মুখোমুখি সাবের চৌধুরি (শেষ পর্ব)

আহমাদ সাব্বির

আহমাদ সাব্বির : আপনার সাথে আমার প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ রিহালার একটা প্রোগ্রামে ঢাকায়। এরও আগে প্রথম পরিচয় তো ফেসবুকে। তারপর হোয়াটসঅ্যাপে একদিন প্রথম কথা হয়। আপনার মনে আছে কিনা, দীর্ঘ সময় কথা বলেছিলাম আমরা। প্রায় এক-দেড় ঘণ্টার মত। ১৯ সালের দিকে। তো, আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, প্রথম যখন কথা বললাম, আমার মনে হলো, আমি যেন ঠিক যাইনুল আবিদীন সাহেবের সাথে কথা বলছি। যেহেতু তাঁর সাথে আগে আমার কথাবার্তা হয়েছিল, যোগাযোগ ও যাওয়া-আসা ছিল। আমি তাঁর কথা বলার ধরনের সাথে পরিচিত। মানে আপনার কণ্ঠস্বর তেমনই মনে হলো। এবং পরবর্তীতে আপনার সঙ্গে যখন রিহলার প্রোগ্রামে দেখা হলো বা আপনার সঙ্গে আমার আরো অনেকবার কথা হলো তখন আমি আবিষ্কার করলাম যে, যাইনুল আবিদীন সাহেবের কিছু কী-ওয়ার্ড আছে কিংবা তার কিছু সাইন আচরণ আছে, সেসবের কিছুটা আপনার মধ্যেও আমি পাচ্ছি।

আপনি তো যায়নুল আবেদীন সাহেবের সরাসরি ক্লাসরুম-ছাত্র; তার কাছে পড়েছেন। এবং সাহিত্যের দিক থেকে তো অবশ্যই তার থেকে উপকৃত হয়েছেন। আমি জানতে চাচ্ছি, হুজুরের কী প্রভাব আপনার জীবনে আছে? বা তার সাথে আপনার সম্পর্কটা বা সম্পর্কের রসায়নটা আসলে কেমন ছিল, যখন তার সান্নিধ্যে ছিলেন বা তারও পরে? আমরা জানি যে, জীবনে রোদ্দুরে বইয়ে তিনি খুবই সুন্দর একটা ভূমিকা লিখে দিয়েছেন। আমি যাইনুল আবিদীন সাহেবকে এত সুন্দর ভূমিকা অন্য কোথাও লিখতে দেখি নাই। আমি যেহেতু তার লেখালেখির খোঁজখবর রাখি; তো, দেখলাম যে, তিনি খুবই যত্নের সাথে আপনার বইয়ের ভূমিকাটা লিখে দিছেন। এ থেকে বোঝা যায়, তার সাথে আপনার সম্পর্কের রসায়নটা অন্য আর সবার মতো না। আমি আসলে এটা একটু বিস্তারিতভাবে জানতে চাচ্ছিলাম।

সাবের চৌধুরী : প্রথম যেই প্রসঙ্গটা বললেন, হুজুরের কিছু কী-ওয়ার্ড বা কিছু হয়তো অঙ্গভঙ্গি বা এই ধরনের কিছু আমার মধ্যে দেখছেন। এটা আমি আরো এক দুইজনের থেকেও শুনেছি। এটা আসলে, ওইভাবে আমি নিজে টের পাওয়ার বিষয় না। বাইরে থেকে যারা দেখবে তারা হয়তো বুঝবে। এবং এই ক্ষেত্রে আমার খুব একটা মন্তব্য করার কিছু আছে বলেও মনে হয় না। বাকি এইটুকু বুঝি যে, পরিচয়ের শুরু থেকেই আমি হুজুরকে অত্যন্ত মুহাব্বত করি এবং খুবই পছন্দ করি। বিশেষ করে হুজুরের চিন্তা, ভারসাম্যপূর্ণতা, আখলাক-আচরণ, কথা বলার ভঙ্গি ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে খুবই আকর্ষণীয় একজন মানুষ আমার কাছে। এবং আমার ধারণা যে, ভালো লাগার একটা শক্তি আছে। মূলত ওই জায়গা থেকেই খুব স্বাভাবিকভাবে নানা ক্ষেত্রে প্রভাবিত হব। আপনি যখন কাউকে খুব ভালোবাসবেন, এবং তার সাথে বেশ একটা সময় পর্যন্ত বসবাস করবেন, তার কিছু বিষয় আপনার মধ্যে চলে আসবে। হয়তো ওই জায়গা থেকেই হুজুরের কথা বলার কিছু ভঙ্গি অথবা কোনো আচরণ সেটা এসে যাওয়াটা স্বাভাবিক এবং সত্যিই এমনটি হয়ে থাকলে আমার জন্য তা গর্বের ও আনন্দের।

