আহমাদ সাব্বির : সাবের ভাই, আপনার কাছে প্রথমেই যে বিষয়টা জানতে আগ্রহ হচ্ছে, তা হলো—বিভিন্ন জায়গায় আমরা কিছুটা পরিচয় সংকটে ভুগি। পরিচয় সংকট বলতে যেমন, আমি যখন আপনার নাম প্রচারের জন্য ব্যানার করতে চাইলাম, আপনাকে জিজ্ঞেস করলাম পরিচিতিতে কী দিব? আপনি বললেন, ‘আলেম, শিক্ষক—এইটুকুই থাকুক।’ কেন? আপনাকে তো আমরা কথাশিল্পী হিসেবেও জানি। ইতিমধ্যে আপনার যে কাজ এসেছে—জীবনে রোদ্দুরে, কথাশিল্পী বা গদ্যকার বলতে আমরা যেটা বুঝি তার সবটাসহই আপনাকে এখানে হাজির দেখছি। অর্থাৎ, আপনার গদ্যের মধ্যে কথাশিল্পের বিষয়টা স্পষ্টতই বিদ্যমান। তাহলে নিজেকে কথাশিল্পী বা গদ্যকার হিসেবে পরিচয় দিতে বাধাটা কোথায় আসলে?
সাবের চৌধুরী : আসলে ওই অর্থে, মানে, মৌলিকভাবে আমি কোনো বাধা দেখি না। এটা বলতে পারেন আমার ব্যক্তিগত চয়েজ। এখন চয়েজকে যদি ব্যাখ্যা করতে বলেন, তাহলে বলব—কথাশিল্পী বা গদ্যকার ধারণাটাকে আমি খুবই উঁচু একটা জায়গা থেকে দেখি। এর জন্য আসলে যে পরিমাণ উচ্চ মানের সাহিত্যশক্তি এবং কর্ম দরকার, এবং যেই পরিসরটা কাভার করা দরকার, আমি নিজেকে ওই জায়গায় কখনোই ভাবি না। বা মূলত ওই জায়গাটাতে আমি কাজ করিনি। আমার কাছে এরকমই মনে হয়। আর দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, ভবিষ্যৎকর্ম হিসেবে আমি বেছে নিয়েছি মূলত শিক্ষকতা, গণমানুষের প্রয়োজনীয় বিষয়ে সাধ্যমতো লেখালেখি এবং সেই সাথে একজন আলেম হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। এটাই মূলত নিজের জন্য ভালো মনে করি। সাহিত্যটা আমার কাছে সেকেন্ডারি।
আহমাদ সাব্বির : আচ্ছা আচ্ছা। আপনি তো নিজেকে এখনও তরুণ মনে করেন। আমরাও আপনাকে তরুণ শিক্ষক, তরুণ আলেম বা তরুণ কথাসাহিত্যিক বলে মনে করি। তো, আমাদের মধ্যে একটা বিষয় চাউর আছে যে, আমাদের তরুণরা অপরাপর তরুণদের লেখাজোখা সেভাবে পড়েন না। আপনি কি পড়েন? তরুণরা তো আগের তুলনায় প্রচুর লিখছেন, অনুবাদ যেমন, মৌলিকও।
সাবের চৌধুরী : এখানে মূল প্রশ্নের আগে তারুণ্য নিয়ে যে ব্যাপারটা বললেন, যে, আমি তরুণ লেখক কি না? ব্যাপারটা আসলে এরকমই। লেখালেখিতে আমি বরং নিজেকে এখনও শিশুই মনে করি। এবং এইখানে বিনয়ের কোনো ব্যাপার নাই আসলে। কারণ, পরিমাণ ও ধারবাহিকতার হিসাব নিলে দেখবেন, মৌলিকভাবে আমি এখনও লেখালেখিতে সিরিয়াসভাবে ঢুকিই নাই। অবশ্য, এই যে ঢুকি নাই বললাম, এর মধ্যে স্বেচ্ছা পরিত্যাগের একটা ব্যাপার থাকে। কিন্তু আমি তো স্বেচ্ছায় বিরত থাকতে চাইনি কখনো। নানা কারণে ঢুকতে পারি নাই। তো, এই হিসেবে তরুণও না; কৈশোর কালটা হয়তো পার করছি বড়জোর। এখন মূল যে প্রসঙ্গটা, তরুণদের পড়ি কি না? এটা কি একটু বিস্তারিত বলব?
