বাবরি মসজিদের ইতিহাস : মিথ বনাম বাস্তবতা (প্রথম পর্ব)

মূল : হাবিবুর রহমান আজমি

হুসাইন আহমাদ খান

১৯৮৬ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারী (২১ জুমাদাল উখরা, ১৪০৬ হি.) শনিবার অযোধ্যা জেলার ফৈজাবাদে অবস্থিত বাবরি মসজিদকে অত্যন্ত নাটকীয় ও  অবৈধভাবে রুপান্তর করা হয় ‘রাম জন্মস্থান মন্দিরে’। এটা এমন এক ঘটনা─যার উপর মুসলমানরা যত শোক যাপন করুক, কম হবে।

এই নিষ্ঠুর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে শুধু জবরদস্তি-হানাহানি, প্রাচুর্য ও ক্ষমতার নেশায়। অন্যদিকে বিশ্বকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য দেখানো হয়েছে আদালতের রায়। অথচ এই বেআইনি কাজকে আদালতের রায় হিসেবে গণ্য করা স্বয়ং আদালতকে অপমানের নামান্তর। উপরন্তু এই তথাকথিত সিদ্ধান্তকে জায়েজ করার উদ্দেশ্যে সম্রাট বাবর ও তার সাথে সম্পৃক্ত করে ‘বাবরি মসজিদ’র ইতিহাস বিকৃত করার জন্য চালানো হচ্ছে দেশব্যাপী আন্দোলন। যদিও এই প্রক্রিয়াটি দীর্ঘকাল ধরে চলছে, কিন্তু এখন তা আরও গতি পেয়েছে। হিন্দু পরিষদ, আর্য প্রতিনিধি সভা, ভারতীয় জনতা পার্টি প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলো চিৎকার করে বলছে, ‘বাবরি মসজিদ বাবর শাহ তৈরি করেছিলেন রামের জন্মস্থান মন্দিরটি ভেঙে।’ সুতরাং এই মসজিদটিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত সঠিক ও ন্যায়সঙ্গত! 

এই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথাকে বৈধ ও সত্য ঘটনা বানাতে জ্ঞান ও গবেষণার মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে ‘তুজকে বাবরী’, ‘আইনে আকবরী’ ও ‘আলমগীরীনামা’ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক গ্রন্থেরও সম্পূর্ণ ভুল উদ্ধৃতি দেওয়া হচ্ছে।

এজন্য ১৯৮৬ সালের ২১-২২ ফেব্রুয়ারী তারিখে অনুষ্ঠিত জমিয়তে উলেমায়ে হিন্দের কাউন্সিল বাবরি মসজিদের সঠিক ইতিহাস জনসাধারণের সামনে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে; যাতে সরকারী ও বেসরকারী মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই ভুলের মেঘ কেটে যায়, যা দেশের পরিবেশকে করে দিয়েছে বিপজ্জনক মাত্রায় দূষিত। একইসাথে দেশের মানুষ যেন মিথ্যা ও অপবাদের অন্ধকারে বিচরণ না করে এই স্পর্শকাতর ও নাজুক বিষয়টিকে জ্ঞান ও গবেষণার আলোকে বিবেচনা করতে পারে। তাই জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি মাননীয় হযরত মাওলানা সৈয়দ আসআদ মাদানী এই দায়িত্ব অর্পণ করেন অধম লেখকের উপর। মজলুম বাবরি মসজিদ বিষয়ে এই প্রবন্ধটি সেই আদেশ পালনার্থে লিখিত। 

সম্রাট বাবর কি অযোধ্যায় এসেছিলেন?

