মুখোমুখি সাবের চৌধুরি (১ম পর্ব)
সাবের চৌধুরী: ওই যে, শুরুতে আপনি বললেন, ইসলামিস্ট ধারা (প্রবীনদের সাপেক্ষ আলেম ধারা) ও জেনারেল ধারা—এই ভাগ বিন্যাসটা মানবেন কি না, তো, ভাগ একটা হয়ে গেছে, এটা হলো বাস্তবতা। মানে, আমরা অগত্য মেনে নিছি। এবং এটা শুধু সাহিত্যে না; শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি সবক্ষেত্রেই। মানে, এক দেশে বসবাস করলেও মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমরা ক্রমশ দুটো জাতি হয়ে উঠেছি। ঐতিহাসিক কারণেই এই ‘দ্বি-জাতি’ ধারণাটার অস্তিত্ব অনিবার্য ছিল। মৌলিক জায়গা থেকে এই বিভাজনটা আমি অকল্যাণকর ও অনাকাঙ্ক্ষিত মরে করি। কিন্তু এটা একটা বাস্তবতা, যার উপাদান ইতিহাসেই রাখা ছিল। আমাদের দেশের চলমান বাস্তবতার সাপেক্ষে বৃটিশদের সময় থেকে। তো, এখন আমি আপনি একপক্ষীয়ভাবে হুট করে তা অস্বীকার করে সব মিলিয়ে ফেলতে গেলে লাভ হবে না কিছু। উল্টো নিজেদের আদর্শিক অস্তিত্বটাই পড়বে হুমকির মুখে। ফলে, আলেম সমাজ মৌলিকভাবে পুরো জাতির বিশেষায়িত একটা অংশমাত্র হলেও কার্যত আমরা এবং অন্যরা ‘আলেম শ্রেণি’কে স্বতন্ত্র একটা জাতি হিসেবে কল্পনা করতে শুরু করেছি। এর কারণে পুরো একটি জাতি মিলে যা যা করার কথা, তার সবটুকু শুধুমাত্র আলেম শ্রেণি থেকেই কামনা করছি। সমাজ, শিক্ষা, রাজনীতি ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে নবীনদের বহু অভিযোগের উৎপত্তি হলো এই জায়গাটা। কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষাটা কীভাবে সম্ভব?
এর বিপরীতে আমরা যদি, ধরেন, ভাষার সূত্রেই, বা রাজনৈতিক সীমানার সূত্রেই, পুরো বাংলাদেশের মানুষকে একক একটা বৃহৎ গোষ্ঠি হিসেবে কল্পনা করতে পারতাম, তাহলে দেখতাম এখানে গল্প উপন্যাস ধর্মীয় সামাজিক বিষয় আশয় সবই আছে। এবং প্রবীন আলেমগণ বৃহৎ একটা জনগোষ্ঠির বিশেষায়িত একটা টিম হিসেবে নিজেদের কাজটাই করছেন। ফলে, এই প্রশ্নটাই আমি আপনি করতাম না। মানে, প্রবীণগণ ঠিক আছেন।
আহমাদ সাব্বির: ইতিহাসের উপাদান যেটা বললেন, একে অতিক্রম করে বৃহৎ এই কল্পনাটা করতে পারতেছি না কেন?
সাবের চৌধুরী: এর পেছনে দায়ী হিসেবে স্রেফ নির্মম একটা বাস্তবতা ছাড়া কিছু নাই। বৃহৎ কল্পনার জন্য আমরা আদর্শিক, স্পষ্টতই দীনি যে দায়বোধ, এটা, আমরা যাদেরকে মেইনস্ট্রিম বলতে অভ্যস্থ হয়ে গেছি, তারা স্বীকার করেন না। তারা বরং উল্টোটা মান্য করেন।
আহমাদ সাব্বির: তার মানে কি বলতে চাচ্ছেন যে, গল্প সৃষ্টি করাটা আমাদের প্রবীনদের দায়ের ভিতরেই পড়ে না?
