মীনা বাজার (প্রথম পর্ব)

আব্দুল হালিম শরর লখনভী

মাসুম বিন শাহাদাত

লেখক পরিচিতি

বিশ শতকের উর্দু গদ্য লেখকদের মধ্যে আব্দুল হালিম শরর একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তাকে একজন বিশিষ্ট লেখক, ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার হিসেবে স্মরণ করা হয়। শরর লখনৌর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতীক হিসেবেও পরিচিত। উর্দু ভাষা-সাহিত্যে তিনি তার কাব্যিক নাটকীয়তার জন্য জনপ্রিয়।

আব্দুল হালিম শরর উর্দু কবিতা ও সাহিত্যে অনেক নতুন বিষয়কে যেমন আলোকিত করেন, তেমনই নিজের রচনাবলিতে সেগুলোকে দেন স্বাতন্ত্র্য। সাহিত্য-যাত্রার শুরুতে তিনি ‘তিক্তফল’ (১৮৮৯) এবং ‘শহিদে ওয়াফা’ (১৮৯০) দুটি নাটক রচনা করে পাঠক-সমালোচকদের আকৃষ্ট করেন। এমন ছন্দবদ্ধ নাটক এর আগে রচিত হয়নি। শরর তার নিজের উপন্যাস ‘ফতেহ আন্দালুস’ এবং ‘রুমতাহুল কুবরা’ নিয়ে দুটি শ্লোক নাটকও লেখেন।

তার জন্ম ১৮৬০ সালে লখনৌতে। প্রথম জীবনে তিনি পড়াশোনায় তেমন মনোযোগী ছিলেন না, তাই তাকে কলকাতার মিটিয়া বুরুজে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে উচ্চপদস্থদের ছেলেদের সাথে মিশে খারাপ হতে শুরু করেন, তাই তার পিতা তাকে লখনৌতে ফেরত পাঠান।

তার জীবনে মূলত পরিবর্তন আসে আল্লামা আব্দুল হাই লখনবির সংস্পর্শ আসার পর। তিনি তার সান্নিধ্য গ্রহণ করে নিজেকে অনন্যসাধারণ করে তোলেন।

লখনৌতে তিনি মুন্সী নোয়েল কিশোরের ‘অযোধ আখবার’ পত্রিকার সাংবাদিকতায় যোগ দেন। এখানে অসংখ্য প্রবন্ধ লেখেন। আরও কয়েকটি চাকরি এবং বিভিন্ন শহরে থাকার পর লখনৌতে ফিরে আসেন। প্রকাশ করেন তার ‘দিল গুদাজ’ পত্রিকা। যাতে তার প্রথম ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘মালিকুল আজিজ ভারজানা’ কিস্তিতে প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি প্রকাশ করেন ‘হাসান অ্যাঞ্জেলিনা’ ও ‘মনসুর মোহান্না’ যা তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। ‘দিল গুদাজ’-এ শরর প্রথমবারের মতো মুক্ত শ্লোকের উদাহরণও উপস্থাপন করেন এবং উর্দুভাষীদের ইংরেজি কবিতা ও সাহিত্যের নতুন ধারার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তাছাড়া তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী উর্দুতে অনুবাদ করেন। প্রায় শতাধিক গ্রন্থের এই লেখক ১৯২৬ সালের ১ ডিসেম্বর নখনৌতে ইন্তেকাল করেন।


প্রথম অধ্যায় : শাহজাহানের দরবার

মোগল সাম্রাজ্যের পঞ্চম সম্রাট, বাদশাহ শাহজাহান মন্ত্রীসভায় নিজের অতুলনীয় রাজকীয় আসন—ময়ূর সিংহাসনের ওপর দ্যুতি ছড়াচ্ছেন। মূল্যবান পাথরখচিত সিংহাসনে স্বর্ণের আভা ও তার মণি-মানিক্যের চাকচিক্য দরবারি লোকদের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। আর তার প্রতিবিম্ব দেখা দিচ্ছে আলি মরদান খানের নদীর স্বচ্ছ প্রবাহিত জলের ওপর : আশ্চর্য চমক ও অস্থির সৌন্দর্য।

