বাবরি মসজিদের ইতিহাস : মিথ বনাম বাস্তবতা (২য় পর্ব)

মূল : হাবিবুর রহমান আজমি

হুসাইন আহমাদ খান

রাম-জন্মস্থান নিয়ে এক ভারতীয় গবেষকের গবেষণা

ড. আর. এল. শুক্লা─যিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক─১৯৮৪ সালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন ‘রামের শহর অযোধ্যা: সত্য নাকি মিথ্যা’ শিরোনামে। নিম্নোক্ত উদ্ধৃতিটি এই গবেষণাপত্র থেকে নেওয়া। লেখাটি যদিও পুরোপুরি উল্লেখ করার উপযুক্ত, কিন্তু সংক্ষিপ্ততার জন্য নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হলো :

“কিছু কিছু ঐতিহাসিক রামায়ণে বর্ণিত রামকে একটি বাস্তব চরিত্র বলে মনে করেন। এই ঐতিহাসিকরা মনে করেন, রামের যুগ খ্রিস্টের আড়াই হাজার বছর আগের। যদি আমরা এই গবেষণাটি মেনে নিই, তাহলে রামজির সাথে সম্পর্কিত রামায়ণে বর্ণিত স্থানগুলোতে ঈসা (আ.) এর আড়াই হাজার বছর আগের মানবজীবনের চিহ্ন থাকতে হবে। এই উদ্দেশ্যে তিনটি স্থানে খননকার্য পরিচালনা করা হয়─ ১. ফৈজাবাদ জেলার অযোধ্যায় ২. এলাহাবাদ থেকে ৩৫ কি. মি. উত্তরে অবস্থিত শেরনাগপুরে এবং ৩. এলাহাবাদে অবস্থিত ভারদ্বাজ আশ্রমে। অযোধ্যায় খননকাজ হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে। সে সময় সেখানে ঈসা (আ.) এর ছয়শত বছর আগের আবাদির কোন নিদর্শন পাওয়া যায়নি। প্রায় দশ বছর আগে আবার সেখানে (অযোধ্যায়) বড় আকারের খননকার্য হয়। এই খনন থেকেও আবাদি সম্পর্কে একই সিদ্ধান্ত আসে যে, ঈসা (আ.) থেকে বেশি থেকে বেশি সাতশ বছর আগের আবাদির চিহ্ন পাওয়া যায় (এর আগে নয়)। এখন যদি মেনে নেওয়া হয়, বর্তমানের অযোধ্যাই ছিলো রামজির শহর, তাহলে প্রশ্ন উঠে আসে, রামজির যুগের সাথে অযোধ্যার আবাদির যুগের সাথে মিল পাওয়া যায় না কেন? অযোধ্যার আবাদি ঈসা (আ.) এর ছয়/সাত শত বছর আগের, অথচ রামের যুগ তার থেকে আড়াই হাজার বছর পূর্বের বা কিছু ইতিহাসবিদের মতে আরও আগের! তাহলে অযোধ্যা কীভাবে রামের ভূমি হতে পারে এবং তার প্রমাণ কী?! 

সত্য হলো, পূর্বাঞ্চলীয় ইউপি, উত্তর বিহার এবং মগধ অঞ্চলে শুধু বনভূমি ছিল। এই অঞ্চলগুলিতে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়। এ কারণে সমতল ভূমিতে বন তৈরি হওয়া একটি প্রাকৃতিক বিষয়। যতক্ষণ না বনগুলো কেটে পরিষ্কার করা হয়নি ততক্ষণ সেখানে বসতি স্থাপন করা ছিলো অসম্ভব। এই বনগুলো পুড়িয়ে বা লোহার কুড়াল দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছিল। আধুনিক গবেষণায় স্থির হয়েছে, খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ সালে লোহার ব্যবহার হয়নি এই অঞ্চলগুলোতে। 

প্রাচীন পালি সাহিত্যে ‘মহাজনপদ’ নামক বৃহৎ বৃহৎ রাজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। পালি সাহিত্যে অযোধ্যারও উল্লেখ পাওয়া যায়। এটা সামনে রেখে বলা যায়, বুদ্ধের যুগে এই অঞ্চলে শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু তার আগে কোনো শাসন প্রতিষ্ঠার প্রমাণ না প্রাচীন সাহিত্যে পাওয়া যায় না প্রত্নতত্ত্বে। তাই যারা অযোধ্যাকে রামের জন্মস্থান বলে, তাদের কাছে এর কোনো প্রমাণ নেই। 

