নজরুল হাফিজ নদভী। বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও আলেমে দীন। উপমহাদেশের প্রসিদ্ধ ইসলামী জ্ঞান ও মনীষা চর্চাকেন্দ্র ‘নদওয়াতুল উলামা লক্ষ্ণৌ‘ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী সাহিত্যের একজন বরেণ্য অধ্যাপক। পঞ্চাশোর্ধ বয়সের এই সাহিত্যসেবক ও গবেষকের প্রধান অর্জন–দীর্ঘকাল সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.-এর প্রায় সার্বক্ষণিক প্রত্যক্ষ সান্নিধ্য ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ। অনেক ক্ষেত্রেই তিনি আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভীর মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করতেন। তাঁর গবেষণাধর্মী প্রধান দুটি গ্রন্থের নাম হল– ১. আয যামাখশারী : কাতিবান ওয়া শাইরান, ২. আবুল হাসান আলী নদভী : কাতিবান ওয়া মুফাক্কিরান। আরবীভাষায় রচিত এই গ্রন্থদুটির প্রথমটিতে প্রখ্যাত আরবী ভাষাবিদ আল্লামা যামাখশারীর গদ্য ও কাব্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। অন্যটিতে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রধান ইসলামী চিন্তাবিদ লেখক আল্লামা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভীর সাহিত্যকর্ম ও তাঁর চিন্তা–দর্শনের ওপর বিশদ আলোকপাত করা হয়েছে। এছাড়াও আরো অনেক পাণ্ডুলিপি তাঁর প্রকাশিত হয়েছে চিন্তাধর্মী বিভিন্ন বিষয়ের ওপর। আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভীর অনেক গ্রন্থেরই ভাষান্তরের দায়িত্ব তিনি আঞ্জাম দিয়েছেন। সম্প্রতি পশ্চিমা মিডিয়ার ভয়াবহতার ওপর অত্যন্ত তথ্যবহুল ও দিকনির্দেশনাধর্মী তাঁর একটি বিশাল প্রবন্ধ ধারাবাহিকভাবে একাধিক আরবী উর্দু সাময়িকীতে প্রকাশিত হচ্ছে।
পারিবারিক মক্তবে উর্দু–ফার্সীর প্রাথমিক শিক্ষালাভ ও পবিত্র কুরআন হিফজ করেন । দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামায় ভর্তি হয়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। কায়রোর আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে সমালোচনা–সাহিত্যের ওপর ডক্টরেট অর্জন করেন। লেবাননের ‘আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেন ইংরেজী সাতিত্যের ওপর বিশেষ ট্রেনিং এর সনদ। মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের রেডিওতে বহুদিন কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভীর একজন স্নেহধন্য ও দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সাহিত্য, গবেষণা, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
সাহিত্যসেবা ও সাহিত্যগবেষকদের মাধ্যমে যাঁরা একটি বিশুদ্ধ জীবনাচারে আয়নারূপে সাহিত্যকে আরো পরিচ্ছন্ন, জীবনঘনিষ্ঠ ও সততাপূর্ণ করে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়াসী, তিনি তাঁদেরই একজন। এই সাহিত্যগবেষক ও চিন্তাবিদ পুরুষের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণের সুযোগ ঘটে গত ২৩ জানুয়ারী ১৯৯৪ রোববার। চট্টগ্রামের চাঁদগাও–এর ‘দারুল মা‘আরিফ‘ মাদরাসায় অনুষ্ঠিত তিনদিনব্যাপী আন্তর্জাতিক ইসলামী সাহিত্য সেমিনারে যোগ দেওয়ার জন্য আল্লামা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী–এর সঙ্গে যে ক‘জন প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশে তাশরীফ আনেন, তিনি তাঁদের অন্যতম। তিনদিনব্যাপী সেমিনারের নিশ্ছিদ্র ব্যস্ততার মাঝেও সাক্ষাৎকারগ্রহীতাকে তিনি কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে রাযী হন। দু’পর্বে গৃহীত এই সাক্ষাৎকারে উর্দুভাষায় পরিবেশিত প্রশ্নোত্তরের প্রায় সবটুকুই ক্যাসেটবন্দী করা হয়েছিল। তারই বাংলা অনুবাদ গ্রন্থিত হয়েছে এখানে।]
শরীফ মুহাম্মদ : সাধারণ সাহিত্য এবং ইসলামী সাহিত্যের মাঝে যে বিভেদরেখা আঁকা হয়ে থাকে, এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
নজরুল হাফিজ নদভী : আমি যা মনে করি এক্ষেত্রে, তা হচ্ছে–সাহিত্য হবে জীবনের জন্য এবং জীবন হবে সাধনার জন্য। সে হিসেবে সে সাহিত্যই গুরুত্ববহ, মানুষ যে সাহিত্যের সাহায্যে জীবনের উন্নয়ন সাধন করতে পারে। সেই সাহিত্যের একটি লক্ষ্য থাকতে হবে। লক্ষ্য–উদ্দেশ্যহীন সাহিত্যের কোন আবেদন থাকে না। লক্ষ্যহীন সাহিত্য যতই শক্তিধর ও শাণিত হয়ে থাকুক, তা শুধু শাব্দিক কারুকার্যেই সীমাবদ্ধ থাকে এবং তার প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে খুবই স্বল্পমেয়াদী ও অতি সাময়িক। তাই যে সাহিত্যে কোন পবিত্র লক্ষ্যের দিকনির্দেশনা নেই, আমাদের কাছে তা নিরর্থক। তার কোন কার্যকর গুরুত্ব নেই জীবন ও সাহিত্যে।