সামনে দরবারি আমির-উমরা লম্বা ঝুলবিশিষ্ট জামা, সূচিকর্ম করা পাগড়ি, কোমরে তরবারি ও কটিবন্ধে খঞ্জর ঝুলিয়ে বিনীতভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে অধিক সম্মানিত রাষ্ট্রের উজির সাদুল্লাহ খান, হাকিম রুকনায়ে কাশি, সাইদায়ে গিলানি, হাকিম মাসিহুয-যামান আফজল খান, মোল্লা আতাউল মুলক তুলি মির সামান।

ইতোমধ্যে হাকিম রুকনায়ে কাশি সামনে অগ্রসর হয়ে জমিনে চুম্বন করে, তারপর আশ্চর্য সুমধুর কণ্ঠে শোনায় স্বরচিত একটি কাসিদা। উপস্থিত লোকেরা প্রশংসা করতে থাকে। আর বাদশা জাহাপনা, যার মধ্যে ধর্মীয়বোধ অত্যন্ত সরলতা ও নিঃস্বার্থতার ভাবাবেগ তৈরি করেছে, যদিও তিনি নিজের চোখ ও ভ্রুতে এবং নম্রস্বরে কবির প্রখর মেধা ও বাগ্মিতার প্রশংসা করছেন, আবার নিজের প্রশংসা শুনে লজ্জিতও হচ্ছেন। 

হেদায়াতের ফেরেশতা তাকে কানে কানে বলে, ‘প্রশংসার যোগ্য কেবল মহাপরাক্রমশালী একক খোদার সত্তা।’ এতে বাদশাহ আরও বেশি লজ্জিত হয়ে পড়েন। যার ফলে একদিকে রুকনায়ে কাশি কাসিদা খতম করে, অন্যদিকে শাহজাহান সিংহাসনের ওপরই খোদার সামনে সেজদায় লুটিয়ে পড়েন। মহান খোদার দরবারে আরজ করেন,

‘হে জগৎসমূহের সৃষ্টিকর্তা, আমি কোনো কিছুর যোগ্য নই। তবে আপনার দয়া ও অনুগ্রহ, আমাকে এমন সম্মান ও রাজত্ব দিয়েছেন, কবিরা আমার তারিফ করছে।’ 

এরপর তিনি সেজদা থেকে মাথা উঠিয়ে নির্দেশ জারি করেন, ‘রুকনায়ে কাশিকে স্বর্ণে ওজন করে সে পরিমাণ স্বর্ণ তাকে অর্পণ করো!’ তাকে স্বর্ণে ওজন করা হয় আর বাদশাহ বলতে থাকেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের দরবারে এমন সূক্ষ্ণ প্রকৃতি ও চিন্তার অধিকারী কবি আছেন, যা অন্য কোনো দরবারে নেই।’ এর ওপর আফজাল খান, যিনি তার যুগের শ্রেষ্ঠ আলেমদের একজন, হাতজোড় করে আরজ করেন—

‘হিন্দুস্তানে আর কোন দরবারই আছে, যা এই স্বর্গীয় মিলনসভার মোকাবেলা করতে পারে? আমার মনে হয়, পারস্য-খোরাসানের রাজ্যগুলোতেও এমন কোনো কামেল শায়ের নেই, যাকে ইরানের দৌলতে সুফিয়া আমাদের সামনে পেশ করতে পারে। কবিরা সেখানে যশ-খ্যাতি লাভ করলে স্বদেশ ছেড়ে চলে আসে। যদিও আমাদের সাধারণ ভাষা ফার্সি নয়, কিন্তু এই দরবারের দৌলতের সৌভাগ্য, আমাদেরকে কবিত্বে মূল ভাষীদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছে।

হাকিম মাসিহুয-যামান বলেন, আমাদের দরবারের জ্ঞান ও বদান্যতা এবং কবিদের পূর্ণতা হিন্দকে জমিনে আজম বানিয়েছে। ইরান থেকে আসা কবি ও আমাদের মুসলমান কবি এক নয়। এখানে এমন কিছু ভালো হিন্দু কবিও আছে, যারা দরবারের কবিদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে। দাতারাম, যে ব্রাহ্মণ ছদ্মনাম গ্রহণ করে, এখন দিল্লিতে আছে। সে এত ভালো কবি, তার কবিতা শুনে কেউ প্রশংসা না করে পারে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখ থেকে বাহবা বেরিয়ে আসে।’ 

বাদশাহ বালিশে হেলান দিয়ে বসা ছিলেন, একথা শুনে তিনি সোজা হয়ে বসে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমিও ব্রাহ্মণের অনেক প্রশংসা শুনেছি। বর্তমানে কি সে এখানেই আছে?’

