ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত সবধরনের জ্ঞানতাত্ত্বিক বিষয়ে পবিত্র কোরআনকে ‘মূলপাঠ্যের’ মর্যাদা দেওয়া হয়, বাকি হাদিস ফিকহ তফসির ও অন্যান্য শাস্ত্র হলো টীকা বা ব্যাখ্যাগ্রন্থের মতো। মুসলিম জাতিকে আল্লাহর রসুল (স.) কোরআন ও হেকমতের শিক্ষা দিয়েছেন। এর মধ্যে রসুল পাক (স.)-এর কথা ও কাজকে একটি নির্দিষ্ট মূলনীতির আওতায় এনে অনুসরণ করা হয়, যাকে এক কথায় বলা হয় ‘সুন্নত’। কেউ কেউ আবার রসুল (স.)-এর সময়কালের পূর্ণচিত্র ও তার সবধরনের বক্তব্যে আগ্রহ রাখেন, তাই তারা রসুল পাক (স.)-এর সমস্ত কথা ও কাজের বিবরণ এক মলাটে আবদ্ধ করার প্রয়াস চালান। এরমধ্যে যদিও কোনোটা প্রামাণ্য আবার কোনোটা আধা প্রামাণ্য। তথাপি এভাবেই ‘হাদিস’ সংকলিত হয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো—হাদিসের কিতাবগুলোর সাহায্যে ‘সুন্নতে রসুল’ বা কেবল অনুসরণীয় নির্দেশনার বিস্তারিত ও ব্যাখ্যামূলক বিবরণ পাওয়া যায়।
কালপরিক্রমায় মুসলিম জাতি যখন নতুন পরিস্থিতি ও অবস্থার পরিবর্তনের সম্মুখীন হয়, তখন তারা আল্লাহর কিতাব ও রসুল (স.)-এর সুন্নাহকে মূলনীতি বানিয়ে সময়োপযোগী নতুন আইন প্রণয়ন করে, এভাবেই সমস্যার সমাধান হয়, এবং নির্দিষ্ট আইনকানুন তৈরি হয়। এসব কাজের নেতৃত্বদানকারী সেই যুগের এক মহান ব্যক্তিত্বের নাম আবু হানিফা নোমান বিন সাবিত (রহ.), যিনি কিয়াসের মূলনীতি অনুসরণ করে কোরআন ও হেকমতের মধ্যে নতুন সম্পর্ক স্থাপন করেন, এবং যুগোপযোগী ফলাফল বের করে আনেন।
এসময় মস্তিষ্কজাত জ্ঞান ও আকিদার রণভূমিতে ‘কালামশাস্ত্রের’ উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। কালামশাস্ত্র এই দুই বিষয়ের মাঝে আলাপ-আলোচনার সেতু নির্মাণ করে, যদিও কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় মীমাংসাক্ষেত্র যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এরপর আসে তাসাওউফের যুগ। মানুষের হৃদয়ে যখন ঈমান ও আকিদা প্রবেশ করে, তখন তাসাওউফ এই বাতেনি উপলব্ধিকে সাক্ষ্যদান করে। আলেমগণ কালামশাস্ত্র ও তাসাওউফের উপরও কিতাব লিখেছিলেন। এমনকি এককালে কালামশাস্ত্রকে ‘ফিকহে আকবর’ (আইনশাস্ত্রের সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ) পর্যন্ত বলা হয়েছে। মুসলিম সমাজে তাসাওউফের চর্চাকে সবসময় সমাদর ও সম্মানের চোখে দেখা হয়েছে। তাসাওউফ হৃদয়কে উজ্জ্বল করে, মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের অনুভূতিকে শক্তিশালী করে এবং মানুষের মনের গোপন রহস্য প্রকাশ করে। এই কারণেই আত্মশুদ্ধি-প্রত্যাশী এবং পীর-আউলিয়া বাতেনি পরিবেশ থেকে শুরু করে সামাজিক ক্ষেত্রে সর্বত্রই তাসাওউফের চর্চা করতে দেখা যায়। একইভাবে, আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলে সুফিদেরকে ইসলামের গূঢ়তত্ত্ব ও জটিল জটিল বিষয়ের ব্যাখ্যা করতে দেখি। তারপর দেখতে পাই সুফি আলেমগণ মানুষের প্রকৃতি ও আল্লাহর সত্তায় বিলীন হওয়ার রহস্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছে।
কালামশাস্ত্র ও তাসাওউফ অবশ্যই সম্মানযোগ্য, তাদের প্রয়োজনীয়তাও মুসলিমরা স্বীকার করে, কিন্তু আর্থসামাজিক জীবনে ডিসিপ্লিনের জন্য আইনের গুরুত্ব বিল্ডিং বাড়িতে ইট-পাথরের মতো। এই কারণেই দেখতে পাই ফিকহকে কেন্দ্র করে মুসলিম সমাজ গড়ে উঠেছে এবং সবাই ফিকহের ইমামদের তাকলিদ (অন্ধ-অনুসরণ) করছেন। যদিও গুটিকয়েক মানুষ হাদিসের ইমাদের তাকলিদ (অন্ধ-অনুসরণ) করেন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই সব সময় ফকিহদের অনুসরণ করেছেন।
ফিকহশাস্ত্রের শ্রেণিবিভাগ এবং সংকলন অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমের বিষয়। প্রথমে ফিকহের মূলনীতি তৈরি করা হয়েছে, তারপর প্রতিটি ফিকহি মাসআলা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগ করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সমেত একত্র করা হয়েছে। মানুষ সেই বিশ্লেষণ সাপেক্ষে জীবন পরিচালনা করতে শুরু করে, এভাবেই মুসলমানদের মধ্যে ডিসিপ্লিন শুরু হয়। এই ফিকহের বদৌলতেই সামাজিক শৃঙ্খলা ও আইনের শাসন কায়েম হয়। সাধারণ চোখে এই তাকলিদ (অনুসরণ) খুবই উপকারী বটেই, অপরিহার্যও ছিল। কিন্তু দুনিয়ার পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে না পারায় একসময় এই তাকলিদই পায়ের শিকলের মতো হয়ে যায়। একারণেই ইসলামের ইতিহাসে বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখতে পাই সুফিরা ‘মুজতাহিদদের’ মতো মতামত দিচ্ছেন, যদিও তারা নিজেদের মুজতাহিদ দাবি করেননি এবং তাদের ইজতিহাদের পেছনে ফিকহি দলিলও দেননি। এছাড়াও সুফিদের আচার-নীতিতে নতুন নিয়ম তৈরি ও বন্ধ ঘরে রাস্তা খোঁজার উদাহরণও আছে।
