ভাষার ঔপনিবেশিকতা

নাদিউজ্জামান রিজভী

ক্ষমতা মানুষের বুনিয়াদি প্রবৃত্তির অন্যতম অংশ। ক্ষমতার নেশা মানুষকে তাড়িত করে। অর্থ কিংবা খ্যাতির বিড়ম্বনায় মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে মূলত ক্ষমতা অর্জনেরই নেশায়। ক্ষমতা একটি শক্তিশালী অস্ত্র। এজন্য ক্ষমতা বিপথে গেলে বিপত্তি বিশাল, যা এড়িয়ে যাওয়া যায় না! কুক্ষিগত-ক্ষমতা জুলুম ও নিপীড়নের পথ খুলে দেয়। এজন্য ক্ষমতার সুষম বণ্টন জরুরি। দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল ১৯৩৮ সালে ক্ষমতা নিয়ে একটি বই রচনা করেন, যার নাম Power: A New Social Analysis । সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, ক্ষমতা সামাজিক সম্পর্কগুলো বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। তিনি দেখিয়েছেন, ক্ষমতা কীভাবে প্রতিষ্ঠান, সরকার, এবং সামাজিক আধিপত্যের পরম্পরাকে প্রভাবিত করে। নোয়াম চমস্কির এখানে বিস্তারিত ও গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ রয়েছে। তার মতে, ক্ষমতা সাধারণত হেজিমনি গ্রুপের হাতে কুক্ষিগত হয়ে যায়, যার মধ্যে বড় বড় কর্পোরেশন, সরকার, এবং মিডিয়া অন্তর্ভুক্ত। তিনি তার বই Hegemony or Survival: America’s Quest for Global Dominance এ দেখিয়েছেন যে, হেজিমনি গ্রুপ ক্ষমতার মূল মসনদে বসে কলকাঠি নাড়তে থাকে এবং জনগণের চাওয়া-পাওয়াকে অবদমিত করে; সীমিত পরিসরে ক্ষমতা চর্চার মধ্য দিয়ে জনগণকে মোহবন্ধ করে রাখে। এভাবে তারা জনগণকে ধোঁয়াশার মধ্যে রাখে এবং নিজেরা প্রকৃত ক্ষমতার স্বাদ উপভোগ করতে থাকে। ক্ষমতাশীলদের এই চালচলন নতুন নয়; অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত সর্বদাই ক্ষমতাবানদের হাতে এভাবেই জাতির অস্তিত্ব ও প্রকৃতি কম্প্রোমাইজড হয়ে এসেছে।

ক্ষমতা সাধারণত দুটি প্রধান উপায়ে কেন্দ্রীভূত হয়—বাহ্যিক কাঠামো এবং অভ্যন্তরীণ উপাদান। বাহ্যিক কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত থাকে রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, কর্পোরেশন, মিডিয়া, এবং অন্যান্য সামাজিক সংস্থা। এই কাঠামোগুলো একত্রে ক্ষমতা প্রয়োগ করে বৃহৎ সমাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। অপরদিকে, অভ্যন্তরীণ উপাদান হলো ভাষা, সংস্কৃতি, শিল্প, সাহিত্য এবং ধর্ম, যা মানুষের মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এসব উপাদানকে ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মানুষকে একপ্রকার মানসিক দাসত্বে বন্দী রাখা হয়। এভাবেই ভেতরে-বাহিরে ক্ষমতার ভিত্তি মজবুত হয়। ক্ষমতার পরিবর্তনে স্থানীয়দের জীবনাচারে পরিবর্তন আসাটা অস্বাভাবিক নয়। ক্ষমতা এভাবেই ফাংশন করে। এবং মানুষের প্রবৃত্তিও ক্ষমতার দিকে ঝুঁকে থাকে। মক্কা বিজয়ের পর বিনা যুদ্ধে আরব বিশ্বে ইসলাম কায়েম হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা মানুষের ক্ষমতার দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতাকেই নির্দেশ করে।

