ইয়াহইয়া মাহমুদ সাআতি, ১৬ পৃ. |
↑4 | মিন রাওয়াঈ হাযারাতিনা, ১২৯ পৃ. |
↑5 | আত-তারবিয়াতু ওয়াত তা‘লিম ফিল উন্দুলুস, ১৬০ পৃ. |
↑6 | মাআলিমুল ঈমান, ১/১২০ |
↑7 | মিন রওয়াঈ হাযারাতিনা, ১২৯ |
↑8 | তারিখে ইবনে আসাকির, ১/ ৩০৮ |
↑9 | বাহসুল ওয়াকফ জামিয়াতুন নাজাহ, ৫ পৃ. |
↑10 | আল–আওকাফ ওয়াল হায়াতুল ইজতিমাইয়া ফিল মিসর, ২৪০ পৃ. |
↑11 | মুহাম্মদ কিরদ আলি, খুতাতুশ শাম ৩/৪৪ পৃ. |
↑12 | মিন রাওয়াঈ হাযারাতিনা, ১৩০ |
↑13 | জাওয়াহেরুল উকুদ, ১/৩৪২ |
↑14 | বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসীর পৃ. ৯/১২৭ |
↑15 | ড. মোস্তফা আস্–সিবায়ী, (অনু: আকরাম ফারুক), ইসলামে জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমের গুরুত্ব, ৪ ফেব্রয়ারী– ২০০২, দৈনিক সংগ্রাম, পৃ. ৭ |
↑16 | Abdul Malik Ahmad Sayed`Role of Awqaf in Islamic History” in Hassan Abdullah Al-Amin, ed, Idarat wa tathmir mumtalakat al awqaf, Jeddah, IRTI, 1989, p. 231 |
↑17 | মাজাল্লাতুশ শরিয়া ওয়াল কানুন, ২২তম সংখ্যা ২০০৫ নভেম্বর |
মাশাআল্লাহ। মুগ্ধ হয়েছি।
বাগদাদের হারানো ইলম কিভাবে ফিরিয়ে আনা যায় । এ বিষয়ে এমন লেখা চায়।