উদাহরণস্বরূপ জাহেলি যুগের সাহিত্যের দিকে আমরা দৃষ্টি ছুঁড়তে পারি। মূলত সে যুগের সাহিত্যের কোন লক্ষ্য ও টার্গেট ছিল না। বর্তমানেও জাহেলী সাহিত্যের উত্তরাধিকার বহন করছে যে সাহিত্য, তার কোন লক্ষ্য নেই। অর্থাৎ মানবতার সৌধ নির্মাণের পরিবর্তে সে সাহিত্যের দ্বারা মানবতা ও মনুষ্যত্ব ধ্বংসের কাজ আঞ্জাম দেওয়া হচ্ছে। মানবিক রিপু ও তাড়নাকে চাঙ্গা করে তোলা, নিষ্ফল আবেগকে উত্তেজিত করা কি এমন কোন লক্ষ্য, যার জন্য মানুষ তার জীবন বিসর্জন দিবে? নিশ্চয়ই নয়। সাহিত্য তো তাই, যার আবেদনে মানবতার পুনর্গঠন ও মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধিত হয়ে থাকে। আর এ ধরনের সমৃদ্ধ সাহিত্যকে বাধ্য হয়েই পথনির্দেশনা গ্রহণ করতে হবে কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফ থেকে। অন্যদিকে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, বিলিসানিন আরাবিয়্যিন মুবীন–বিশুদ্ধ ও সাহিত্যপূর্ণ ভাষায় কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে।’
কেন কুরআন শরীফকে বিশুদ্ধ ও সাহিত্যপূর্ণ ভাষায় অবতীর্ণ করা হলো? এ প্রশ্নের জবাব অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, ভাষার এমন একটি প্রভাব ও কার্যকারিতা রয়েছে, যার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মানুষ যখন কোন কিছু শোনে এবং পড়ে, তখন তার দ্বারা তার মস্তিষ্ক ও হৃদয় প্রভাবিত হয়। তাই যে সাহিত্য মানুষের হৃদয় ও মগজে শুভপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং তাকে বিশুদ্ধ জীবন ও সংস্কারবাদী পথের দিকে ধাবিত করে, সেটাকেই আমি যথার্থ সাহিত্য মনে করি।
শরীফ মুহাম্মদ : এখানে অন্য একটি প্রশ্ন এসে যায়। সেটি হচ্ছে, যে সাহিত্য ইসলামী সাহিত্যের সীমানাবহির্ভূত। কিন্তু সাহিত্যিক ও শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য তাতে বিদ্যমান। সে সাহিত্যকে আমরা কোন দৃষ্টিতে দেখবো?
নজরুল হাফিজ নদভী : মূলত সাহিত্যকে আমরা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই মূল্যায়ন করার পক্ষে। আমরা দেখতে চাই, সে সাহিত্য মানবতার কোন কাজে আসছে কিনা। তবে, নিছক ভাষাগত ও শাব্দিক কারুকার্য তো একটি তুচ্ছ ও নিষ্ফল ক্রীড়াশৈলী ও যাদুকরির নামান্তর। তার দ্বারা মানবতার কোন কল্যাণ আসে না, আসার কথাও নয়।
শরীফ মুহাম্মদ : এবার আপনার কাছে উপমহাদেশের মুসলমানদের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে জানতে চাই। উপমহাদেশের মুসলিম–সাহিত্যের ওপর আপনার একটি সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন প্রত্যাশা করছি।
নজরুল হাফিজ নদভী : উপমহাদেশের ভাষা ও সাহিত্যে উর্দু সাহিত্যের যতটুকু সম্পর্ক আছে, সে সম্পর্কে বলছি। উর্দুসাহিত্য সম্পর্কে আমার কথা বলার কারণ হচ্ছে, ভারতের সাথে উর্দুর সম্পর্ক রয়েছে। উর্দুসাহিত্যে মূলত আলিমদের চিহ্ন ও প্রভাব বিদ্যমান। তাঁরা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। উর্দুভাষার চারজন পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন ।
উর্দুভাষার চারজন স্বীকৃত পথিকৃৎ পুরুষ হলেন আল্লামা শিবলী নুমানী, আলতাফ হোসাইন হালী, ডেপুটি নজীর আহমদ, মাওলানা আযাদ। এঁরা তো সবাই আলেম ছিলেন। ভাষা ও সাহিত্যের সাথে এঁদের সম্বন্ধ ছিল গভীর। তাই এঁরা যা লিখেছেন, তা বিশুদ্ধ ধর্মীয় ও ইসলামী চেতনাসমৃদ্ধ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই লিখেছেন। তাঁদের যেসব গ্রন্থ পড়া হয়েছে, তার প্রভাব ও কার্যকারিতা নতুন প্রজন্ম অনুভব করেছে। আমি আপনাকে বলতে চাচ্ছি, শক্তিশালী সাহিত্যের প্রভাব এমনই হয়ে থাকে এবং তার বিশুদ্ধ অভিব্যক্তি ঘটে আলেমদের কলমে। কারণ তাঁদের উপলব্ধি ও বেড়ে ওঠা নিখাদ ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতেই হয়ে থাকে। আর সেই বিশুদ্ধ উপলব্ধির ছাপ তাদের সাহিত্যে অনিবার্যভাবেই পড়ে। তারা সেভাবেই পরিবেশনে অভ্যস্ত হন।