সাবের চৌধুরী: আসলে গল্প-উপন্যাস জিনিসটা তো দায়ের সাথে যায় না। এটা সম্পূর্ণ মানসিক স্ফুর্তি ও স্বতঃস্ফুর্ততার ব্যাপার। সামাজিক আকাঙ্ক্ষা। দরকার। থাকাটা ভালো ও কল্যাণকর—এই। আমি বলতে চাচ্ছি—আলেম ও ওয়ারেসে নবী হিসেবে প্রবীনদের কাজের জায়গাটা ছিল পার্থিব ও পরকালীন জীবনঘনিষ্ঠ দরকারী লেখাজোকা। সেটা তারা করেছেন। গল্প উপন্যাসটা এই শ্রেণির মূল কাজ ছিল না।
আহমাদ সাব্বির: কিন্তু যেভাবেই হোক, আমাদের সমাজে তো মননশীল গল্প উপন্যাস থাকতে হবে। এটা একটা বৃহৎ সমাজের খোরাকের অংশ। বিশেষ করে কিশোর তরুণদের। এখন যারা আদর্শিক দায়টা স্বীকার করেন না, তাদের থেকে স্বভাবতেই মননশীল জিনিসটা আকাঙ্ক্ষা করতে পারি না। এ জায়গটায় কি ইসলামি ধারার লোকদের কিছু করার ছিল না?
সাবের চৌধুরী: ছিল’র বিষয়টা তো আমাদের আলাপে ইতিমধ্যে এসেছে, এখন আলাপ হতে পারে ‘আছে’ কি না? হ্যাঁ, আছে। আমাদের ইসলামিক ধারার সাহিত্য চর্চার বয়স তো বেশি না আসলে। এবং আপনি জানেন, প্রতিটি চর্চাই ধীরে একটা সুন্দর পরিণতির দিকে এগোয়। একটা ভাষায় গল্প উপন্যাস তৈরী হওয়া হলো সে পরিণতির একটি অংশ। সাহিত্যের চর্চাটা, আমি যেটাকে মূলত লেখালেখির চর্চা বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করি, প্রবীনরা শুরু করেছিলেন। সেটা পরিণতির দিকে যাচ্ছে, এবং এখন এসে গল্প উপন্যাস তৈরী হচ্ছে। সামনে এটা বাড়বে। আমি আপনি চাইলেও বাড়বে, না চাইলেও বাড়বে। প্রতিটি সংস্কারের, একটু বড় করে বললে বিপ্লবের, নিজস্ব একটা অনিবার্য অন্তঃস্রোত আছে। এই স্রোতটা জেনারেশন ভেদে বিভিন্ন রূপ ধরে। আমাদের এখনকার তরুণদের গল্প উপন্যাসের দিকে যাওয়াটা হলো সেই অনিবার্য অন্তঃস্রোতের গতিটা। এটা রুদ্ধ হবার উপায় নাই। ভালো। এদিক থেকে ভাবলে দেখবেন গল্প-উপন্যাস তৈরীর গোড়াতে মূলত আমাদের প্রবীনরাই বসে আছেন।
দ্বিতীয় বিষয় হলো, আলেমগণ যেহেতু বিশেষায়িত অংশ এবং সেই সূত্রে তাদের কর্ম পরিসরও বিশেষায়িত, তাই গল্প-উপন্যাসটা শুধু তাদের থেকেই আসবে না। ইসলামমনা, আদর্শিক দায় অনুভব করেন এমন মননশীল জেনারেল এবং সেমি জেনারেল লোকদের অংশগ্রহণটা লাগবে। মানে, এরিয়াটা বড় হতে হবে। খেয়াল করলে দেখবেন এটা ক্রমশ বড় হচ্ছে। বিশেষ করে তেরোর পর থেকে। এবং এর একটা ফলাফল কিন্তু আমরা পেতে শুরু করেছি।
আহমাদ সাব্বির: আমার প্রশ্নটাকে ভাগ করে আপনি তৃতীয় যে প্রশ্নটা উঠিয়েছিলেন যে, প্রবীণগণ আসলেই কি ফিকশনে যাননি? এর দ্বারা আসলে কী বুঝাতে চেয়েছেন?