বাল্মীকির  রামায়ণ অনুসারে কোশলের আসন ছিল অযোধ্যার নদীর (ঘাগড়া) ডানদিকে দেড় যোজন (সাড়ে তেরো মাইল) দূরত্বে। আর সারদা ছিল তা থেকে পশ্চিমে। অথচ আজকের অযোধ্যা সারদার একেবারে তীরে অবস্থিত। এমনকি বর্তমান সময়ের সারদা অযোধ্যা থেকে পূর্বে অবস্থিত, পশ্চিমে নয়। (বাল্মীকির এই বক্তব্য অনুসারেও বর্তমান অযোধ্যা রামের জন্মস্থান হতে পারে না)।” [1]দেখুন : রামজির শহর অযোধ্যা : সত্য নাকি মিথ্যা: নভেম্বর, ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত, … Continue reading

অতঃপর মনে রাখতে হবে, হিন্দুধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘অথরবেদ’ থেকে বোঝা যায়, অযোধ্যা শব্দটি বিশেষ্য হিসেবে নয়, বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটি শিমলা’র ফেলো প্রফেসর বি বি লাল─যিনি প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের মহাপরিচালকও ছিলেন─তিনি প্রকাশ করেছেন,  ‘কোনো একটি স্থানেও অযোধ্যা শব্দটি বিশেষ্য (নাম) হিসাবে ব্যবহৃত হয়নি। তাই এটা মনে করা করা ভুল হবে যে, এটি একটি শহরের নাম।’’ [2]দেখুন : সাপ্তাহিক নয়া দুনিয়া, দিল্লা, সংখ্যা : ১৮, ২০ মার্চ,‌ ১৯৮৬, পৃষ্ঠা : … Continue reading

রাম কি কোশলের রাজা ছিলেন?

এই গবেষণাগুলো ছাড়াও‌ কিছু গবেষক এই মতও পোষণ করেছেন, রামকৃষ্ণ─যার রাজধানী (অযোধ্যা) বলা হয়─তিনি কোশলের রাজা ছিলেন না। তিনি ছিলেন বেনারসের শাসক।

এ. এল. হাশেম লিখেছেন, 

“এটাও নিশ্চিত নয় যে, রাম কোশলের রাজা ছিলেন। কেননা এই সময়ে মহাকাব্য রামায়ণের প্রাচীনতম সংস্করণ, যা আমাদের হাতে রয়েছে, তা থেকে জানা যায়, তিনি বেনারসের রাজা ছিলেন। অল্প সময়ের জন্য যা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য।” [3]দেখুন : হিন্দুস্তান কা শানদার মাযী : ৬৭-৬৮

মোটকথা, প্রাচীন হিন্দু সাহিত্য ও আধুনিক গবেষণা উভয়ের মতে, রামায়ণের চরিত্র রামের সাথে বর্তমান অযোধ্যার সম্পর্ক কোনোভাবেই প্রমাণিত হয় না। কেননা অযোধ্যার বসতি রামের আঠারোশো (১৮০০) বছর পরে অস্তিত্ব লাভ করেছে। এজন্য জ্ঞান-গবেষণার দৃষ্টিকোণ থেকে অযোধ্যাকে রামের জন্মভূমি বলা খুবই হাস্যকর, যার অবস্থান দেবমলয়ের লোককথার বেশি নয়।

সম্ভবত এ কারণেই বিদেশি পর্যটকরা যখন ভারতের প্রাচীন নিদর্শনগুলো দেখতে আসেন, তখন তাদের বেনারস, সারানাথ, মগধ, নালন্দা, হাজর, আহওয়া, জনতা ইত্যাদিতে স্থানে একটি সরকারি ও বেসরকারি সফর করা হয়, অথচ অযোধ্যাকে করা হয় সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা।

সুতরাং অযোধ্যাই যখন রামজন্মভূমি হওয়াটা ঐতিহাসিক ও গবেষণাগত দিক থেকে ভুল, তখন সাড়ে চারশো বছর পর সেখানে অবস্থিত একটি মসজিদকে চিহ্নিত করে ‘এ স্থানে রামজির জন্ম হয়েছে’ এমন কথা কি গুজব নয়?