আহমাদ সাব্বির : জি, অবশ্যই।
সাবের চৌধুরী : ‘পড়ি’ বলার জন্য যে পরিমাণটা দরকার, সেটা সম্ভব হয় না আসলে। এমনিতে পড়ি বা বলতে পারি যে, পড়া হয়ে যায়। বেশি পড়ার সুযোগ না হওয়ার পেছনে নানান কারণ আছে। যেমন, বয়সের দিক থেকে কৈশোর ও তারুণ্য পেরিয়ে আসার পর স্বভাবতই একজন মানুষের সময়ে টানাপোড়েন তৈরি হয়। ফলে, পড়াশোনার কাজটাও করতে হয় খুব হিসাব করে। আমি প্রধাণত তিন কারণে পড়ি : শিক্ষকতার প্রয়োজনে একাডেমিক পাঠ। দ্বিতীয়ত, আলোচনা ও লেখালেখির প্রয়োজনে নির্বাচিত পাঠ; তৃতীয়ত, চিন্তাগত ও ইলমি সমৃদ্ধির প্রয়োজনে বিশেষায়িত পাঠ। আমার পাঠ বলতে মৌলিকভাবে এ তিনটিই। খেয়াল করলে দেখবেন, এ তিন প্রয়োজনের সবটাই আমাকে নিতে হয় আরবি বা উর্দু থেকে। সেখানে বাংলার উপস্থিতি আসলে সামান্য। এবং যা-ও আছে, আমার সীমিত জানাশোনায় এ জায়গাটাতে তরুণদের মৌলিক লেখালেখিটা বেশি না আসলে। ফলে, স্বভাবতই তাদের মৌলিক রচনা আমি পড়বার সুযোগ পাই কম। সুযোগ এলে অবশ্যই পড়ি। যদি উদাহরণ দিতে বলেন, এই মুহূর্তে মনে পড়ছে হিসেবে আমি কয়েকটা বইয়ের নাম বলতে পারি। যেমন, তরুণ লেখক আবদুল্লাহ আল মাসউদের প্রাচ্যবাদের ইতিকথা, ইমরান রাইহানের ইতিহাস পাঠ : প্রসঙ্গ কথা। হুযাইফা কাসিমের ইলমুল মানতিক। শেষ বইটা অবশ্য ছোটদের জন্য লেখা। খুব সুন্দর। বাকি দুইটা আমি মনে করি সমকালে তরুণদের লিখিত মৌলিক সেরা বইগুলোর অন্তর্ভুক্ত।
আমার পড়াশোনার চতুর্থ জায়গাটি হলো—মিশ্র প্রয়োজন। যেমন, সমকালের পৃথিবীকে জানা, সময়ের বিবর্তনটা ধরতে পারা, সমাজকে বুঝা বা মানসিক বিশ্রামের জন্য সাহিত্য পাঠ। তো, এ জায়গটায় তরুণরা যেমন আসেন, অন্যরাও আসেন।
এ তো হলো বই পাঠের কথা, কিন্তু এর বাইরে পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন, বা ওয়েবজিনে তো তাদের রচনা সাধারণত পড়া হয়ই। বই পাঠের ক্ষেত্রে হিসেবি হলেও বিচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিত রচনাপাঠে আমি হিসেবি নই। সামনে যা পাই পড়ি। সবাই যেমনটি করেন সাধারণত।
আহমাদ সাব্বির : এখানে সম্ভবত আরেকটা ব্যাপার আছে—মনোযোগী পাঠের বাইরে আমাদের আরেকটা পাঠ আছে, এটাকে পাঠ না বলে বলা ভালো দেখা। মানে, নজর বুলানো, ধরনটা বুঝা, খোঁজখবর রাখা।