কিন্তু ঝুঁকে পড়া এবং ঝুঁকিয়ে দেয়ার মধ্যে শব্দগত পার্থক্য যেমন রয়েছে, তেমনিভাবে ক্ষমতাবানদের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক আনুগত্য অন্যদিকে বলপ্রয়োগে আনুগত্যশীল বানানো উভয়ের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। আমাদের উপমহাদেশে বহুবার পাওয়ার শিফট হয়েছে। কখনো আর্যরা এসেছে, মুসলমানরা এসেছে, আফগান-পাঠানসহ ইউরোপীয় নানান ঔপনিবেশিক শক্তি এখানে এসে ভীড় করেছে। পাওয়ার প্রাকটিসের মাধ্যমে এখানকার মানুষদের জীবন ও সংস্কৃতিকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। এ প্রক্রিয়ার মধ্যে স্বস্তঃস্ফূর্ত এবং বলপ্রয়োগ উভয় ব্যাপারই ছিল; বলপ্রয়োগ সকলের দ্বারাই কম-বেশি চর্চিত হয়েছে। কিন্তু এখানকার মানুষের জীবনবোধ, ধর্ম, শিল্প-সংস্কৃতি, ভাষাকে সবচেয়ে বেশি কম্প্রোমাইজড হতে হয়েছে বিট্রিশ শাসনে এসে। তারা ভারতীয়দের অস্তিত্বকেই উল্টেপাল্টে দিয়েছে। ভারতীয় জনজীবনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রকে তারা বলপ্রয়োগে-কৌশলে প্রভাবিত করেছে। সুলতানী আমলে কিংবা মুঘল আমলে উপমহাদেশের মানুষ যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি একদমই হয়নি। 

ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের বাহ্যিক নমুনা

ঔপনিবেশিক শক্তির আগ্রাসনের ইতিহাস সুদীর্ঘ। ব্রিটিশদের আগ্রাসনে সৃষ্ট ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে (১৭৭০) কয়েক মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর হয়। তারা গরীব কৃষকদের উপর উচ্চকর আরোপ করে নীল এবং আফিম চাষে বাধ্য করত। ভারতীয়দের জীবনের কোনো মূল্যই তাদের কাছে ছিল না! ব্রিটিশ প্রশাসন খাদ্যের সংকট থাকা সত্ত্বেও চাল রপ্তানি অব্যাহত রেখেছিল। প্রায় এক কোটি মানুষের মৃত্যুর পরও কোম্পানির রাজস্ব সংগ্রহে কোনো কমতি ছিল না।

কঙ্গোবাসীদের সাথে কী করা হয়েছিল, পৃথিবী আজও তা ভোলেনি। বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপল্ড কঙ্গো ফ্রি স্টেট এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। কঙ্গো ফ্রি স্টেট ছিল তার নিজের উদ্যোগে পরিচালিত একটি ব্যক্তিগত প্রকল্প। সেখানে তিনি নির্মম শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন এবং কঙ্গো অধিবাসীদের রাবার চাষ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে বাধ্য করেছিলেন। তার শাসন এতটাই নির্মম ছিল যে, রাবার সংগ্রহের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হলে মানুষকে বিকলাঙ্গ করে দেয়া হতো। হাত কেটে দেয়া ছিল অতি সাধারণ শাস্তি। জনসংহারও ঘটত। তাদের এই নির্মম অত্যাচারে প্রায় দশ মিলিয়ন কঙ্গোবাসী মৃত্যুবরণ করে। মর্মান্তিক!

হেরেরো এবং নামা গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে আরো একটি জঘন্য অধ্যায়। ১৯০৪ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত জার্মান বাহিনী এই গণহত্যা চালায়। তাতে হেরেরো জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮০% এবং নামা জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫০% মানুষ নির্মূল করা হয়। মরুভূমিতে মৃত্যুর জন্য ফেলে দেওয়ার পাশাপাশি, অনেককে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পেও বন্দি রাখা হয়েছিল, যেখানে তাদের উপর পাশবিক নির্যাতন করা হতো। জার্মান কর্মকর্তারা গোলাবারুদ বাঁচাতে কঙ্গোবাসীদের মরুভূমিতে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়; খাদ্য-জলের অভাবে মরূভূমির বিরূপ পরিবেশে ধুঁকে ধুঁকে মরার জন্য তাদের ফেলে রাখা হয়।

নির্লজ্জ ঔপনিবেশিকরা মাদকের চোরাচালানের জন্যও যুদ্ধ করেছে। ভারতে ব্রিটিশনিয়ন্ত্রিত আফিম বাণিজ্যকে পৃষ্ঠপোষণ করার জন্য ব্রিটেন চীনকে তার বন্দরগুলো খুলে দেয়ার জন্য বাধ্য করতে থাকে। কিন্তু চীনে আফিম আসক্তির মাত্রা প্রবলভাবে বেড়ে গিয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। চীন আফিম বাণিজ্য বন্ধের চেষ্টা করলে ব্রিটিশরা দুইবার যুদ্ধে পর্যন্ত নিপতিত হয়, ১৮৩৯-৪২ এবং ১৮৫৬-৬০ সালে। মাদক রপ্তানির জন্য যারা যুদ্ধ করতে পারে, তারা নিজেদের সভ্য কীভাবে দাবি করতে পারে? এছাড়াও তাসমানিয়াতে গণহত্যা এবং অমৃতসর গণহত্যার ঘটনাগুলো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক দমননীতির উজ্জ্বল উদাহরণ।