সাবের চৌধুরী: হ্যাঁ। তো, আমার মনে হয় তারা একদমই যাননি বিষয়টা মনে হয় না এমন। এমন বেশ কিছু বহুল প্রচারিত বইয়ের নাম করা যাবে, যেগুলো গল্প ছিল। যেমন, ধরুন, এ মুহূর্তে দুটো বইয়ের নাম মনে আসছে: আলোর পরশ, অধ্যাপক মরহুম আখতার ফারুকের লেখা দাঙ্গা। গল্প-উপন্যাস শব্দ দুটো এড়িয়ে আমরা যদি ফিকশন শব্দটার দিকে মনোযোগ দিই, তাহলে অন্য একটা দিক সামনে আসতে পারে। ফিকশন এর একাডেমিক ডেফিনেশন কি আমি জানি না আসলে। কিন্তু জনপরিসর থেকে আবছা ধারণা নিয়ে আমরা আপাতত এর অর্থ যদি ধরি ‘স্টোরি টেলিং’, তো, সেটা কিন্তু তাদের রচনায় আছে প্রচুর পরিমাণেই। জীবনী, আত্মজীবনী, সফরকাহিনী, অনুভূতি, অবলোকন, জীবন-বিশ্লেষণ, স্মৃতিচারণ, সুহবতের গল্প, নবী-সাহাবিদের জীবনের গল্পভাষ্য, রাজনীতির অভিজ্ঞতা এমনতরো বহু কিছু রচিত হয়েছে, যেখানে আমরা স্টোরি টেলিংয়ের ব্যাপারটা জোরালোভাবে পাই। মরহুম মুহিউদ্দিন খান, মাওলানা মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন, শরীফ মুহাম্মদ, আবু তাহের মেসবাহ, ইয়াহয়া ইউসুফ নদভি—সমকালীনদের মধ্যে উনাদেরকে যদি প্রবীন ধরি, তাহলে তাঁদের প্রচুর রচনা আছে এমন। সুখদ গদ্যে গল্পের স্বাদ পাই। এ বিবেচনা থেকে আমি যদি আমাদের সাহিত্য যাত্রার পূর্ণ সময়টার একটা তালিকা করি, আমার মনে হয় না পরিমাণটা সামান্য কিছু হবে। এগুলোকে আমি একটু বৃহৎ অর্থে ফিকশন বলব না কেন? গল্প তো!
আহমাদ সাব্বির: আপনার ‘জীবনে রোদ্দুরে’ বইয়ে এমন কিছু লেখা পড়েছি, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এগুলো ছোট গল্প হয়ে হয়ে উঠছে বা এগুলোকে আপনি যদি ছোটোগল্প হিসাবে পরিচয় করাতেন, মনে হয় না কোনো সমালোচক সেটা অস্বীকার করতে পারতো। কিন্তু আপনি সেই অর্থে এগুলোকে ছোট গল্প বা ফিকশন বলেননি, যেহেতু আপনার নিজেরই জীবনঘনিষ্ট স্মৃতি বা আত্মস্মৃতিরই উপাদান। কিন্তু আমি কমপক্ষে তিন চারটা লেখা দেখাতে পারবো, সত্যস্মৃতি হলেও এসব মূলত ছোটোগল্পই। মানে, শেইপটা এরকমই। শুধু এটুকু যে, আপনি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে স্বীকৃতিটা দেননি।
তো, আপনি ফিকশনের গুরুত্ব বোঝেন এবং আপনার মধ্যে, আমি যতদূর বুঝি, ফিকশন করার বা গল্প উপন্যাস লেখার যথেষ্ট সামর্থ্য ও উপাদান আছে। এখন আমি যদি প্রশ্ন করি, আসলে এই প্রশ্ন করাটা ঠিক হবে কিনা আমি অনেকক্ষণ ধরে ভাবছিলাম যে, কে কী লিখবে বা কার কী লেখা উচিত এটা তো যার যার ব্যক্তিগত বিষয়; যার যার যায়গা থেকে সে ঠিক করবে; তবু, যদি প্রশ্ন করি, আপনি ফিকশনে গেলেন না কেন?
