ত্বাহা আব্দুর রহমান। মরোক্কান দার্শনিক। মুসলিম দুনিয়াতেই কেবল নয়; বরং ইতোমধ্যে পশ্চিমা একাডেমিয়াতেও তিনি বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন। তুরাস (ঐতিহ্য), আধুনিকতা, দর্শন, রাজনীতি ও আখলাক ইত্যাদি নিয়ে তাঁর পাঠ ও চিন্তার মৌলিকত্ব অনস্বীকার্য। জ্ঞান ও চিন্তার এসব ময়দানে তিনি সমান্তরালভাবে ভুমিকা রেখেছেন। ত্বাহা আবদুর রহমান ১৯৪৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন ‘জাদিদাহ’ শহরে। রিবাতের ‘জামিআ মুহাম্মদ আল খামিছ‘ থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে ‘সারবোন’ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘দর্শন শাস্ত্রের’ ওপর গ্রাজুয়েট লাভ করেন। তাঁর আগ্রহের বিষয় ছিল দর্শন। শিক্ষকতা জীবনে তিনি ‘জামিআ মুহাম্মদ আল খামিছে‘ ‘ভাষা–দর্শন ও যুক্তিবিদ্যার’ পাঠাদানে নিয়োজিত ছিলেন, ১৯৭০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত। এছাড়াও তিনি ছিলেন ‘আল জামইয়্যাতুল আলামিইয়্যা লিদ দিরাসাতিল হিজাজিইয়্যা’র গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ও মরক্কো প্রতিনিধি।—অনুবাদক
সাধারণত এ ধরনের শিরোনাম সকল ক্ষেত্রে চিন্তাগত প্রশ্নের দুয়ার খুলে দেয়। কিন্তু প্রজ্ঞার দাবি হচ্ছে, আপনি কেবল দরকারি প্রশ্নের বৃত্তেই থেমে যাবেন। এতে আপনার প্রজ্ঞাপূর্ণ অবস্থান তৈরি হবে, আপনি অ-স্থির হবেন না। অন্যরাও আপনাকে ভ্রষ্টাচারী ভাববে না। আমরা বাস্তব প্রশ্নের নিশানা ধরে হাঁটতে চেয়েছি। সদালাপী মাত্রই তা স্বীকার করবে, মানুষের কর্ম ও আচরণ পরিপূর্ণ মুক্ত-স্বাধীন হতে পারে না, আসলে মুক্ত-স্বাধীন কোনো মানুষই নেই। থাকলে সে প্রভুর অবস্থানে চলে যেতো। ফলে বাকস্বাধীনতা কখনও পরিপূর্ণ বাঁধমুক্ত থাকে না যে, যেখানে যা খুশি বলা যাবে।
তবে ব্যতিক্রম আছে, প্রাচ্য-পশ্চিমের অনেকেই বাকস্বাধীনতা যে অসীম নয় তা মেনে নিলেও, এটার সসীমতা স্বীকার করতে রাজি না। তাদের ধারণায় নিয়ন্ত্রিত হলে স্বাধীন হওয়া যায় না। অন্যদিকে ‘ভিন্নচিন্তার অধিকার অবাধ নয়’ এ কথা মেনে নিলেও অধিকারকে সীমায়িত করতে রাজি না। তাদের ধারণা অধিকারকে নিয়ন্ত্রিত করলে সেটি আর অধিকার থাকে না। অথচ আপনি যখন ‘অসীম নয়, অবাধ নয়’ বলছেন, তখন এর সসীমতা ও সীমাবদ্ধতা মেনে নেওয়া জরুরি। তবে তারা যদি অসীমতা ও সসীমতার মাঝামাঝি কোনো অবস্থান তৈরি করতে পারেন, বাকস্বাধীনতাকে সে হিসেবে চর্চা করার এখতিয়ার তাদের আছে। সেটা তো সম্ভব নয়।