‘জি হুজুর, সে এখানেই। পুরো শহরে শোরগোল পড়ে গেছে। লোকেরা খুব আগ্রহ-উদ্দীপনার সাথে তার কালাম শোনার জন্য যাচ্ছে। আর কিছু লোক তো দাওয়াতের বাহানায় নিজের বাড়িতে এনে কালাম শুনছে।’ 

বাদশাহ মোল্লা আতাউল মুলকের দিকে মুখ করে বলেন, ‘তাকে এক্ষুনি ডাকো, তার শের শুনতে আমার বড়ই আগ্রহ।’ 

মোল্লা সাহেব যুগের নামিদামি আলেমদের একজন। তিনি মির সামানি ও দারুয়িগি মহল-এর মতো আলিমের যুগেও সম্মানিত ব্যক্তি, ‘খুব ভালো’ বলে তিনি বাহিরে যান। দাতারামকে নিয়ে আসার জন্য একজন পত্রবাহক পাঠিয়ে ফিরে আসেন। তারপর বাদশাহ সায়িদায়ে গিলানির প্রতি মনোনিবেশ করে বলেন, ‘হিন্দু ব্রাহ্মণ না আসা পর্যন্ত তুমি নিজের কিছু কালাম শোনাও। তবে কাসিদা নয়, গজল গাও।’ 

সায়িদায়ে গিলানি গজল শোনাতে শুরু করে, বাদশাহ আগ্রহ ও আনন্দের সাথে শুনতে থাকেন। অধিকাংশ গজলেই প্রশংসা করে আবার শোনাতে বলেন। মজলিশ ঘণ্টা-দেড়েক চলে, এরইমধ্যে শোনা যায়, দাতারাম চলে এসেছে। আতাউল মুলক তাকে  নিয়ে আসে। সে সিংহাসনের সামনে এসেই পড়েছিল, এমন সময় নকিব কড়া ভাষায় বলে, ‘আদবের সাথে, সম্মানের সাথে!’ সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন আওয়াজ দেয়, ‘জাহাপনার সুদৃষ্টি কামনা করো!’ 

বাদশাহ তার দিকে দৃষ্টি ফেরায়, সে নৈবেদ্য দেখানোর উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়। দূতেরা তার উভয় বাহু ধরে ফেলে। একজন তার দুই হাতের সামনে নিজের হাত দ্বারা আড় দিয়ে রাখে, যেন সে বেশিদূর হাত বাড়াতে না পারে। 

এমতাবস্থার মধ্য দিয়ে দাতারাম সিংহাসনের কাছে গিয়ে পাঁচটি আশরাফি পেশ করে। বাদশাহ তার ওপর হাত রাখলে সে ফিরে গিয়ে দরবারের সভাসদদের শেষে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ায়। বাদশাহ সহাস্যবদনে তার প্রতি মনোযোগী হয়ে বলেন, ‘দাতারাম, অনেক দিন ধরে তোমার নাম শুনছি, তোমাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। এখন আমার কাছে এসে দাঁড়াও আর নিজের কালাম শোনাও।’ 

দাতারাম নত হয়ে প্রণাম করে; যথারীতি জমিন সংলগ্ন হয়ে সালাম করে সিংহাসনের কাছে সাদুল্লাহ খান বরাবর দাঁড়ায়। তারপর নিজের কালাম শোনাতে শুরু করে। 

তার স্বভাবে ছিল আশেকানা জোশ, আচরণে সুফিয়ানা মত্ততা। যাকে ওই সময়ের কাব্যরসিকরা খুব পছন্দ করত। 

তার শের শুনে বাদশাহ খুশি হন, যেসব শেরে অধিক খুশি হন তাতে আস্তে করে প্রশংসা করেন। কখনো উজির সাদুল্লাহ খানের প্রতি প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার কাছ থেকেও প্রশংসার দাবি করেন। 

পুরো দরবারে ‘বাহবা’, ‘বাহবা’ ধ্বনি পড়ে যায়। অনেক শের শোনানোর পর দাতারাম নিজের এই শেরটি পাঠ করে—