এই গুজবের উৎপত্তি ও উদ্দেশ্য

রামজি’র সময় থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর পরে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। যদি সত্যিই এই স্থানে একটি মন্দির থাকত এবং এই গুরুত্ব─যা আজ প্রকাশ করা হচ্ছে যে, এর উপর দেশের অখণ্ডতা ও ঐক্যের বলি দেওয়াকে গ্রহণ করে নেওয়া হয়েছে─তাহলে এর উল্লেখ ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক বইয়ে অবশ্যই থাকত বা অন্ততপক্ষে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খননকালে এর কিছু আলামত পাওয়া যেত। কিন্তু আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, অযোধ্যার আবাদি শুরু হয়েছে রামের সময় থেকে প্রায় আঠারোশো বছর পরে। তাহলে সেখানে কীভাবে তার জন্ম হবে যে, তার জন্মের স্মরণে এই স্থানে একটি মন্দির তৈরি করা হয়েছিল।  

বস্তুত রাম জন্মস্থানের এই বিষয়টি হলো ব্রিটিশদের কুখ্যাত কূটনীতি ‘লড়াই বাধাও এবং শাসন করো’ নীতির একটি চাল। ওয়াজেদ আলী শাহের সময়ে ইংরেজরা এই গুজবের প্লট প্রস্তুত করে। সেটা হলো, তারা পূর্বেই একজন বৃদ্ধ জ্যোতিষীকে প্রস্তুত করে। তাই সে বৃটিশদের অভিপ্রায় অনুসারে, একটি রাশিফল অঙ্কন করে জন্মস্থান ও সীতার সেবাঘর চিহ্নিত করে বাবরি মসজিদ প্রাঙ্গণের মধ্যে। এ সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু আগ্রহী ব্যক্তিকে প্ররোচিত করা হয় যে, তারা যেন এই দুটি স্থান অধিগ্রহণের চেষ্টা করে। যেহেতু নবাব ওয়াযেদ আলী শাহের মন্ত্রী নকী আলী খান ঘুষখোর হওয়ার সাথে সাথে ব্রিটিশদের প্রতি অনুগতও ছিল, তাই সে এই পৌরাণিক কাহিনীতে রঙ মাখানোর কাজ করে। সে ওয়াজেদ আলী শাহকে রাজি করায় যে, মসজিদের সীমানার বাইরে, কিন্তু মসজিদের আঙ্গিনার মধ্যে রাম-জন্মস্থান ও সীতা’র সেবাঘরের জন্য জায়গা ছেড়ে দেওয়া হবে। ফলে মসজিদের খাড়া অংশের বিপরীতে ডানদিকে প্রাঙ্গণের দেয়াল সংলগ্ন স্থানে সীতার সেবাঘরের জন্য এবং মসজিদের আঙ্গিনার বাইরে বাম ও পূর্ব দিকে জন্মস্থানের জন্য ২১ ফুট দীর্ঘ ও ৭ ফুট চওড়া জায়গা দেওয়া হয়, যার উপর এক বালিশ-উচ্চতা পরিমাণ মঞ্চ তৈরি করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল… একই সময়ে মসজিদের আঙ্গিনাটি লোহার বার দিয়ে ঘেরা হয়, যা এ পর্যন্ত ছিলো উন্মুক্ত। এই হলো সীতার সেবাঘর ও রাম-জন্মস্থানের আসল সত্য।

জন্মস্থানকে যে দেবালয়ের মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল, তা জনসাধারণকে হয়তো কিছুটা প্রভাবিত করতে পেরেছিল, কিন্তু শিক্ষিত শ্রেণি এতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। এজন্য এই দেবালয়ের পদক্ষেপের কিছু পরে যখন ফৈজাবাদের নতুন গ্যাজেট তৈরি করা হয়, তখন প্রথমবারের জন্য এই গুজবও লেখা হয় যে, ‘১৫২৮ সালে সম্রাট বাবর অযোধ্যায় আসেন এবং এখানে এক সপ্তাহ অবস্থান করেন। তিনি এই প্রাচীন মন্দির (রাম জন্মস্থান) ভেঙ্গে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন, যা এখন পর্যন্ত বাবরি মসজিদ নামে পরিচিত।’

এটা আশ্চর্যজনক যে, উত্তরপ্রদেশ সরকার ১৯২০ সালে ফৈজাবাদ জেলার গ্যাজেট প্রকাশ করে, তাতে এই গুজবকে কোনো গবেষণা ও তদন্ত ছাড়াই অন্তর্ভুক্ত করে। ইউপি সরকারের এই মনোভাব এটাই প্রকাশ করে, আমাদের সরকার মানসিকভাবেও ব্রিটিশদের দাস; যা একটি স্বাধীন জাতির জন্য খুবই লজ্জাজনক।

বিরোধের সূচনা

যাই হোক, ব্রিটিশদের এই কৌশল সফল হয় এবং অযোধ্যায় বসবাসকারী হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে শুরু হয় উত্তেজনা। প্রথমে ১৮৮৫ সালে রাখু বিবরদাস নামে এক মহন্ত সাব-জজ আদালতে দাবি করে, রাম-জন্মভূমিতে কোনো বিল্ডিং নেই এবং পূজারিদের গরম ও বৃষ্টিতে কষ্ট হয়, তাই সেখানে একটি ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হোক। সে তার দাবিতে এটাও যোগ করে, ইতোপূর্বে মুসলিমদের আপত্তিতে রাম জন্মভূমিতে ভবন নির্মাণ বন্ধ করে দেয় জেলা জজ।