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, হুজুরের সাথে আমার পরিচয়। আমি ঢাকা কত সনে গিয়েছিলাম   এখন ঠিক মনে পড়তেছে না। দাওরা হাদিস ফারেগ হইছি হইল ২০১১-২০১২, এই সময়টাতে। তো দাওরা হাদিসের বছরসহ মোট পাঁচ বছর আমি সরাসরি হুজুরের দরসে ছিলাম। জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া, মুহাম্মদপুর, ঢাকা। মাদরাসাটা আমাদের সময়ে তেজগাঁও লিংক রোডে ছিল। সেখানে নিয়ে আমাকে ভর্তি করিয়েছিলেন আমার আরেকজন প্রিয় উস্তাদ এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার সূত্রে বড় ভাই,  মাওলানা তাহমিদুল মাওলা সাহেব। তো, ওখানে যাওয়ার পরে স্বাভাবিকভাবেই সব হুজুরদের ব্যাপারেই একটা কৌতূহল তৈরি হয় যে, কে কেমন! সবার সাথেই পরিচিত হওয়া। তখন যাইনুল আবিদীন সাহেবকে তার লেখক পরিচয়সহ আলাদাভাবে চিনতাম না। হুজুর একদিন ডেকে আমাকে একটা প্রশ্ন করলেন শুধু যে, আপনি ভবিষ্যতে কী হইতে চান? এক সপ্তাহ পর এসে আমাকে জানাবেন। এটা আমার জন্য খুব অদ্ভুত একটা প্রশ্ন ছিল। এর আগে অন্যভাবে হালকাচালে কেউ হয়তো এই প্রশ্ন করেছেন; কিন্তু শুধুমাত্র এই প্রশ্নটার জন্য ডেকে নিয়ে যাওয়া এরপরে আবার কোনো জবাব দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে বলা যে, এক সপ্তাহ পরে জবাব দিবেন, এই ব্যাপারটা একটা বিশেষ বোল্ড ঘটনা ছিল। এর ভিতর দিয়ে হুজুরের সাথে আমার পরিচয়। এর কিছুদিন পরে থেকেই হুজুরের বাসায় আমরা নিয়মিত যেতাম। মাসে খুব সম্ভব একবার অনুষ্ঠানিকভাবে যেতাম। আর এর বাইরে মাঝেমধ্যে এমনিতে যাওয়া হইছে। তো সেখানে হুজুর ওই যে, আমাদেরকে নিয়ে বসতেন, ধরেন তিনটা থেকে মাগরিব পর্যন্ত। প্রথম প্রথম এমনিই গেছি। অন্যরা লেখা নিয়ে যেত আমি লেখা ছাড়াই যেতাম। এরপরে হুজুর বললেন যে, আপনি লেখাসহ আসুন। তখন আমিও লিখলাম। খুব ছোট ছোট রচনা। আধা পৃষ্ঠা এক পৃষ্ঠা। তিনি সবার লেখা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, আলোচনা করতেন। আমাদের আলোচনা মন্তব্য শুনতেন। একটা সুন্দর আড্ডার মতো হতো। এবং এটা শুধু সাহিত্য-আড্ডায় সীমিত ছিল না। বলতে পারেন তারবিয়তি মজলিস। চিন্তা, আদব আখলাক, সাহিত্য, পড়াশোনা ইত্যাদি সব মিলিয়ে উপভোগ্য ও নির্মাণধর্মী।

এটা হুজুরের বিশেষ একটা দিক আমি বলব, শিক্ষক হিসেবে এবং একজন মুরুব্বি হিসেবে যে, হুজুর ছাত্রদেরকে এমনভাবে আপন করতে পারেন—একটা সময় সে নিজে থেকেই সম্পর্কটা কনটিনিউ করতে থাকে। তো, আমার ক্ষেত্রেও তাই হইছে। হুজুর প্রচুর প্রশ্রয় দিয়েছেন। এখনও নিয়মিত যোগাযোগ হয়। নানান সংকটের সময়ে তাঁর পরামর্শ আমাকে পথ দেখায়।

আহমাদ সাব্বির : আরেকটা অংশ আমরা যুক্ত  করতে পারি এই জায়গাতেই। এটা তো আপনার জীবনের ওপর তার একটা প্রভাব দেখালেন। আমি যদি আরও স্পষ্ট করে বলি, আপনার বর্তমান লেখালেখি বা চিন্তা, ঠিক লেখালেখি বা গদ্যের কথাও বলতে পারি, এখানে হুজুরের কী প্রভাব বা হুজুরের কতটুকু ভূমিকা কিংবা অবদান আছে?