যেহেতু এই মজলুম মসজিদকে সম্রাট বাবরের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়, এজন্য সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, এটি নির্মাণ করিয়েছেন সম্রাট বাবর। অতঃপর এই ধারণার উপর ভিত্তি করে বলা হয়, বাবর অযোধ্যায়  এসে রাম জন্মস্থান মন্দিরটি ভেঙে সেখানে নির্মাণ করেন এই মসজিদ। উল্লেখ্য, উত্তরপ্রদেশের তথ্য দফতর কর্তৃক প্রকাশিত ‘উত্তরপ্রদেশ’ মাসিকেও একই কথা বলা হয়েছে। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘১৯২৮ সালে বাবর এখানে (অযোধ্যায়) আসেন। তিনি এক সপ্তাহ অবস্থান করে রাম-জন্মস্থান মন্দির ভেঙ্গে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন, যা এই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে নির্মিত হয়েছিলো।’ (মাসিক উত্তরপ্রদেশ : এপ্রিল, ১৯৮৪, পৃ. ২৭)

সুতরাং প্রথমেই নির্ধারণ করতে হবে যে, বাবর কি অযোধ্যায় এসেছিলেন! কারণ এই দাবির ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে ‘রাম-জন্মস্থান মন্দির’ ভেঙে ফেলার গল্প।

ভারতের ইতিহাসবিদরা─মুসলিম যুগের হোক বা এই যুগের─সকলেই একমত, বাবরের শাসন সম্পর্কে সবচেয়ে প্রামাণিক উৎস হলো তার নিজের হাতে লেখা রোজনামচা, যা ‘তুজকে বাবরি’ নামে পরিচিত। সম্রাট বাবর ৮৯২ সালে মাত্র বারো বছর বয়স থেকে এটি লিখতে শুরু করেন এবং তার মৃত্যুরোগের ছয় মাস আগে অর্থাৎ ৯৩৬ হিজরি পর্যন্ত লিখতে থাকেন। ‘তুজকে বাবরি’তে এই লেখার সর্বশেষ তারিখ হলো ৩ মুহাররম, ৯৩৬ হিজরি। একই বছর রজব মাসে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এই রোগেই তিনি ৫ জুমাদাল উলা, ৯৩৭ হিজরিতে মারা যান। এভাবে এই রোজনামচাটি জুড়ে আছে তার জীবনের শেষ এক বছর ছাড়া সমগ্র জীবন। তিনি জীবনের প্রতিটি ছোট-বড় ঘটনা তুলে ধরেছেন। এমনকি তিনি যে স্থানগুলো পরিদর্শন করেছিলেন, সেখানের মানুষের অবস্থা, প্রাণীর প্রজাতি, জলবায়ু, বাগান, প্রাসাদ ইত্যাদি খুব আগ্রহের সাথে লিপিবদ্ধ করেছেন। মূল বইটি লেখা হয়েছে তুর্কি ভাষায়, সম্রাট আকবরের আদেশে ফারসি ভাষায় যার প্রথম অনুবাদ করেন খানেখানান আব্দুর রহিম। এই অনুবাদ আজও অপ্রকাশিত। অতঃপর ইংরেজ ঐতিহাসিক এ. এস. বেভারিজ ‘বাবরনামা ইন ইংলিশ’ নামে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন, যা ১৯২২ সালে দুটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়। ইউনিভার্সিটি ও অন্যান্য একাডেমিক মহলে এই অনুবাদটিই প্রচলিত। অনুবাদক বইটিতে বিস্তারিত পাদটীকাও যুক্ত করেছেন, যা এর উপযোগিতা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। পরবর্তী সময়ে বাবরনামা নামে উর্দুতেও প্রকাশিত হয়েছে গ্রন্থটি। এখন এই উর্দু ও ইংরেজিতে অনূদিত গ্রন্থদ্বয় জীবনী লেখকদের উৎসগ্রন্থ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই অনুবাদটি আদ্যোপান্ত পাঠ করলে কোথাও অযোধ্যায় বাবরের আগমনের উল্লেখ পাওয়া যায় না। শুধু ৯৩৫ হিজরির ঘটনাবলীর অধীনে এই লেখাটি পাওয়া যায়─ 