একটা গল্প অবশ্য লিখছিলেনও। কিন্তু সেটাও কিছুটা ছদ্মনামে। ‘দন্তস্য চৌধুরী’। ফাতেহ’তে। এবং খুবই চমৎকার একটা গল্প ছিল সেটা। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই মুগ্ধ হয়েছিলাম গল্পটা পড়ে। আমি চেয়েছিলাম যে, সাবের ভাই আরো গল্প লিখবেন। তো, আমরা সাবের চৌধুরী থেকে, ছদ্মনামেই হোক, অন্য কোনো গল্প পাচ্ছি না কেন। এটার কারণ কী?
সাবের চৌধুরী: হা হা হা…। এটার একাধিক কারণ হতে পারে। এর মধ্যে একটা ব্যাপার হচ্ছে, আমি লেখালেখিতে কখনই সিরিয়াস ছিলাম না। মানে, এখন পর্যন্ত হইতে পারি নাই। ফলে বিশেষ কোনো জনরা নিয়ে কাজ করবো এমন কোন ভাবনা নাই। মানে, আমি তো ওভারঅল লেখাটা নিয়েই সিরিয়াস না।
আহমাদ সাব্বির: এর কারণ কী?
সাবের চৌধুরী: খুব সম্ভব অলসতা, বিচিত্র রকমের ব্যস্ততা এবং সেই সূত্রেই লেখক হয়ে উঠার জন্য বিশেষ যে পরিশ্রম, সেটার ঘাটতি। সাহসের অভাবও আছে কিছুটা।
আহমাদ সাব্বির: কিন্তু আপনাকে তো আমরা লেখক হিসেবেই চিনতেছি।
সাবের চৌধুরী: সত্যি কথা যেটা, এই যে, আজকে এখানে বসছি, আপনি আমাকে কথাশিল্পী বা লেখক হিসেবে ইনভাইট করছেন। তো, এটার জন্য আমি মানসিকভাবে অস্বস্তিতে ভুগতেছি। এবং হয়তো শুনলে হাসবেন, মানে লেখালেখির সূত্রে আমি যে কয়জনের সাথে পরিচিত হয়েছি, বা মূল লেখালেখিটা, বলতে গেলে ফেসবুকের সূত্রেই। মাসিক পত্র পত্রিকায় টুকটাক লিখেছি, বইও অনুবাদ করেছি; কিন্তু আপনি আমাকে লেখক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মূল প্ররোচণাটা তৈরী হয়েছে ফেসবুকে লেখালেখির সূত্রেই। আমি এটা মনে করি। তো, এইটা নিয়া আমার নিজের কাছে নিজেকে একটু অপরাধীই লাগে। আসলে ফেসবুকের ভেতর দিয়ে লেখক হওয়াটা এখন পর্যন্ত আমার কাছে ওইভাবে সঠিক মনে হয় না। অন্তত নিজের জন্য আরকি। এটার একটা ব্যাখ্যা আছে। আমার আপনার কথাটা মানুষের কাছে রীচ করবার মাধ্যম হিসেবে ফেসবুক গুরুত্বপূর্ণ। এর গুরুত্বকে স্বীকার করেই আমি বলছি যে, ফেসবুকের ভেতর দিয়ে একজন লেখক দাঁড়ায়ে যাবে এটা আমার কাছে অন্তত এখন পর্যন্ত খুব একটা স্বাভাবিক মনে হয় না। তো, সেই জায়গা থেকে আমি অস্বস্তির ভেতরে আছি।