আঠার শতকের প্রথমার্ধে নবাবি শাসনের বাংলা অঞ্চল আর্থিকভাবে সচল ও সমৃদ্ধ ছিল। কোম্পানি শাসনের তিন দশকের মধ্যে শুধু এই সমৃদ্ধি নষ্ট হয়নি, অর্থনৈতিক গতি ও প্রবাহ ধ্বংস হয়ে এই অঞ্চল নজিরবিহীন দুর্দশায় পতিত হয়। অধিক হারে রাজস্ব আদায়, একচেটিয়া বাণিজ্য কায়েম, দেশি শিল্প ধ্বংস এবং অর্থপাচারই এই দুরবস্থার কারণ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পলাশি-উত্তর কর্মকাণ্ডকে  বিট্রিশ পার্লামেন্ট ও ঐতিহাসিকগণ নাম দিয়েছেন ‘Plassey Plunder.’ (বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন ও রবীন্দ্রনাথ, মুহাম্মদ আজম, পৃ. ৪৯) হিটলারের গ্যাস চেম্বারে যতজন ইহুদি মারা গেছে, তার চেয়েও বেশি ভারতীয় মারা গেছে চার্চিলের পলিসির কারণে। অথচ, চার্চিলকে ওয়ারহিরো হিসেবে বিশ্বে চিহ্নিত করা হয়।

প্রাক-ঔপনিবেশিক বিশ্ব

ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোকে গরীব, অসভ্য হিসেবে চিত্রায়নে অভ্যস্ত যদিও প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগে এসব অঞ্চলের নিজস্ব সমৃদ্ধ ইতিহাস ছিল, শক্তিশালী বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক ছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের সময় ভারত বিশেষ করে বস্ত্রশিল্প, কৃষি এবং ধাতব শিল্পে যথেষ্ট উন্নতি অর্জন করেছিল। বাংলার বস্ত্র ছিল জগৎবিখ্যাত। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে মুঘল সাম্রাজ্য শিল্প, স্থাপত্য এবং শিক্ষাকে পৃষ্ঠপোষণকারী বিশ্বের অন্যতম উৎপাদনশীল অর্থনীতির প্রতিনিধিত্ব লাভ করেছিল।

চীনের মিং সাম্রাজ্যে নগরায়ণ ও বাণিজ্যিক উন্নতি ঘটেছিল। সিল্ক রোডের মাধ্যমে চীন, মধ্য এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শ্রীবিজয়া ও মাজাপাহিত সাম্রাজ্য মালয় দ্বীপপুঞ্জে মশলা, সোনা এবং অন্যান্য সামগ্রী বাণিজ্য করে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। পশ্চিম আফ্রিকায় মালির সম্রাট মানসা মুসার শাসনকালে এই অঞ্চলে সোনা ও লবণের বাণিজ্যে সমৃদ্ধি আসে এবং টিম্বুকটু বিদ্যাচর্চার প্রাণকেন্দ্র পরিণত হয়। পূর্ব আফ্রিকার সোয়াহিলি শহরগুলো আরব, এশিয়া এবং আফ্রিকার বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল। সোনা, হাতির দাঁত এবং অন্যান্য দ্রব্যের বাণিজ্যে এই অঞ্চল সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু ঔপনিবেশিক শক্তির নির্মম আগ্রাসনে এসব অঞ্চলের সকল সমৃদ্ধি অল্পদিনেই বিলুপ্তির শিকার হয়। ঔপনিবেশিক শক্তিরা যখন কোথাও তাদের আস্তানা গেঁড়েছে, সেখানকার অর্থনীতি পুনর্বিন্যস্ত করে দেশীয় শিল্পকেও নষ্ট করে দিয়েছে। শশি থারুর তার ‘Inglorious Empire’-এ লিখেছেন, 

“Britain’s rise for two hundred years was financed by its depredations in India.” 