‘৭ রজব শনিবার আমরা অযোধ্যা থেকে তিন ক্রোশ (ছয় মাইল) দূরে ঘাঘর ও সারদা নদীর সংযোগস্থলে অবস্থান করি। (এই সংযোগস্থলটি ছিলো বাহরাইচে)। এ সময় পর্যন্ত শেখ বায়জিদ নদীর ওপারে ছিলো। সে সুলতানের (হোসেন তৈমুর) সাথে চিঠি চালাচালি করছিলো। তার ধোঁকাবাজি জানতে পেরে আমরা জোহরের সময় সুলতানকে আদেশ দিলাম, তিনি যেন নদী পার হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। খবর পৌঁছতেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে নদী পার হন। সেখানে পঞ্চাশটি ঘোড়া ও তিন-চারটি হাতি ছিলো। তারা যুদ্ধে পেরে উঠতে না পারায় পালাতে শুরু করে। ঘোড়া থেকে নেমে পড়া কয়েকজনের মাথা কেটে সামনে রাখা হয়।’ (বারবনামা উর্দু : ৩৩৯) 

বাবরের এই বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট, তিনি শেখ বায়েজিদের বিদ্রোহ দমন করতে ৯৩৫ হিজরির রজব মাসে এই নদীর তীরে এসেছিলেন। কিন্তু তার নিজের কথা অনুযায়ী, তার অবস্থান ছিলো অযোধ্যা থেকে ছয় মাইল দূরে সারদা নদীর সংযোগস্থলে। শেখ বায়জিদের পরাজয়ের পর নিজের এক আমির মীর সাইয়েদ বাকী ইসফাহানীকে এই স্থানের শাসক নিয়োগ করেন। এখান থেকে সরাসরি এলাহাবাদ ও বিহারে যান, যেখানে সুলতান মাহমুদ বিন সিকান্দার লোধী বিদ্রোহের পতাকা তুলেছিলেন। বিহার অঞ্চলে প্রায় একমাস কাটিয়ে তিনি ফিরে আসেন। ফেরার পথেও অযোধ্যা থেকে যথেষ্ট দূর দিয়ে অতিক্রম করেন; যেমনটি নিচের লেখা থেকে স্পষ্ট─

‘২২ রমজান, সোমবার আমরা চোপাদায় পৌঁছি। চিতারমাকের রাস্তায় সারদা নদীর তীর ধরে বাহার ও সারদা পার হয়ে আরও দশ ক্রোশ (বিশ মাইল) চলার পর সারদা নদীর তীরে অবস্থিত কিলরাহ নামক গ্রামে─যা ফাতেহপুর এলাকার অন্তর্গত─অবস্থান করি। কয়েক দিন এখানেই অতিবাহিত হয়। এখানে রয়েছে জলপ্রপাত, উঁচু দালান, গাছপালা; বিশেষ করে আমের গাছ এবং রঙ-বেরঙের পাখি। অতঃপর আমরা গাজীপুরের দিকে রওনা হওয়ার আদেশ দিলাম।’ (বাবরনামা উর্দু) 

এই দুটি লেখা ব্যতীত ‘তুজকে বাবরি’তে এমন কোন লেখা পাওয়া যায়নি, যাতে এই ভূমিতে বাবরের সফরের সন্ধান পাওয়া যায়। 

তুজকে বাবরি ছাড়াও খাজা নিজামুদ্দিন আহমদ কর্তৃক সংকলিত তবাকাতে আকবরী, আবুল ফজল লিখিত আকবরনামা, মোল্লা আব্দুল কাদির বাদায়ুনী লিখিত মুনতাখাবুত তাওয়ারীখ, মুন্সী সুবহান রায়ের খুলাসাতু তারিখ, মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা লিখিত তারিখে ফিরিশতা, মুহাম্মদ হাশিম খান লিখিত মুনতাখাবাতুল লুবাব; এককথায় সমসাময়িক বা অ-সমসাময়িক প্রামাণিক ও নির্ভরযোগ্য ইতিহাসে বাবরের অযোধ্যা সফরের কোনো উল্লেখ নেই। এজন্য যার ভিত্তিতে ‘মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণ’ করার দালান দাঁড় করানো হয়; যখন এই ভিত্তির অস্তিত্ব নেই, তাহলে দালানের কী অবস্থা হবে, তা বোঝা কঠিন নয়।