ইমাম শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি (রহ.)-এর যুগ পর্যন্ত বিদ্যমান ফিকহি মূলনীতি মুসলিম জাতিকে সঠিক পথপ্রদর্শন এবং এলেমের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়েছিল। আগের জমানায় কালামশাস্ত্র, মস্তিষ্কজাত জ্ঞান ও শরিয়ত ছিল যুক্তি ও ফিকহের আলোচনার বিষয়, তাসাওউফ ছিল হৃদয় ও আত্মার খোরাক, আর এই সবই ছিল কোরআনলব্ধ জ্ঞানের নির্যাস, কোরআন থেকেই আহরিত হয়েছিল সব তত্ত্ব। এইসব জ্ঞানতত্ত্ব যদিও কোরআন ও হেকমতের তালিম থেকে জন্ম নিয়েছিল, কিন্তু শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি (রহ.)-এর জীবনে পূর্বের কোনো তত্ত্বের স্থায়িত্ব হয়নি। রাজনীতি, কূটনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল। আগেকার উপায়-পদ্ধতি অচল হয়ে গেছিল। এই নতুন সময় আর নতুন পরিস্থিতিই শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবিকে ‘জমানার ইমাম’-এ পরিণত করেছিল। তিনি নিজেকে ইমাম দাবিও করেছিলেন, স্রেফ এই ভিত্তিতে যে, তিনি আধুনিক জীবনে কোরআন ও হেকমত থেকে উপকৃত হওয়ার ও দীনি এলেমের নতুন ও যুগোপযোগী বিন্যাসের পথ উন্মুক্ত করেছিলেন।
ইমাম ওলিউল্লাহ দেহলবি (রহ.) কোরআন ও সুন্নত বোঝার ক্ষেত্রে এবং ফিকহ, তাসাওউফ ও কালামশাস্ত্রের নতুন বিন্যাসের জন্য নতুন বুনিয়াদ তৈরি করেন। তিনি কালামশাস্ত্রের জন্য শরিয়তের গোপন রহস্য ও হুকুম উদ্ঘাটন করেন। নতুন যুগের সমাজব্যবস্থাকে বোঝার জন্য জ্ঞানের নতুন একটি শাখার ভিত্তি স্থাপন করেন, যার নাম দেন ‘ইরতিফাকাতে মাআশিয়াহ’। শাহ সাহেব জানতেন আধুনিক কালামশাস্ত্র দর্শনের মূলনীতির ভিত্তিতে নয়, সমাজতত্ত্বের মূলনীতিতে হবে, তাই তিনি সেভাবেই তাকে বিন্যস্ত করেন।
শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি (রহ.) তাসাওউফেরও কয়েক জায়গায় ইজতিহাদ করেছেন। তিনি তাসাওউফে ‘লতিফায়ে জাওয়ারেহ’ নামক নতুন এক ‘লতিফা’ যোগ করে শরিয়ত ও তরিকতকে এক করে ফেলেন। তিনি ‘ওহদাতুল ওজুদ’ ও ‘ওহদাতুশ শুহুদ’-এর প্রাচীন বিতর্ক মিটিয়ে দিয়ে এই দুয়ের মাঝখানে সমন্বয় ঘটিয়েছেন। একইভাবে হাদিস থেকে এলেম গ্রহণের জন্য ফিকহশাস্ত্রের জ্ঞান থাকাকে শর্তযুক্ত করেন।
এই সমস্ত চেষ্টাপ্রচেষ্টাই তার নিজ অবস্থানে খুব গুরত্ব রাখে, কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তার যেই কাজটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও বৈপ্লবিক, সেটি হলো—তিনি তফসিরের সাহায্য ছাড়া মূল কোরআন বোঝা অতঃপর তালিম ও গবেষণা করার প্রতি মানুষকে নতুন করে জাগিয়ে তোলেন। তিনি কোরআন শিক্ষার প্রতি এমনভাবে উৎসাহ দেন, বোধহয় তিনিই বিশ্বব্যাপী ‘তাহরিকে রুজু ইলাল কুরআন’ বা কোরআনের দিকে ফিরে আসার আন্দোলনের পথিকৃৎ ছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে তিনি সর্বপ্রথম তফসিরের মূলনীতির ওপর জোরালোভাবে কলম ধরেন, এবং মূলনীতিগুলো এমনভাবে সাজান যে সেগুলো কোরআন অধ্যয়নের বুনিয়াদ হয়ে দাঁড়ায়। আজকালকার জমানায় ইমাম ওলিউল্লাহ দেহলবির কোরআনের দিকে ফিরে আসার আন্দোলন খুব আশ্চর্যজনক মনে না হলেও তার সময়ে এটি রীতিমতো ইনকিলাব ছিল। কারণ ওই সময়কালটা ছিল ‘মূল বই বাদ দিয়ে নোট বই পড়ার যুগ’, এ কারণে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আর টীকাভাষ্য বাদ দিয়ে মূল বই পড়তে বলার ডাক দেওয়া তার জন্য সহজ কাজ ছিল না।
ইসলামি জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে দেখা যায় কেউ একজন কিতাব লিখেছেন, কয়েকজন তার ওপর টীকাভাষ্য ও ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেন, তারপর সেই ব্যাখ্যাগ্রন্থের আবার টীকা-টিপ্পনী লেখা, এরপর সেসবের ওপর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ও টীকা-টিপ্পনী৷ এই টীকার ওপর টীকা লিখিয়েদের কাছ থেকে ইজতিহাদ বা মৌলিক গবেষণার আশা কীভাবে করা যায়? তাদের কাছ থেকে নতুন চিন্তার প্রত্যাশা নিশ্চিতরূপে জ্ঞানচর্চার দরজা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া অন্যকিছু নয়।
শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি এই টীকার ওপর টীকা লিখিয়েদের বিপরীতে হয় কিতাব লিখেছেন, নয়তো মূল কিতাব সম্পর্কে লিখেছিলেন। তিনি কোরআনের তর্জমা ও টীকাভাষ্য লিখেন। মুয়াত্তায়ে মালিকের আরবি ও ফারসি টীকাভাষ্য (আল মুসাওয়া ও আল মুসাফফা) লিখেন। তিনি এমনসব কিতাব লিখেন, যেগুলো সেই বিষয়ে মূল কিতাব হিসেবেই আখ্যা দেওয়া হয়। তাসাওউফ, কালামশাস্ত্র, ইতিহাস, হাদিস, সুন্নাহ ও তফসির ইত্যাদি বিষয়ে তার অবস্থান মুকাল্লিদ (অনুসরণকারী) নয়, বরং একজন মুজতাহিদ বা মৌলিক চিন্তক পর্যায়ে। যদিও তিনি নিজের জন্য ‘মুজতাহিদে মতলক’ উপাধির চেয়ে ‘মুজাতাহিদ ফিল মাযহাব’ ও ‘মুজতাহিদে মুনতাসিব’ উপাধি পছন্দ করতেন।