হৃদয় আমার এত পরিচিত কুফরের সাথে,

গিয়েছি কয়েকবার কাবাতে, তবু

ফিরে এসেছি ব্রাহ্মণ হয়েই।’

রুকনায়ে কাশি হঠাৎ মুগ্ধ হয়ে বলে ওঠে, ‘বাহবা, বাহবা! কত সুন্দর বলেছ, আবার বলো!’ সে দ্বিতীয়বার পাঠ করে দেখে, বাদশাহর মেজাজ খারাপ। তিনি সাদুল্লাহ খানের প্রতি ক্রুদ্ধ দৃষ্টি ফেলছেন। এই কৌতুকপূর্ণ চিন্তাকে পূর্ববর্তী কবিরা, বিশেষত সুফিরা ফার্সিতে অতিসাধারণ বানিয়ে ফেলেছে। 

রুমি, জামি ও অন্যান্য মহাকবির কবিতায় এসব চিন্তা ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়। কিন্তু একজন ধার্মিক বাদশাহর জন্য এমন ধর্মীয় স্বাধীনতা খুব বিস্বাদ লাগে। এই শেরটিই যদি কোনো মুসলমান কবি আবৃত্তি করত, তাহলে অনেক প্রশংসা পেত। কিন্তু একজন হিন্দু কবির মুখ থেকে এমন কবিতা শুনে বাদশার খারাপ লাগল। 

বাদশাহর মেজাজ-মর্জি সম্পর্কে জ্ঞাত, উপস্থিত বুদ্ধির অধিকারী উজির সাদুল্লাহ খান মুচকি হেসে বিনীতভাবে বলেন, ‘জাহাপনা, এর উত্তর তো শেখ সাদি বহু পূর্বেই দিয়ে গেছেন।’

‘সাদি কী বলে গেছেন?’

‘তিনি বলেছেন, ‘ঈসার গাধা মক্কায় গেলেও গাধা হয়েই ফিরে আসে।’

এটা শুনে বাদশাহ আন্দোলিত হন, উজিরের উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করেন। গোটা দরবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। দাতারাম মুসলিম বাদশার সামনে এমন শের পড়ার কারণে লজ্জিত হয়। সে চুপচাপ মাথা ঝুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এবার বাদশাহ পূর্ণ জোশের সাথে বলেন, ‘থামলে কেন, অন্য কোনো গজল গাও!’ সে সালাম করে ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে পুনরায় তার কালাম শোনাতে শুরু করে। 

দীর্ঘক্ষণ শোনার পর বাদশাহ উপহার দেন। তাকে দান করেন ১ হাজার আশরাফিয়া। সম্মানে ও উপহারে ভূষিত হয়ে দাতারাম কৃতজ্ঞতাভরে প্রণাম করে স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর আফজল খান, যিনি  একজন সরকারী কর্মকর্তা হওয়ার পাশাপাশি ধর্মীয় বিষয়ে পণ্ডিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত, শাহি দরবারে আরজ করেন, ‘দাতারাম আকবরের যুগে হলে বড় ব্যক্তি বলে গন্য হতো।’

বাদশাহ হেসে বলেন, ‘নিঃসন্দেহে তিনি তার প্রকৃত গুনগ্রাহী হতেন। কিন্তু ইসলামি শরিয়তের এমন অপমান তিনিও সহ্য করতেন না। হিন্দু উচ্চপদস্থ বাহাদুরদের তার যুগে যেমন সম্মান-মর্যাদা দেওয়া হতো, আজও তা বহাল আছে।’

‘নিশ্চয়ই, বরং এরচেয়েও বড় বড় পদে ভূষিত। জায়গির ও ক্ষমতায় তারা অধিক সম্মানের অধিকারী। সেনাপতিদের মধ্যে তাদের সম্মান মুসলিম সেনাপতিদের থেকে কম নয়। সম্রাট আকবর যে নৈকট্যের সম্পর্ক হিন্দু রাজাদের সাথে তৈরি করে যান, এখন পর্যন্ত তা বেড়েই চলছে। পূর্বে যেসব হিন্দু সরদার ছিল, তারা এখনো আমাদের কাছে অতি সম্মানিত।