শুধু অযোধ্যায় নয়, অন্য কোনো স্থানে সম্রাট বাবরের মন্দির ভাঙার কোনো প্রমাণ নেই; এমনকি যাদবনাথ সরকার, ইস্ট ও ডাওয়াসনও বাবরের মন্দির ভাঙার কোনো উল্লেখ করেননি। অথচ এই ঐতিহাসিকগণ ছিলেন মুসলিম শাসক কর্তৃক মন্দির ধ্বংসের ঘটনাতে বিশেষ আগ্রহী।

বাবরের একটি ওসিয়ত 

এই ঐতিহাসিক প্রমাণ ছাড়াও বাবর এমন মন ও মেজাজের শাসক ছিলেন, যার সম্পর্কে এটা কল্পনাও করা যায় না যে, তিনি কোন ধর্মীয় উপাসনালয়ের দিকে ভুলেও নজর দেবেন। তার মেজাজ বোঝার জন্য এই ওসিয়তই যথেষ্ট, যা তিনি নিজের ছেলে হুমায়ুনের জন্য লিখেছিলেন─

‘হে বৎস! ভারতের সাম্রাজ্য বিভিন্ন ধর্মে পূর্ণ। আল্লাহর শুকরিয়া, তিনি আমাদের এই রাজ্য দান করেছেন। তোমার জন্য আবশ্যক হলো, নিজের হৃদয় থেকে সমস্ত ধর্মীয় কুসংস্কার মুছে ফেলা, প্রতিটি ধর্মের পদ্ধতি অনুসারে ন্যায়বিচার করা এবং বিশেষ করে গরু কুরবানী না করা। এতে তুমি ভারতবাসীর হৃদয়কে বশীভূত করতে পারবে। তাহলে এই দেশের প্রজারা রাজকীয় অনুগ্রহে বেঁচে থাকবে। যে গোষ্ঠী সুলতানের আনুগত্য করে থাকে তাদের মন্দির ও উপাসনালয় ধ্বংস করবে না। এমনভাবে ন্যায় ও ইনসাফ করবে, যাতে রাজা তার প্রজাদের উপর খুশি থাকে এবং প্রজারা থাকে রাজার উপর খুশি। ইসলামের প্রচার জুলুমের তরবারির চেয়ে অনুগ্রহের তরবারি দ্বারা বেশি হবে। শিয়া ও সুন্নিদের মতানৈক্য থেকে চোখ বন্ধ করে নেবে। অন্যথায় এর দ্বারা ইসলামের মধ্যে দুর্বলতা তৈরি হতে থাকবে। এই চারটি উপাদান অনুসারে বিভিন্ন ধর্মের প্রজাদের একত্রিত করবে; যেভাবে একত্রিত হয় মানবদেহ, যাতে সাম্রাজ্যের কাঠামো মতপার্থক্য মুক্ত থাকে।’ পহেলা জুমাদাল উলা, ৯৩৫ হিজরি। {ইন্ডিয়া ডিভাইডেড : ১৩৯। লেখক: ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ (ভারত প্রজাতন্ত্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি)}