সাবের চৌধুরী : হ্যাঁ, এটা ভালো বলেছেন। বইপত্র পড়েন এমন সবাই এ কাজটা করেন। অর্থাৎ, বই পড়া তো একটা প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার ভিতরে যিনি আছেন, দেখা যাবে তিনি দশটা বই পড়লে এর ভিতর দিয়ে আরো বিশটা বইয়ের উপর তার নজর পড়ে, নানাভাবে। এটা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমার মনে আছে, তখন মেশকাত পড়ি সম্ভবত। মাদরাসায় পরীক্ষার ছুটি হয়েছে। বাড়ি ফেরার জন্য ব্যাগপত্র গুছিয়েছি। আমার উস্তাদ মাওলানা মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন দা. বা. ডেকে বললেন, আপনি আরো একদিন মাদরাসায় থেকে যান। কাজ হলো সাহিত্য পাঠাগারের বিশেষায়িত বইগুলো সব নামিয়ে নাড়াচাড়া করা। পড়তে হবে না। নজর বুলাবেন। একটুআধটু খুলবেন। ভালো লাগলে কোথাও কোথাও থেকে টুকটাক পড়বেন। কাজটা অদ্ভুত এবং মজার। এবং পরে বুঝেছি যে, গুরুত্বপূর্ণও। এভাবেও আমাদের একটা পাঠ হয়ে যায়। অনেকে আছেন বই হাদিয়া হিসেবে পাঠান। খুব ঘনিষ্ঠজন যারা আছেন তারা। নতুন বই আসলে সাধারণত পাঠান। তো ওই সময় ধারাবাহিকভাবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত না হলেও মোটামুটি পড়া হয়ে যায়। পরিচিতিটা হয়ে যায় আরকি। আর এর বাইরে ঢাকা গেলে বা বই মেলায় গেলে, সেখানেও এই সুযোগটা আসে। এক তো হলো স্টলে থেকেই বিভিন্ন বইয়ের সাথে পরিচয়টা আমার একটা পুরোনো অভ্যাস। এছাড়া টুকটাক বই তো কেনা হয়। আর আমি মাদরাসায় যেই রুমটাতে বসবাস করি, এখানে আমাদের মাদরাসার পাঠাগার। আকারে ছোট হলেও বেশ কিছু বই আছে। নতুন নতুন বই যোগ হচ্ছে প্রতিনিয়তই। আমাদের পারিবারিক লাইব্রেরিতে তরুণদের লিখিত নতুন পুরাতন বইপত্র আছে। সব মিলিয়ে মোটামুটি লেখাগুলো আমার নজরে থাকে। তবে, ওই যে, প্রয়োজনের বাইরে ওইভাবে নিয়মিত পড়া হয় না আসলে, না তরুণদের, না প্রবীণদের।
আহমাদ সাব্বির : আপনার পাঠ প্রক্রিয়া যেটা বললেন, কর্মজীবনে এটা আসলে একটা বাস্তবতা। কর্মজীবনে প্রবেশের পর আমাদেরকে আসলেই রিডিংটাইমটা খুব হিসেব করে খরচ করতে হয়।
সাবের চৌধুরী : ফাঁকে একটা কথা বলে রাখি—পাঠের এইসব ভাগবিন্যাস দ্বারা মনে হতে পারে আমি বুঝি খুব পড়িটরি। আসলে বিষয়টা এমন না। আমি মূলত শিক্ষকতা করি। কওমি মাদরাসার শিক্ষকতা মানে তো জানেনই। এখানে শুধু পাঠদানের ব্যাপার নয়, তদারকি ও তারবিয়ত—এসবের পেছনেও প্রচুর সময় দিতে হয়। এর বাইরে আমি খুব মনোযোগ দিয়ে এবং আনন্দের সাথে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে সংসারটা যাপন করি। এই সীমাবদ্ধতার ভিতর দিয়ে সামান্য যা পড়ার সুযোগ পাই, যার বেশিরভাগই হলো শিক্ষকতার প্রয়োজনে, সামান্য এটুকুর ভিতরেই মূলত এসব বিন্যাসটিন্যাস। খুব যে পরিকল্পনা করে তৈরি করেছি এসব তা না; আমার যে লাইফস্টাইল, সেখান থেকে এ আপনাতেই তৈরী হয়েছে।
আমরা সম্ভবত মূল প্রশ্ন থেকে একটু দূরে চলে এসেছি।
আহমাদ সাব্বির : হ্যাঁ, প্রশ্নটা ছিল তরুণদের লেখা পড়েন কি না।