প্রবন্ধকারের ওস্তাদ শায়খুল কোরআন মওলানা মুহাম্মদ তাহের (রহ.) মওলানা আবুল কালাম আজাদ (রহ.)-এর তফসির ‘তরজুমানুল কুরআন’ সম্পর্কে বলেন, ‘তফসিরের জগতে তরজুমানুল কুরআনকে মূল বই আর বাকিসব তফসিরকে টীকাভাষ্য বলা যায়।’
ইমাম শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবির তর্জমা ও টীকাভাষ্য ‘ফাতহুর রহমান’ সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। শাহ সাহেব তফসিরের মূলনীতির ওপর ‘আল ফাওজুল কাবির’ শিরোনামে একটি বই, এবং কোরআনের এক অংশের তফসিরও লিখেছিলেন।
আল ফাওজুল কাবিরের আগে ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতির ‘আল ইতকান’ নামে তফসিরের মূলনীতির একটি কিতাব ও ইবনে তাইমিয়ার একটি চিঠি পাওয়া যায়। এছাড়া আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ পাওয়া যায় না। শাহ সাহেব তফসিরের মূলনীতির উপর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও গবেষণাধর্মী কাজ করেন। কোরআন ও হাদিসের শিক্ষার সাধারণীকরণের মাধ্যমেই গবেষণার মানসিকতা বৃদ্ধি পেতে পারে। এইজন্য তিনি কোরআন-হাদিস ও সমাজবিজ্ঞান শিক্ষার কাজ শুরু করে ইজতিহাদ ও গবেষণার দরজা খুলে দিয়েছিলেন। এবং সেই দরজা দরাজ গলায় গাইছিল :
کون ہوتا ہے حریف مے مرد افگن عشق
ہے مکرر لب ساقی پہ صلا میرے بعد
কার এমন সাহস আছে আফগান মর্দকে কাবু করে দেওয়া প্রেমমদিরার স্বাদ নেবে? আমার পরে সাকির মুখে আবার আমারই নাম ঘোষিত হচ্ছে। (মানে আমার পরে আমার মতো শক্তিমান কেউ নাই।)
কিন্তু এইক্ষেত্রে ‘আফগান মর্দকে কাবু করে দেওয়া প্রেমমদিরা’ পান করতে এগিয়ে এলেন ইমামে ইনকিলাব মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি (রহ.)। তিনি ছিলেন সেই ‘রহস্যজ্ঞানী’, যার ব্যাপারে বলা যায় :
عمرہا در کعبہ و بتخانہ می نالد حیات
تاز بزم عشق یک دانائے راز آید بروں
কা’বা আর এবাদতখানায় উদ্ভ্রান্তের মতন জীবন কাটানোর পর
একদিন প্রেমের মেলায় গিয়ে পেয়েছি সেই রহস্যজ্ঞানীর সন্ধান
এই ‘রহস্যজ্ঞান’ ছিল ইমাম শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি থেকে শায়খুল হিন্দ (রহ.) পর্যন্ত কোরআনি এলেমের উত্তরাধিকার। এবং শায়খুল হিন্দ ওই সমস্ত এলেম, যা তিনি পূর্ববর্তীদের কাছে পেয়েছিলেন, তার সব আপন শিষ্য মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধির সিনায় স্থানান্তর করেছিলেন। মওলানা সিন্ধির প্রথমে দেওবন্দি আলেমদের কাছ থেকে তফসিরের জ্ঞান হাসিল পোক্ত হয়। হজরত রশিদ আহমদ গাঙ্গোহি (প্রবন্ধকার তারই ফয়েজপ্রাপ্ত পরিবারের সন্তান) ও হজরত মাজহার নানুতবি (রহ.)-এর শাগরেদ শায়খুল কোরআন হজরত মাওলানা হুসাইন আলি (রহ.)-এর তফসির ‘বালাগাতুল হাইরান’ একথার সাক্ষ্য যে দেওবন্দি আলেমরা পবিত্র কোরআন নিয়ে কী পরিমাণ গবেষণা করতেন এবং কোনো কালে কোরআনের সুরা ও আয়াতের ধারাবাহিকতা নিয়ে চিন্তা-ফিকির করতেন। মাওলানা হুসাইন আলি (রহ.) তার কিতাবে এই দুই বুজুর্গ সম্পর্কে লিখেছেন : তারা সেই আমলের মানুষ ছিলেন যখন ‘নিজামুল কোরআন’ রচয়িতা মাওলানা হামিদুদ্দিন ফারাহি সবে স্লেটে ‘আলিফ-বা-তা’ লিখতে শুরু করেছেন।
মওলানা সিন্ধি শায়খুল হিন্দের সান্নিধ্যে কোরআনের মন ও মগজ আয়ত্ত্ব করেন। শায়খুল হিন্দ তার ওস্তাদ ও সালাফদের প্রাপ্ত এলেমের রত্নভাণ্ডার কীভাবে খুঁড়ে খুঁড়ে আপন শিষ্যকে দিয়েছেন, খোদ মওলানা সিন্ধির জবানেই তা শোনা যাক :
‘আমি ইমাম ফখরুদ্দিন রাযির (মৃত্যু : ৬০৬ হিজরি) তফসির পড়েছি। এমনকি জারুল্লাহ যমখশরির (মৃত্যু : ৫৩৮ হিজরি) তফসির অধ্যয়ন করেছি। এছাড়াও আবু মুহাম্মদ হুসাইন বিন মাসউদ আল ফাররা আল বাগাবি (মৃত্যু : ৫১০ হিজরি) প্রণীত মাআলিমুত তানজিল পাঠ করেছি। হাফেজ ইমাদুদ্দিন আবুল ফিদা ইসমাইল (মৃত্যু : ৭৭৪ হিজরি), যিনি ইবনে কাসির নামে সমধিক পরিচিত, তার তফসিরও পড়েছি। এইসব তফসিরের মাধ্যমে আমি আমার সাধ্যমতো কোরআন বোঝার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি, কিন্তু অবাক হওয়া ছাড়া আমার নসিবে আর কিছুই জুটেনি। যদি ছাত্র অবস্থায় শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দি (রহ.)-এর মুখ থেকে কিছু আয়াতের তফসির না শুনতাম, যেই তফসির কিতাবে পাওয়া যায় না, অথবা শায়খুল ইসলাম কাসেম নানুতবি (রহ.)-এর সংক্ষিপ্ত তফসির যদি না পড়তাম, তাহলে পূর্ববর্তীদের তফসির গ্রন্থ পাঠের পর তফসিরশাস্ত্রের ওপর একেবারে নিরাশ হয়ে যেতাম। নিঃসন্দেহে একথা স্বীকার করি আগেকার দিনে মুসলমানরা ওই তফসিরের আলোকেই কোরআন বুঝতেন। এবং সেসব মূলনীতি ও কায়দাকানুনের ভিত্তিতে ইজতিহাদ করে কোরআনের হুকুমত কায়েম করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান যুগের মানুষজন যেসব বিষয়-আশয়ের সাথে সম্পৃক্ততা রাখে, আমাদের জন্য ওই ধরনের তফসির দিয়ে কোরআন বোঝা সম্ভব নয়। (শাহ ওলিউল্লাহ আওর উন কা ফালসাফা, পৃষ্ঠা ৫৪)