উদাহরণস্বরূপ বলছি, প্রসিদ্ধ পাকিস্তানী সাহিত্যিক ও সাংবাদিক শোরেশ কাশ্মিরীর একটি অভিব্যক্তি হল এরকম– ‘যখন তথাকথিত প্রগতিশীলতার বড় বেশি চর্চা হচ্ছিল উপমহাদেশে এবং বৃটিশ রাজশক্তি আমাদেরকে একপর্যায়ে নজরবন্দী করে রেখেছিল, তখন আমাদেরকে কোন কিছু পড়ার অনুমতি দেওয়া হতো না। কিন্তু ‘দারুল মুসান্নিফীন‘ থেকে যেসব বই–পত্র বের হতো, তা পড়ার অনুমতি দেওয়া হতো। শোরেশ্ কাশ্মিরী লিখেছেন, ‘আমরা পরামর্শ করে আল্লামা শিবলী ও মাওলানা সায়্যিদ সোলায়মান নদভীর বই–পত্র চেয়ে পাঠালাম। সেসব বইপত্রের মাঝে আল ফারুক, সীরাতুন্নবী সা., খুতুবাতে মাদরাজ, শাহরুল আজম, মাকালাতে সুলায়মানী, হুকামায়ে ইসলাম, আল মামুন প্রভৃতি বইগুলো আমরা পড়েছি। যেহেতু শক্তিশালী ভাষায় এবং দীনী দৃষ্টিভঙ্গিতে বইগুলো রচিত, তাই আমাদের মূল্যবোধে বিপ্লব ঘটে গেছে এবং অবচেতনভাবেই আমরা সেই সাহিত্যে প্রভাবিত হয়েছি। আমাদের হৃদয় ও মস্তিষ্কে কম্যুনিজমের যে প্রভাব ও আধিপত্য ছিল, তার বিলুপ্তি ঘটেছে।’
এখন লক্ষ্য করুন– যদি আল্লামা শিবলী নুমানী এবং সায়্যিদ সোলায়মান নদভী তাঁদের রচনায় ভাষা ও সাহিত্যের গুরুত্ব না দিতেন, তাহলে কম্যুনিজমের কাছে আত্মসমর্পণকারী এ যুবক কিভাবে প্রভাবিত হতো? তার মন ও মগজের পরিবর্তনে, বিশ্বাস ও চেতনার বিপ্লবে বড় ভূমিকা ছিল দীনী দৃষ্টিভঙ্গিতে রচিত এমন সব গ্রন্থের, যেগুলোর সাহিত্যমান ছিল প্রবল।
শরীফ মুহাম্মদ : উপমহাদেশের দুটি বড়রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানে উর্দুভাষার চর্চা হয়। আপনি উর্দুভাষার সাহিত্যকীর্তির ওপর আলোকপাত করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশও তো উপমহাদেশের একটি দেশ এবং এদেশের ভাষা ও সাহিত্যের একটি অবস্থা ও ইতিহাস আছে। যে সম্পর্কে…।
নজরুল হাফিজ নদভী : হ্যাঁ, বাংলাদেশের সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। সম্প্রতি…।
শরীফ মুহাম্মদ : আমরা জানি– বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে কোন ইতিহাস ও সমালোচনা উর্দু– আরবীতে প্রকাশ হয়নি। কিন্তু এই সেমিনারে আসার পর বাংলাভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক উর্দু–আরবীতে যেসব প্রবন্ধ–আলোচনা পরিবেশিত হয়েছে, তাতে বাংলাসাহিত্য সম্পর্কে আপনার বর্তমান সিদ্ধান্ত কী?
নজরুল হাফিজ নদভী : আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, বাংলাসাহিত্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধি সম্পর্কে আমাদের মাঝে ভুল ধারণা বিরাজ করছিল। আমরা মনে করতাম, বাংলাদেশী সাহিত্য কিংবা বাংলাসাহিত্য হিন্দু সাহিত্যিকদের দ্বারা প্রভাবিত। আমরা ভাবতাম, হিন্দুদের চিন্তা–চেতনা এবং তাদের বিশ্লেষণভঙ্গি ও পরিভাষার ছাপ রয়েছে বাংলাসাহিত্যে। কিন্তু প্রথমবার বাংলাসাহিত্য সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের পরিবেশিত আরবী প্রবন্ধ শুনলাম, তাতে জানতে পারলাম ইসলামী চেতনাসমৃদ্ধ লেখক–সাহিত্যিকগণও অনেক কন্ট্রিবিউশন দিয়েছেন এবং বাংলাসাহিত্যে তাদের প্রচুর রচনা ও প্রকাশনা রয়েছে। হিন্দু লেখক সাহিত্যিকদের বিরুদ্ধে তারা রীতিমত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
বিশেষত লেখকদের মাঝে যারা প্রবাদব্যক্তি ছিলেন; যেমন রবি ঠাকুর, তার সাহিত্যকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হতো। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তার রচনার ভাবগত প্রভাব প্রতিরোধের জন্য এখানে মুসলমানগণ যে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন এবং সাহিত্যযুদ্ধে অবতরণ করে যেসব বই রচনা করেছেন, সেই প্রবন্ধ এবং আরো কয়েকটি প্রবন্ধ শুনে আমার ধারণা হয়েছে যে, বাংলাসাহিত্যে মোটামুটিভাবে একটি পরিচ্ছন্ন ধারা সবসময়ই বিরাজ করেছে এবং এই সাহিত্য বিপুলভাবে ইসলামী মূল্যবোধে সমৃদ্ধ ।
শরীফ মুহাম্মদ : আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে নিয়ে জাতীয় পর্যায়েও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য চলছে, অপসাংবাদিকতার যে স্রোত ইসলামী চেতনার মুখোমুখি উদ্ধত হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সে সম্পর্কে কিছু জানতে চাই। এই অপসাংবাদিকতার ফলাফল কী হতে পারে এবং এর প্রতিরোধের উপায়টাই বা কী হবে– দয়া করে বলবেন কি?