“ভারতের সম্পদ লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে ব্রিটেনের দুইশ বছরের উত্থান নিশ্চিত হয়েছিল”

উপরে উল্লিখিত উদাহরণগুলো মূলত ঔপনিবেশিকতার নির্মম বাহ্যিক প্রভাবকে নির্দেশ করে। কিন্তু আমি মূলত ঔপনিবেশিকতার অভ্যন্তরীণ প্রভাব নিয়ে আলাপে আগ্রহী। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যে অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন এসেছিল, তার অনেকটা আজও প্রকটভাবে বিরাজমান। সাংস্কৃতিক আত্তীকরণ, আত্মপরিচয়ের সংকট, সামাজিক হায়ারার্কি, ভাষিক পরিবর্তনসহ নানাবিধ মনস্তাত্ত্বিক সংকটে আজও অধ্যুষিত অঞ্চলের মানুষগুলো ভুগছে! ষোড়শ শতক-পরবর্তী ইউরোপীয় উপনিবেশ গুণগত ও মাত্রাগতভাবে মানুষের আগের যেকোনো অভিজ্ঞতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। পৃথিবীর বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে ঔপনিবেশিক শাসন বলবৎ থাকায় এর প্রভাবমুক্ত জনপদ খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর বলা যায়। রবার্ট জে. ইয়ুঙের নিম্নোলিখিত বয়ান থেকে এর সর্বব্যাপী ধ্বংসাত্মক প্রভাব সম্পর্কে ঠাওর করা যায়:

….the long, violent history of colonialism, which symbolically began over five hundred years ago, in 1492: a history which includes histories of slavery, of untold, unnumbered deaths from oppression or neglect, of the enforced migration and diaspora of millions of peoples— Africans, Americans, Arabs, Asians and Europeans, of the appropriation of territories and of land, of the institutionalization of racism, of the destruction of cultures and superimposition of the other cultures. (Young 2003:4)

“পাঁচশো বছরেরও বেশি পুরনো ঔপনিবেশিকতার দীর্ঘ ও সহিংস ইতিহাস, যা প্রতীকীভাবে ১৪৯২ সালে শুরু হয়েছিল। এটি এমন এক ইতিহাস, যেখানে দাসত্ব, নিপীড়ন ও অবহেলার কারণে অগণিত মানুষের মৃত্যু এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জোরপূর্বক স্থানান্তর ও ছিন্নমূলতার কাহিনি জড়িত রয়েছে। এই ইতিহাসে আফ্রিকান, আমেরিকান, আরব, এশীয় ও ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর শোষণের গল্প যেমন রয়েছে, তেমনি ভূমি দখল, বর্ণবাদের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, সংস্কৃতির ধ্বংস এবং অন্য সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার ঘটনাও অন্তর্ভুক্ত।”

ঔপনিবেশিক শাসনের বস্তুগত দুর্নীতি ও শোষণ নিয়ে অনেক আলাপ, তথ্যগত উপাদান রয়েছে। আধুনিক ইউরোপের জাঁকজমক তৈরির পাটাতন ছিল অধ্যুষিত মানুষের রক্ত। তাদের লহু মেখেই সুসজ্জিত ইউরোপের এই নজরকাড়া শানশওকত। ভারতের মতো শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ কয়েক দশকের বিট্রিশ শাসনে এসে দেউলিয়া হয়ে যায়, দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা পড়ে। এমনকি তাদের প্রস্থানকালেও দেশভাগের মধ্য দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে গৃহহীন হতে হয় এবং হাজারো মানুষের রক্তে আমাদের ইতিহাস রঞ্জিত হয়। সেই রক্তের কোনো বিনিময় আজও পরিশোধিত হয়নি!

ভাষা, সংস্কৃতি, ক্ষমতা ও নৈতিকতার আন্তঃসম্পর্ক

ঔপনিবেশিক শক্তি কেবল অধ্যুষিতদের দুনিয়া হরণের মধ্যে নিজেদের মশগুল রাখেনি, বরং, তাদের লক্ষ্য ছিল মানুষের আত্মার দখলদারি। মরোক্কান দার্শনিক ত্বহা আবদুর রহমান যেমন বলেছেন, মস্তিষ্কের উপনিবেশন অর্থ ভূমির উপনিবেশ। এক্ষেত্রে তিনি ‘আল হুলুল’ আরবি পরিভাষাটি ব্যবহার করেছেন। তার মতে, ঔপনিবেশিকরা মানুষের ফিতরতকে নষ্ট করে দিতে চায়। ফিতরত নষ্টের মধ্য দিয়ে তারা অধ্যুষিতদের আত্মাকে আত্মসাৎ করতে চায়। ত্বহার ভাষায়,

“By removing the connection between the divine and the temporal, the colonizer severed the lifeline of the soul.”