হজরত শায়খুল হিন্দ ও তার শিক্ষক মওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবি (রহ.)-কে ইমাম ফখরুদ্দিন রাযি ও আল্লামা তাফতাজানি (রহ.)-এর মতো মুফাসসিরদের মোকাবেলায় কেবল এইজন্যই সামনে এনেছেন, কারণ তিনি জানতেন এই নতুন যুগ শুধুমাত্র হজরত শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি (রহ.) ও তার অনুসারীদের যুগ।
দেওবন্দে পড়ার সময় প্রথম মওলানা সিন্ধির কোরআন বোঝার প্রতি ঝোঁক উঠে। তিনি কোরআন বোঝার জন্য সিলেবাসভুক্ত তফসিরের কিতাবগুলোকে প্রথম দিন থেকেই যথেষ্ট মনে করেননি, এবং এরকম মানসিকতার মূলে ছিল শায়খুল হিন্দের তালিম ও তরবিয়ত। এমনিতেও তো মাওলানা হুসাইন আলি (রহ.) এবং তার ওস্তাদগণ তফসিরের সাহায্যে শিক্ষার বিপরীতে সরাসরি কোরআনের মাধ্যমে কোরআন শিক্ষার ধারাবাহিকতা চালু রেখেছিলেন। এই ধারাবাহিকতা ইমাম শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি (রহ.) শুরু করেছিলেন, এবং তার অনুসরণকারী প্রত্যেক সিলসিলায় এই নীতি পরিচিত ছিল। মওলানা সিন্ধিকে যখন দেওবন্দ থেকে বহিষ্কার করা হয়, তখন তার অনেক বক্তব্যের উপর আপত্তি করা হয়। এই আপত্তি ঘুরেপ্যাঁচে তার কোরআন বোঝার পদ্ধতির উপরও পড়েছিল। আদতে মওলানা সিন্ধি তার ওস্তাদ শায়খুল হিন্দের স্টাইলে কোরআন বুঝেছিলেন, আর তার বিরুদ্ধবাদীরা বুঝেছিলেন পূর্ববর্তী মুফাসসিরদের স্টাইলে। তারপর প্রাচীনপন্থী শিক্ষকেরা শায়খুল হিন্দের এই মহান শাগরেদকে [ইংরেজদের ইশারায়] দেওবন্দ থেকে বের করে দেয়।
মওলানা সিন্ধি তার ওস্তাদ শায়খুল হিন্দের নির্দেশে দিল্লিতে কাজ শুরু করেন। তার প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল নাজারাতুল মাআরিফ আল কুরআনিয়া। এখানেই মওলানা আহমদ লাহোরি (রহ.) মওলানা সিন্ধির অধীনে তফসির পাঠ করেন। কিন্তু আফসোসের বিষয়, পরবর্তীকালে হজরত আহমদ লাহোরি অনভিজ্ঞ লোকদের খপ্পরে পড়ে মওলানা সিন্ধির সাথে সম্পর্ক বজায় রাখেননি।
মওলানা সিন্ধি যখন কাবুলে ছিলেন, ওখানে তার শাগরেদ যফর হাসান আইবেককে কোরআন পড়িয়েছেন। মওলানা রাশিয়া গেছেন, তুরস্ক গেছেন, তারপর মক্কায় ফিরে এসেছেন। মক্কায় তিনি অনেককেই কোরআন পড়িয়েছেন, তার সংস্পর্শে অনেকেই কোরআন বোঝার সৌভাগ্য লাভ করেছেন।
শায়খুল কোরআন মওলানা মুহাম্মদ তাহের (রহ.) একবার আমার কাছে বর্ণনা করেন, তিনি যখন তিনজন আলেমকে সাথি বানিয়ে হজে যান, তারা চারজন মওলানা সিন্ধির খেদমতে হাজির হন। পরিচয়পর্বের পর মওলানা সিন্ধি আচমকা তাদেরকে কোরআনের এক সুরার তফসির জিজ্ঞেস করেন। তো প্রথমজন চুপ রইলেন। দ্বিতীয়জন ওজর দেখালেন। তৃতীয়জন তো নিজের আলেম হওয়ার বিষয়টিই অস্বীকার করলেন। মওলানা মুহাম্মদ তাহের (রহ.) তাদের নাম প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন, যেন আকাবিরপূজারীদের জযবায় চোট না লাগে। এই তিনজনের একজন আবার মওলানা সিন্ধিকে কাফের ফতোয়া দিয়ে আমাদের জযবায় মারাত্মকভাবে আঘাত হেনেছিলেন। আল্লাহ পাক তাকে ক্ষমা করে দিন। তো চতুর্থজন ছিলেন মওলানা মুহাম্মদ তাহের, তিনি সামনে এগিয়ে তফসির বর্ণনা করেন। তিনি ছাড়া তিনজনই মওলানা সিন্ধিকে একপ্রকার অসম্মান করেন, মওলানা তাদেরকে চলে যেতে বলেন। আর মওলানা মুহাম্মদ তাহেরকে তার কাছে অবস্থান করতে বলেন। তিনি এক বৎসর তার সান্নিধ্যে থাকেন। আল্লাহ পাক শায়খুল কোরআনকে সহিসালামতে রাখুন।
মওলানা সিন্ধি সারা জীবন নিয়মিত কোরআন পড়েছেন, কোরআনের ওপর গবেষণা করেছেন এবং কোরআনের শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি উর্দুতে ‘তফসিরে মাকামে মাহমুদ’ লিখেন। আরবিতে কোরআনের তফসির ‘ইলহামুর রহমান’ লিখেন। তারপর উপমহাদেশে ফিরে এসে বিভিন্ন জায়গায় কোরআনের বিভিন্ন সুরার ওপর ক্লাস নিয়েছেন। অনেকেই সেইসব একত্র করে প্রকাশ করেছেন। এভাবে সারা জীবনই কোরআনের খেদমত চালিয়ে গেছেন। এমনকি তার খেদমত আজকের দিনেও জারি আছে।
মওলানা সিন্ধি জীবনভর এলেম হাসিলের সফর করেছেন। তিনি অন্যান্য মৌলিক চিন্তাবিদদের মতোই নিজের মতামতে পরিবর্তন ও সংশোধন আনতে কখনো পিছ-পা হননি। এইজন্য ওনার শেষজীবনের কোরআনের সমঝদারি প্রথমজীবনে তালাশ করা অনুচিত। তবু বলতে হয়, প্রথমজীবনেই তিনি কোরআনকে যেভাবে বুঝেছিলেন, আজও তা আমাদের জন্য মাইলফলক, তার অনুসরণ আমাদের জন্য উপকার বৈ অন্যকিছুই বয়ে আনবে না।
মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি ১৯১৪ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে অল ইন্ডিয়া এজুকেশনাল কনফারেন্সে সভাপতির ভাষণ দিয়েছিলেন, যার বিষয় ছিল ‘কোরআন বোঝা’। এই সভাপতির ভাষণই পরবর্তীতে ‘কোরআন কা মুতালাআ কেয়সে কিয়া জায়ে’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এই কিতাবের পাঠ কেবল মওলানা সিন্ধির কোরআনের সমঝদারি বুঝতে সহায়তা করবে এমন নয়, বরং মওলানার চিন্তার বিবর্তনের প্রথম স্তর সম্পর্কেও জানা যাবে। এই দীর্ঘ প্রবন্ধ আমাদের প্রথমেই এই ধারণা দেয় যে, মওলানা সিন্ধি ১৯১৪ সালে যখন অল ইন্ডিয়া এজুকেশনাল কনফারেন্সে সভাপতির পদ অলংকৃত করবার দাওয়াত পান, তখন তার চিন্তাভাবনার মূলে ছিল কীভাবে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের কাছে কোরআনকে পরিচিত করা যায়। এবং স্যার সৈয়দের হাতে গড়া এই কনফারেন্সে তার অংশগ্রহণও একথা প্রমাণ করে তিনি সংগ্রামী জীবনের প্রারম্ভকাল থেকেই চাইতেন কোরআনি শিক্ষা ও জাগতিক শিক্ষা একীভূত হোক।
মওলানা সিন্ধি তার প্রবন্ধে দাবি করেছেন যে কোরআনের প্রচলিত তফসির পরিপূর্ণভাবে কোরআন বুঝতে সহায়তা করে না। তিনি প্রথম দফাতেই তফসিরের সহায়তায় কোরআন পড়ার পরিবর্তে সরাসরি কোরআন পড়ার দাওয়াত দিয়েছেন। মুসলিম সমাজে শতশত বছর ধরে তফসিরের শিক্ষাকে কোরআন শিক্ষার সমার্থক ভাবা হয়, কিন্তু ইমাম শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি (রহ.) তফসিরের বদলে কোরআন শিক্ষার রেওয়াজ চালু করার কোশেশ করেন। এ নিছক সাদামাটা পরিবর্তন নয়, একে বলতে হয় বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা। এ ছিল তফসিরের গোলকধাঁধা থেকে বের করার প্রথম পদক্ষেপ, একজায়গায় পাথরখণ্ডের মতো বসে থাকা বা অন্ধ অনুসরণকে ‘না’ বলা। এ ছিল সরাসরি কোরআনের মাঝে প্রবেশের পথ, কোনো ‘দালাল’ ছাড়া সরাসরি আল্লাহর ফয়েজ হাসিলের চেষ্টা। এ ছিল কোরআন নিয়ে চিন্তা ও গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত করা।
শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবির চিন্তাদর্শনের সংক্ষিপ্তরূপই মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধির বক্তব্যে বিস্তারিত পাওয়া যায়। এইজন্যই মওলানা সিন্ধি গৎবাঁধা তফসির শিক্ষাকে না বলেন, এভাবে তফসির পড়ার যুক্তিকে খণ্ডন ও প্রতিবাদ করেন। আর এটা স্পষ্ট যে এই বক্তব্য যখন দিয়েছেন তখনও তিনি কাবুল ও রাশিয়া সফর করেননি অথবা বহির্জগতের নানাবিধ ধারণার সাথে তিনি পরিচিত হননি, বরং একমাত্র এই উপমহাদেশের চিন্তাদর্শনের সাথেই তার পরিচয় ছিল। এইজন্য জোরগলায় এই দাবি করা যায় মওলানা সিন্ধির এই চিন্তাভাবনায় শায়খুল হিন্দের প্রভাব ভিন্ন অন্যকিছু ছিল না। মওলানা সিন্ধি বলেন :
‘বড়ই দুঃখজনক কথা, আমরা মনে করি কোরআন বুঝব না। কোরআনের কত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আছে, বিভিন্ন তফসিরের কিতাবে কত জটিল জটিল বিষয় লেখা আছে, মুফাসসিরদের গবেষণা ও মতামত পড়লেই কেবল কোরআন বুঝব। কিন্তু এই ‘মনে করা’ বাস্তবিক নয়। এইসব তফসিরগুলো যদি নিখাদ ও কোরআনের হক আদায় করে লেখা হতো তাহলে এই ‘মনে করা’ মেনে নিতে আপত্তি থাকত না। কিন্তু গজব কাণ্ড হলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট ও মতবাদের প্রভাবে কোরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে পরিবর্তন করা হয়েছে, এমনকি এমন অনেক কিছুই যুক্ত করা হয়েছে যেসবের সাথে আল্লাহর বাণীর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নাই। সাধারণ মানুষ ওই সবকেই কোরআন মনে করে। কোরআনের প্রকৃত শিক্ষার সাথে ওই সব ব্যক্তিগত মতের কোনোপ্রকার লেনাদেনা নাই।’
মওলানা সিন্ধি শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবির দেখানো পথ অনুসরণ করে মঞ্জিলে গিয়ে পৌঁছে স্পষ্ট ভাষায় বলেন :
‘কোরআনের শিক্ষা ও তফসির—দুটো আলাদা জিনিস, এক জিনিস নয়। কোরআন নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কিতাব।’
আমাদের পূর্ববর্তী আলেমগণ কোরআন বোঝার জন্য অনেক এলেম ও শর্ত-শরায়েত নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। সেই শর্তের সংখ্যা প্রত্যেক যুগে যুগে বেড়েছে, এমনকি কোনো কোনো আলেম সেইসব শর্তের সংখ্যা দুই ডজন পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছিলেন। কিন্তু শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি (রহ.) সেই গল্পের সুতো কেটে দিয়ে স্পষ্ট ভাষায় অসার শর্তের প্রতিবাদ করেন। তিনি বলেন :
‘এবং আমি তালেবে এলেমদের বলি—তোমরা যারা নিজেদের আলেম বলো, ওরে বেকুবের দল, তোমরা এখনো গ্রিক ধারার জ্ঞানচর্চায় মশগুল হয়ে আছো, এখনো আটকে আছো আরবি ব্যাকরণে, অথচ তোমরা কিনা ভাবছো এটাই প্রকৃত এলেম!’