আর এখানে যেহেতু প্রসঙ্গটা আসছে, আমি ওই আলাপে যাওয়ার আগে এই কথাটা একটু পরিষ্কার করে নিই। কোনো নিয়ম বা আইন হিসেবে বলছি না বা কারো ওপর কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি না; সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অভিমত হিসেবে বলছি: লেখক মানে হচ্ছে সে, যিনি দৈনিকে লিখছেন, ম্যাগাজিনে লিখছেন, বিভিন্ন ধরণের স্মারক, আশপাশের যে ছোটো কাগজ-বড় কাগজ নানা জায়গায় তিনি লেখালেখি করছেন। তিনি হয়তো বই লিখছেন না; কিন্তু লেখালেখির সূত্রেই তার একটা পরিচিতি তৈরী হচ্ছে সাধারণ রচনার ভেতর দিয়ে। অসংখ্য সম্পাদকের কলমের আঁচড়ের ভেতর দিয়ে তিনি উঠে আসছেন। ধীরে তাকে পাঠক চিনে উঠছে। আমি মনে করি এটাই হলো একজন লেখকের সত্যিকারের প্রতিষ্ঠা। বই লেখাটা লেখক হওয়ার জন্য আমি জরুরি মনে করি না। একজন মানুষ সারাজীবন একটামাত্র বই না লিখেও লেখক হতে পারে। কিন্তু লেখকের জন্য দরকার যেটা, সেটা হচ্ছে, ওই যে বললাম, এর ভিতর দিয়ে তার উঠে আসা। এই পরিচয়ের ভেতর দিয়ে যখন একজন মানুষ আসবে তখনই আমি তাকে ব্যক্তিগত জায়গা থেকে লেখক হিসাবে বিবেচনা করতে চাই। এরপরে বই লিখলে ভালো, না লিখলেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এর বাইরে যে অংশটা আছে, যেমন ধরেন আমি সারা জীবন অনুবাদ করে গেলাম, আর কিছুই করলাম না, এমন হলে আমার কাজটা গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই, মর্যাদাপূর্ণও, দরকারিও; কিন্তু ব্যক্তিগত বিবেচনা থেকে আমি নিজেকে লেখক বলতে পারি না। তারপরে ধরেন আমি ফেসবুকের ভেতর দিয়ে লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করছি। তারপর বইটই করে ফেলছি, ইত্যাদি। তো এটা আমার চোখে লাগে।
বাকি মূল যে প্রশ্নটা, গল্প লিখি নাই কেন? তো, এক হলো, আমার যখন যেটা লিখতে ভালো লাগছে আমি ওইটাই লিখছি। আলাদাভাবে কখনো চিন্তা করি নাই বিশেষ কোন জনরায় কাজ করি নাই কেন। দ্বিতীয় একটা ব্যাপার হলো, গল্প আমি মূলত লিখতে চাইছি সবসময়ই, এখনও চাই। কিন্তু জিনিসটা শেষ পর্যন্ত আমার দ্বারা হয় না আসলে। বেশ কিছু সমস্যা আছে।
আহমাদ সাব্বির: যেমন?
সাবের চৌধুরী: ধরেন, আমি যদি গল্প বা উপন্যাস লিখতে যাই, দেখা যায় একটা মুহূর্তের ভেতরেই দীর্ঘ সময় বন্দি হয়ে থাকি। একটা ব্যাপারকেই বিশ্লেষণের ভিতর দিয়ে খুঁটিয়ে চিত্রায়িত করতে থাকি। গভীরে ঢুকে যাই। যার ফলে কাহিনি আর আগায় না। শুনলে হয়তো হাসবেন, আমি কিন্তু অনেকবার ট্রাই করেছি। আগায় না। দ্বিতীয় একটা সমস্যা হলো—প্রত্যেকটা উপন্যাস বা গল্পেরই তো একটা মূল পয়েন্ট থাকে, বা মূলত বলবার বিষয় থাকে। যদিও গল্প এবং উপন্যাস আসলে ম্যাসেজ বহনকারী না; মানে স্পষ্টভাবে ম্যাসেজ বহনকারী না, প্রচ্ছন্নভাবে হয়তো; কিন্তু তারপরেও তো মিনিমাম একটা ম্যাসেজ থাকে বা বলতে