নজরুল হাফিজ নদভী : পশ্চিমা সাংবাদিকতা সম্পর্কে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ আমি তৈরি করছি। ধারাবাহিকভাবে দু‘একটি পত্রিকায় তা প্রকাশিতও হচ্ছে। এই প্রবন্ধটিকে পূর্ণাঙ্গ করার ইচ্ছা আমার রয়েছে। প্রবন্ধটির শিরোনাম ‘পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এবং তার প্রতিক্রিয়া।‘ এতে আমি পশ্চিমা সাংবাদিকতার ওপর একটি বিশদ জরিপ চালিয়েছি। পশ্চিমা সাংবাদিকতার ব্যাকগ্রাউন্ড কী, কারা এ অঙ্গনটির পৃষ্ঠাপোষকতা করছে, তা উল্লেখ করেছি। নিউজ এজেন্সীসমূহ, দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক এবং বার্ষিকীগুলো সম্পর্কে নিরীক্ষাধর্মী আলোচনা করেছি।
সাংবাদিকতার এই শাখার বাইরে রেডিও, টিভিরও জরিপ চালিয়েছি। কীভাবে এই মিডিয়াগুলো সাড়া জাগালো বৃটেন ও আমেরিকায় এবং কীভাবে তার আসবাব–উপকরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে– এসবের পূর্ণ ইতিহাস আমি তুলে ধরেছি এবং বলেছি– এসবের প্রায় ৯৫% ইহুদী পৃষ্ঠাপোষকতার অধীনে। বড় বড় নিউজ এজেন্সীগুলোর পর্দার ভেতরের খবরও আমি বর্ণনা করেছি…।
শরীফ মুহাম্মদ : পাক্ষিক ‘তা‘মীরে হায়াত’ এ আমরা তার অল্প কিছু অংশ পড়ার সুযোগ পেয়েছি।
নজরুল হাফিজ নদভী : হ্যাঁ, তাহলে তো সেটাই আপনাদের জন্য যথেষ্ট হয়ে যায়। ….
শরীফ মুহাম্মদ : কিন্তু রচনাটিতো ধারাবাহিক এবং আমরা তার অল্পই পড়ার সুযোগ পাচ্ছি…।
নজরুল হাফিজ নদভী : ধারাবাহিকভাবে এখন প্রকাশিত হচ্ছে। ইনশাআল্লাহ পূর্ণ গ্রন্থাকারেই তা প্রকাশিত হবে। পূর্ণগ্রন্থরূপে প্রকাশিত হলেই দেখতে পাবেন, তাতে পাশ্চাত্য সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আলোকপাত থাকবে। আরবজগত থেকে নিয়ে অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রে যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেয়েছে মুসলমানদের নিত্যদিনের জীবনাচারে, পশ্চিমা মিডিয়া থেকেও ফিল্ম, সাংবাদিকতা, সাহিত্য এবং রেডিও টিভির প্রভাব পড়েছে। এখন যে অবস্থাচিত্র, যে সকল উপকরণ পাশ্চাত্য প্রচারমাধ্যম একত্রিত করেছে, অথবা যেসব ধ্বংসের আয়োজন করেছে, সেসব আয়োজনের প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টি রাখলে তো এ অনুমানই করতে হয় যে, পশ্চিমা সাংবাদিকতা এবং পশ্চিমা মিডিয়া সম্পূর্ণ ইসলামী জগতের ধস সৃষ্টির ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র এঁটেছিল। এসব প্রচেষ্টার ফলে তো ইসলামী জীবনাচার বিলকুল বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। বস্তুত তাদের কর্মকৌশল এতই প্রচণ্ড ও সুদূরপ্রসারী যে, তাতে চেতনার পাহাড় ধসে পড়ার কথা।
কিন্তু আল্লাহ তাআলার হিকমত দেখুন! এসব আয়োজনের উল্টো প্রতিক্রিয়া হচ্ছে এবং বিপরীত প্রভাব পড়ছে। মিসরের কথাই ধরুন। সেখানে বহু অশ্লীল উপন্যাস লেখা হতো, পড়া হতো। পত্র–পত্রিকায় কুপন বের হতো যে, পত্রিকাটি কিনলে অর্ধেক মূল্যে কিংবা তার চেয়েও কম মূল্যে আপনি ফিল্ম দেখতে পারবেন। এ রকম ঢালাও অনুমোদন যখন ছিল এবং সয়লাব ছিল ব্যাপক, অনুমান করুন– তখন কতবেশি সংখ্যক মানুষ ফিল্মে মজে থাকতো! ফিল্মগুলো কেমন ছিল? সেগুলোর কোন সেন্সর ছিল না। আমেরিকান এবং বিলেতি যেসব ফ্লিম আমেরিকা বৃটেনেও প্রকাশ্যে দেখানো হতো না, সেসব ফিল্ম মিসরের সিনেমাহলগুলোতে ঢাক–ঢোল পিটিয়ে দেখানো হতো। এতে অনুমান করতে পারেন, কী পরিমাণ ধস নামতে পারে সেখানে!