“ঐশ্বরিক ও পার্থিবের মধ্যে সম্পর্ক বিচ্ছিন্নের মাধ্যমে ঔপনিবেশিকরা মূলত আত্মার জীবন-স্রোতকে ছিন্নমূল করে দিল।”

ত্বহা ফিতরত, ভাষা-সংস্কৃতি ও নৈতিকতার পাটাতনে তার দার্শনিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। ত্বহার মতে, ফিতরত হলো মানুষের অভ্যন্তরে আল্লাহপ্রদত্ত প্রকৃতিগত স্বভাব, যা মানুষকে সত্য, সুন্দর ও ভালোত্বের গুণে উদ্ভাসিত করে। ফিতরত যেমন আধ্যাত্মিক, তেমন বুদ্ধিবৃত্তিকও। এটি জগতের সঙ্গে মানুষের বোঝাপড়াকে পরিগঠন করে, কাঠামো দেয়। এই সম্পৃক্তার কাঠামোই ব্যক্তিকে ভাষার সঙ্গে বিজড়িত করে এবং সংস্কৃতির নির্মাণ ঘটায়। এজন্য, ত্বহার আলোচনায় ভাষা ও সংস্কৃতির আলাপে ফিতরতও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ত্বহা বলেন,

“The soul of a people is rooted in their cultural values, and when these values are attacked, their spirit is weakened.”

“একটি জাতির সত্ত্ব তাদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে নিহিত থাকে, এবং যখন এই মূল্যবোধ আক্রমণের শিকার হয়, তখন তাদের আত্মিক প্রেরণাও নষ্ট হয়ে যায়।”

ত্বহা ভাষাকে কেবল যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে নয়, বরং, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিক সত্যকে ধারণ ও প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে দেখেছেন। ফিতরতের সঙ্গে সংযুক্ত ভাষা শৃঙ্খলাকে নির্দেশ করে; মানবীয় মর্যাদা, নৈতিকবৃত্তি ও আত্মিক উন্নতিকে ধারণ করে। বিপরীতে ফিতরতের সঙ্গে বিযুক্ত ভাষা নৈতিক অবক্ষয়কে ধারণ করে। ত্বহা সংস্কৃতিকে ফিতরতের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখেছেন। এজন্য ঔপনিবেশিক শক্তিরা একনিষ্ঠভাবে মানুষের আত্মিক-অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে তাদের সামগ্রিক দখল নিশ্চিত করার জন্য। তারা অধ্যুষিত মানুষের ভাষা-সংস্কৃতিকে আঘাত করেছে, দখলের প্রচেষ্টা চালিয়েছে যেন তাদের ফিতরতকে নষ্ট করে দেয়া যায়। ঔপনিবেশিক আমলের নৈরাজ্য স্থানীয়দের চরিত্র ও মাসুমিয়াতকে নষ্ট করে দিয়েছে। এজন্য উত্তর-ঔপনিবেশিক কালেও আমাদেরকে সেই ক্ষতির ক্ষতিপূরণ দিয়ে যেতে হচ্ছে। ঔপনিবেশিক চালচলন আমাদের মাঝে আত্মপরিচয়ের গ্লানি, হীনম্মন্যতা, অস্তিত্বগত সংকট এবং নৈরাজ্য উৎপাদন করেছে; যার মোকাবালায় আমরা পদে পদে হেরে যাচ্ছি আজও।