সাব-জজ হরি কিষাণ পণ্ডিত তার রায়ে বিশদভাবে লিখেছেন, ‘এই চত্বরের প্রবেশদ্বারে ‘আল্লাহ’ লেখা রয়েছে। তার পরের মঞ্চটি দখল করে আছে হিন্দুরা। এই মঞ্চ সম্পর্কে বলা হয়, এটা রাম-জন্মস্থান। মঞ্চের চারপাশে রয়েছে মসজিদের প্রাচীর। এই মঞ্চ ও মসজিদটির মাঝখানে আলাদা আলাদা সীমানা রয়েছে। যদি এই মঞ্চের স্থানে মন্দির তৈরি করা হয় এবং তাতে ঘণ্টা ও শঙ্খ বাজানো হয় আর মুসলমানরা এর পাশ দিয়ে অতিক্রম করতে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে অনেক রক্তপাতের আশঙ্কা রয়েছে এবং হাজার হাজার জীবন নষ্ট হতে পারে। এজন্য মন্দির নির্মাণের জন্য অনুমতি দেওয়া মানে দাঙ্গা, হাঙ্গামা ও খুনখারাবিকে আমন্ত্রণ জানানো। তাই ইনসাফের দাবি হলো, মন্দির নির্মাণের অনুমতি না দেওয়া।’ এই দাবি থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, জন্মস্থানের মঞ্চটি ছিলো মসজিদের বাইরে।  

এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিলও ২৬ মার্চ, ১৮৮৫-এ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ফৈজাবাদ খারিজ করে দেন। [4]দেখুন : সিভিল আপিল (২৭) ১৮৮৬ যদিও এই মামলার সময় থেকেই উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল, যা দিন দিন বাড়তে থাকে; কিন্তু মুসলমানরা যথারীতি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে থাকে মসজিদে। মসজিদ নির্মাণের সময় অর্থাৎ ৯৩৫ হিজরি মোতাবেক ১৮২৮ সাল থেকে ২২ ডিসেম্বর ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হতে থাকে। স্বতন্ত্রভাবে নিয়োগ হতে থাকে মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিন। মসজিদের খরচের জন্য মুঘল আমলে সরকারী কোষাগার থেকে বার্ষিক ষাট টাকা ধার্য করা হয়েছিল। অযোধ্যার নওয়াবের সময়ে এই পরিমাণ বাড়িয়ে তিন শত দুই রুপি তিন আনা ছয় পাই করা হয়। বৃটিশ সরকারও এই খরচ জারি রাখে। তারপর প্রথম ব্যবস্থার সময় এই অর্থের পরিবর্তে অযোধ্যা সংলগ্ন দুটি গ্রাম ভোরনপুর ও শোলাপুরের খারাজ মাফ করে দেওয়া হয়, যার আয় ব্যয় করা হয় মসজিদের কাজে। রেজিস্টারের (৩০) ধারায় তৎকালীন জিম্মাদার জাওয়াদ হোসেন, মৌজ শাহনাওয়ান, দক্ষিণা দর্শননগর, জেলা ফৈজাবাদের বর্ণনা রয়েছে। ওয়াকফ অ্যাক্ট ১৯২০/১৩ এর অধীনে প্রধান কমিশনার ওয়াকফ বোর্ড বাবরি মসজিদ হিসাবে নথিভুক্ত করেন।

মোটকথা, ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাবরি মসজিদ ঐতিহাসিক ও আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো বিরোধ বা দ্বন্দ্ব ছাড়াই মসজিদ হিসেবে মুসলমানদের অধীনে ছিল। মুসলমানরা কোনো প্রতিরোধ বা বাধা ছাড়াই এতে পাঁচ ওয়াক্ত জামাত নামাজ আদায় করতেন।