সাবের চৌধুরী : অবদানের কথা ইতিমধ্যে সংক্ষেপে বলেছি। টুটাফাটা যাই লিখছি, এসবের অবদান সবটাই হুজুরের। ছোটবেলা থেকে একটা আগ্রহ লালন করে পেলে-পুষে হুজুরের কাছে নিয়ে গিয়েছি, তিনি সেটাকে পরিচর্যা করে পরিণতি দিয়েছেন। আর, নিজের গদ্যের বিচার এটা আমার জন্য আসলে অস্বস্তিকর। আমি বা অন্য যারা লেখালেখি করেন, সম্ভবত সবাই নিজের গদ্যের বিচারে যেতে অস্বস্তি বোধ করবেন। আমার এখন বয়সটাই কী, কর্মই কতটুকু, অভিজ্ঞতাই বা কী পরিমাণ! আমি ব্যাপারটা এভাবে দেখি আরকি যে, কথা বলার মতো কিছু হলে আমার লেখা নিয়ে কথা বলুক অন্যরা, আমি বলি অন্যের লেখা নিয়ে। এটাই আমার কাছে সুন্দর মনে হয়। নিজেরটা নিয়ে নিজে কথা বলার কোন যৌক্তিকতা আছে বলে মনে হয় না। এই জায়গাটায় কেউ কেউ দ্বিমত করতে পারেন। বলতে পারেন, নিজের বিচারটা কনফিডেন্টলি করতে পারা উচিত। এটা লেখকের ‘সুন্দর আমিত্ব’ বা আত্মবিশ্বাস। কিন্তু আমার মনে হয়, বিশেষ করে লেখকদের জন্য আত্মবিশ্বাসের চর্চাটা জরুরি হলেও জিনিসটা খুবই স্পর্শকাতর। সতর্কতার সাথে চর্চা না করলে প্রায়শই আত্মবিশ্বাসটা আত্মপ্রতারণার দিকে নিয়ে যায়। আর, ‘সুন্দর আমিত্ব’ বলতে কোনোকিছুর অস্তিত্ব আমি মানতে রাজি নই।

তো, এমনিতে হুজুর থেকে যে জিনিসটা আমি বুঝেছি, তাঁর আলোচনা ও লেখালেখি থেকে যে, একজন লেখকের জন্য সেভাবে নির্দিষ্ট কাউকে অনুসরণ করা নিষ্প্রয়োজন। একদমই স্বচ্ছন্দ থেকে যখন যেটা ভালো লাগে, যেভাবে ভালো লাগে ‌ওইভাবেই লিখবে। এই চিন্তা আমার ভালো লেগেছে। তবে, এর ভিতর দিয়ে স্বভাবতই কেউ কেউ ছায়া ফেলবে গভীরভাবে। এটা হতে পারে। যেমন আমি সৈয়দ আলী আহসান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ—এই রকমের কিছু মানুষের গদ্য বিশেষ ভালো লাগা থেকে পড়ি।  সৈয়দ আলী আহসান-এর চিন্তা, মানে চিন্তা বলতে হলো, গদ্যটাকে সাজাতে গিয়ে তার যে চিন্তার সৌন্দর্য, গভীরতা এই জিনিসগুলো আমাকে চম্বুকের মতো ধরে রাখে। এবং তার শব্দের যে ব্যবহার, এবং খুব সম্ভব সৈয়দ আলী আহসানই একমাত্র লেখক, যার গদ্য আমাকে প্লাবিত করে।

আহমাদ সাব্বির : আপনার মধ্যে মনে হয় সৈয়দ হকেরও একটা প্রভাব আমি আবিষ্কার করছি। যেমন আপনার জীবনে রোদ্দুরের একটা লেখায় আপনি লিখছেন, ‘অক্ষর সৃষ্টি করা’ ‘যন্ত্রে শব্দের উৎপাদন’। এই বিষয়গুলা আমার মনে হয় কিছুটা সৈয়দ হকীয়। আমার কাছে মনে হইছে আরকি। সৈয়দ শামসুল হকের কি কোনো প্রভাব আছে আপনার লেখায়? বা তাকে কী পরিমাণ পড়ছেন আপনি?