আর্লবার্ট মেমি আমাদের এক ভিন্ন প্রকারের পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে ঔপনিবেশিক এবং অধ্যুষিত উভয়েরই মনস্তাত্ত্বিক হাল নিয়ে আলাপ টেনেছেন। ঔপনিবেশিকরা অধ্যুষিতদের না-মানুষ, উনমানুষ স্তরে নামিয়ে আনার চেষ্টা করে। অধ্যুষিতদের উপর তাদের শাসনকে জায়েজ বানানোর জন্য তারা সভ্যকরণ পদ্ধতির আশ্রয় নেয়, নানা মিথ তৈরি করে। সভ্যকরণের নামে তারা প্রচুর মিথ বানায় যেন অধ্যুষিতরাও তাদের এই সিভিলাইজিং প্রজেক্টকে স্বাগত জানায়। ফলশ্রুতিতে এক সময় অধ্যুষিতরাও তাদের মিথগুলো সত্য বলে মেনে নেয় এবং হীনম্মন্যতা ও আত্মপরিচয়ের সংকটে ভোগে। অধ্যুষিতদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন নিয়ে অনেক আলাপ থাকলেও ঔপনিবেশিকদের মনস্তাত্ত্বিক হালত নিয়ে খুব বেশি আলাপ হয় না! আলবার্ট মেমি ঔপনিবেশিকদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা নিয়ে আলাপ করেছেন। তার মতে, অধ্যুষিতদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে তারা নিজেরাও ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তার মতে, ঔপনিবেশিকরা এক প্রকার নৈতিক দ্বন্দ্বে নিপতিত হয়। কারণ, তাদের প্রতিপত্তি শোষণ এবং জুলুমের উপর প্রতিষ্ঠিত। ক্ষমতা বলবৎ রাখতে তাদেরকে  বিমানবীকরণ পদ্ধতিতে এগুতে হয়। এজন্য তাদেরকে নৈতিকতার এক প্রকার মিথ্যা ন্যারেটিভ দাঁড় করাতে হয়। সভ্যকরণ, সমৃদ্ধিকরণ ইত্যাদি নামে তারা জুলুমের পথ জারি রাখে। এটা করতে গিয়ে কালক্রমে ঔপনিবেশিক শাসনের বেইনসাফির প্রতি তারা সংবেদনশীলতা হারিয়ে ফেলে। নৈতিক অবকাঠামোকে অস্বীকার করতে হয় নিজেদের শাসনকে বৈধ করার জন্য। এতে ঔপনিবেশিকদের নিজের কাছেই নিজের এক বিচূর্ণ প্রতিচ্ছবি তৈরি হয়। ক্ষমতা তার পরিচয় নির্ধারণ করে দেয় বিধায় সে একা হয়ে যায়, সমগ্র থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন অনুভব করে, স্বকীয় স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলে। ঔপনিবেশিক মাইন্ডসেটের কারণে পার্থিব সমৃদ্ধি ও জুলুমের পথকে সে নিজের জন্য নির্ধারণ করে নেয়। এছাড়াও আরো নানাবিধ কারণ ও আলামত ঔপনিবেশিকদের মাঝে ফুটে উঠে। এজন্য ভাষা, সংস্কৃতি, ক্ষমতা, মানবীয় স্বভাব ও নৈতিকতার মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক বুঝে উঠা অতীব জরুরি। এদের মধ্যে এক প্রকার গতিময়তা ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা কাজ করে, যা সমাজ ও ব্যক্তি পরিচয়কে রূপদান করে।

ভাষা সংস্কৃতির বাহক। ভাষা একটি সমাজের ইতিহাস, মূল্যবোধ এবং বিশ্বদর্শনকে ধারণ করে সংস্কৃতির সংক্রমণ ঘটায়। ভাষাতাত্ত্বিক এডওয়ার্ড সাপির ভাষাকে একটি সাংস্কৃতিক পণ্য হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তিনি বলেন,

“Language does not exist apart from culture… It is a cultural product.”

“ভাষা সংস্কৃতির বাইরে অবস্থান করে না… এটি একটি সাংস্কৃতিক উপাদান।”

অর্থাৎ, ভাষা আমাদের সাংস্কৃতিক রীতি-নীতি, ঐতিহ্য এবং সম্মিলিত স্মৃতিকে সংরক্ষণ করে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলা ভাষায় আপনি, তুমি, এবং তুই এই তিনটি সম্বোধন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, যা ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সামাজিক শ্রদ্ধা এবং ঘনিষ্ঠতার স্তরকে প্রকাশ করে। ভাষা ছাড়া সম্পর্কের এই বিভিন্নতাকে প্রকাশ করা মোটেও সম্ভব নয়। এভাবে ভাষা সমাজের সাংস্কৃতিক উপাদানকে নিজের মধ্যে হাজির করে এবং প্রজন্মের মধ্যে তা স্থানান্তর করে। অর্থাৎ, সংস্কৃতি হলো বংশানুক্রমে প্রাপ্ত ধারণাসমূহের সমষ্টি এবং ভাষা হলো সেই ধারণাগুলো প্রজন্মান্তরে প্রেরণের প্রধান মাধ্যম।