এসব যুক্তি ও প্রমাণের আলোকে একজন সৎ ঐতিহাসিক ও বাস্তববাদী পর্যবেক্ষক এই মত গ্রহণ করতে বাধ্য হবেন, সম্রাট বাবর মন্দির ভাঙার অভিযোগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এজন্য অধ্যাপক শ্রী রাম শর্মা তার বিখ্যাত বই ‘মুঘল এম্পায়ার ইন ইন্ডিয়া’তে সম্পূর্ণ পরিষ্কারভাবে লিখেছেন, ‘আমরা এমন কোনো প্রমাণ পাই না যে, বাবর কোনো মন্দির ভেঙেছেন বা কোনো হিন্দুকে শুধু হিন্দু হওয়ার কারণে নিপীড়ন করেছেন।’ (পৃ. ৫৫, সংস্করণ ১৯৪৫, মাআরিফ সূত্রে : ১৮৬)

সত্যের সন্ধান

যখন নিশ্চিতভাবে জানা গেলো যে, বাবর অযোধ্যায় আসেননি, তখন তার বাবরি মসজিদ নির্মাণের প্রশ্নই ওঠে না। এজন্য এখন ইতিহাসের আলোকে খুঁজে বের করতে হবে, এই মসজিদের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা কে এবং তিনি কখন নির্মাণ করেছিলেন? এই বিষয়ে প্রথমেই মনে রাখতে হবে, ভারতের লক্ষাধিক মসজিদের তুলনায় অযোধ্যার বাবরি মসজিদের কোনো বিশেষ পার্থক্য নেই। এ কারণেই ইতিহাসবিদরা অন্য সাধারণ মসজিদের ইতিহাস বর্ণনা করার ব্যাপারে যেমন বিশেষ গুরুত্ব দেননি, একই কথা অযোধ্যার বাবরি মসজিদ সম্পর্কেও। যদি এই মসজিদের কোন বিশেষ গুরুত্ব থাকতো বা এর নির্মাণের সঙ্গে জড়িত থাকতো কোনো আবেগঘন ঘটনা কিংবা অন্তত কোন সুলতান কর্তৃক নির্মিত হতো, তাহলে ইতিহাসবিদরা এভাবে নীরব না থেকে তার বিবরণ লিখতেন। কিন্তু ইতিহাসবিদদের এই সম্পূর্ণ নীরবতা সত্ত্বেও বাবরি মসজিদের ইতিহাস একেবারেই অন্ধকারে নয়, বরং এ সম্পর্কে লিখিত বইয়ের বিবরণ অনুযায়ী আয়নার মতো উজ্জ্বল।

আজকের বিশ্বে শিলালিপির গুরুত্ব জ্ঞানীদের কাছ থেকে গোপন নয়। আজ সরকারগুলো এগুলোর সংস্থান ও সুরক্ষার জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে। এ থেকে শুধু ইমারতগুলোর ইতিহাসই জানা যায় না, বরং বিভিন্ন জাতির ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস সংকলনে সবচেয়ে খাঁটি উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হয়। 

অযোধ্যার বাবরি মসজিদের শিলালিপি

সর্বসম্মতভাবে বলা যায়, ‘একটি নয়, তিনটি শিলালিপি বাবরি মসজিদে স্থাপিত হয়েছিলো, যার মধ্যে দুটি ঐতিহাসিকভাবে বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। কারণ এতে মসজিদটি নির্মাণের সন-তারিখ ও প্রতিষ্ঠাতার নাম রয়েছে।

প্রথম শিলালিপিটি দুই মিটার দীর্ঘ ও ৫ সেন্টিমিটার চওড়া পাথরের ফলকের উপর, যা মসজিদের মাসকাফ অংশের মধ্যম দরজার উপরে স্থাপিত, যার উপর বিসমিল্লাহসহ তিনটি লাইনে আটটি কবিতা লেখা আছে। দ্বিতীয় স্তবকে, প্রতিষ্ঠাতার নামটি স্বচ্ছতার সাথে ছন্দিত হয়েছে এবং অষ্টম কবিতার দ্বিতীয় স্তবকে রয়েছে নির্মাণের ইতিহাস।