সাবের চৌধুরী : সৈয়দ হকেক আমি পড়ছি হলো বিক্ষিপ্তভাবে। যেমন, নানান সময়ে তার কয়েকটা উপন্যাস পড়া ছিল। তারপর ধরেন, হঠাৎ একদিন মনে হলো সৈয়দ হকের কিছু উপন্যাস আমি পড়ব। সম্ভবত এই দুই বছর আগে। তখন রচনাবলীর পিডিএফ নামালাম। বেশ কয়েকটা উপন্যাস টানা পড়ে ফেলছি। আর এছাড়া কিছু কিছু গল্প বা এখানে সেখানে প্রকাশিত বিভিন্ন রচনা। আর আরেকটা বই আছেনা, কি যেন!

আহমাদ সাব্বির :  মার্জিনে মন্তব্য!

সাবের চৌধুরী: হ্যাঁ। মার্জিনে মন্তব্য। তারপরে ছোট গল্প, বিভিন্ন সংকলনে। এভাবে বিক্ষিপ্ত আকারে পড়েছি। এবং সৈয়দ হককে আমার ওরকম নিবিষ্টভাবে আসলে  পড়া হয়নি। আর এমনিতে যন্ত্রের উৎপা… শব্দের উৎপাদন… কী বললেন!

আহমাদ সাব্বির : হ্যাঁ, “অক্ষর সৃষ্টি করা’… তারপর ‘যন্ত্রে শব্দের উৎপাদন’… এই ধরনের কিছু শব্দ। মানে আমি সৈয়দ হককে হয়তো কিছুটা বেশি পড়ছি, এজন্য মনে হয় যে, সৈয়দ হকের কোনো রচনাতেও আমি এভাবে দেখছি, এই ধরনের কিছু বাক্য। আমি যখন পড়ছিলাম মনে হচ্ছিল যে, সৈয়দ হকের লেখা পড়তেছি। তো, সেইখান থেকে প্রশ্নটা করছিলাম।

সাবের চৌধুরী : হতে পারে, যেহেতু অল্প হলেও তাকে পড়েছি। এখানে একটা ব্যপার কি, আমি আবারো সেই সৈয়দ আলী আহসানের দিকেই যাব। সৈয়দ আলী আহসানের গদ্য পড়ার পরে আমার একটা অনুভব হয়েছে এই—আমরা সাধারণত শব্দ দিয়ে আমাদের চিন্তাকে প্রকাশ করি। কিন্তু আমি দেখেছি সৈয়দ আলী আহসান যেটা করেন, সেটা হলো তিনি চিন্তা থেকে শব্দ তুলে আনেন। কথাটা কিন্তু একটু বিভ্রান্তিকর এই অর্থে যে, শব্দ দিয়ে চিন্তা প্রকাশ করার ব্যাপারটা তো তিনিও করেন। যেটা বলতে চাচ্ছি মূলত, অনেকে হয়তো শব্দ ব্যবহারের সময় শব্দের সাথে চিন্তার যে গভীর যোগাযোগটা, সেটা ওইভাবে টের না পেয়ে হালকাচালে বা মোটের উপর কথাটা বলে ফেলেন। কিন্তু সৈয়দ আলী আহসানের মধ্যে আমি যেটা দেখলাম, তিনি যা ভাবেন যেন একদম চোখে দেখে উঠেন, তারপর সে অনুভবটা তাকে ঠিক যে শব্দটা দিবে, তিনি সেটাই লেখেন। এটা অনেকের মধ্যেই আছে, বা বলতে পারেন লেখকমাত্রই এটা করেন কমবেশ। কিন্তু দার্শনিক চিন্তায় প্রভাবিত লোকদের মধ্যে এটা আমি বেশি পাই। সৈয়দ আলী আহসান তাদের মধ্যে অন্যতম। একটা সময় আমার কাছে এই ব্যাপারটা চর্চা করতে বেশ ভালো লাগত। ঝিম মেরে অনুভূতিটার দিকে তাকিয়ে থাকা ও গভীরভাবে টের পাওয়া, এরপর সেখান থেকে শব্দটা তুলে আনা। আমি জানি না আসলে ব্যাপারটা ঠিক বুঝাতে পারলাম কি না।