সমাজের অন্যান্য উপাদানের মতো ভাষা ও সংস্কৃতিও ক্ষমতা দ্বারা প্রভাবিত হয়। ফলে ভাষা-সংস্কৃতির রূপ ও চরিত্রে পরিবর্তন আসে। কখনো এই পরিবর্তন স্বতঃস্ফূর্তভাবে, আবার কখনো বলপ্রয়োগে। স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তন জগতের নিয়তি-নিজাম, সেটা নিয়ে মন্তব্য করার তেমন কিছু নেই। কারণ, এই প্রক্রিয়ায় ভাষা-সংস্কৃতির নিজস্বতা লুপ্ত হয় না, ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কিন্তু ইতিহাস থেকে আমরা দেখেছি যে, বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নানান ঔপনিবেশিক শক্তি ও হেজিমনি গ্রুপ কার্যকর থেকে অধ্যুষিত বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে চিরস্থায়ী কবর দিয়ে দিয়েছে। এই প্রচেষ্টা মূলত জগতের বৈচিত্র্য-বিভিন্নতার ধ্রুব সত্যকে নাকচ করার শামিল। আন্তেনিও গ্রামসি তার ‘Prison Notebook’-এ আলাপ করেছেন কীভাবে রুলিং ক্লাস পাশবিক বলপ্রয়োগের তুলনায় সাংস্কৃতিক পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ হাসিল করে। বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক অবকাঠামো মানুষের চেতনাকে গঠন করে। শোষকশ্রেণি এই বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। এই নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়েই মূলত হেজিমনি গ্রুপগুলো জনতার মাঝে তাদের শাসনের পক্ষে সমর্থন পয়দা করে। গ্রামসির ভাষায়:

The supremacy of a social group manifests itself in two ways, as ‘domination’ and as ‘intellectual’ and moral leadership.

“একটি সামাজিক গোষ্ঠীর আধিপত্য দুটি উপায়ে প্রকাশ পায় : ‘প্রভুত্ব’ এবং ‘বুদ্ধিবৃত্তিক’ ও নৈতিক নেতৃত্ব হিসাবে।”

গ্রামসির মতে, সাংস্কৃতিক হেজিমনির কেন্দ্রবিন্দুই হলো ভাষা। কারণ, ভাষা মানুষের জগতকে দেখার পদ্ধতিকে নির্ধারণ করে দেয়। হেজিমনি গ্রুপ তাদের ভাষিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোকে প্রমোট করে, যেন তাদের বিশ্ববীক্ষাকে জনসাধারণের মধ্যে চাপিয়ে দেয়া যায়। এই চাপিয়ে দেয়াটা বলপ্রয়োগে কাউকে কিছু করানোর চেয়েও মারাত্মক। কারণ, ভাষা-সংস্কৃতির এই পরিবর্তন বা নিয়ন্ত্রণ মূলত ইন্টার্নাল হেজিমনির অংশ। একারণে এই আধিপত্যকে প্রতিরোধ করা বা চিহ্নিত করা মানুষের জন্য দুষ্কর হয়ে যায়। ক্ষমতা ভাষা-সংস্কৃতি-নৈতিকতাসহ মানবজীবনের সকল ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করে। Benjamin Whorf এর একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য আছে:

“Language is not simply a reporting device for experience but a defining framework for it.”

“ভাষা কেবল অভিজ্ঞতার প্রতিবেদন করার একটি মাধ্যম নয়, এটি অভিজ্ঞতাকে সংজ্ঞায়িত করার একটি কাঠামো।”

অর্থাৎ, ভাষার কাজ কেবল অভিজ্ঞতার প্রতিবেদন করা নয়; বরং, এটি আমাদের অভিজ্ঞতার কাঠামোকেও নির্ধারণ করে। হেজিমনি গ্রুপগুলো ভাষার কাঠামোকে নিজেদের ইচ্ছামতো গড়ে তোলার চেষ্টা করে যেন তারা মানুষের চিন্তা ও অভিজ্ঞতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজি, ফরাসির মতো ভাষাগুলো অধ্যুষিত অঞ্চলের শিক্ষা ও প্রশাসনে প্রাধান্য লাভ করেছে, যার ফলে স্থানীয় ভাষাগুলো অবহেলিত হয়েছে। ক্ষমতা কী বলা যাবে আর কী বলা যাবে না, তা নির্ধারণ করে দিতে চায় এবং বিরোধী কণ্ঠকে চরমভাবে দমন করে। এজন্য ভাষা দখলের মাধ্যমে মূলত মানুষের মস্তিষ্ককেই দখল করা হয়। নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো তার ‘Decolonizing the Mind’ বইয়ে লিখেছেন:

The domination of a people’s language by the languages of the colonizing nations was crucial to the domination of the mental universe of the colonized।”

“উপনিবেশবাদী জাতির ভাষার মাধ্যমে একটি জনগণের ভাষার উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা, উপনিবেশিত জনগণের মানসিক জগতের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ভারতীয় উপমহাদেশে সংস্কৃতিগত নিপীড়নের এক জ্বলন্ত উদাহরণ হলো, বাংলা ভাষার অবমূল্যায়ন এবং ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য আরোপ। লর্ড ম্যাকলের Minute on Indian Education (1835) নীতিমালায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল, স্থানীয় ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য হলো একটি “অনুগত শ্রেণি” তৈরি করা, যারা ইংরেজি শিখবে, দোভাষীর কাজ করবে এবং ব্রিটিশদের গোলামি করবে। ম্যাকলের মতে,

“We must at present do our best to form a class who may be interpreters between us and the millions whom we govern.”