বাবরি মসজিদে জোরপূর্বক মূর্তি স্থাপন

১৯৪৮-৪৯ সালে ইউপি, দিল্লি, মেওয়াত, পাঞ্জাব প্রদেশে এত বড় আকারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হত্যাকাণ্ড ঘটে, যা এই অশান্ত ও বিশৃঙ্খল যুগে কয়েক দিনের জন্য দেশের সমগ্র ব্যবস্থাকে স্থগিত করে দেয়। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে ২২, ২৩ ডিসেম্বর ১৯৪৯ সালের মধ্যরাতে হনুমান গাড়ির মহন্ত অভয় রামদাস জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কে. কে. নারায়ণ এবং তার শিষ্যদের সহায়তায় মসজিদের প্রাচীর ভেঙ্গে মসজিদে প্রবেশ করে। রামের মূর্তি স্থাপন করা হয় মিহরাবের ভিতরে। সকালে যখন মুসলমানরা ফজর নামাজ পড়তে যায়, তখন মূর্তি দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ে। তৎক্ষণাৎ মূর্তি সরানোর দাবি জানায়। ২৩ তারিখ সকালে ডিউটিরত পুলিশ মাতুপ্রাসাদ তৎকালীন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শ্রী রাম দেবের কাছে একটি লিখিত প্রতিবেদন দাখিল করে, যাতে লেখা ছিলো, ‘অভয় রাম দাস, শুক্লা দাস, সুদর্শন দাস ও পঞ্চাশ বা ষাট জন অজ্ঞাত ব্যক্তি মসজিদে মূর্তি স্থাপন করেছে, যা শান্তি ভঙ্গের হুমকির সৃষ্টি করেছে।’ একই রিপোর্টের ভিত্তিতে ফৈজাবাদ জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ১৪৫ ধারা অনুযায়ী মসজিদকে গঞ্জ শাহীদান থেকে আলাদা করে দেন। প্রদত্ত রাম, চেয়ারম্যান মিউনিসিপ্যাল বোর্ড ফৈজাবাদকে রিসিভার নিযুক্ত করে মসজিদে তালা লাগিয়ে উভয় পক্ষকে তাদের নিজ নিজ দাবির পক্ষে প্রমাণ জমা দেওয়ার জন্য নোটিশ জারি করেন।

এই চরম অপরাধমূলক ও ধর্মহীন কর্মকাণ্ডে সারা দেশের মুসলমানদের মধ্যে উদ্বেগ ও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। এজন্য জমিয়তে উলামার মহান নেতা হযরত শায়খুল ইসলাম মাওলানা সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানী, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা হিফজুর রহমান প্রমুখ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত জওহরলাল নেহরুকে বিষয়টি জানান। পণ্ডিত জওহরলাল উত্তর প্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী পান্থ কোলখারকে লেখেন, ‘তিনি যেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়ে মসজিদ থেকে মূর্তি সরিয়ে ফেলে।’ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যেহেতু নিজেই এই ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল, তাই সে আদেশ পালন না করে অভয় রামদাস প্রমুখকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করে। সে তাকে বলে, ‘আমি এই আদেশ কার্যকর করতে কিছু সময়ের জন্য বিলম্ব করব। আপনারা এর মধ্যে আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিন।’ হিন্দুরা তার কথা অনুযায়ী এই আদেশের বিরুদ্ধে আদালত থেকে রায় গ্রহণ করে। এভাবে মসজিদ থেকে মূর্তিটি সরানো যায়নি‌। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কে. কে. নারায়ণের কাছ থেকে পান্থজি এরই ভিত্তিতে পদত্যাগ গ্রহণ করে। কিন্তু তারপরে পান্থজি এই বিষয়টিতে আগ্রহ প্রকাশ না করার কারণে মূর্তি একই জায়গায় রয়ে যায়।

ধারাবাহিক মামলা 

মসজিদে অবৈধ মূর্তি স্থাপনের প্রায় ২৩/২৪ দিন পর ৬ জানুয়ারি, ১৯৫০ সালে গোপাল সিং নামে এক হিন্দুর পক্ষ থেকে জহুর আহমদ, হাজী মুহাম্মদ ফায়কো, হাজী ফেকো, আহমদ হোসেন ওরফে আছান, মুহাম্মদ সামি, ডি. এম সিটি ম্যাজিস্ট্রেট ও উত্তরপ্রদেশ সরকারকে পার্টি বানিয়ে দাবি করা হয়, ‘এটা রাম-জন্মভূমি। আমরা এখানে পূজা করি। মুসলমানরা ও জেলা প্রশাসন এটাকে বাধাগ্রস্ত করছে। এজন্য এই বাধা সরিয়ে আমাদের পূজা করার অনুমতি প্রদান করা হোক।’ এখানে উল্লেখ্য, ১৮৮৫ সালে রঘুনাথ দাশের পক্ষ থেকে যে দাবি তোলা হয়েছিল, সেখানে মসজিদের বাইরের মঞ্চকে দাবি করা হয়েছিল রাম-জন্মস্থান হিসেবে। সেই স্থানে একটি ভবন নির্মাণের অনুমতি চাওয়া হয়েছিল এবং এই দাবিতে দাখিল করা অপটিক্যাল মানচিত্রে মসজিদটিকে ‘বাবরি মসজিদ’ হিসাবে দেখানো হয়েছিল। 