পারেন একটা পরিণতি থাকে। আমি আসলে কী বোঝাতে চাই, কোন্ আবেগটা ফুটিয়ে তুলতে চাই? আমি লিখতে গিয়ে দেখলাম মূল যেই বিষয়টা, এটাকে আহমাদ সাব্বির যখন গল্প লিখছেন তখন নানা রকমের ছোটো বড় উপাদান দিয়ে বিভিন্ন উপলক্ষের ভেতর দিয়ে ফুটিয়ে তুলছেন। কিন্তু আমি সরাসরি চলে যাচ্ছি। সমস্যা দুটো আপাত পরস্পর বিরোধী, কিন্তু আমার মধ্যে উভয়টা যুগপৎ কাজ করে। খুবই অদ্ভুত এটা। তবে, আমি এখনও মনে মনে চাই যে, জিনিসটা আমি লেখব। গল্পের ভিতর দিয়ে অনেক কিছু বলা যায়, যেটা অন্য কিছু দিয়া পারা যায় না।
আহমাদ সাব্বির: আমরাও চাই সাবের চৌধুরীর কলমে গল্প উঠে আসুক। এবং আমার মনে হয় আপনি হয়তো ভাবছেন যে, আপনার গল্পটা ঠিক গল্প হয়ে উঠতেছে না। কিন্তু আপনি যদি সরাসরি গল্প লেখেন কিংবা যে লেখাগুলো আপনি মাঝে মাঝে লেখেন স্মৃতি হিসেবেই, এগুলোকে যদি কিছুটা পরিবর্তন করে গল্প হিসেবে পরিণতি দেন, আমার মনে হয় পাঠক এগুলোকে গল্প হিসেবেই নিবে। আপনার লেখালেখির সাথে বা আপনার গল্পের সাথে আমার যতদূর পরিচয় সেখান থেকে বলছি কথাটা।
সাবের চৌধুরী: আপনি যেটা বললেন, এখানে আমার একটা মৃদু আপত্তিমতো আছে, যেমন ধরেন, একসময় আমি কবিতাও লিখতে চাইছিলাম।
আহমাদ সাব্বির: ও আচ্ছা, আচ্ছা, হ্যাঁ, আপনার লেখার মধ্যে বার বার এই আক্ষেপ ফুটে উঠছে যে, আপনি একসময় কবি হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেভাবে কবিত্ব, আপনার মনে হয় যে, শব্দ নিয়ে যে খেলা, ভাব ভাবনা ও মর্মকে উপভোগ্য বিশেষ ফর্মেটে নিয়ে প্রকাশ করা, কবির যে মূল কাজ, সেটা আপনার দ্বারা হয়ে ওঠে না। আপনার অনেক রচনার মধ্যে বার বার ফিরে আসছে আক্ষেপটা।
সাবের চৌধুরী: কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিনি। কবিতার যে যন্ত্রণাটা, সেটা আমি মনে করি আমার ভিতরে এখনও আছে। এখনও মাঝে মধ্যে কষ্ট হয়, খারাপ লাগে। ভিতরের যে যন্ত্রণাটা সেটা তো আসলে ফেলে দেওয়া যায় না। ধরুন, আমি লিখলাম, কিছু মানুষ তো পড়বে। মানে, যিনি টুকটাক গদ্য লিখেছেন, তিনি কবিতা লিখলে একদম অখাদ্য কিছু যে হবে তা তো না। সে জায়গা থেকে আমি যদি কবিতা লিখি বা গল্প-উপন্যাসও লিখি, ছোট একটা পাঠ হলেও আমি পাব। কিন্তু তিরিশ পেরিয়ে আসার কারণে হোক, বা মোটামুটি একটা পাঠের কারণে হোক, বিশেষ একটা রুচি ও সিদ্ধান্ত তৈরী হয়েছে এমন—কোন কিছু টেনেটুনে বা গড়পরতা পর্যায়ের করা উচিত না। ফলে নিজের সাথে একটা বুঝাপড়ায় গিয়েছি এভাবে যে, আমার উচিত কমফোর্ট জোনে থাকা। আর না হয় স্রেফ সময় নষ্ট হবে। আমাদের কবিকুলের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন, প্রচুর সময় দিয়েছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু করতে পারেননি, দল ভারী করা ছাড়া।