কিন্তু এখন লক্ষ্য করুন! আবার সেখানে ইসলামী জীবনাচার ফিরে আসছে এবং ফিল্মজগতের প্রধান প্রধান কুশিলব ও অভিনেতারা তওবা করছে। মিসরের প্রখ্যাত অভিনেতা শামস বারুদী; যিনি নগ্ন ও অশ্লীল ফিল্মগুলিতে কাজ করার জন্য খ্যাত ছিলেন; যার ছবি দেখার জন্য লোকেরা ভেঙ্গে পড়তো, তিনি তওবা করেছেন। তার সাথে অনেক কুশিলবই তওবা করে ফিরে আসছেন। ফিল্ম এক্টর থেকে নিয়ে ফিল্ম জগতের অনেকেই তওবা করছেন এবং ফিরে আসছেন। এ কারণে এবং এরও পূর্বে ‘৬৭ সালে যখন ইসরাইল মিসরে আক্রমণ করে বেশ কিছু অঞ্চল দখল করে নিয়েছে, তারও বিপরীত প্রতিক্রিয়া পড়েছে আরব যুবকদের মাঝে; বিশেষত মিসরের যুবকদের মাঝে। এখন মিসরী যুবকদের অভিব্যক্তি হলো, আমরা ভাবতাম সমাজতন্ত্রই আমাদের অগ্রগতির সোপান এবং সমাজতন্ত্রেই আমাদের অর্থনৈতিক সংকট মোচন সম্ভব। কিন্তু সমাজতন্ত্রের কাণ্ডারীরাও যখন বিশ্বাস–ঘাতকতা করল, তার মানে হচ্ছে আমাদেরকে ইসলামের দিকেই প্রব্যাতন করতে হবে।
বড় বড় নাস্তিক লেখক; যারা শক্তির সাথে লিখতেন, ইসলামের বিরোধিতা করতেন, তারাও ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে নৈতিক কারণে বাধ্য হচ্ছেন। তারা এখন বলছেন, আমাদের এতোটা অবমাননা, আমাদের জাতীয় চেতনা ও অবস্থানের এ পরিমাণ বৈরিত্য ও অমর্যাদা হলো। বুঝা যাচ্ছে, আমাদের মাঝে কেউ নেই। আরব জাতীয়তাবাদও আমাদের কোন কাজে আসেনি। ইউরোপ এবং রাশিয়াও কোন কাজ দেয়নি। এখন আমাদের কোথায় যাওয়া উচিত? ইসলামের দিকেই তো ফিরে আসা উচিত। ইসলামের কারণেই তো আমাদের খ্যাতি ছড়িয়েছিল। মিসর মিসর হতে পেরেছিল।
এজন্যই বলতে হচ্ছে, ব্যাপক প্রতিক্রিয়া বিপরীতভাবেই পড়ছে। তরুণ হোক কিংবা তরুণী, সবাই উপলব্ধির সাথে ইসলামের দিকেই ফিরছে। অথচ পশ্চিমা মিডিয়া এখনো তৎপর। বরং প্রতিমুহূর্তে ওরা আরো আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। সিএনএন–এর মাধ্যমে ১৮–১৮ চ্যানেল চালু হয়েছে। ‘নিউজ কর্পোরেশন‘ এবং হংকং থেকে প্রকাশিত টিভি চ্যানেল অব্যাহতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এসবগুলির ওপর ইহুদী আধিপত্য বিদ্যমান। ঘরে ঘরে এখন তা পৌঁছে যাচ্ছে। যে ধস এশিয়াতে এতদিন এসেছিল না, তা এশিয়াতেও আসছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও আমাদের নিরাশ হওয়া উচিত নয় এবং এসবের মধ্য দিয়েই আমাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। প্রকাশনা ও প্রচারণার যেসব উপাদান ও উপকরণ আছে, সেগুলোকে আমাদের সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। সেই সঠিকভাবে ব্যবহারের পদ্ধতিটি কী হবে? বৈধ সীমারেখার ভেতরে মিডিয়ার যতগুলো মাধ্যম উপকরণ আছে, সেগুলোকে আমরা সেভাবেই ব্যবহার করবো, যার ফলে তাতে আকর্ষণ থাকে, আবেদন থাকে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যেসব ফিল্মী এক্টর বিশুদ্ধ চিন্তা লালন করেন, তাদের দ্বারা হারামের দিকে ধাবিত করার পরিবর্তে এখন শিশুদের প্রোগ্রাম তৈরি করতে পারি আমরা। অন্য একটি পদ্ধতি হচ্ছে, অমুসলিমদের প্রভাবিত করা এবং মুসলিম যুবকদের চেতনা শাণিত করার জন্য আমাদের ইতিহাসের প্রবাদ পুরুষদের নিয়ে বিভিন্ন আকর্ষণীয় সিরিয়াল তৈরি করা যেতে পারে।
শরীফ মুহাম্মদ : নিশ্চয়ই আপনি অবগত আছেন মোস্তফা আসুদ নামের এক নওমুসলিম চিত্রপরিচালক হুজুর আকরাম সা.-এর মিশন, সাহাবায়ে কেরামের যুদ্ধের ওপর একটি ফিল্ম তৈরি করেছেন। ‘দ্যা মেসেজ’ নামের সেই ফিল্মটি এখন মুসলিম বিশ্ব থেকে নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বেও সাড়া জাগিয়েছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