“আমাদের বর্তমানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে একটি শ্রেণি গড়ে তোলার, যারা আমাদের এবং আমাদের শাসিত লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হতে পারবে।”

এর ফলশ্রুতিতে স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতি নানাভাবে প্রান্তিক হয়ে পড়ে। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে সরকারি কার্যক্রম—সবক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষাকে একমাত্র মাধ্যম হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয়। এতে কেবল ভাষার বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়নি, বরং ভারতীয় সংস্কৃতিই হুমকির মুখে পড়ে যায়। একইভাবে, আফ্রিকায় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে দমন করার জন্য ধর্ম, শিক্ষা এবং প্রশাসন ব্যবস্থায় ইউরোপীয় ভাষা চাপিয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, আলজেরিয়ায় ফরাসি শাসনের সময় স্থানীয় আরবি ভাষার পরিবর্তে ফরাসিকে শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম করা হয়। এটি শুধু আরবি ভাষার প্রভাবকে কমিয়ে দেয়নি, বরং স্থানীয় জনগণের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক পরিচয়কেও বিপন্ন করেছে। আজও আলজেরিয়ার সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে এর প্রভাব গভীরভাবে বিদ্যমান।

প্রতিরোধ

অনেকে ঔপনিবেশিক প্রভাব কাটিয়ে উঠার জন্য কালচারাল রেজিস্ট্যান্স বা সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের কথা বলেন। তবে, ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে অধ্যুষিত ও উপনিবেশিতদের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক বিভাজন বা কালচারাল বাইনারি সৃষ্টি হয়েছিল, তা ভেঙে অনেকেই একধরনের সাংস্কৃতিক সংকরায়নের দিকে মনোযোগ দেন। উদাহরণস্বরূপ, হোমি কে. ভাভা তার The Location of Culture গ্রন্থে Cultural Hybridity বা সাংস্কৃতিক সংকরায়নের ধারণা উপস্থাপন করেছেন। তার মতে, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়ার ফলে একটি নতুন-মিশ্র সংস্কৃতি বা থার্ড স্পেস তৈরি হয়। এই থার্ড স্পেস একটি রূপক স্থান, যেখানে ভিন্ন সংস্কৃতিগুলো পারস্পরিক সংলাপের মাধ্যমে নিজেদের পুনর্গঠন করে এবং নতুন পরিচয়ের সন্ধান দেয়।

যদিও অনেকেই এই সংকরায়নকে ঔপনিবেশিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধের কৌশল হিসেবে দেখেন, এটি কিছু ক্ষেত্রে উল্টো ঔপনিবেশিক স্বার্থকেই জোরদার করে। এর একটি উদাহরণ টমাস ম্যাকলে, যিনি তার Minutes on Indian Education-এ উল্লেখ করেছেন। ম্যাকলের লক্ষ্য ছিল এমন একটি শ্রেণি তৈরি করা, যারা দেহে ভারতীয় হলেও চিন্তা ও রুচিতে ব্রিটিশ। এদের উদ্দেশ্য ছিল ঔপনিবেশিক শাসন ও সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক হওয়া। এই পরিকল্পনার ফলে এক ধরনের হাইব্রিড ভারতীয় শ্রেণির উদ্ভব হয়, যারা একদিকে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন, অন্যদিকে ঔপনিবেশিক শাসকের প্রতি অনুগত। এভাবে সাংস্কৃতিক সংকরায়ন মুক্তি ও শৃঙ্খলের দ্বৈত ভূমিকা পালন করে। এটি যেমন একটি প্রতিরোধের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারে, তেমনি ঔপনিবেশিক আধিপত্যকে দীর্ঘায়িত করার হাতিয়ারও হতে পারে।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ
মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ
6 months ago

পুরো লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়লাম আলহামদুলিল্লাহ। ভাষার ঔপনিবেশিকতা এবং তার প্রতিরোধ বিষয়ে রিজভী ভাই সুন্দর লিখেছেন। তাঁর জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