সাবের চৌধুরী : হ্যাঁ। তো, বিস্তারিত বলেছি, এর সাথে একটু সংযুক্ত করব এই যে, একজন তরুণকে পাঠ করবার এখন সবচাইতে বড় মাধ্যম হচ্ছে সম্ভবত ফেসবুক। এটা হয়তো একটু শুনতে কেমন লাগে। কিন্তু তারপরও শেষ পর্যন্ত সত্য তো এই যে, আহমাদ সাব্বিরকে বইয়ের ভেতর দিয়ে যতটুকু পাঠ করতে পারছি তার চেয়ে বেশি পাঠ করতে পারছি ফেসবুকে। তো, এই অর্থে আমি বলতে পারি যে, হ্যাঁ, আমরা নিজেরা নিজেদেরকে পড়ি আসলে। সবাই সবাইকে পড়ছি।
আহমাদ সাব্বির : সাবের ভাই, এই সূত্রেই যদি বলি—আপনি মাত্র যে কথাটা বললেন, অবশ্যই আহমাদ সাব্বিরের নামটা উদাহরণ হিসাবেই এনেছেন, কিন্তু আমি যদি এই উদাহরণটাকে লিটেরারি নিই, তাহলে আহমাদ সাব্বির তো তার সাহিত্যচর্চার সবটা বা কোনোটাই দেখা যায় ফেসবুকে করে না। বরং সে বইয়ের মাধ্যমেই তার সাহিত্যের—কোট আন-কোট—বিষয়টা প্রকাশ করে। ফেসবুকে ততোটা না। এবং আমাদের অনেক তরুণের ব্যাপারেই আমরা এটা জানি যে, তারা মূলত ফেসবুকে তাদের লেখালেখির চর্চাটা করে না; বরং বিভিন্ন এক্টিভিটি বা আমাদের সমাজের সাথে কিংবা সময়ের সাথে যুক্ততার কারণে তারা ফেসবুকে আছেন। তো এই তরুণদের লেখালেখির সাথে পরিচিত হওয়ার কোনো দায় কি আপনি আরেকজন তরুণ লেখক হিসেবে অনুভব করেন না!
সাবের চৌধুরী : তরুণরা ফেসবুকে লেখালেখি করেন বা করেন না, আমি মনে করি দুটোই সত্য। ধরেন, আপনি হয়তো সিরিয়াস লেখালেখি ফেসবুকে করেছেন না; কিন্তু অনেকে করছেনও। এবং সাহিত্য যেটা, আমি আসলে ওই যে সিরিয়াস লেখালেখি এবং সাহিত্য—এই দুইটাকে ভাগ করার পক্ষে না। আমি ওভারঅল বলি আরকি যে, লেখালেখি। তো সত্যিকারের লেখালেখিটা ফেসবুকে অনেকেই করছেন। এবং একটা সময় পর্যন্ত আমিও লেখালেখিটা মূলতই ফেসবুকে করেছি। তো, আহমাদ সাব্বির হয়তো করে না। কিন্তু অনেকেই করে; কেউ বেশি, কেউ হয়তো কম। কিন্তু করে আসলে। আমার কাছে এরকম মনে হয়। আবার অনেকে আছে হলো, এই যে অনলাইনের কারণে আমাদের লেখালেখির জগৎটা তো বেশ বিস্তৃত হইছে। ফলে দেখা যায় আহমাদ সাব্বির হয়তো তার টাইমলাইনে লিখছে না। কিন্তু অন্য একটা ওয়েবজিনে লিখছে। তো এটার আবার লিংক শেয়ার করছে। লিংকে গিয়ে পড়ার সুযোগ হচ্ছে। এই আরকি, নানাভাবে আমার মনে হচ্ছে, কিছু না কিছু, মোটামুটি ভালো একটা অংশ আসলে পড়া হয়ে যায়।
আহমাদ সাব্বির : আচ্ছা। মানে, অন্যান্য তরুণদের লেখা আপনি বিশেষ একটা প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে পড়েন। আপনার সিরিয়াস পড়াশোনায় তাদের উপস্থিতি কম।
সাবের চৌধুরী : হ্যাঁ, তবে তা মৌলিকে। নিজের প্রয়োজনেই তাদের তাদের অনুবাদের দ্বারস্থ আমাকে হতে হয়। আর, আপনি যেটা বললেন যে, পড়া উচিত কিনা! এই প্রশ্নটা একটু ভারী হয়ে যায়..