বাদশাহ : এই সম্পর্ককে আমি আরও বৃদ্ধি করতে চাই। এটা জেনে আমি খুব খুশি হয়েছি, রাজস্থানে সাধারণ হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিবাহের প্রচলন শুরু হয়েছে। এতে করে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে গড়ে উঠছে সম্প্রীতির বন্ধন। 

সাদুল্লাহ খান : সম্রাট আকবরের কোনো কাজ কল্যাণ থেকে খালি নয়। বলা হয়ে থাকে, তার অধিক হিন্দুপ্রীতি ছিল। তা অবশ্য ছিল, কিন্তু তা শুধুই এজন্য যে, তিনি হিন্দু-মুসলমানের মিলন ঘটিয়ে একই ধর্ম ও আদর্শের অনুসারী করতে চেয়েছিলেন।

আফজল খান : এরমধ্যে সবচেয়ে গভীর রহস্য হলো, কোনো মুসলিম যতই হিন্দুদের রীতি পালন করুক, তাদের পথে চলুক, হিন্দু হতে পারবে না। অন্যদিকে হিন্দুরা যখন মুসলমানদের সাথে মিশবে, আচার-অনুষ্ঠান পালন করবে, স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করবে। 

হিন্দু নিজ ধর্মে অটল, কিন্তু অন্য ধর্মের লোকদের হিন্দু বানাতে পারবে না। অপরদিকে মুসলিম সব মানুষকে নিজের ধর্মে শামিল করতে প্রস্তুত। এতে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহ নেই, উভয়ের মধ্যে মেলামেশা যত বাড়বে, তত মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। তাই আমার মতে এসব বিষয়ে সম্রাট আকবরের মূলত উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের প্রচার-প্রসার।

বাদশাহ : আমারও একই মত। কিছু অজ্ঞ ঐতিহাসিক তার ধর্ম ও বিশ্বাসে আঘাত করেছে। কিন্তু তুমি যা বলেছে সেটাই প্রকৃত বাস্তবতা। তিনি এই কর্মনীতিতে পুরো হিন্দুস্তানকে মুসলমান বানাতে চেয়েছিলেন। এটা তারই বরকত, আজ হিন্দুস্তানে এত বেশি ইসলামের অনুসারী বিদ্যমান রয়েছে।

সাদুল্লাহ খান : শুধু তাই নয়, তিনি যত কাজ করেছেন তাতে কোনো-না-কোনো কল্যাণ অবশ্যই ছিল। যেমন, তিনি মিনা বাজার নামে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। বাহ্যিক জ্ঞানপূজারি আলেমরা মনে করে, এটা মুসলিম নারীদের জন্য ছিল অপমান ও অসম্মানজনক। কিন্তু বাস্তবতা অনুসন্ধান করলে স্পষ্ট বোঝা যায়, এতে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম পর্দানশীন নারীরা যারা দুনিয়া সম্পর্কে বেখবর, তারা যেন একে অপরের সাথে মিশে যুগ সম্পর্কে সচেতন হয়।

তাছাড়া হিন্দু-মুসলিম নারীরা যারা পৃথকভাবে থাকে, তারা যেন পরস্পর মিলেমিশে একে অন্যের আচার-স্বভাব গ্রহণ করে। মুসলিম নারীরা হিন্দু নারীদের থেকে শেখে স্বামীভক্তি ও আত্মবিস্মৃতি, অন্যদিকে হিন্দু নারীরা মুসলিম নারীদের থেকে শেখে শিষ্টাচার ও ভালো অভ্যাস।

আফজাল খান : আমি বলব এ সমস্ত কল্যাণের মধ্যে সবচেয়ে বড় কল্যাণ হলো, হিন্দু নারীগণ মুসলিম নারীদের সাথে মিলে তাদের বৈষয়িক সৌন্দর্যের সাথে খাঁটি দ্বীন ও ঈমান শিখে মুসলিম হবে। যার ফলে তাদের স্বামীদেরও বুঝিয়ে মুসলিম বানাবে।

বাদশাহ : নিশ্চয়ই এর মধ্যেও আকবরের উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের কল্যাণ ও উন্নতি। কিন্তু এই মিনা বাজারটা আসলে কী? তা কেমন ছিল? আমি মহলের নারীদের মধ্যে কয়েকবার তার আলোচনা করতে শুনেছি, সকল নারীদের তার প্রতি দেখেছি খুব উৎসুক।