بسم الله الرحمن الرحيم

بنام آنکه او داناست اکبر+ کہ خالق جملہ عالم لا مکانی+ درود مصطفی بعد از ستائش

که سرور انبیاء زیدہ جہانے+ فسانہ در جہاں بابر قلندر+ که شد در دور گیتی کامرانی

چناں کہ مطلع کشور گرفته+ زمین را چون مبارز آسمانے+ دراں حضرت یکے سید معظم

که نامش میر باقی اصفہانے+ مشیر سلطنت تدبیر ملکش+ کہ زین مسجد حصار مهستانے

خدایا در جہاں تابندہ ماند+ که خیر و بخت و تخت و زندہ گانے+ دریں عہد و دریں تاریخ میموں

که نه صد پنج وسی بودہ نشانے+ 

(শেষ দুই লাইনে আরবীতে এমন কিছু লেখা আছে, যা পড়া যায়নি। হাবিবুর রহমান)

এই শিলালিপির কবিতায় প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা, তারপর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরুদ এবং তাঁকে সকল নবীর সরদার ও বিশ্বজগতের সারসংক্ষেপ বলা হয়েছে। তারপরের দুটি কবিতায় বাবরের প্রশংসা এবং তার বিজয়গুলো সম্পর্কে অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও সমৃদ্ধ ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। এটি বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, এই স্থানে ‘বাবর’কে একজন রাজার পরিবর্তে একজন কালান্দর হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই শব্দটি সুফী পরিভাষায় মেরাঞ্জন মেরাঞ্জ এবং সব ধরনের ধর্মীয় পক্ষপাত থেকে মুক্ত ব্যক্তিত্বের সাথে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

অতঃপর বলা হয়েছে, বাবরের দরবারীদের মধ্যে একজন সম্মানিত আমির আছেন, যার নাম ‘মীর বাকি ইসফাহানি’। এরপর মীর বাকির সাম্রাজ্যের ব্যবস্থাপনাগত পরিচিতি দেওয়া হয়েছে। তার পরের অংশে বলা হয়েছে, এই মীর বাকির সুবাদে এই মসজিদটি আলোকিতদের জন্য বেষ্টনী হিসেবে নির্মিত হয়েছে। পরের চার লাইনে তার জন্য দুআ করা হয়েছে যে, হে আল্লাহ! দুনিয়াতে তার কল্যাণ অর্থাৎ মসজিদ, তার অবস্থান ও মর্যাদা এবং তার জীবনকে হেফাজত করুন, যাতে ৯৩৫ হিজরিতে নির্মিত এই স্মরণীয় স্থান অবশিষ্ট থাকে।

মিসেস বেভারিজ তার অনুবাদগ্রন্থ ‘দি বাবরনামা ইন ইংলিশ’ দ্বিতীয় খণ্ডের পরিশিষ্টে ‘অযোধ্যার বাবরি মসজিদ’র শিলালিপি’ শিরোনামের অধীনে মিম্বরের বাম দিকের শিলালিপি ছাড়া উল্লিখিত শিলালিপির কথাও লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু তিনি আটটি স্তবকের মধ্যে শুধু প্রথম তিনটি উল্লেখ করেছেন। বোঝা যায়, অবশিষ্ট অংশগুলো তিনি পড়তে পারেননি, তাই ছেড়ে দিয়েছেন।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিলালিপিটি মসজিদের ভিতরের অংশে মিম্বারের ডান ও বাম পাশে ছিল।  

২. (ডান দিকের শিলালিপি) 

بمنشائے بابر خدیوں جہاں + بسا که با کاخ گردوں عناں

بنا کرد این خانه پائیدار+ امیر سعادت نشاں میر خان

بماند همیشه چنیں با نیش+ چناں شهریار زمین و زماں

৩. (বাম দিকে শিলালিপি)