মওলানা সিন্ধি এই বক্তব্যের এই ফলাফল বের করেন :
‘কোরআন নিজেই একটি পূর্ণাঙ্গ শাস্ত্র, এবং সাদাসিধে আরবি ভাষায় অবতীর্ণ।’
এবং বক্তব্যের দলিল হিসেবে খোদ আল্লাহর কালাম উপস্থাপন করেন :
فَاِنَّمَا یَسَّرْنٰهُ بِلِسَانِكَ لَعَلَّهُمْ یَتَذَكَّرُوْنَ
হে নবী, আমি এই কিতাবকে তোমার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি যাতে এই লোকেরা উপদেশ গ্রহণ করে। (সুরা দুখান, আয়াত ৫৮)
মওলানা সিন্ধি এই উদ্দেশ্যেই কোরআন নিয়ে চিন্তা-ফিকির বা গবেষণার ওপর জোর দেন, এবং তফসিরের মধ্যস্থতা গ্রহণের বদলে সরাসরি কোরআন বোঝার প্রতি আহ্বান জানান।
কোরআন বিষয়ক সেই বক্তৃতার দ্বিতীয় পর্বে মওলানা সিন্ধি হাদিসে বর্ণিত তফসির ও পরবর্তীকালে তাতে অপ্রাসঙ্গিক মতামত ঢুকিয়ে দেওয়ার কাহিনিও সবিস্তারে জানিয়েছেন। মূলত বেশ কিছু আয়াতের তফসিরে সাহাবায়ে কেরামের বক্তব্য প্রসিদ্ধ আছে। মওলানা সিন্ধি কাশফুজ জুনুন ও আল্লামা সুয়ুতির রেফারেন্সে একথা প্রমাণ করেন যে, তফসিরে এমন অনেক জাল বক্তব্য আছে যা সাহাবায়ে কেরামের নামে বর্ণিত হয়েছে। এই আলোচনা করতে গিয়ে মওলানা সিন্ধি আল্লামা সুয়ুতির এই বক্তব্য সামনে আনেন :
‘আমি غَيْرِ ٱلْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا ٱلضَّآلِّينَ (গইরিল মাগদু-বি আলাইহিম ওলাদ্দ-ল্লি-ন) আয়াতের দশটি ভিন্ন-ভিন্ন তফসির দেখেছি, অথচ আল্লাহর রসুল (স.) থেকে এই আয়াতের তফসিরে ইহুদি ও খ্রিষ্টান ছাড়া অন্য কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না।’
মওলানা সিন্ধি আমাদেরকে গ্রহণযোগ্য তফসিরের সাথে পরিচিত করার পাশাপাশি সেইসব তফসিরের কিতাবেরও গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন, যেগুলো ব্যক্তির খেয়ালখুশি-মাফিক তত্ত্ব দিয়ে সাজানো হয়েছে। কেউ কেউ তো কোরআনকে আরবি ব্যাকরণের সাথে যুক্ত করার প্রয়াস চালিয়েছেন, আবার কেউ কেউ কোরআনের সাথে জুড়ে দিয়েছেন যত্তসব আজব-গজব বিষয়।
تاویل بڑھ کے اقرب الکفر ہوگئ
کچھ نہیں ہے شیخ تیرے علم و فن سے دور
‘ব্যাখ্যা বাড়তে বাড়তে কাফেরদের চিন্তাভাবনার কাছাকাছি চলে গেছে। এ আর অন্যকিছু নয় শায়খ, কেবল আপনার এলেম ও বিষয়বস্তু থেকে দূরে সরে যাওয়ার পরিণতি।’
মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধির দাওয়াত কেবল এবং কেবলই কোরআনের প্রতি ফিরে আসার ছিল। মানে টীকাভাষ্য বাদ দিয়ে মূলভাষ্যের দিকে আসো।
জাতির উত্থান-পতন তাদের চিন্তা-ফিকির ও দৃষ্টিভঙ্গিকে কীভাবে প্রভাবিত করে তা বলতে গিয়ে শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি (রহ.)-এর এই উক্তি পেশ করেন :
امَا الْأَخْلَاقُ بِالْأَحْوَالِ لَا بِالْعُلُومِ
‘আখলাক-চরিত্র পরিবেশ থেকে তৈরি হয়, জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে না।’
মওলানা সিন্ধি কোরআনের তফসিরে মুসলমানদের উত্থান-পতনের ছাপ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। কতগুলো শব্দের পরিভাষা মুসলমানদের চারিত্রিক অধঃপতনের সাথে সাথে পালটে যাওয়ার বিষয়টি সামনে আনেন। বিশেষ করে ‘তাওয়াক্কুল’ ও ‘সবর’ শব্দ দুটি। কোরআনে বর্ণিত এই শব্দ দুটো মুসলমানদের অবস্থার পরিবর্তনের প্রভাবে সম্পূর্ণ কোরআনবিরোধী ধারণা নিয়ে মুসলিম সমাজে প্রচলিত হয়ে যায়।
কোরআনের অনেক শব্দের প্রকৃত মর্ম এই কারণেও পালটে গেছে যে, কোরআন কেবল তফসিরের মধ্যস্থতায় পড়ানো হয় এবং মাদরাসাগুলোতে মাত্র আড়াই পারার বিস্তারিত ব্যাখ্যা সিলেবাসভুক্ত করা হয়েছে। কোরআনের দৃষ্টিতে যে যে বিষয়গুলো অপরিহার্য, তার বেশিরভাগই আড়ালে-আবডালে থাকায় কোরআনের প্রকৃত তালিম ও দাওয়াত বন্ধ হয়ে গেছে। ইবনে খালদুন (রহ.) কোরআনকে কেবল পরকালে মুক্তির মাধ্যম বলেছিলেন। মওলানা সিন্ধির সময়কালে এই ধারণাই আকিদায় রূপ নিয়েছিল। মওলানা এবিষয়টি স্পষ্ট করেন যে, কোরআন ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে উন্নতি ও সম্মানের পথ দেখায়। কোরআন পরকালীন জীবনে মুক্তির জামিন, আবার ইহকালীন জীবনে সম্মানের উপায়ও। আমাদের পূর্ববর্তী আলেমগণ ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন এবং সম্মানের সাথে জীবনযাপন করতেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিলেন। এরকমভাবে বহু আলেম ব্যবসা করে সম্মানজনক উপায়ে রুজিরোজগার করতেন। ওইসব মহামনীষীদের প্রজ্ঞাময় কোরআন চিন্তা-ফিকিরের পথ গ্রহণের দাওয়াত দিয়েছিল, আর তারাও গ্রহণ করেছিলেন।