আহমাদ সাব্বির : হ্যাঁ, আমি বিষয়টা ধরতে পারছি। আশা করি দর্শকরাও পারবেন। এবং এই প্রসঙ্গে আমি আরেকটু বলি সেটা হচ্ছে যে, আমাদের এখনকার তরুণদের যারা একটু সচেতন, যারা একটু লেখালেখি করতে চায়, তারা কিন্তু এই গদ্যের ব্যাপারে অনেক সচেতন হতে চায় বা চেষ্টা করে যে, তাদের গদ্যটা যেন একটু ঋজু হয়, একটু পোক্ত হয়। মননশীল স্বাদু একটা গদ্য, এটা কিন্তু অনেকেই আয়ত্ব করতে চায় এবং সচেতনভাবে চেষ্টা করে। আমি নিজেও কিন্তু ব্যক্তিগত আলাপে আপনার কাছে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, আমার গদ্যটাকে আরও শাণিত কিভাবে করা যায়! আপনি এই কাছাকাছি উত্তরই দিয়েছিলেন। তখন আরো স্পষ্ট করে বলছিলেন কথাটা, আমি যদি একটু মনে করি, একবার বলেছিলেন—আসলে গদ্যকে পরিশীলিত করার জন্য শুধু ভাষা শিখলেই হবে না; বরং জগতের আরও নানাবিধ বিষয় আছে। আপনি একটা উদাহরণও দিয়েছিলেন। তখন সিয়ানের পেইজে একটা লেখা লিখছিলেন। সম্ভবত শীর্ষেন্দুর একটা উপন্যাসের কথা আপনি তুলে আনছিলেন। আর বলছিলেন যে, দেখেন, আমি এই লেখাটা লিখছি, এর মধ্যে পাঠের একটা সমর্থন আছে। মানে, আমি যেহেতু শির্ষেন্দুর উপন্যাসটা পড়েছি, তাই সেখান থেকে জিনিসটা নিয়ে আসতে পেরেছি। কী এনেছি? ভাষা না কিন্তু; উদাহরণটা। অর্থাৎ আপনি আমাকে তখন বলতে চেয়েছিলেন যে, একটু ঋজু গদ্যের জন্য বা একটা মননশীল গদ্যের জন্য শুধু ভাষা জানাই যথেষ্ট না। বরং জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে আরও অনেক ধারণা ও পর্যবেক্ষণ থাকা দরকার। এবং আরও অনেক বিষয়ের পাঠ থাকা জরুরি। তো এই বিষয়ে যদি আরেকটু বলতেন…

আমি এইখানে একটু বলে নিই, সাবের ভাই, আপনি নিজেকে কী মনে করেন বা আপনি আপনার জায়গা থেকে কিভাবে বিচার করেন সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু আমরা মনে করি যে, আপনার থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে বা নেয়ার আছে, এজন্যই আমরা আপনাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে প্রশ্নগুলো করতেছি। আশা করি বিব্রত বোধ করবেন না। যদিও আপনি আপনার গদ্যকে সেভাবে বিচার করেন না, কিন্তু আমরা তো বিচার করি। সেই বিচারের জায়গা থেকেই এই প্রশ্নগুলো করতেছি।

সাবের চৌধুরী : শুরুতে যে কথাটা বললেন যে, ভালো লেখার জন্য বা গদ্যটাকে আরো মজবুত করার জন্য, শুধু ভাষাজ্ঞানটা যথেষ্ট না। এই কথাটাতে কেউ দ্বিমত করবে বলে মনে হয় না। একদম পরিষ্কার। এই জায়গাটায় আমি সবসময় একটা উদাহরণ দেই। ধরেন, ওই যে, বনসাই; জিনিসটা কিন্তু খুব সুন্দর। এতে অবিকল গাছটা কিন্তু আমরা পাচ্ছি। গাছের যা যা দরকার সব কিছুই আছে এর মধ্যে। কিন্তু মাঝখান থেকে একটা জিনিস নাই। সেটা কী? তা হলো গাছটা নাই। এর মানেই হচ্ছে এর মধ্যে দৃশ্যটা আছে, আকৃতিটা আছে, কিন্তু ভিতরের জিনিসটা নাই। এখন লেখালেখিতে কারো যদি ভাষা সুন্দর হয় কিন্তু তার যদি যে বিষয় সে লিখতে যাচ্ছে, ওই বিষয়ে পর্যাপ্ত পড়াশোনা না থাকে, জানাশোনা না থাকে, অভিজ্ঞতা না থাকে, যদি অভিজ্ঞতার বিষয় হয় আরকি, তাহলে সে মূল বিষয়টাকেই গভীর থেকে টের পাবে না। ফলে, ফুটিয়েও তুলতে পারবে না। খুব স্বাভাবিক।