নজরুল হাফিজ নদভী : মূলত বিষয়টি যেখানে ছবির, সেখানে বলতে হচ্ছে, তেমন ফিল্ম করতে চাইলে হুজুর আকরাম সা., সাহাবায়ে কেরাম এবং ইসলামী ব্যক্তিত্বগণের ছবি ছাড়াও ফিল্ম তৈরি করা যায়। তবে, উপস্থাপনা ও পরিবেশনের ভঙ্গি এতোটা ব্যাপক ও শক্তিশালী হওয়া উচিত যে, তার দ্বারা উদ্দেশ্য সাধিত হয়ে যায়।
শরীফ মুহাম্মদ : সাহিত্য সম্পর্কিত অন্য একটি প্রশ্ন এসে যাচ্ছে। সেটি হচ্ছে– প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক– এসবই তো সাহিত্যের একেকটি শাখা। কিন্তু প্রবন্ধের বৃত্তটি থাকে চিন্তা ও মেধাদ্বীপ্ত। এর পাঠক তুলনামূলকভাবে কম। অধিকাংশ পাঠক, বিশেষত তরুণদের দেখা যায়, গল্প–উপন্যাস নিয়েই বাস্ত থাকে। অথচ সেদিকটিতে বিশুদ্ধ চিন্তার ছাপ অত্যন্ত কম। এ বিষয়ে কিছু বলুন।
নজরুল হাফিজ নদভী : দেখুন। এ মুহূর্তে যা প্রয়োজন, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সাহিত্যের শাখাগুলি প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প এবং নাটক; এগুলোতে মৌলিক বিষয়টি হচ্ছে স্টাইল। পরিবেশনের ধরন। ভাষা শক্তিশালী হতে হবে এবং জীবন্ত হতে হবে। যার জন্য আপনি লিখছেন তার সাইকোলজী বিবেচনা করতে হবে। পাঠক যদি তরুণ–যুবক হয়, তাহলে তার সাইকোলজী কী হতে পারে, দশ বছরের শিশুর মনস্তত্ত্ব কী, তার উপলব্ধি ও ভাবনার ধরন কী, তাদের কোন জিনিসের প্রতি আহ্বান করবেন, যার দিকে তারা ধাবিত হবে। সাহিত্যের মানে তো চরিত্র, নৈতিকতার শিক্ষা, জ্ঞান ও বুদ্ধির পাঠ, ভালো ও সদুপদেশ। ফুল ফুটলো, শিশু কাঁদলো; এ ধরনের বিবরণে শিশুদের আবেগে নাড়া পড়ে। তাদের জানতে ইচ্ছা করে, কেন শিশুটি কাঁদলো। এখন আপনি সাহিত্যকে যেভাবেই পরিবেশন করুন– গল্প দিয়ে হোক কিংবা নাটকের মাধ্যমেই হোক, এদিকগুলির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। কুরআন মজীদে এজন্যই বলা হয়েছে ‘বিলিসানিন আরাবিয়্যিন মুবীন।’
আল্লাহ তাআলা মুখাপেক্ষী নন। যেকোনভাবেই কুরআন অবতীর্ণ করতে পারতেন। তথাপি সাহিত্য কেন? আকর্ষণ ও আবেদনের জন্য। ভাষার প্রভাব অত্যন্ত শক্তিশালী…। অন্যদিকে হযরত আলী রা.-এর উক্তি হলো, মানুষের সাথে তার জ্ঞান অনুযায়ী কথা বলো।‘ এতো বুঝাচ্ছে মানুষের মনস্তত্ত্ব, ভাষা এবং চিন্তার গতির দিকে লক্ষ্য রেখে কথা বলা উচিত। যদি তাদের উপলব্ধির উপযোগী করে উপস্থাপন না করে শুধু বলা হয়, ‘আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল একথা বলেছেন’। তাহলে তারা বলে বসবে, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল এ কেমন কথা বলেছেন, যা আমরা বুঝতেই পারছি না। সেজন্যই শক্তিশালী ভাষার পাশাপাশি উপযোগিতার দিকটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। সাহিত্য–সাধনার জন্য এগুলি অপরিহার্য।
শরীফ মুহাম্মদ : উপমহাদেশের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখক নাসিম হিজাযী সম্পর্কে আপনি কিছু বলবেন কি?
নজরুল হাফিজ নদভী : নাসিম হিজাযী নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বিশাল প্যাটার্ন নিয়ে বিশ্লেষণের সাথে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, ইসলামী ব্যক্তিত্বকে তিনি উপন্যাসের রূপ দিয়ে পরিবেশন করছেন। কিন্তু এখন সেই যুগ অতিবাহিত হয়ে গেছে। উপন্যাসের প্যাটার্ন হতো বিশাল ও ব্যাপক। কিন্তু এখন সময় এসে গেছে দ্রুততার। যাতে দ্রুত পড়তে পারে এবং প্রভাবিত হয়ে স্বাদ ও আনন্দ নিতে পারে। এখন তো সময় সেইসব গল্প কাহিনীর, যা মিসাইল যুগের দ্রুততা নিয়ে চলতে পারে। সেকেন্ডের হিসেবে এখন সময়ের হিসেব করা হয়ে থাকে। তাই এসব কাজের জন্য এখন ছোট ও শর্ট আঙ্গিক বেছে নিতে হবে।
শরীফ মুহাম্মদ : ঔপন্যাসিক নজীব মাহফুজ এবং আরবী সাহিত্যের আরো কয়েকজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আরবী সাহিত্যের বিশুদ্ধ ধারার লালনকারী এবং ধর্মপ্রাণ আরব লেখকগণ নিস্পৃহ কেন? নজীব মাহফুজের সাহিত্যের আবেদন কতটুকু?