به فرموده شاه بابر که عدلش+ بناییست با کاخ کردوں ملاقی

بنا کرده این محیط قدسیان را+ امیر سعادت نشاں میر باقی

بود خبر باقی و سال بنائش+ عیاں شد چون گفتم بو ی گفتم بود خیر باقی 

۹۳۵

সামান্য পার্থক্য ছাড়া এই দুটি শিলালিপির অর্থ অভিন্ন। তবে দ্বিতীয় স্তবকের শেষ লাইনে দুআ এবং তৃতীয় স্তবকের শেষ বাক্যে এটি নির্মাণের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু মিসেস বেভারিজ এটি পড়তে ভুল করেছেন, যা নির্মাণের অর্থকে বিকৃত করে। তিনি শেষ কবিতায় লিখেছেন, 

بود خیر باقی چو سال بنائش عیاں شد که گفتم بود خیر باقی

অথচ শুদ্ধ হবে এভাবে, 

بود خیر باقی وسال بنائش عیاں شد چون گفتم بود خیر باقی

২৭ মার্চ ১৯৩৪ মোতাবেক ১১ জ্বিলহজ, ১৩৫৩ হিজরিতে অযোধ্যায় একটি বিশাল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। এই সময় দাঙ্গাকারীরা বাবরি মসজিদে প্রবেশ করে এবং সেখানে ভাঙচুর চালায়। এই দুটি শিলালিপিও সরিয়ে ফেলা হয়, কিন্তু পরে মিম্বরের বাম পাশের শিলালিপির একটি কপি তাহের খান ঠিকাদার দ্বারা প্রস্তুত ও স্থাপন করা হয়, কিন্তু তিনি ডান দিকেরটি কপি করতে পারেননি।

সৈয়দ বদরুল হাসান ফৈজাবাদীর কাছে এই ধ্বংসকৃত শিলালিপির একটি অনুলিপি ছিলো। এই অনুলিপি অনুযায়ী এখানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

এই তিনটি শিলালিপির ফিল্ম এবং এর ছবি (ফার্সি ও আরবি ভারতীয় শিলালিপি ১৯৬৫ এর পরিশিষ্ট; নাগপুরে পাওয়া যায়) দেখা যেতে পারে।

মসজিদের মূল দরজার মূল শিলালিপি এবং মিম্বারের বাম পাশে কপিকৃত শিলালিপি─এই দুটি শিলালিপি ১৯৪৯ সালের আগে মসজিদে উপস্থিত ছিলো। এটা এখনও রয়েছে নাকি বৈরাগীদের হাতে ধ্বংসের শিকার হয়েছে, আল্লাহ ভালো জানেন। কেননা প্রায় ৩৭ বছর ধরে মুসলিমদের জন্য এই প্রাচীন মসজিদের পাশ দিয়ে যাওয়াও নিষেধ; এর ভিতরে যাওয়া তো দূরের কথা। তাই এই মুহুর্তে এই শিলালিপিগুলো সম্পর্কে চূড়ান্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।

কিন্তু এসব শিলালিপি এখন মসজিদে আছে কি নেই, তাতে এগুলোর সত্যতার উপর কোনো প্রভাব পড়বে না। কেননা এগুলোর সূত্র পরম্পরায় প্রামাণিক কপি সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য বইগুলোতে পাওয়া যায়। 

এই শিলালিপিগুলো আজও সাক্ষ্য দিচ্ছে, অযোধ্যার বাবরি মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা শাহ বাবর নন, বরং তার একজন আমির ‘মীর বাকি ইসফাহানি’, যাকে বাবর কর্তৃক ৯৩৫হি./১৫২৮ খ্রিস্টাব্দে অযোধ্যা অঞ্চলের শাসক হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছিলো। মীর বাকি এই নিযুক্তির স্মারক হিসাবে এই মসজিদটি নির্মাণ করেন; যেমনটি প্রথম শিলালিপির শেষ স্তবক থেকে স্পষ্ট।