তাদের এই অবস্থান যুক্তিবিদ্যার (মানতেক) প্রেক্ষিতে যথার্থ নয়। কেননা অসীম নয়, এমন প্রত্যেক বস্তুই নিয়ন্ত্রিত। এতটুকু সংবেদন তো রাখাই যায়, যখন দায়িত্বের তুলনায় অধিকারের প্রতি মনোযোগ বাড়ছে, কর্তব্যের তুলনায় বাড়ছে স্বাধীনতার দাবি। অথচ দায়িত্ব-কর্তব্য ছাড়া অধিকার ও স্বাধীনতার প্রশ্নই আসে না। ফলে আমরা নিয়ন্ত্রিত শব্দের বদলে অভিন্ন-অর্থের আরেকটি শব্দ বেছে নিতে চাচ্ছি, যাতে এর মন্দভাব দূর করা যায়। শব্দটি হচ্ছে সুশৃঙ্খল-বিন্যাস (তাহজিব); বাকস্বাধীনতার নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে আমরা বলব ‘বাকস্বাধীনতার সুশৃঙ্খল-বিন্যাস’। ভিন্নচিন্তা-নিয়ন্ত্রণ-এর বদলে বলা হবে ‘ভিন্নচিন্তার সুশৃঙ্খল-বিন্যাস’।
এই শব্দ-বদলের বিশেষ তাৎপর্য আছে; এর ফলে আমরা বেশকিছু বাস্তব সত্যের মুখোমুখি হবো— প্রথমত, বাকস্বাধীনতা এবং ভিন্নচিন্তার সৃশৃঙ্খল-বিন্যাসে আখলাকের প্রতিফলন ঘটবে। আখলাকের বৈশিষ্ট্যেই মানুষ প্রকৃত-মানুষ হয়ে ওঠে। ব্যক্তি যখন নৈতিক/আখলাকি মুল্যবোধের চর্চা করবে না, তখন সে মনুষ্যত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
দ্বিতীয়ত, বাকস্বাধীনতা ও ভিন্নচিন্তায় বিশৃঙ্খলা-ই একধরনের নৈতিক-বিপর্যয়, যা মনুষ্যত্বের দাবির পরিপূরক না। এর ফলে ব্যক্তি পশুতুল্য হয়ে যায়। তৃতীয়ত, ভিন্নচিন্তার অধিকার ও বাকস্বাধীনতার যে প্রস্তাব তোলা হচ্ছে, সেটিও কিন্তু পুরোপুরি শর্ত ও নিয়ন্ত্রণহীন না। নতুবা সে অর্থে বাক-স্বাধীনতা চাওয়ার মানে হচ্ছে আখলাক-নীতি-নৈতিকতার শর্ত ও নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হতে চাওয়া। দ্বীন-ইসলাম এবং নবির নামে কটূক্তি হলেও কিছু বলা যাবে না, প্রতিবাদ করা যাবে না, এমন দাঁড়াচ্ছে ব্যাপারটা। এনলাইটেনমেন্টের আমল থেকেই আখলাক বুদ্ধির জন্য জরুরি শর্ত হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। চেরাগায়িত লোকের কাছে সবচেয়ে অপ্রীতিকর চিত্র হচ্ছে— কেউ তাকে ওয়াজ-নসিহত করছে, সে শুনছে।
ভিন্নচিন্তার অধিকার ও বাকস্বাধীনতাকে আমরা পুরোপুরি অনিয়ন্ত্রিত মনে করি না। অধিকার হয়তো সৃশৃঙ্খলভাবে বিন্যস্ত হবে নতুবা হবে অস্থির ও গোলযোগপূর্ণ— এ দুয়ের মধ্যে আমরা যেহেতু প্রথমটির পক্ষে, সুতরাং কোনো ধরনের প্রশ্ন তোলা যাবে, কথা বলার অধিকার কতটুকু থাকবে কতটুকু থাকবে না, তা নির্দিষ্ট। স্বাধীনতা ও অধিকারের প্রশ্নে কোনো কোনো নৈতিক-শর্তের উপস্থিতি জরুরি, এসব শর্ত কেন অন্যরা স্বীকার করতে চায় না, চাইলেও কেন জরুরি মনে করে না কিংবা জরুরি মনে না করলে এসব শর্ত তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ আছে কি না, এসব বিষয়ে বাতচিত করা আমাদের তরফ থেকে জরুরি। পাশাপাশি কোনো ধরনের রাজনৈতিক বা আইনি শর্ত থাকতে পারে কি না, থাকলে সেই শর্তভঙ্গের শাস্তি কী হবে, নাকি এটি ক্ষমাযোগ্য বিষয়। শাস্তি ও ক্ষমার মানদণ্ড কী হবে, নিজের এবং ক্ষমতাবানের বেলায় ক্ষমা দুর্বল বা অন্যের বেলায় শাস্তি, এমন কিছু নাকি সুনির্দিষ্ট ও জরুরি কোনো নীতিমালা আছে?