নজরুল হাফিজ নদভী : মূলত নজীব মাহফুজ, ইহসান আব্দুল কুদ্দুস, বাহাউদ্দীন এবং তাওফীক আল হাকীম ও জাকী নজীব মাহমুদ– জাকী নজীব মাহমূদ অবশ্য ঔপন্যাসিক নন, তাকে বলা হয়ে থাকে দার্শনিক– এরা সবাই এবং এদের চেতনার যেসব আরব লেখক সাহিত্যিক আছেন, তাদের ফল্ট এটাই যে, পশ্চিমা সাহিত্যের ওপর তারা বেড়ে উঠেছেন এবং পশ্চিমা সাহিত্য ও দর্শন তারা গিলে ফেলেছেন। কেউ বেড়ে উঠেছেন ফ্রান্সে, কেউবা আমেরিকায়। একারণেই তারা নিজেদের উপন্যাসের সাহায্যে আরবজীবনাচারকে পশ্চিমা বার্নিশে রাঙিয়ে তুলতে চান এবং সেজন্য সরাসরি কিংবা পরিষ্কার বিবরণের পরিবর্তে কখনো অশরীরি এবং কখনো চরিত্রের সহায়তা নিয়ে থাকেন। যেমন নগ্নতার বৈধতা প্রমাণ করতে হলে কিংবা ব্যভিচারকে স্বাভাবিকত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে হলে, তারা সেই চিত্রগুলিকে সংলাপের ভেতরে নিয়ে আসেন। সংলাপের মধ্য দিয়েই নগ্নতা ও ব্যভিচার ফুটিয়ে তোলেন তারা। আর সেই সংলাপের অন্তর্গত নগ্ন ঘটনার চরিত্রগুলির এমনসব নাম তারা দিয়ে থাকেন, যে নামের মানুষ সাধারণত আরব সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। সেইসব চরিত্রের সাহায্যে অনেকটা যুক্তিসঙ্গত ও উন্নত পন্থায় তারা সকল অনৈতিকতা ও অপকর্মকে বর্ণিল ও শোভনীয় করে পরিবেশন করেন ।
কুরআন মজীদ যেমন ঘোষণা করেছে– ওয়া যাইয়ানা লাহুমুশ শাইতানু আ’মানাহুম মা কানূ ইয়া’মালুন। ‘এবং শয়তান তাদের কর্মকাণ্ডকে সুসজ্জিত ও শোভিত করে দেয়– যা তারা করে।’ তো তাদের কাজও হচ্ছে মন্দ ও অপকর্মকে শোভনীয় করে পরিবেশন করা। আপনি কিন্তু তাদের প্রতি এই অপবাদ ছুঁড়তে পারবেন না যে, তারা অপকর্মের প্রতি প্রকাশ্যে আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ সেটাতো একটা সংলাপ। ঘটনা ও চিত্রটি সংলাপের অন্তর্গত। বলা হবে ‘এটাতো সমাজের একটি ছোট চিত্র। কোন একটি ব্যক্তি কি সমাজে এরকম নেই?’ এইসব শক্তিশালী অথচ দায়িত্বহীন লেখকদের কারণে নতুন প্রজন্ম বড় ভয়ংকরভাবে নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হচ্ছে। আরবসমাজ ও জীবনাচারে ধস সৃষ্টির প্রচেষ্টায় একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করছে এদের রচনা। আর যেহেতু এরা পশ্চিমা স্বার্থের দাবিকে পূরণ করে চলেছেন, তারই মূল্যায়ন করতে গিয়ে এবং স্বার্থ সংরক্ষণের পুরস্কার দিতে গিয়ে পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে এদেরই একজনকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
শরীফ মুহাম্মদ : আধুনিক আরবী সাহিত্যের বিশুদ্ধ ধারা বহনকারী লেখক–সাহিত্যিক ও ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে কিছু বলবেন?
নজরুল হাফিজ নদভী : এই সময়ে আরবজগতে যারা শক্তিশালী লেখক আছেন, তাদের সবচেয়ে বড় লেখক; যাকে আরব জগতে ‘আদীব‘ বলা হয়ে থাকে, তিনি হলেন, আল্লামা আলী তানতাবী। তিনি সিরিয়ার অধিবাসী। বর্তমানে সৌদী টিভিতে তার নিয়মিত প্রোগ্রাম হয় এবং রেডিও ও সাংবাদিকতার সাথেও তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাঁর ভাষা বেশ শক্তিশালী, তরল এবং বিশুদ্ধ ইসলামী চিন্তা–চেতনা বহন করেন তিনি। তাঁকে ছাড়াও আরো অনেক লেখক–সাহিত্যিক আরবজগতে রয়েছেন, যাদের নাম হয়তো ইতোমধ্যেই শুনেছেন। ড. হেলমী কাউদ তাঁর প্রবন্ধে দীর্ঘ তালিকা পরিবেশন করেছেন বিশুদ্ধ চেতনার আরব লেখকদের।
শরীফ মুহাম্মদ : ইসলামী সাহিত্য ও সাংবাদিকতা নিয়ে এই নাজুক সময়ে আপনার কোন বিশেষ ভাবনা আছে কি? সাহিত্যের শাখা–প্রশাখা কিংবা সাংবাদিকতার কলাকৌশল অথবা উপস্থাপনার ধারা নিয়ে আপনি ভিন্ন কোন চিন্তা করেন কি?
নজরুল হাফিজ নদভী : হ্যাঁ, বিশেষ কিছু কথাতো অবশ্যই বলতে চাই। ‘রাবেতায়ে আদবে আলমে ইসলামীর‘ যে সম্মেলন এখানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তার সুযোগ নিয়েই আমি বলতে চাচ্ছি যে, এখানে একটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। যত লেখক এখানে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি সামনে নিয়ে লেখালেখি করছেন, প্রথমত তাদের মাঝে সমঝোতা থাকা উচিত এবং একটি পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের লেখালেখি অব্যাহত রাখা উচিত। উদাহরণস্বরূপ যা বলা যেতে পারে, এমন কিছু লেখক, যারা শিশুদের মেধা ও মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে সচেতন আছেন, তাদের উচিত শিশুদের জন্য লিটারেচার প্রস্তুত করা। শিশুদের মান ও মনস্তত্ত্ব বিবেচনা করে গল্প, উপন্যাস, নাটক এবং এমন সব বিষয় প্রস্তুত করা, যা শিশুদের রুচিকে পরিচ্ছন্নভাবে জাগিয়ে তুলবে এবং তাদের হৃদয় ও মননকে করবে বিকশিত ।
এমন একটি দল সাহিত্যসাধনায় থাকবেন, যারা যুবক–তরুণদের জন্য লিখবেন। অন্য একটি দল থাকা উচিত, যারা ইসলামী ইতিহাসকে নিজেদের বিষয় বানিয়ে নেন। তেমনি এমন আরেকটি দলেরও প্রয়োজন যারা সাংবাদিকতাকে নিজেদের চর্চার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করবেন। সাংবাদিকতার পথ ধরেই তারা অগ্রসর হবেন। মনে রাখতে হবে, সাংবাদিকতা সেই তাৎপর্যপূর্ণ গদ্য, যার দ্বারা কোন জাতির নির্মাণ কিংবা ধ্বংসের সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। আপনাদের এই বাংলাদেশের কথা শুনলাম, এখানকার সাংবাদিকতার অঙ্গনে কাদিয়ানীদের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। তাদের এই প্রভাবের কারণটা কী? কারণ, তারা প্রথমেই এ দিকটির প্রতি মনযোগী হয়েছে এবং বড় বড় দৈনিক পত্রিকাগুলি কিনে ফেলেছে। এ অবস্থায় ইসলামী লেখক ও সাহিত্যিকদের একটি দায়িত্ব হল এসবের প্রতিরোধ এবং সে প্রতিরোধের পদ্ধতি হল, শক্তিশালী সাংবাদিকতা সৃষ্টি করা। নতুন নতুন বিষয় সম্পর্কে যারা অবগত থাকবে এবং দীনের ব্যাপারে থাকবে সচেতন ও গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন।
শরীফ মুহাম্মদ : বাংলাদেশের লেখক সাহিত্যিকদের প্রতি; বিশেষত তরুণ লেখকদের প্রতি আপনার কোন পরামর্শ কিংবা পয়গাম আছে কি?