আমরা দেখি যে, আমাদের ভিতরে যে শব্দ তৈরি হয় এই শব্দগুলো আসলে আসে কোত্থেকে! শব্দগুলো আসে হলো তথ্যনির্ভর হয়ে। আমি আপনি যখন কথা বলছি, আমার এখনের যে শব্দগুলো উৎপাদিত হয়ে প্রকাশ পাচ্ছে সেটা কিন্তু এই কথা বলতে শুরু করবার আগে কিছু তথ্য আমাকে শুনতে হয়েছে। সেই একই কারণে আগের প্রশ্নের জবাবে আমি কথা বলছিলাম আরেক রকমভাবে। কারণ ওইখানে আমি ওই কথা বলবার জন্য তথ্য নিয়েছিলাম ভিন্ন।

আহমাদ সাব্বির : দারুণ… দারুণ…উদাহরণটা খুব ভালো হয়েছে…

সাবের চৌধুরী : …ফলে, ওভারঅল আমাদের বাক্য এবং শব্দ উৎপাদিত হয় মূলত তথ্য থেকে। এখন একটা বিষয়ে যদি আপনি তথ্য না জানেন তাহলে আপনার শব্দ ওই পরিমাণ কম হবে, ওই পরিমাণ দুর্বল ও ভঙ্গুর হবে। এই জন্য মূল বিষয়টাতে আপনার পর্যাপ্ত পড়াশোনা জানাশোনা এবং মতবিনিময় ইত্যাদি নানান কিছু লাগবে। এইখানে অনেকে অনেক সময় আমরা মনে করি কি, শুধু পড়লেই জিনিসটা আমি সুন্দরভাবে বলতে পারব। আমার কাছে লাগে যে, এটাও যথেষ্ট না। একটা বিষয় কি, আমাদের অনলাইনে যেরকম এলগারিদমের একটা টান আছে, আমার বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনার ক্ষেত্রেও এলগারিদমের মতোই এক ধরনের একটা টান আছে। আমি যদি পড়াশোনার পাশাপাশি আমার বিষয়ে ইন্টারেস্টেড আরেকজনের সাথে গল্প করি, মতবিনিময় করি, তখন আমার চিন্তাগুলো কিন্তু ঝালাই হয়। ওই সময়ে আমি জিনিসটাকে আরো সুন্দর করে লিখতে পারব। ফলে পড়া, চিন্তা করা, মানুষের সাথে আলোচনা করা এটা হচ্ছে মূল বিষয়টাকে বোঝার জন্য।

তো, সুন্দর গদ্যের জন্য এটা একটা মৌলিক বিষয়, অর্থাৎ, আলোচ্য বিষয়টাকে গভীর থেকে টের পাওয়া। এই টের পাওয়াটাই আপনাকে যুৎসই অনেক গভীর শব্দ দিবে। এরপর সেকেন্ড হলো, একে প্রকাশ করার বিষয়টা, মানে, চিন্তা ও উপলব্ধিকে শব্দায়িত করা। আমি যা বুঝলাম, আমার ভিতরে যে বক্তব্য তৈরি হলো সেটাকে আমি প্রকাশ করব কী দিয়ে, টেকনিকগুলো কী কী? এইটার জন্য আপনাকে শব্দ জানতে হবে। এবং আপনার প্রশ্নটা সম্ভবত এই জায়গায় যে, এই যে প্রকাশ করবার বাহনটা, বাহনটা মানে ভাষাটা, এটাকে আমি আরো শানিত করবো কিভাবে?

তো, প্রকাশ করতে গেলে আমাদের সরাসরি বিষয় সম্পর্কিত শব্দ লাগবে। আরো লাগবে উপমা ও তূলনা।

দেখেন, আমরা অনেক সময় যা বলতে চাই, এটা তো বায়বীয় ব্যাপার। একটা চিন্তাগত বিমূর্ত বিষয়। এখন এই বিষয়গুলোতে আমাদের চেষ্টা থাকে, কম শব্দে যেন সামনের লোকটাকে পুরো বক্তব্যটা বুঝিয়ে বলে ফেলতে পারি।  এই সময় আমরা কীসের সাহায্য নেই। সাধারণত দুজনেই বুঝি এরকম কোনো চিত্রকল্প, বা ঘটনার আশ্রয় নিই। যেটাকে আমরা বলতে পারি তুলনা করা বা উপমা দেয়া। এখন, ধরেন এ বিষয়ে আমার কাছে উপমা আছে দশটা। এর ভিতর থেকে ঠিক কোনটা আমার জন্য পারফেক্ট হবে। এটা চয়েজ করার কিন্তু একটা ব্যাপার আছে। আর এই যে বললাম, আমার সামনে দশটা উপমা আছে। আপনার যদি জীবন-অভিজ্ঞতা কম থাকে, পড়াশুনা ও অন্যান্য বিষয়ে জানাশোনা কম থাকে, তাহলে কিন্তু আপনার সামনে উপমা দশটা থাকবে না। দুইটা থাকবে। এবং এই দুইটা হয়তো সুন্দর না। কিন্তু আপনার জানাশোনার পরিধি থাকলে, জীবন-অভিজ্ঞতা বিচিত্র হলে, পড়াশোনা বিস্তর করলে, মানুষের সাথে মিশ্রণটা বেশি হলে, আপনি আপনি বহুবর্ণিল দৃশ্য, শব্দ, চিন্তা, অনুভব ও উপলব্ধির ভিতর দিয়ে অগ্রসর হবেন। দেখা যাবে, তখন আপনার সামনে উপমা দশটা নয়; বিশটা থাকতে পারে। ফলে, সবচেয়ে ভালোটা গ্রহণ করা সহজ হবে। ক্লিয়ারলি যদি বলি, আপনি পাখির জীবনটা না জানলে সেখান থেকে নিজে একজন পুরুষ প্রেমিক হিসেবে প্রেমিকার উদ্দেশ্যে বলতে পারবেন না যে—‘বাবুই পুরুষের মতো বাসা বুনছি দিন রাত; তুমি এলে, উড়ে গেলে’।