আর তৃতীয় শিলালিপির দ্বিতীয় কবিতা থেকে বোঝা যায় যে, এই মসজিদটি ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে নির্মিত হয়েছে। কেননা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ফেরেশতাদের দরুদ পাঠের স্থানকে কখনোই জুলুমের উপর ভিত্তি করে রাখা যায় না। ইসলামী আইন অনুযায়ী যেকোনো ধর্মের উপাসনালয় ধ্বংস করা নিষ্ঠুরতা ও বাড়াবাড়ি। এই অন্যায় কাজ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছেন।

এই কারণেই মিসেস বেভারিজ তার অনুবাদ ও ব্যাখ্যায় কোথাও লেখেননি যে, এই মসজিদটি রামের জন্মস্থান ভেঙ্গে নির্মিত হয়েছিলো। একইভাবে উইলিয়াম এরস্কিন, অসব্রুক উইলিয়াম যারা বাবরের যুগের ইতিহাস লিখেছেন, তারা কেউ বাবরের আমলে মন্দির ভাঙার কথা উল্লেখ করেননি।

এসব প্রামাণিক ঐতিহাসিক তথ্য ছাড়াও মসজিদের স্থান থেকেও বুঝে আসে যে, মসজিদের আগে এখানে কোন মন্দির থাকতেই পারে না। কেননা মসজিদের চার দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে ‘গঞ্জ শহীদান’ অর্থাৎ ঐ শহীদদের সমাধি, যারা ছিলেন সেনাপতি মাসুদ গাজীর সাথী-সঙ্গী। তার দুই ধাপ দূরে কাজী কুদওয়ার কবর রয়েছে, যিনি ছিলেন কুদওয়াই পরিবারের উত্তরাধিকারী।

মাসুদ গাজী হিজরি পঞ্চম শতাব্দীতে এই ভূখন্ডে আসেন…। তাই এই স্থানে তার সঙ্গীদের সমাধির উপস্থিতি নির্দেশ করে যে, এখানে কোন মন্দির ইত্যাদি ছিলো না। এই মাজারগুলো নির্মিত হওয়ার পর মহল্লা কাজিয়ানা এবং আরও একটি মুসলিম মহল্লার শুরু হয়, যেখানে ছিলো শেখ নাসিরুদ্দিন চেরাগ দাবিলির পৈতৃক বাড়ি। মসজিদের পশ্চিমে একটু দূরে ছিলো বেগমপাড়া, যা অযোধ্যার নবাবের সময় পর্যন্ত ছিলো শুধু মুসলমানদের বসতির অন্তর্গত। উত্তর দিকে মসজিদ সংলগ্ন প্রায় পনের মিটার চওড়া একটি প্রাচীন রাস্তা রয়েছে। এই প্রাচীন রাস্তার দক্ষিণ পাশে শুধু মুসলমানদের জনবসতি এবং তাদের প্রাচীন কবরস্থান রয়েছে। এই দিকে অযোধ্যার নবাবদের আমলের আগে না কোন হিন্দু জনবসতি ছিলো, না কোনো মন্দির। তাদের সমস্ত মন্দির ছিলো রাস্তার উত্তর দিকে। এ থেকে বোঝা যায়, মসজিদের জায়গাটি আগে থেকেই মুসলমানদের মালিকানাধীন ছিলো, তাই এখানে মন্দির থাকার প্রশ্নই আসে না।

আজ প্রায় আট-নয় বছর আগে বাবরি মসজিদের পশ্চিম দেয়ালের ঠিক পাশেই সরকার প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর দ্বারা একটি বড় আকারের খননকার্য পরিচালনা করে। কিন্তু খননের পরও এই স্থানে কোনো ভবনের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এই খননের প্রতিবেদন সরকারের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। এই সমস্ত তথ্য ও দলিলের উপস্থাপনের পর আমরা উপযুক্ত মনে করছি যে, এ বিষয়ে একজন হিন্দু গবেষকের গবেষণা তুলে ধরা, যাতে প্রকৃত সত্য আলোকিত হয়ে সামনে আসে।

 

চলবে…

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