আহমাদ সাব্বির : সাবের ভাই, আমি আসলে উচিত কিনা এভাবে হয়তো জিজ্ঞেস করতে চাইনি। আমি বলতেছি যে, কোনো দায় অনুভব করেন কি না! বা কোনো দায় আসলে আসে কি না কারো ওপর? মানে, বর্তমান সময়ে আমার আপনার বয়সি যারা লিখছে, তাদেরকে একটু পড়ে দেখি—এমন কোনো দায় কি সমসাময়িক কোনো লেখকের উপর বর্তায়? প্রশ্নটা আমার মনে এইভাবে ছিলো আরকি।
সাবের চৌধুরী : আচ্ছা। আমি আসলে ‘দায়’ এই শব্দটাই এড়াইতে চাচ্ছি। এক হলো, আমার নিজের প্রয়োজনে খোঁজখবর রাখা দরকার। এটুকু আমি মনে করি। অর্থাৎ, আমি যদি সমকালের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে চাই, এবং আমার আশপাশে তরুণ যারা আছেন বা নতুন যারা লিখছেন, তাদের ভাষা ভঙ্গিটা এখন কেমন বা তারা আসলে কী নিয়ে ভাবছেন, তার সাথে আপডেট থাকতে চাই, সেই জায়গা থেকে আমি নিজের জন্য মনে করি যে, তরুণদের লেখালেখি সম্পর্কে খোঁজখবর রাখা—এটা দরকার। নিজের জন্য। আর এর বাইরে একটা ব্যাপার থাকে, স্বাভাবিকভাবে যারা একটু লেখালেখি করেন তাদের সাথে, তাদের কমবয়সি যারা আছেন, এংগেইজড হতে চান, অথবা দিকনির্দেশনা কিংবা নানা রকমের পরামর্শ পেতে চান, লেখালেখির জগৎটার ভিতরে প্রবেশ করার পথ তালাশ করেন। তো সেই সুবাদেই আমি মনে করি, মিনিমাম যার যার সক্ষমতা অনুযায়ী লেখকগণ একটা এফোর্ট, এটা দেয়া উচিত। মানে, যার যার সক্ষমতা অনুযায়ী এটা করলেই সম্ভবত ভালো। আমি এটুকুই মনে করি। আর দায় শব্দটা আমি মনে করি, যারা হচ্ছেন গিয়ে প্রবীণ, প্রচুর লেখালেখি করেছেন, প্রতিষ্ঠিত লেখক, তাদের ক্ষেত্রে হয়তো এটা বলা যায় যে, তাদের উচিত এখন পরবর্তী প্রজন্মকে ভালোভাবে রেখে যাওয়া। লেখালেখির পথঘাট অলিগলি চিনিয়ে যাওয়া। রচনার কুশলতায় যেমন, লেখা প্রকাশের মাধ্যমগুলোর সাথে পরিচিত করানোর ক্ষেত্রেও। কিন্তু ওই যে, উচিত বা দায়— শেষ পর্যন্ত একই হয়ে গেল।
আহমাদ সাব্বির : হা হা..
সাবের চৌধুরী : তো, উচিত বা দায় না। বরং এটা হলো একটা সামাজিক আকাঙ্ক্ষা। বা ইনজেনারেল দ্বীনি কর্তব্য। কে কতটুকু কখন এবং কীভাবে করবে, এগুলো নির্দিষ্ট করা নেই। যার যার সামর্থ ও সুবিধা।
আহমাদ সাব্বির : একটা বিষয় খেয়াল করছেন কি না? আমাদের সাহিত্য চর্চার বা সাহিত্য যাত্রার বয়স তো অনেক, বিশেষ করে আমাদের ঘরানায়, যদিও ঘরানার এই ভাগটা ঠিক কি না বা ঘরানার ভাগটা আদৌ জরুরি কি না—এই বিষয়ে আমাদের আলাপ সামনে আসবে। এমনি আমরা এখন ধরে নিচ্ছি, যেহেতু আমাদের মধ্যে এক প্রকার প্রতিষ্ঠিতই হয়ে গেছে যে, আমাদের এখানে দুইটা ঘরানা আছে। তো সেই ঘরানার জায়গা থেকে বিচার করলে আমাদের এই সাহিত্য যাত্রার বয়স তো অনেক হলো। শুরুর দিকে আমাদের আলেম লেখক যারা, তারা গল্প উপন্যাস বা ফিকশন যেটাকে বলি, ফিকশন চর্চায় কিন্তু আমাদের বড়দেরকে সেভাবে পাইনি বা এখনো পাই না। ইদানীং তরুণদেরকে দেখা যাচ্ছে, আমি ইসলামিস্ট বা কওমি তরুণদের কথা বলছি, তারা গল্প উপন্যাস বা ফিকশন সেটার দিকে ঝুঁকছে। এটাকে আপনি কীভাবে বিচার করবেন?