এখানে দুটো প্রশ্ন তৈরী হতে পারে, এর একটা তৈরী করব আমি, অপরটা হয়তো আপনি করবেন। আমি যেটা করব—তবে কি গদ্যে আমি অগড়পরতা অসাধারণ কিছু করছি? এর উত্তর হলো, না। আমার ভিতরে বলবার যে বেদনা আছে, সেটা প্রকাশ করবার মিনিমাম ওয়ে হলো গদ্য। আর না হয় আমি যাব কোথায়? ফলে, কবিত্বের সেই বেদনার জায়গা থেকে একে আমি দেখছি অগত্যা মধুসুদন হিসেবে। সে অর্থে এটা আমার কমফোর্ট জোনও বটে।
দ্বিতীয় যে প্রশ্নটা, যেটা আপনি উঠাতে পারেন, তা হলো মানুষ তো শুরুতেই অগড়পরতা হতে পারে না। ধীরে এগোয়। হ্যাঁ, এটা সত্য। কিন্তু নিজের কাছে মনে হতে হবে যে, আমার দ্বারা এটা হবে। এই মনে হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। এটা কিন্তু মানুষ ইচ্ছেমতো তৈরী করতে পারে না। একটা তূলনা ও বিচারের ভিতর দিয়ে ‘মনে হওয়া’টা তৈরী হয়। কবিতার ক্ষেত্রে আমার মনে হয়নি আমি পারব। তবে, গল্প বলার লোভটা এখনো আছে। দেখা যাক।
আহমাদ সাব্বির: খুবই সুন্দর কথা এটা। আসলে এটাই, একজন ব্যক্তির যেখানে স্বচ্ছন্দ্য, তার সেখানেই থাকা দরকার। আমরা অনেক সময় এটা ভুলে যাই যে, আমার দক্ষতার জায়গা কোনটা? আমরা অনেক সময় এই সঙ্কটে পড়ি যে, আমার দক্ষতার যায়গা হয়তো আমি ভালো মুফতি হইতে পারতাম। কিন্তু সামাজিক চাপে বা বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকতায় গিয়ে ভর্তি হইলাম উলূমুল হাদিসে। আমার দ্বারা হয়তো গল্প ভালো হতো; কিন্তু বিভিন্ন চাপে পড়ে পুরোপুরি অনুবাদে ঢুকে গেলাম। এই সংকট তো আমাদের মধ্যে আছে এবং এটা মনে হয় মোকাবেলা করা দরকার।
এবার নতুন একটা প্রশ্ন করি—আপনার গদ্য আমাদেরকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করে। বলা যায় আপনার গদ্য পাঠে আমরা মোহিত। ব্যক্তিগতভাবে আপনার জীবনে রোদ্দুরে ইতিমধ্যে দুইবার পড়েছি। এবং খুবই মনেযোগের সাথে পড়েছি। যেটা আপনি হয়তো সাক্ষাৎকারের যে খসড়া আপনাকে পাঠাইছিলাম সেইটা দেখে কিছুটা বুঝতে পেরেছেন। তো ব্যক্তিগতভাবে আমি আমার যে কোনো পছন্দের লেখকের জার্নিটা জানতে চাই। আপনার জার্নিটা কেমন ছিল? ঠিক কখন মনে করলেন আমি লিখতে চাই! আমার বলবার মতো কিছু কথা আছে। কখন কিভাবে এটা আপনি প্রথম উপলব্ধি করতে পারলেন?