পহেলা জুলাই, ১৯৫৬ সালে ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার ফৈজাবাদ আদালতে একটি পাল্টা দাবি দাখিল করার সময় তার বক্তব্যের ১৪ থেকে ১৮ অনুচ্ছেদে লিখেছেন : 

“এই মামলাকৃত সম্পত্তিটি বাবরি মসজিদ নামে পরিচিত। দীর্ঘদিন ধরে এটি মুসলমানদের উপাসনার জন্য মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। রামচন্দ্রজির মন্দির হিসাবে কখনোই ব্যবহার করা হয়নি। ২২ ডিসেম্বর, ১৯৪৯ সালের রাতে রামচন্দ্রজির মূর্তিটি চুরি করে মসজিদের ভিতরে বেআইনিভাবে স্থাপন করা হয়। এই অনৈতিক ও বেআইনি কাজের কারণে মুসলমানদের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। তাই এই এলাকায় তৈরি হয় শান্তি ভঙ্গের হুমকি। এজন্য সিটি ম্যাজিস্ট্রেট গুরুদত্ত সিং ২৩ ডিসেম্বর ১৯৪৯-এ ১৪৪ ধারা জারি করে। একই তারিখে ম্যাজিস্ট্রেট শ্রী মারখন্ড সিং এই মসজিদটিকে ১৪৫ ধারার অধীনে শ্রেণীবদ্ধ করে রিসিভার নিয়োগ করে।”

মামলায় ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার উত্তরের এক মাস আগে অর্থাৎ ১৯৫০ সালের পহেলা জুন, ফৈজাবাদের এস. পি. পাল সিংও একটি উত্তর দাখিল করেন, যাতে লেখা ছিলো, ‘এটি প্রাচীনকাল থেকেই ‘বাবরি মসজিদ’ এবং মুসলমানরা সর্বদা এই মসজিদটি ব্যবহার করে আসছে। সেখানে হিন্দুদের কোনো স্থান নেই।’ 

এই মামলার পর হিন্দুদের পক্ষ থেকে দায়ের করা আরও দুটি মামলা; একটি প্রেমহংস রামচন্দ্র দাস এবং অন্যটি নির্মোহী আখড়ার পক্ষ থেকে। ১৯৬৮ সালে ইউপি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ড থেকে মুসলমানদের পক্ষ থেকে আরও একটি মামলা দায়ের করা হয়, যেখানে জমিয়তে উলামার মাওলানা নাসির আহমদ ফৈজাবাদী বাদি ছিলেন। এই দাবিতে বলা হয়েছিল, ‘বাবরি মসজিদ’ মুসলমানদের একটি মসজিদ; যেখানে তারা ১৫২৮ সাল থেকে ইবাদত করে আসছে। এই মসজিদটি তাদের ফিরিয়ে দেওয়া উচিত এবং নামাজে কোনো হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।

এখন অবধি এই সমস্ত মামলার ফাইলগুলো আলাদা আলাদা ছিল। সহজতার জন্য আদালতের আদেশে সেগুলোকে একত্রিত করা হয় এবং কেন্দ্রীয় ওয়াকফ বোর্ডের মামলা ১২/১৬ কে অগ্রণী মামলা হিসাবে ঘোষণা করা হয়। 

ইতিমধ্যে ইয়াহ দত্ত রিসিভার হিসাবে মৃত্যুবরণ করেন। তাই আদালত তার জায়গায় শ্রী কে. কে. রামবর্মা অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটকে রিসিভার নির্ধারণ করে। এরই মধ্যে মুসলমানরা জানতে পারে, মসজিদের মধ্যে পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে। এজন্য তারা রামবর্মাকে রিসিভার পদ থেকে অপসারণ করার আবেদন জানায়। দেওয়ানী বিচারক মুসলমানদের অভিযোগকে সত্য বলে মেনে নিয়ে রামবর্মাকে রিসিভার পদ থেকে অপসারণের নির্দেশ দেয়। এই আদেশের বিরুদ্ধে হিন্দুরা লাখনৌ ব্রাঞ্চের হাইকোর্টে আপিল করে স্থগিতাদেশ লাভ করে। এই সময় সমস্ত মামলার ফাইল তলব করা হয় হাইকোর্টে। ফৈজাবাদে সমস্ত মামলা বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় পনেরো বছরের দীর্ঘ সময় কেটে যায়, কিন্তু ফৈজাবাদ আদালতে এই মামলার বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যদিও এই সময়কালে মুসলমানরা বারবার অনুরোধ করেছিল, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক এবং হাইকোর্টের পক্ষ থেকেও ফৈজাবাদ আদালতকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, শীঘ্রই মামলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার, কিন্তু কোনোকিছুই কার্যকর হয়নি।