সাবের চৌধুরী : এইটা মোটামুটি বেশ বড় একটা প্রশ্ন। দায়িত্বশীলতার সাথে জবাব দিতে হবে এবং স্বাভাবিকভাবেই ওই রকমের দায়িত্বশীলতার সাথে এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য আমি প্রস্তুত নই। জ্ঞানগত দিক থেকে না, বয়স, কর্ম বা অভিজ্ঞতার দিক থেকেও না। সাহিত্যের শিক্ষানবিশ ও একজন তরুণ হিসেবে আমি যদি নিজের বুঝাপড়াটা বলি—আমার ধারণা একটু তলিয়ে দেখলে আপনার প্রশ্নটার ভিতরে তিনটা অংশ আছে : এক. আমরা যে সাহিত্যটা করতে আসছি, সেখানে গল্প-উপন্যাস, আপনি যেটাকে ফিকশন বলছেন, এটা আসলেই জরুরি কিছু কি না, কিছু কিছু আঙ্গিকের ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসবে বৈধ কি না। দুই. আমাদের অগ্রজ ও প্রবীণগণ সেদিকে গেলেন না কেন? তিন. তারা বিলকুল যাননি বিষয়টা এমন? নাকি গিয়েছেন?
আহমাদ সাব্বির : তাহলে আমরা একটা একটা করে আলাপে যাই। ফিকশনের ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
সাবের চৌধুরী : এমনিতে ফিকশনটাকে আমি মৌলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কারণ, যত কিছুই হোক শেষ পর্যন্ত আপনার যেই গবেষণা অথবা বিষয়ভিত্তিক তাত্ত্বিক যে বইগুলা আছে, সেইগুলো সাধারণত মানুষ প্রয়োজন ছাড়া সচরাচার পড়তে চায় না। পড়ে এই গল্প-টল্প ফিকশন ভ্রমণ এই জাতীয় সহজিয়া বিষয়গুলাই। তো এটা দাওয়াতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা মাধ্যম। সেই জায়গা থেকে আমি ফিকশনের দিকে ঝোঁকা বা ফিকশনটাকে বিশেষ চর্চার মধ্যে নিয়ে আসা, এটাকে ইতিবাচকভাবে দেখি। এই ক্ষেত্রে যদি কোনো ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করতে হয় সেগুলোরও চর্চা জারি রাখা দরকার মনে করি।
আমাদের বিপরীত যে সাহিত্যস্রোতটা আছে, এরা সারা বাংলাদেশব্যাপী যে একটা জাগরণ তৈরি করছে বা ছেলেদেরকে আকৃষ্ট করছে, একটা দল তৈরি করছে নানাভাবে, এদের মূল হাতিয়ার এর মধ্যে অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে ফিকশন। খুব সম্ভব মুভি এবং খেলার পরই এর স্থান। মানে, আক্রান্তের বিচারে আরকি। আপনি এক জাফর ইকবালের দিকে তাকান না, এই লোকটা সারাজীবনে কয়টা তাত্ত্বিক বই লিখছেন! হুমায়ূন আহমেদ? এর বাইরেও যারা আছেন, ধরেন সৈয়দ শামসুল হক, তাকে তো আমরা আসলে গল্পকার কবি ঔপন্যাসিক এই পরিচয়গুলো দিয়েই চিনি। মনস্তাত্ত্বিক জায়গা থেকে তরুণদের সাপেক্ষে এঁরা কিন্তু খুবই পাওয়ারফুল পার্সন।
এ দিক থেকে বিচার করলেও ফিকশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা আমি মনে করি।
কয়েকদিন আগে লেখক আফিফা মারজানা একটা উপন্যাস লিখেছেন গুলমোহর নামে। সে বইয়ের ভূমিকাটা আমাকে লেখতে হয়েছিল। তো, ভূমিকার শেষ দিকে আমি ফিকশনের গুরুত্বের বিষয়টা ব্যখ্যা করার চেষ্টা করেছি, সাথে ওই যে—ওভারঅল ফিকশন জিনিসটার বৈধতা অবৈধতা, এ নিয়েও প্রশ্ন হাজির করার চেষ্টা করেছি। এবং লেখিকাও দেখলাম এই দিকটা মাথায় রেখেই বেশ সংযতভাবে কাহিনিটা লেখার প্রয়াস চালিয়েছেন। এখানে সেটুকু উল্লেখ করাটা প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে :
‘‘যে গল্প যত বেশি বাস্তব জীবনকে ধারণ করে তা তত বেশি স্বার্থক, সত্য ও জীবনমুখী—এমন একটা ধারণা হয়তো অঘোষিতভাবে প্রচারিত আছে। কিন্তু আসলে কি তাই? গল্প ও উপন্যাস জীবনের প্রতিচ্ছবি, নাকি ব্যাখ্যা? এর সমাধান হয়তো চট করে বলে ফেলা মুশকিল। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এই—এ মূলত উভয়ের মিশেলে তৈরী হওয়া একটি শিল্পভাষ্য। একটি দূরবীনের মতো–যা দিয়ে আমরা আমাদের জীবন ও চারপাশের পৃথিবীকে বিশেষ একটি দৃষ্টিকোণ থেকে গভীরভাবে অবলোকনের সুযোগ পাই। এখানে দৃশ্যরা আসে, শব্দসমূহ উচ্চারিত হয়, পাতারা ঝরে, বিকেলগুলো মরে যায়, আকাশে জাগে নক্ষত্রের দল, নিজস্ব ভঙ্গি ও অবয়ব নিয়ে এসে হাজির হয় বহুবিধ চরিত্র ও মানুষ, পরিচিত দৃশ্যকল্পে প্রবাহিত হয় বিচিত্র জীবনস্রোত; কিন্তু এসব কিছু আসে মূলত লেখকের চিন্তা ও অনুভবের সমান্তরাল হয়ে। ফলে, এখানে আমরা বাস্তবজীবনকেই পাই, কিন্তু পাই খানিকটা সম্পাদিতভাবে। একটা গল্প পাঠ করবার পর পাঠকের হৃদয়ে যে ভাষাহীন সংশ্লেষ, এটুকুর জন্যই একজন ঔপন্যাসিক পাড়ি দেন গল্পের বিস্তীর্ণ প্রান্তর। একজন প্রবন্ধকার ও একজন ঔপন্যাসিক–উভয়েই মূলত নিজস্ব অনুভব ও চিন্তার কথা বলেন; কিন্তু ব্যবধান হয়তো এই—প্রাবন্ধিক চিন্তাকে তুলে ধরেন সোজাসাপ্টা ও সরাসরি, কিন্তু ঔপন্যাসিক একে দৃশ্যায়িত করেন এবং সূক্ষ্ম কৌশলে নিজেকে লুকিয়ে ফেলেন সেসব দৃশ্যের অভ্যন্তর থেকে। ফলে, আমার কাছে গল্প শুধু গল্প নয়, চিন্তার অভিযাত্রাও, যে অভিযাত্রায় সঙ্গী হন পাঠক, শব্দ ও দৃশ্যের মোহে শিল্পগ্রস্ত হয়ে, স্বেচ্ছায় ও সানন্দে।
উপন্যাস বা কথাসাহিত্য দ্বারা মানুষ প্রভাবিত হয় খুব সহজে, ফলে জনরা হিসেবে একে আমি খুবই গুরুত্বের চোখে দেখি। এবং এখানে যেহেতু জীবনেরই গল্প থাকে, তাই আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ হিসেবে স্বভাবতই আসবে প্রেম ও দাম্পত্য সম্পর্কের কথকতা। এই জায়গাটায় সম্ভবত আমাদের একটা স্বচ্ছ বুঝাপড়ায় যাওয়া দরকার। বিশেষত তিনটি জিনিসে নজর দেওয়া যায়: এক. বেশ লম্বা একটা সময় অনেকটা ধারাবাহিকভাবে প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের কথাটি আলোচিত হয়। শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে এটা কেমন? দুই. নারী পুরুষের সম্পর্কের যে রসায়ন, তা কতটুকু প্রকাশ্যে প্রচারিত হতে পারে? তিন. বিয়ে ছাড়া শুধু প্রেমের সম্পর্কটি কি আলোচিত হতে পারে? হলে তা কতটুকু? এই প্রশ্নগুলোর সুচিন্তিত সমাধান দরকার। আমি আশাবাদী, নিশ্চয়ই এসবের উত্তরও বাংলা সাহিত্যে ধীরে একসময় গড়ে উঠবে এবং সেই গবেষণায় ‘গুলমোহর’ তার সংযমী উপস্থাপনাসহ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে। ’’
তো, এখন যারা গল্প-উপন্যাস লিখছেন, একে আমি ইতিবাচকভাবেই দেখি। বিশেষ করে গল্পভাষ্যে ইতিহাস নির্মাণের সুন্দর একটা চেষ্টা দৃশ্যমান। পাশাপাশি ইসলামিস্ট লেখকগণ শরীয়তের অনুশাসন মেনে যে জীবনটাতে বিলং করছেন, সেসব গল্পও উঠে আসছে। পাশাপাশি গল্পের ভিতর দিয়ে শরীয়তের বন্ধনমুক্ত বিপরীত জীবনধারার কদর্যতাও দেখাচ্ছেন অনেকে। এগুলো খুবই সুন্দর ব্যাপার।
আহমাদ সাব্বির : আমরা তাহলে দ্বিতীয় বিষয়টিতে যেতে পারি।
সাবের চৌধুরী : হ্যাঁ। আপনার প্রশ্ন এবং আমার একটু আগের উত্তর—এ দুয়ের সম্মিলনে ‘প্রবীণরা কেন গল্প-উপন্যাসে যাননি?’ প্রশ্নটাকে কিছুটা অভিযোগের কাঠামোতে নিয়ে যায়। তো, শুরুতেই বলে রাখি এই অভিযোগ চর্চার বিষয়টাতে আমি কখনো বিশ্বাস করি না এবং অভিযোগ সত্যও নয়। এক তো হলো আমাদের অভিযোগগেুলো তৈরি হয় নিজেদের ব্যক্তিগত আকাঙক্ষা ও বুঝাপড়া থেকে। কিন্তু আমাদের নিজস্ব এই বুঝাপড়া তো একচেটিয়া নয়। বহু ক্ষেত্রেই বিবেচনাসাপেক্ষ, তর্কসাপেক্ষ, কখনো স্পষ্টতই প্রশ্নবিদ্ধ। দ্বিতীয়ত, ধরুন, আমার পিতা মৃত্যুকালে আমার জন্য দশ বিঘা জমি রেখে গেছেন, আমি প্রশ্ন উঠাতে পারি তিনি কেন বিশ বিঘা রেখে গেলেন না? কিন্তু এ প্রশ্নের ভিত্তি কী? তিনি যা রেখে গেছেন, এর জন্য আমার সবিনয় কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। এই এখানে, আমি উচিত শব্দটা নির্দ্বিধায় ব্যবহার করতে পারি। এখন যদি আমি আমার পর্যবেক্ষণটা বলি—তারা বিলকুল যাননি, এটা আমি মানছি না। কেন, তা তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলব ইনশাআল্লাহ। কিন্তু দৃশ্যত আমরা যেটা দেখি যে, গল্প-উপন্যাসে প্রবীণদেরকে আমরা সেভাবে পাইনি। তো, আমার যেটা মনে হয়েছে, তারা যে সময়টাতে লেখালেখিতে ঢুকছেন, সে সময়টাতে লেখালেখির আঙিনায় পা রেখেই তারা বিপুল একটা প্রয়োজনের মুখে পড়ে গেছেন। যেখানে আসলে ফিকশন বা ওই দিকে যাওয়ার সুযোগ তাদের ছিল না, বা বলা যায় যে, ওই দিকে পা বাড়ানোর আগেই বিস্তৃত কর্মের ময়দান তৈরি হয়ে ছিল। মুহিউদ্দিন খান সাহেব রহ. থেকে নিয়ে পরবর্তী সময় বা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.’র সময় থেকে নিয়ে পরবর্তী সময়ের কাজগুলো যদি আপনি দেখেন, দেখবেন সবগুলো হচ্ছে প্রয়োজনের সাথে সংশ্লিষ্ট। এবং প্রয়োজনের জায়গাগুলো কিন্তু এখনও পূরণ হয়নি। তো সেই হিসেবে আমার কাছে মনে হয় যে, তারা যেই জায়গাগুলোতে কাজ করে গেছেন এবং কর্মের নমুনাগুলো রেখে গেছেন এটা খুবই দরকার ছিল এবং সেটা তারা করে গেছেন।
এই কথাটাকেই যদি আরেকটু ডিপলি বলি, আমার ধারণা কথাবার্তা একটু দুর্বোধ্য হয়ে উঠবে, হয়তো।
আহমাদ সাব্বির : না, না; তা হোক, আপনি বলুন।
সাবের চৌধুরী: … (চলবে…)
জরুরি সাক্ষাৎকার। পরের কিস্তির জন্য অপেক্ষায় থাকলাম।