তাছাড়া, আমাদের স্মৃতির ভিতরে অসংখ্য তথ্য জমা আছে। এবং আপনি একটা বিষয় খেয়াল করে দেখবেন যে, সব তথ্য কিন্তু আমরা প্রতিমুহূর্তে স্মরণ করছি না।  যখন যে প্রয়োজনের মুখোমুখি হচ্ছি আমাদের মস্তিষ্ক সেই জিনিসটাকে সামনে এনে হাজির করছে। এটা আমাদের জীবন চলার ক্ষেত্রে যেরকম সত্য, লেখালেখির ক্ষেত্রেও কিন্তু একই রকম সত্য। আপনার স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, অনুভব, অনুভূতি, উপলব্ধি, ঘটনা, চিন্তা যত বেশি ও বিচিত্র হবে, লেখাকালীন দরকারের সময়টাতে সেসব থেকে অজস্র শব্দ ও উপমা আপনার সামনে আপনাতেই হাজির হবে। ডেকে আনতে হবে না। এভাবে পাঠক আর আপনার মাঝে সেতুর নির্মাণটা অনেক মজবুত ও শক্তিশালী হবে, পাশাপাশি উপভোগ্যও হবে। আরো একটা ব্যাপার হলো, পৃথিবীতে দুটো বস্তু যেমন পরস্পরের সাথে মিলে তৃতীয় একটি বস্তু সৃষ্টি করে, বা দুটো রঙ মিলে দৃশ্যমান করে তৃতীয় একটি রঙ, আমাদের অভিজ্ঞতা এবং সঞ্চিত তথ্যও এমন। আপনার জানাশোনাটা যত বেশি ও বিচিত্র হবে, সেগুলোর মিথস্ক্রিয়ায় আপনার ভিতরে নানান রঙ-ও  সে পরিমাণে তৈরি হবে, শক্তি আসবে, শব্দ সৃষ্টি হবে। ধরুন, আপনি ওয়েস্টার্ন পড়লেন। এটা তাফসীর বিষয়ক একটা লেখার ক্ষেত্রে আপনাকে সরাসরি সাহায্য করবে না, কিন্তু পরোক্ষভাবে সমর্থন করবে। এটাকে আমরা খাবারের সাথেও তুলনা করতে পারি। খাবার গিয়ে আপনার শরীরে ভিটামিন ইত্যাদি তৈরি করে এবং সেটা সুস্থতা ও শক্তিরূপে আপনাকে সাহায্য করে। জানাশোনার বিষয়টাও আমার কাছে এমনই। সুন্দর ও মজবুত গদ্যের জন্য শুধু ভাষা জ্ঞানের বাইরে এই পড়াশোনা ও জানাশোনার বিষয়টি খুবই জরুরি। এই। কথা বোধ করি বেশ লম্বা হয়ে গেল।

আহমাদ সাব্বির : না, ঠিক আছে। লম্বা করলেও, খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিষয়টা। আসলে এটা তো আমাদের একটা জিজ্ঞাসা। আমরা চাই যে আমাদের ভাষা শানিত হোক; কিন্তু আমাদেরকে কখনও এভাবে বলা হয় না বা কেউ কখনও বলেনি। বা আমরা কখনো কারো কাছে এই ধরনের উত্তর পাই না। সেই জায়গা থেকে এটা খুবই কার্যকরী উপাদান হবে আমাদের জন্য। তরুণ যারা আমাদের দেখছেন বা পরবর্তীতে দেখবেন তারা অবশ্যই এই বিষয়টা এখান থেকে রিলেট করতে পারবেন এবং এখান থেকে তারা অবশ্যই উপকৃত হবেন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা আলাপ আপনি তুলেছেন।