মামলা চলাকালে বেআইনিভাবে মসজিদের মধ্যে পরিবর্তন

পূর্ববর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে বলা হয়েছে, বাবরি মসজিদের চারদিকে দেয়াল ছিল। মসজিদের মূল ফটক ছিল উত্তর দিকে। এই দরজায় মোটা অক্ষরে লেখা ছিলো আল্লাহ শব্দটি, কিন্তু রিসিভার ও পুলিশের তত্ত্বাবধান সত্ত্বেও খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মুছে ফেলা হয় এই লেখাটি। আর দরজায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয় ‘রাম-জন্মস্থান মন্দির’ লেখা বোর্ড। বেষ্টনীর চার দেয়াল ও মসজিদের উঠানের ফাঁকা জায়গায় সাদা ও কালো মার্বেলের মেঝে তৈরি করা হয়, যার নাম দেওয়া হয় ‘পুরিকার্মা’। মসজিদের উঠানের উত্তর দিকে হাতের নল লাগানো হয়। মসজিদের আঙ্গিনার বাইরে পূর্ব দিকে তৈরি করা হয় মাটির মন্দির। এরই পাশে নির্মাণ করা হয় মহন্তদের আবাসও। দক্ষিণ দিকের সেই মঞ্চের স্থানে─যেটাকে প্রথমে রাম-জন্মস্থান দাবি করা হয়েছিল─মন্দির তৈরি করা হয়। এর পাশে তৈরি করা আরো দুটি মন্দির। মসজিদের কেন্দ্রীয় গম্বুজে স্থাপন করা হয় পতাকা। এই সমস্ত পরিবর্তন ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৮ সালের মধ্যে করা হয়। যদিও রিসিভারকে আইনত নিয়োগ এজন্য করা হয়েছিল যে, উভয় পক্ষের কারো দ্বারা যেন অমীমাংসিত ভবনে কোনো পরিবর্তন বা সংযোজন করা না হয়। কিন্তু এই সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটতে থাকে; না হেডকোয়ার্টারে রিসিভার রামবর্মা এর কোনো নোটিশ জারি করে, না সেখানে নিয়োজিত পুলিশরা। কারণ হলো, এই সমস্ত লোকও জড়িত ছিল এই অবৈধ পরিবর্তনের কাজে।

মসজিদকে মন্দিরে রূপান্তর

লাখনৌ ব্রাঞ্চের হাইকোর্টের রিসিভার বর্মার ক্ষেত্রে দাখিলকৃত রিট শুনানি শুরু করে। আইনত এর বিরুদ্ধে তখনও আপিল করা যাচ্ছিল না। কিন্তু ১৫ জানুয়ারি, ১৯৮৬ সালে রমেশ চন্দ্র পান্ডে নামি একজন ব্যক্তি─যে আজ পর্যন্ত কোনো মামলার পক্ষ হিসেবে ছিল না─ফৈজাবাদ আদালতে মামলা (২) ১৯৫০ এর মামলায় একটি একটি নতুন আবেদন করে যে, ‘রাম-জন্মস্থানে পূজা করার ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া উচিত। এজন্য আদালত যেন জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়, রাম-জন্মভূমি বা বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেবে, যাতে আমরা হিন্দুরা কোনো বাধা ছাড়াই পূজার কাজ করতে পারি।’ এ বিষয়ে বিচারপতি এই বলে আবেদনটি খারিজ করে দেন, এই মামলার শীর্ষ ফাইলের শুনানি চলছে হাইকোর্টে। তাই এই আবেদনের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। এই রায়ের বিরুদ্ধে জেলা জজ মি. কে. এম. পান্ডের আদালতে দেওয়ানী আপিল  নং (৬) ১৯৮২, ৩০ জানুয়ারীতে দাখিল করা হয়। ৩১ জানুয়ারিতে দেওয়ানীর পাবলিক অ্যাডভোকেট নারায়ণ দত্ত খত্রী উপস্থিত হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ডি. এম-ও এসপির বয়ান নেন। ১৯৮২ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি এই দুই বিচারপতিও উপস্থিত হন, যাদের কাছে জেলা মেজিস্ট্রেট জানতে চান, মসজিদ বা জন্মভূমির তালা খোলা হলে আপনারা কি আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবেন? উত্তরে তারা বলেন, এটা আমাদের দায়িত্ব এবং আমরা তা পালন করার চেষ্টা করবো। এই কাজের পর ওই দিনই অর্থাৎ শনিবার সাড়ে পাঁচটার দিকে বিচারক এই সিদ্ধান্ত দেন, জেলা প্রশাসন যেন তালা খুলে দেয় এবং এই স্থানে রমেশ চন্দ্র পান্ডে ও অন্যান্য হিন্দুদের পূজার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এতে কোন বাধা সৃষ্টি করা হবে না। এমনকি জেলা প্রশাসন যেন শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