আমার ওস্তাদ শায়খুল কোরআন মওলানা মুহাম্মদ তাহের (রহ.) প্রায়ই বলতেন :
মুফতিদের উচিত ফতোয়া দেওয়াকে পেশা হিসেবে উল্লেখ করা। যদি তারা একে পেশা না বলে, এর মানে দাঁড়ায় তারা ধর্ম বেচে কামাই করছে। আর এই ক্ষেত্রে তাদের ফতোয়াও গ্রহণযোগ্য হবে না।
মওলানা সিন্ধি অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে গরিবানা জীবনযাপনের দাওয়াত দিতেন, একই সাথে দুনিয়াবিরাগী হওয়াকেও মন্দকাজ বলতেন। মওলানা সিন্ধি কেবল আয়াত আর হুকুম-আহকাম নিয়ে চিন্তা-ফিকিরের কথা বলতেন না, বরং পুরো কোরআন বোঝার দাওয়াত দিতেন। তিনি কোরআনের প্রতিটি শব্দকে হেদায়েত বলতেন, এবং তা নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করার কথা বলতেন।
কোরআন বিষয়ক প্রবন্ধের তৃতীয় পর্বে মওলানা সিন্ধি কোরআনে বর্ণিত কিসসা-কাহিনির গুরুত্বের দিকে চোখ বুলিয়েছেন। মহান শায়খ ইবনে আরাবি ‘ফুসুসুল হিকাম’ গ্রন্থে কোরআনের এইসব কিসসা-কাহিনির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি ‘তাবিলুল আহাদিস’ গ্রন্থে কোরআনে বর্ণিত কিসসা-কাহিনির নতুন ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন। মওলানা সিন্ধি এই কাজকে আরও প্রসারিত করেছেন এবং কোরআনের ফয়েজ পেতে ও জীবনকে তার জ্যোতিতে পূর্ণ করতে দাওয়াত দিয়েছেন।
মওলানা সিন্ধি এই কিতাবে একথাও স্পষ্ট করেন যে, কোরআন মানুষকে একটি আদর্শ সমাজব্যবস্থার ধারণা দেয়। শাহ আবদুল আজিজ দেহলবি (রহ.) هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ (হুদাল্লিল মুত্তাকিন)-এর তফসিরে বলেন :
কেউ যদি বলে—‘এই যুবককে অমুক দাই মা দুধ পান করিয়েছেন’, এর মানে এই দাই মা’র দুধের কারণে ওই যুবক পরিপুষ্ট হয়েছে। ঠিক সেভাবেই বলা যায়, কোরআনের দুগ্ধ মানুষকে মুত্তাকিরূপে পরিপুষ্ট বানায়।
মওলানা সিন্ধি তার ‘ইলহামুর রহমান’ কিতাবে মুত্তাকির সংজ্ঞায় বলেন :
যিনি সৎকাজে আদেশ, অসৎকাজে নিষেধ ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেন, তাকে মুত্তাকি বলে।
মওলানা সিন্ধি এই সংজ্ঞা কোরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকেই গ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহ পাক বলেন :
اِعْدِلُوْا هُوَ اَقْرَبُ لِلتَّقْوٰى
তোমরা ইনসাফ কায়েম করো, ওটাই তাকওয়ার সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থান। (সুরা মায়িদা, আয়াত ৮)
মওলানা সিন্ধি তার এই বক্তৃতায় বিভিন্ন আয়াত ও হাদিস দিয়ে মুসলিম ক্যারেক্টার ও মুত্তাকি ক্যারেক্টারে পার্থক্য দেখিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে মওলানা মুসলিমদের থেকে হারিয়ে যাওয়া চরিত্রের খোঁজ করতেন। আল্লামা ইকবাল বলেন :
میں کہ مری غزل میں ہے آتش رفتہ کا سراغ
میری تمام سرگذشت کھوئے ہوؤں کی جستجو
আমার আহাজারিতে পাবে তুমি সেই নিভে যাওয়া আগুনের ধোঁয়া,
আমার গোটা জীবনসফর কেটেছে সেই ‘হারিয়ে যাওয়ার’ সন্ধানে।
মওলানা সিন্ধিও তার সন্ধানে ছিলেন। কোরআন বিষয়ক তার বক্তৃতার চতুর্থ পর্বে মওলানা সিন্ধি কোরআন থেকে মুসলমানদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণ হিসেবে অনারবদের ষড়যন্ত্রকে দায়ী করেছেন। আল্লামা ইকবাল তো সারাজীবনই অনারবদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝেড়েছেন, কিন্তু মওলানা সিন্ধি এমন বক্তব্য কেবল এখানেই দিয়েছেন, অন্য কোথাও নয়। ইকবাল তো একথা পর্যন্ত বলেছেন :
تمدن تصوف شریعت کلام
بتان عجم کے پجاری تمام
তমদ্দুন তাসাওউফ শরিয়ত ও কালাম
অনারবের অপব্যাখ্যা সব করেছে সাবাড়
কিন্তু বাস্তবতা এর একদম উল্টোটা। আরবরা ইসলামের দাওয়াত আরবের বাইরে ছড়িয়েছে, অনারবরাও তাদের সর্বোচ্চ যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে ইসলামের প্রচার-প্রসার চালিয়েছে। অনারবদের অপরাধী বানানো কিংবা তারা ইসলামে অনারব সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটিয়ে ইসলামকে ভিন্নদিকে প্রবাহিত করেছে বলে যে অভিযোগ হানা হয়, তার কোনো বাস্তবভিত্তি নাই। অন্যদিকে ইসলামে যেভাবে আরব সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে, এবং যা নিয়ে রীতিমতো গর্ব করা হয়, সেটাই বরং আমাদের চিন্তার কারণ হওয়া উচিত। এমনকি ইসলামকে আরব কালচারের সাথে একাকার ধারণা আমাদের আকিদার অংশও বানিয়ে নেওয়া হয়েছে। বলে হচ্ছে :
الدعاء في العربية أسرع في الإجابة
আরবিতে দোয়া করলে সেই দোয়া দ্রুত কবুল হয়।
মওলানা সিন্ধি জীবনের শেষদিকে আরব সংস্কৃতি আর ইসলামকে আলাদা করে ফেলেন। ইসলাম ও আরবকে এক করে ফেলার বেদআত মুহাম্মদ বিন ইসহাকের আমলে শুরু হয়েছিল, বাকিরা কেবল কপির ওপর কপি করেছে। বর্তমানে তো তথাকথিত ‘আসল ইসলামের’ দাবিদারদের কাছে আরব সাজা রীতিমতো গর্বের বিষয়।
১৯১৪ সালের কোরআন বিষয়ক সেই বক্তৃতাটি যখন আমি বই আকারে পাই, আমি পড়ে ভীষণ অবাক হই। আশ্চর্যজনকভাবে এই বইয়ে উল্লিখিত চিন্তাভাবনা মওলানা সিন্ধির জীবনের শেষদিকের চিন্তাভাবনার সাথেও মিল রাখে। দু-চারটা কথায় ভুল থাকা কিংবা মতপার্থক্য তৈরি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। আসল কথা হলো মওলানা সিন্ধির সাথে তার ওস্তাদ ও গুরুদের সাথে খুব গভীর সম্পর্ক ছিল, এই কারণে তার চিন্তাভাবনা ভাসাভাসা ক্ষেত্রের দিকে যায়নি, বরং গিয়েছে মৌলিক ক্ষেত্রগুলোয়। তার চিন্তায় বারবার পরিবর্তন আসার বদলে গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে।
মওলানা সিন্ধি শেষজীবনে ‘হুরুফে মুকাত্তাআত’ ও ‘মুতাশাবিহাত’-এর প্রতি গভীর মনোযোগের আহ্বান করেছেন এবং কোরআনের ‘মানসুখুত তিলাওয়াত’ অস্বীকার করেছেন। [খুব সম্ভবত মানসুখ আয়াতের হুকুম জারি থাকার ধারণা অস্বীকার করেছেন।] মওলানা সিন্ধির জমানায় এই দুটো বিষয়ই ছিল বৈপ্লবিক। তিনি যখন এ দুটো বিষয় নিয়ে আলাপ তুলেছেন, তখন তার বসবাস ছিল মক্কায়। মক্কার ওলামায়ে কেরাম তার এই বক্তব্যে খুবই অসন্তুষ্ট হন, কিন্তু তিনি যখন ‘মুতাশাবিহাত’ বিষয়ে ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.)-এর বক্তব্য দেখান, তখন তারা মেনে নেন।
মওলানা সিন্ধি কোরআনের সমঝদারির সিলসিলায় এমন এক পথ দেখান—যা নতুন বটে, কিন্তু কোরআনবিরোধী নয়। তিনি শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি (রহ.)-এর চিন্তাদর্শনের আলোকে সামনে এগিয়েছেন। এখন তারই বক্তব্য দোহরিয়ে লোকজন পণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে, ‘চিন্তাবিদ’ খেতাব লাগাচ্ছে। জনৈক তথাকথিত ইসলামি চিন্তাবিদ তো কোরআনের ত্রিশ পারার তফসিরে জায়গায় জায়গায় মওলানা সিন্ধির বক্তব্য রিপিট করেছে, কিন্তু তার স্বীকৃতি দেয়নি।
মওলানা সিন্ধি কোরআনের সমঝদারির জন্য যে মূলনীতি তৈরি করেছেন, তা ছাত্রদের জন্য খুবই সহজ হবে। আমার ওস্তাদ শায়খুল কোরআন মাওলানা মুহাম্মদ তাহের (রহ.) ‘আল ইরফান’ কিতাবে মওলানা সিন্ধির মূলনীতির সাথে মওলানা হুসাইন আলির মূলনীতি মিলিয়ে নতুন এক ধারা তৈরি করেন।
আজকাল যেখানেই কোরআন নিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ করতে দেখা যায়, সেখানেই মওলানা সিন্ধির চিন্তাদর্শন ও গবেষণা পদ্ধতির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। সত্যি বলতে যে শিশিরের ছোঁয়ায় বাগিচার ফুলকলিরা নতুন জীবন পেয়েছে, মওলানা সিন্ধি হলেন সেই শিশির। আল্লামা ইকবাল বলেন :
شبنم افشانی مری پیدا کرے گی سوز و ساز
اس چمن کی ہر کلی درد آشنا بن جائے گی
আমার শিশিরের স্পর্শ সৃষ্টি করবে সুখ-দুঃখের জীবনতরঙ্গ
এই বাগানের ফুলকলিরা সব দেবে আমার ব্যথায় সঙ্গ
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে দুনিয়া ও আখেরাতে সৌভাগ্যশীল করুন। আমিন।
৬ মে ১৯৯৭