সাদুল্লাহ খান : এটা ছিল একটা নারীদের বাজার, যেখানে আমির-উমরা ও অভিজাত লোকদের স্ত্রীরা  মণিমুক্তা ও দুর্লভ জিনিসপত্র বিক্রি করত। স্বয়ং বাদশাহ আকবর, সব শাহজাদা ও দরবারি আমিরগণ বাজারে গিয়ে ক্রয় করত, আর নারীরা যা দাম চাইত পরিশোধ করত। পুরুষ ছাড়া সাধারণ নারীরাও প্রমোদ-ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আসত বাজারে। এক আশ্চর্য মিলনমেলা হতো।

বাদশাহ :  খরিদদার আমিরদের সাথে নারীরা কি পর্দা করত না?

সাদুল্লাহ খান : প্রাচীনকাল থেকে তুর্কী-তাজিক অভিজাত বর্গ এবং আরব-আজমের সম্মানিত লোকদের মধ্যে এই প্রথা চলে আসছে, বাদশাহকে তারা মনে করে সবার স্নেহশীল পিতা। নারীরা তার সাথে পর্দা করে না। বাকি থাকে শাহজাদা ও আমির। তাদের ইচ্ছাধিকার ছিল, কেউ চাইলে জরিদার নেকাবে মুখ ঢাকতে পারে। তবে শোনা যায়, সম্রাট আকবরের মিনা বাজারে কোনো মুসলিম নারীর মুখে পর্দা ছিল না

বাদশাহ : তাহলে কি সকল আমির ও অভিজাতের স্ত্রীদের বাজারে আসতে বাধ্য করা হয়েছিল?

সাদুল্লাহ খান : কাউকে বাধ্য করা হয়নি। বাজারে অংশগ্রহণ করায় বাদশাহর সন্তুষ্টি ছাড়াও এত অধিক পরিমাণ লাভের সম্ভাবনা ছিল, এমন কোনো অভিজাত লোক নেই যার স্ত্রী আসেনি। বিনোদনের জন্য  সাধারাণ-অভিজাত সব শ্রেণির নারীরাই আসত।

বাদশাহ : বাজারটির কারণে জনসমাজে কোনো ক্ষোভ ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়নি?

সাদুল্লাহ খান : তা হয়নি। আজ পর্যন্ত লোকেরা তাকে কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করে।

বাদশাহ : আমার মন চায় আমার শাসনকালেও এমন একটি বাজার হোক। এতে তোমাদের কী মত?

সাদুল্লাহ খান : খুব ভালো হবে। সবার মধ্যে আনন্দ ছড়িয়ে পড়বে। যেহেতু নারীদের মধ্যে এর প্রতি ব্যাপক আগ্রহ এবং সম্রাট আকবরের যুগের মিনা বাজারের কথা কিংবদন্তির মতো বর্ণিত হয়ে থাকে। এতে তারা অনেক খুশি হবে, খুব আগ্রহের সাথে চলে আসবে।

বাদশাহ : আমার কালের মিনা বাজারের জন্য আমি এর উপযোগী একটি প্রাসাদ নির্মাণ করব। যাতে দীর্ঘকাল পর্যন্ত এর ভিত্তি প্রস্তুত হয়। প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময় কিছু দিনের জন্য এই আনন্দমেলা জারি থাকে। কিন্ত এটা যেহেতু নারীদের বিষয়, তাই প্রথমে রানির সাথে পরামর্শ করি। সে যদি রাজি হয়, তাহলে কাল থেকেই নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করব।

সাদুল্লাহ খান : এই মর্যাদাপূর্ণ কাজটি তার হাতেই পূর্ণতা পাওয়া উচিত। খুব ভালো হয় যদি বাজারটি তিনি নিজ হাতে পরিচালনা করেন। এতে নারীরা দ্বিধাহীন চিত্তে চলে আসবে।

বাদশাহ : আমি তাকে রাজি করাব, যাতে বাজারের ঘোষণাটি সে দেয় এবং তার নির্দেশমতো প্রাসাদটি নির্মিত হয়। 

যেহেতু এ আলোচনায় দীর্ঘ সময় চলে যায়, তাই বাদশাহ দরবার মুলতবি ঘোষণা করে অন্দরমহলে চলে যান। রাজ্যের আমিরগণও নিজ নিজ বাড়িমুখি পথ ধরে।

 

চলবে…

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