সাবের চৌধুরী: স্বাভাবিকভাবেই যারা লেখালেখি করেন, সাধারণত এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হন। আমি কয়েকজনের এই টাইপের প্রশ্নের জবাব শুনেছি। কিন্তু শোনার পরে মনে হয়েছে এটা হয়তো এভাবে সত্য নয়। হয়তো পরবর্তীতে উনি ওনার এই চিন্তাটাকে মহিমন্বিত করেছেন বা বিশেষ একটা আবেগের জায়গা থেকে বিশেষ কোন একটা ঘটনাকে সমুন্নত করছেন। অর্থাৎ, সে ঘটনাগুলোতে লেখালেখির প্রতি উদ্দীপনাটা ছিল নিশ্চয়ই; কিন্তু এটাই আসলে সবটা না, বা সেভাবে না যেভাবে তিনি দেখাচ্ছেন। তো, আমার মনে হচ্ছে যে, আমিও হয়তো এখন এই ধরনেরই কোনো একটা উত্তর দিতে যাচ্ছি। যাইহোক। এটা আসলে একদম নিরেটভাবে বলা মুশকিল যে, ঠিক কখন আমার মনে হলো আমি লেখক হবো বা আমার লেখক হওয়া দরকার। এরপরও যতদূর মনে হয়, আমি যখন হেফজ পড়ি। বয়স কত, চৌদ্দ পনেরো বা তের চৌদ্দ এই ধরনের সময়টা হবে। তো ওই সময় আমার নানা রকমের সুন্দর দৃশ্য কল্পনা করতে ভালো লাগতো। কাগজে লেখবার আগে আমি অনেক দিন মনে মনে লিখেছি। এরপর কাগজে লেখতাম। সে সময়টাতে ছোট ছোট কাগজে পাহাড় নদীর ছবিও আঁকতাম। এঁকে পকেটে নিয়ে ঘুরতাম। মাঝে মাঝে পাশের এক দুজনকে দেখাতাম। এখন এসব ভাবলে একটু অদ্ভুত লাগে। কিন্তু ছোট বয়সের কাজকারবার। আমার মনে আছে, সে সময়টাতে ছোটো ছোটো এক দুটা রচনা ছেঁড়া কাগজে লিখে কয়েকজনকে দেখিয়েছি।
এর একটা ছিল পিপিলিকা সমাজকে নিয়ে। আরেকটা ছিল হলো খুব সম্ভব একটা কবিতা বা ছড়া এই ধরনের কিছু। তো তিন চারবার এমন ঘটনা ঘটছে। আমি লেখলাম; লেখার পরে বুকের ভেতর কেমন একটা সলজ্জ গোপন খুশি তৈরী হলো। তারা দেখার পরে বললেন যে, এটা কি তুমি লিখছো নাকি কোথাও থেকে লিখে এনেছো? কয়েকটা লেখার ক্ষেত্রে এমন হয়েছে। আমার খুবই খারাপ লাগলো জিনিসটা। লেখকের আত্মসম্মানবোধ জিনিসটা সম্ভবত সেই প্রথম টের পেয়েছি। হিফজখানায় আমি যে পরিবেশে ছিলাম, সেখানকার প্রকৃতিটা ছিল খুবই সুন্দর। তারপরে ওই সময়টায় আমি কৈশোর পাড়ি দিচ্ছিলাম। বয়ঃসন্ধিকাল। অযথা ও অচেনা আবেগে উদ্বেলিত হবার সময়। সে সময়গুলোতেই লেখার আকুলতাটা তৈরী হয়েছিল। সে থেকেই পরে বাড়িতে দেয়ালিকা প্রকাশ করতে শুরু করি। কিন্তু নিজের লেখাজোকা নিয়ে আমার অসম্ভব ভীতি ছিল। সেই ভীতি কাটিয়ে নিজেকে লেখক হিসেবে ভাবতে শিখিয়েছেন আমার উস্তাদ মাওলানা মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন। দীর্ঘদিন তিনি হাতে ধরে শিখিয়েছেন শব্দ, বাক্য, গদ্যের শরীর। সবমিলিয়ে বলতে পারি আমার ‘লেখক’ হয়ে উঠার বিশেষ কোন মুহূর্ত নাই। তবে, মনে রাখার মতো উদ্দীপক ঘটনা বা টার্নিং পয়েন্ট আছে, স্বভাবতই সবার যেমনটা থাকে। অভারঅল ইচ্ছাটা ছিল, সেটাকে প্রকাশিত করে একটা পথে উঠিয়ে দিয়েছেন আমার উস্তাদ। জীবনে রোদ্দুরে’র একটা লেখায় আমি শুরুর সে জার্নির সবটা বলেছি, সবিস্তারে।
চলবে…
এটা কি আহমাদ সাব্বির ভাইয়ের ইউটিউব চ্যানেলে যে সাক্ষাৎকারটা নেওয়া হয়েছিলো সেটা?
জি।