তো এই জায়গা থেকে… সাবের ভাই আরেকটা বিষয়… যেহেতু গদ্যের শানিত করা বা মননশীলতার একটা আলাপ এখানে উঠছে, এর সাথে সাথে আরেকটা প্রশ্ন আমাদের মধ্যে আসে। অনেক সময় দেখা যায় যে, উদাহরণত ধরুন আপনার গদ্যটাই, তো, একে আমি বলছি খুবই দারুণ, ঋজু, পোক্ত, মননশীল। কিন্তু সেই সাথে আমাদের একটা বড় পাঠকশ্রেণি বলছে যে, এনার লেখা অনেক কঠিন। বুঝি না। তো একজন লেখক এই যে একটা দোটানা, পাঠকের মধ্যে এই যে একটা বিভাজন, এটার সাথে সে মোকাবেলা করবে কীভাবে! একইসাথে তার গদ্যকে শানিত করার একটা দাবি থাকে বা ইচ্ছা থাকে। আবার এক সাথে লেখকের তো উদ্দেশ্য পাঠকের সাথে কানেক্টেড হওয়া। আমি লিখলাম, কিন্তু পাঠক কিছু ধরতে পারলো না; তাহলে এই জায়গা থেকে বিষয়টার কোলাবরেশন বা একটা সম্মতি ও সংযোগ লেখক-পাঠক উভয়ের মধ্যে কীভাবে হবে! নাকি লেখকের কাজ হলো শুধু লিখে যাওয়া তার মত করে। কোনো পাঠক সেটা রিলেট করল কি করল না—সেটা তার ভাববার বিষয় না। এই বিষয়ে যদি কিছু বলেন!

সাবের চৌধুরী : আচ্ছা আচ্ছা। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন। এই ক্ষেত্রে কোনো সাজেশন দেওয়ার মতন কোনো বক্তব্য তো আমার নাই। আমি আমার অভিজ্ঞতাটা বলি।

আহমাদ সাব্বির : হ্যাঁ, অবশ্যই অবশ্যই…

সাবের চৌধুরী : আমি আমার মতো করে লেখব, যা মন চায় তাই লিখব, কার কাছে কঠিন কার কাছে সহজ এটা আমি দেখব না—ব্যক্তিগতভাবে এই জেদ আমি নিজের জন্য সঙ্গত মনে করি না। কেউ যদি বলে কঠিন, তাহলে সেটা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে আগ্রহী। তবে, সরাসরি না। একটু দূরে রেখে। নিজের ভাবনা ও বিচারটাকে সবার আগে রেখে। সেই সাথে দেখতে হবে মন্তব্যটা কে করছেন, তিনি এ লেখার উদ্দিষ্ট পাঠক কি না। লেখা তো নানারকম হয়, লেখা ভেদে কাঙ্ক্ষিত পাঠকও নানা মাত্রার হবেন। সেটা আমলে নিতে হবে।  

আহমাদ সাব্বির : এটা গুরুত্বপূর্ণ কথা…

সাবের চৌধুরী : কেউ কেউ আছে যে, আমার লেখার স্টাইলটাই তার ভালো লাগতেছে না। মানে আপনি একটা বিষয় বলবেন তো সেখানে নিজেকে টানছেন কেন? ভাই, এটাই তো আমার গল্প বলার পলিসি। এখন দশ লাইনে যেই জিনিসটা বলে ফেলতে পারি, এর সাথে রিলেট করতে হলে আমাকে নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে এখানে হাজির হতে হবে। শব্দ উৎপাদনের জন্যও এই বিলীনতাটা জরুরি আমার জন্য। ফলে, দশ লাইনের জিনিসটা বিশ লাইন হবে। আমার জন্য ওই বিশ লাইনেই সহজ। ধরেন, ওইটাই আমি। দশ লাইনে যে লেখবে, সেটা আমি না। আবার আমিও সে না। প্রত্যেকে যার যার।

আহমাদ সাব্বির : আমরা অনেক্ষণ গল্প করলাম। আপনাকে অশেষ শুকরিয়া।

সাবের চৌধুরী। আপনাকেও শুকরিয়া। মাআসসালাম।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
মাসউদ সরওয়ার
মাসউদ সরওয়ার
21 days ago

খুব গুরুত্বপূর্ণ

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