আমাদের আরও ভাবতে হবে, রাজনৈতিক ও আইনি-শর্ত ভঙ্গ হলেই কেন আইনবিভাগ বিচারের কথা বলেন, নৈতিক-শর্ত-ভঙ্গের বেলায় কেন বলেন না। অথচ নৈতিক অবক্ষয়ের ফলেই মানুষ রাজনৈতিক ও আইনি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে। তাছাড়া রাজনৈতিক ও আইনি-শর্তগুলো তো প্রকৃত অর্থে নৈতিক শর্ত, যদিও তা থেকে নৈতিকতার ছাপ মুছে ফেলা হচ্ছে। ব্যক্তি ও সমাজজীবনে বিপর্যয়ের শঙ্কা সত্ত্বেও আইনপ্রণেতাগণ কেন নৈতিক-শর্তভঙ্গ হলে শাস্তির ব্যবস্থা রাখেন না?
অধিকার এবং স্বাধীনতার পারস্পরিক সম্পর্কের রসায়ন কী ধরনের— মুক্তচিন্তা ও বাকস্বাধীনতার মতো ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ নাকি বাকস্বাধীনতা ও প্রাইভেসির মতো ‘দ্বান্দ্বিক’, নাকি একদিক থেকে দ্বন্দ্ব অন্যদিকে সাজুয্য? যে ব্যক্তি স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করল, সে তো একইসাথে মুক্তচিন্তাও করেছে, কেননা স্বাধীনভাবে বলার আগে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে হয়েছে। কেউ বাকস্বাধীনতার অপব্যবহার করলে অন্যের ভিন্নচিন্তার সুযোগ থাকবে কি? যদি মতপ্রকাশে স্বাধীন লোকটি ভিন্নচিন্তার কারণে বিব্রত হন, তার কি উচিত নয় নিজের স্বাধীনতা-বোধকে বিন্যস্ত করা, নিজের স্বাধীনতা ও অন্যের অধিকারের মাঝে সমন্বয় ঘটানো?
শেষোক্ত প্রশ্নসমূহের আলোকে পশ্চিম এবং মুসলিমদের দ্বন্দ্ব-দ্বৈরথের রসায়ন পষ্ট বুঝে আসবে। মূলত পশ্চিমের বাকস্বাধীনতা এবং মুসলিমদের ভিন্নচিন্তার অধিকার—এ দুয়ের মাঝেই যাবতীয় দ্বন্দ্ব ঘুরাপাক খাচ্ছে। মতপ্রকাশের মতো দ্বীন (ধর্ম) সম্পর্কেও মুসলিমদের রয়েছে একান্ত নিজস্ব বোধ ও অনুভূতি; ধর্মের সাথে পশ্চিমের সম্পর্ক পুরোপুরি দ্বীনের সঙ্গে মুসলিমদের সম্পর্ক থেকে আলাদা। পশ্চিম যেভাবে ধর্মকে দেখে মুসলিম কিন্তু সেভাবে দেখে না। দ্বীনের সঙ্গে মুসলিমের সম্পর্ক আত্মার চেয়েই ঘনিষ্ঠ। অথচ পশ্চিমা ধারণায় ধর্মের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করার কিছু নেই। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও মানবাধিকার প্রসঙ্গে পশ্চিম যা কিছু জরুরী মনে করে, কমপক্ষে ইসলামের বেলায় তা বিবেচনা করা উচিত। কেননা মুসলিম নিজের তুলনায় দ্বীনের প্রতি বেশি শ্রদ্ধাশীল। এমনিভাবে মুসলিম সমাজ বাকস্বাধীনতাকে যেভাবে দেখে পশ্চিম কিন্তু সেভাবে দেখে না। তারা কাজের জায়গায় মতামতকে প্রতিস্থাপিত করে। ফলে ‘মতপ্রকাশ’ যেন তাদের দৃষ্টিতে ‘পরিবর্তনের স্বাধীনতা’র সমপর্যায়ের। যে মতপ্রকাশ করল সে পরিবর্তনের পদক্ষেপ নিল। খেয়াল করলে দেখবেন, বাকস্বাধীনতার মতো ‘কর্মের স্বাধীনতা’ কিংবা ‘পরিবর্তনের স্বাধীনতা’ নামে কিছুই নেই তাদের চিন্তা-বিশ্বাসে।