এ মামলায় মুসল্লিদের পক্ষ থেকে তিনটি আবেদন করা হয়। কিন্তু জজ এ কথা বলে─ বিষয়টি জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং তাতে মুসলমানদের পক্ষ বানানোর কোনো প্রয়োজন নেই─তিনটি আবেদনই খারিজ করে দেয়। সিদ্ধান্তের পরপরই ৫টা বেজে ১৯ মিনিটে বাবরি মসজিদের দরজা খুলে দেওয়া হয় এবং সে-সময় হাজার হাজার হিন্দু পূজার জন্য উপস্থিত হয় মসজিদে। এভাবে কলমের এক খোঁচায় হাজার বছরের পুরনো মসজিদকে রূপান্তর করা হয় মন্দিরে! 

ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

মামলার এই দিকটি কতটা নাটকীয় যে, বাদি রমেশ পান্ডে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইন্দর কুমার পান্ডে, জেলা জজ কে. এম পান্ডে ও আইনজীবী বীর বিশুর দোদিদি সকলেই ছিলো পান্ডে সম্প্রদায়ের। এজন্য এই মামলার কী রায় হতে যাচ্ছিল, তা ছিল ইতিমধ্যেই স্পষ্ট।  

কবি বলেন, 

তারই শহর তারই বাদি এবং বিচারকও তার 

আমরা নিশ্চিত ছিলাম দোষ বের হবে আমাদেরই 

 রায় নিয়ে একটি পর্যালোচনা

আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই মামলার রায় হয় বিকেল ৫টায় হয়। কিন্তু অযোধ্যা ও ফৈজাবাদে দুপুর ২টায়ই  পিএসি অতিরিক্ত হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তারা মুসলিম মহল্লায় টহল দিতে শুরু করে। এদিকে আদালতও ঘিরে ফেলা হয় পুলিশ ও পিএসি দ্বারা।  

রায় ঘোষণার এই প্রাক-প্রস্তুতিগুলো স্পষ্টতই দেখায় যে, যা ঘটেছে সবই পূর্ব-পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ!  এটাও কম আশ্চর্যজনক নয় যে, মামলাটি মুন্সেফ আদালত থেকে জেলা জজ আদালতে চলে গেছে মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যে এবং সমস্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করে সিদ্ধান্তও ঘোষণা করা হয় এরই মধ্যে। ভারতীয় আদালতে এত দ্রুত বিচার সম্পন্ন হয়েছে, ভারতীয় বিচার বিভাগ কি এমন কোনো উদাহরণ দেখাতে পারবে? এরপর হাইকোর্টে শুনানিধীন যে মামলার আপিল এবং তাও অধস্তন আদালতে─ এটা করা হয়েছে কোন আইনি ধারায়? দ্বিতীয় পক্ষকে নোটিশ না দিয়ে মামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া কি আইনত সঠিক হতে পারে?

শেষকথা 

ইসলামের ইতিহাস সাক্ষী─ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে এরকম, বরং এর চেয়েও গুরুতর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু মুসলমানরা স্বতন্ত্রতা, অবিচলতা, ধৈর্য, প্রজ্ঞা ও সাহসিকতার সাথে প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘুরিয়ে দিয়েছে পরিস্থিতির মোড়। তাই আজও আমাদের উচিত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া। দুশ্চিন্তা, ক্রোধ, হতাশা, নিরাশা ও হায়হুতাশ না করে আল্লাহর সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া ধৈর্য, অবিচলতা ও সাহসের সাথে। অত্যাচার-নিপীড়নের নৌকা বেশিদিন টিকে না, বিজয় ও সাফল্য সবসময় পদচুম্বন করে সত্য ও ন্যায়ের।

‘বিজয়ী তোমরাই হবে, যদি হয়ে থাকো প্রকৃত মুমিন।’ (আল-কুরআন) 

তথ্যসূত্র:

তথ্যসূত্র:
1 দেখুন : রামজির শহর অযোধ্যা : সত্য নাকি মিথ্যা: নভেম্বর, ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত, পৃষ্ঠা : ১২-১৩
2 দেখুন : সাপ্তাহিক নয়া দুনিয়া, দিল্লা, সংখ্যা : ১৮, ২০ মার্চ,‌ ১৯৮৬, পৃষ্ঠা : ১৩-১৫
3 দেখুন : হিন্দুস্তান কা শানদার মাযী : ৬৭-৬৮
4 দেখুন : সিভিল আপিল (২৭) ১৮৮৬

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