নজরুল হাফিজ নদভী : আমার পক্ষ থেকে পরামর্শ ও পয়গাম এছাড়া আর কী হতে পারে যে, তারা এ পরিস্থিতিটিকে অবজ্ঞা না করে গুরুত্ব দিবেন। সময়টাতো বড়ই নাজুক। মাওলানা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভীর ভাষায় খৃস্টীয় উপকরণ এবং ইহুদী বুদ্ধি উভয়টাই একীভূত হয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ইসলামের বিরুদ্ধে এবং সকল অঙ্গনে। রাজনীতি, সমাজ, সাংবাদিকতা, শিক্ষা, পরিচর্যা সবকিছুতেই ওরা একতাবদ্ধ হয়ে অবতরণ করেছে। সম্পূর্ণ মুসলিম দুনিয়া ও মুসলিম জীবনাচারকে ওরা বিলুপ্ত করে দিতে চায়। তবে শিগগিরই মৌলিক যে পরিবর্তনটার প্রতি সকলের মনযোগী হওয়া উচিত– এ পরিবর্তন অতি প্রয়োজনীয় এবং খুবই দ্রুত– শিক্ষাব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত, যার মাঝে ইসলামী চেতনা থাকে, চেতনার ছাপ থাকে। ইসলামী ছাঁচে শিশুদের গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই আপনারা আপনাদের জীবনাচার প্রতিষ্ঠিত রাখতে পারবেন। শুরু থেকেই এই ছাঁচ গড়ে তোলা প্রয়োজন।
শরীফ মুহাম্মদ : আপনি তো বহু স্থানেই হযরত মাওলানা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী সাহেবের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করে থাকেন। যিনি প্রায় তার সারাটা জীবন মিশন নিয়ে কাটিয়েছেন, অসংখ্য কালোত্তীর্ণ রচনা যার হাত দিয়ে বের হয়েছে, তিনি আজ জীবনের শেষধাপে উপনীত। অবশেষে তাঁর সম্পর্কে কিছু শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে আপনার মুখে।
নজরুল হাফিজ নদভী : হযরত মাওলানার সকল প্রচেষ্টা ও সাধনা এটাই যে, মুসলমান সাংবাদিক, সাহিত্যিক, লেখক, আলেমদের মাঝে এ প্রেরণার জন্ম দেওয়া যে, তারা তাদের মৌলিক প্রচেষ্টা হিসাবে গ্রহণ করে নেন ইসলামের প্রতি একটি ব্যাপক আহ্বানকে। শিক্ষা কিংবা শাসকশ্রেণী কিংবা বুদ্ধিজীবী দার্শনিক ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের মাঝে এ বিশ্বাস ও চেতনা প্রতিষ্ঠিত করা যে, ইসলামই সেই একমাত্র দীন ও ধর্ম, যা পৃথিবীর নেতৃত্ব দিতে পারে এবং সততা ও যোগ্যতার আধার এই দীন।
মাওলানার প্রচেষ্টা হচ্ছে, দীনের দায়ীদেরকে এমনভাবে প্রস্তুত করে তোলা যে, তারা বিভিন্ন অবস্থান, ক্ষেত্রে ও পর্যায়ের মুসলমানদেরকে তাদের অবস্থান ও দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন করে তুলতে পারে। দীন ও ঈমানের সাথে তাদের যে বন্ধন, সেটাকে যেন পরিষ্কার করে তাদের সামনে ধরিয়ে দিতে পারে। এভাবে যাতে সকল পর্যায়েই একটি পারস্পরিক সৌহার্দের মধ্যেই দীনের চেতনার একটি সয়লাব জন্ম নেয়। আপনি গভীরভাবে ভাবলে দেখবেন, সময় এখন এটাই চাচ্ছে। সময়ের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাশা হচ্ছে এই মিশন ও দাওয়াত।
(সাক্ষাৎকারটি প্রথম প্রকাশিত হয় মাসিক অগ্রপথিক, জুন ১৯৯৪ সংখ্যায়। গুরুত্বের বিবেচনায় সাক্ষাতকার গ্রহীতার অনুমতি সাপেক্ষে যোগাযোগ–এর পাঠকদের জন্য পুনরায় প্রকাশ করা হলো। লেখকের বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।—সম্পাদক।)
সাক্ষাতকারটা বইয়ে পড়েছিলাম মনে হয়। শরীফ মুহাম্মদের নতুন লেখা নিয়মিত ছাপা হোক!
সাক্ষ্যৎকারটি অনেকগুলো চিন্তার ধোয়ার খুলে দিয়েছে।
এটা বতর্মান সময়ে সকল উঠতি বয়েসি তরুণ-তরুণিদের পড়া উচিত! আমি মনে করি।
আলহামদুলিল্লাহ। সম্পূর্ণ টা পড়লাম। আল্লাহ তায়া’লা সকল কে জাযায়ে খায়ের দান করুন। আমীন।