স্বাধীনতাকে সুশৃঙ্খল-বিন্যাসে সাজানোর দায়িত্ব যদি তারা পালন করত, তবে তারা ব্যঙ্গচিত্র-নির্মাণের প্রতিযোগিতায় মত্ত হতো না। উদ্ভট দলিল পেশ করত না। ব্যঙ্গচিত্র আর উদ্ভট প্রমানাদি আপনি মুসলিমদের চর্চা করতে দেখবেন না। কারণ ইসলাম কথা ও দ্বীনচর্চায় রুচিশীলতাকে জরুরি মনে করে। সন্দেহ নেই যে, আমাদের দ্বীন, নবি, ইতিহাস ও আমাদের লোকদের উপর অনবরত আক্রমণ হচ্ছে, সীমালঙ্গন হচ্ছে। গভীর ও বিস্তৃত পরিসরে হচ্ছে। শক্তিমানের ভক্তি এবং দাসত্বের মুগ্ধতা নিয়ে মুসলিমজাতির সন্তানেরা স্বজাতির বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ছে। প্রতিপক্ষ কেবল তার ইরাদা দিয়েই রাজ করছে এমন নয়, বরং আমরা যাদের সময়ের সন্তান মনে করি, নিজেদের গতিপথ বিন্যস্ত করবার জন্য তাদের সামনে কোনো কেবলা নেই, নেই কোনো কেন্দ্রীয় অভিমুখ। ফলে সে তার দাসত্বের জন্য, খাহেশাতের বশে কিছু ভগবান বানিয়ে নিয়েছে। এজন্য মুসলিম সমাজের উপর অবধারিত হয়ে গেছে নিজেদের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক করণীয় নির্ধারণ করা।
দলছুট ও কেবলাহীন এসব সন্তানদের সাথে আমরা যদি প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ করি, সে পুরোপুরি বখে যাবে, কেবলা থেকে আরো বিভ্রান্ত হয়ে যাবে। খাহেশাতের আরো গভীরে নিমজ্জিত হবে। আমাদের বরং হেকিম বা চিকিৎসকের ভুমিকায় আসতে হবে। তার খাহেশাত নির্ণয় করে, সংক্রামক ক্ষতিগুলোর প্রতি সচেতন করে নীড়ে ফেরার প্রস্তাব রাখতে হবে। কেবলাহীনতা, উদ্দেশ্যহীন মনোভাব কীভাবে বিশ্বব্যাপী আখলাকি সংকট তৈরি করছে, যার মোকাবেলা করতে হচ্ছে, সকলের সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা করতে হচ্ছে। প্রচেষ্টা বাস্তবায়নের জন্য দুটি শর্ত অবশ্যই পূরণ করতে হবে— এক. বুদ্ধিবৃত্তিক রসদ জোগাড় করতে অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হবে। তবে অন্যদের মতো খাহেশাতে পড়ে কেবলাহীন হলে হবে না। দুই. আমাদের আখলাকি-মুল্যবোধ বিশ্বের সামনে তুলে ধরব, দৃষ্টি আকর্ষণ করব। একটি সমন্বিত ও সুবিন্যস্ত মুল্যবোধের প্রস্তাব রাখব, এ সুবাদে দুটি মাধ্যম প্রয়োগ করা যেতে পারে—প্রথম মাধ্যম, সুপ্রতিষ্ঠিত প্রমাণ-পদ্ধতির ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র জ্ঞানতাত্ত্বিক ও যৌক্তিক প্রমানসমৃদ্ধ উপস্থাপনাই যথেষ্ট নয়, মুসলিমের উপস্থাপনে ঠাট্টা, বিদ্রুপ এবং কষ্টদায়ক কিছু থাকা যাবে না। বরং মৌলিক টেক্সট এবং ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজে বুদ্ধির প্রয়োগ ঘটাতে হবে।
দ্বিতীয় মাধ্যম, সার্বজনীন আখলাকি-ব্যবস্থা নির্মাণ; মুসলিমের জন্য কেবল এতটুকুই যথেষ্ঠ নয় যে, আপনি প্রতিপক্ষের সমন্বয়ে একটি মানবিক-নৈতিকতা নিশ্চিত করবেন। বরং বৈশ্বিক মুল্যবোধের পাটাতন তৈরির জন্য তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক প্রচেষ্টা জারি রাখতে হবে। যেন বিদ্রুপকারী প্রতিপক্ষও বাধ্য হয়ে যায় আমাদের মুল্যবোধ কবুল করতে।
গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা