বাদিয়া হাঁটতে হাঁটতে রামাল্লা হাসপাতালে প্রবেশ করে। প্রতিদিনের মতো। যেন এটি তার নিজের জায়গা। তাড়াহুড়ো করে না। সবাইকে অভিবাদন জানায় এবং তাদের শুভেচ্ছা গ্রহণ করে। তার হুঁশিয়ারি, কৌতূহল আর গা শিউরানো গল্পগুলোও দল বেঁধে আসতে থাকে। সে ধীর পায়ে হাঁটে। রিসেপশনিস্ট সামিরার (সম্প্রতি বিবাহিত, সবাইকে খুশি করতে আগ্রহী) কাছে জানতে চায়, তার স্বামীর ওপর ট্রানকুইলাইজারের প্রভাব কেমন ছিল, যে কি না তাকে ষাঁড়ের মতো কামনা করে।
ফ্লোর বয় সাইদকে বলে, শিরদাঁড়া ব্যথার একটা বিশেষ চিকিৎসা দেবে তাকে। ব্যথায় ছেলেটা নাকি সারা রাত ঘুমাতে পারে না। দেখে, সুদর্শন তরুণ ডাক্তার সামি—নার্সরা যাকে থামিয়ে আবহাওয়া ও দুরারোগ্য ব্যাধি সম্পর্কে হাস্যকর প্রশ্ন করতে ভালোবাসে—তার দিকেই আসছে। সে এগিয়ে গিয়ে শ্রদ্ধাভরে তার হাতে চুম্বন করে পুরোনো দিনের সিনেমার মতো। ‘খোদা আপনাকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করুন,’ সে হাসতে হাসতে বলে এবং তার মা সিত্ত ফিকরিয়ার কুশল জিজ্ঞেস করে, ছেলেকে ডাক্তার বানাতে যিনি জীবন দিয়ে দিয়েছেন।
বাদিয়া হাঁটতে হাঁটতে কমলা রঙের সাইড ব্যাগ দোলায়। কী আছে এই ব্যাগে কেউ জিজ্ঞেস করতে সাহস করে না। মাথার কোমল স্কার্ফ আলগা হলে লাল খোঁপা থেকে পিছলে মেঝেতে নেমে যায়। তরুণ ডাক্তারকে চুম্বনের স্মৃতি মনে পড়ে আবার। গালভরা হাসি ছলকে উঠলে নিজেকে দমন করে। মুখে আওড়ায়, ‘আপনাকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করুন।’ নীল পুতির চাবি দিয়ে মর্গের দরজা খোলে, সাদা গাউন গায়ে চড়াতে পোশাক অদলবদল করে। মুঠোফোনে রিং বাজে। উম্মে সালামা, ফোন করে বলছে যে, সে হাইফা থেকে চামড়া–ওঠা রোগে আক্রান্ত একটা মেয়েকে পাঠিয়েছে, একটু যেন পানি দেয়।
মেয়েটির মায়ের সাথে খালাফ পারফিউমের দোকানে দেখা হয়েছিল উম্মে সালামার। তাকে বলেছে সে, বাদিয়া তার জাদুর পানি দিয়ে নিশ্চয় তাকে সারিয়ে তুলতে পারবে। কোথায় কাজ করে বাদিয়া তার লোকেশনও দিয়েছে। উম্মে সালামাকে নিয়ে বাদিয়া বিরক্ত, এই এক কথা সে সবাইকে বলে বেড়ায়। খানিকটা উদ্বিগ্নও। এমন চলতে থাকলে খোদা না করুন রামাল্লা হাসপাতালে তার কর্মস্থল তো একদিন মাজারে পরিণত হবে, নয়তো খানকায়। তাকে বলাই উচিত হয় নাই যে, ওসামার মৃত্যুর পর তার গা ধোয়া পানিতে কীভাবে তার একজিমা জর্জরিত হাত পরিষ্কার হয়ে গেছে।
সেই মহিলার কথা না বললেই না, যে একবার মর্গে ঢুকে পড়েছিল একটি মেয়ের মরদেহ থেকে ছিটকে পড়া পানি চুরি করার জন্য। সেই পানি নাকি তার কোন আচার–অর্চনায় লাগবে। বাদিয়া তাকে সরানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু সে নীচু হয়ে মেঝের ঢালুতে যেখানে সামান্য পানি জমে আছে, সেগুলো চাটতে হামাগুড়ি দিয়ে পড়ে।
নার্স সামাহ আসে। প্রতিদিন তাম্মুন থেকে যাতায়াত করে সে। আজকের দিনে কোন মরদেহের কী সময়সূচি দেখে নেয়। প্রথম মরদেহটি আশির কাছাকাছি আল–বিরহের এক মহিলার। দ্বিতীয়জনও মহিলা, বছর পঞ্চাশের; তাকে নাবলুসে যাওয়ার জন্য রেডি করতে হবে। তৃতীয়টি বিশ বছরের এক তরুণী, যে তিন দিন ধরে মর্গে। গোটা দিনের কাজ অপেক্ষা করছে কিন্তু বাদিয়া তার বিশেষ ভেষজ তৈরি এক গ্লাস চা এবং একটা সিগারেট না খেয়ে কাজ শুরু করে না।
অল্পবয়সী মেয়েদের ধুতে ভালো লাগে না তার, বিশেষ করে মা হলে। বয়স্করা ভালো—তাদের দেহ থেকে নিস্তার পেতে সবাই তাড়া দেয়, শোক করে কমই। তাদের মেয়েরা বা ছেলে বউরা তার হাতে দু–চারটা অর্থও গড়িয়ে দেয়। এভাবে তারা বৃদ্ধ মায়ের অনিবার্য মৃত্যু–শোকের অসহায় অনুভূতি খানিকটা ঝেড়ে ফেলার সুযোগ পায়। বিশেষ করে যদি বৃদ্ধার শরীরে বেডসোর দেখা দেয়, আর তার দীর্ঘ, বিরামহীন ঘুমের কারণে ফুলে গোলাপি হয়ে ওঠে। এসব তখন নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত ছেলে–মেয়ের চোখে পঁচা ক্ষতের মতো যন্ত্রণার লাগে। বাদিয়া প্রথমে তাই দুই বয়স্ক মহিলাকে ধরে, পরে তরুণীর কাছে যাবে।
সামাহ সীমাহীন শ্রদ্ধা আর কিছুটা বিস্ময় মেখে বাদিয়ার দিকে তাকায়। বাদিয়ার অদ্ভুতসব গল্প শুনিয়ে সে তার বন্ধুদের মুগ্ধ করে প্রায়ই। তার মা তাকে একদিন সাবধান করে দিয়েছেন, বাদিয়ার খুব কাছে যেন না ঘেঁষে, তাতে তার বিয়ের সম্ভাবনা নষ্ট হতে পারে। সে কি চিরকাল আইবুড়ো থাকবে নাকি? মৃতধোয়া জাদুর পানি অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু বাদিয়া সামনে এলে ওসব ভুলে যায় সামাহ। বরং তাকে চেকপয়েন্টে আটকে থাকা রাস্তার হালহকিকত বলতে থাকে। আসলে সে তাকে আরও কিছু জানাতে চায়, পারে না।
মাসখানেক থেকে সামাহ’র পরিবর্তন লক্ষ করছে বাদিয়া। বুঝতে পারছে যে, এমন একটি গোপনীয়তা আছে, যা কাউকে বলতে পারছে না, এমনকি বাদিয়াকেও না—যার কাছে সবাই তাদের হৃদয় খুলে দেয়। আজকাল সামাহ’র অভ্যাস হয়ে গেছে, প্রতিদিন শিফটের মধ্যখানে এক ঘণ্টা ছুটি চায়। এরকম এক মাস ধরে চলছে, দীর্ঘ ছুটি থেকে ফিরে আসার পর থেকে। তার দাবি, ওই সময়টায় সে পরিবারের সাথে গ্রামের বাড়ি কাটিয়েছে। কেউ বলতে না চাইলে বাদিয়া মনে করে তাকে জিজ্ঞেস করতে যাবে না।
প্রথম বডির কাজ শেষ। সহজ কাজ—সবকিছু সময়ের আগে প্রস্তুত ছিল। মৃত মহিলার দুই ছেলে-বউ’র তত্ত্বাবধানে সব সম্পন্ন হয়েছে। যদিও তারা মর্গের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, যখন বাদিয়া স্ফীত শরীরে পানি ঢেলেছে, প্রার্থনা করেছে। ‘মেয়ে ছাড়া মা’র চেয়ে নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আর কী আছে? কন্যাহীন মায়ের জন্য শোক করার কেউ থাকে না, বাদিয়া ভবে। কাজ শুরু করার আগে অবশ্য একজন তার হাতের তালুতে পঞ্চাশটি ডলার গুঁজে দিয়েছে। এমন হলে সে সমস্ত হৃদয় ঢেলে কাজটি করতে পারে।
সে এবার দুই পায়ের মধ্যখানে একটি পরিষ্কার তোয়ালে রাখে, তারপর শরীরের ডান দিকটি তার দিকে টেনে আনে এবং পরিষ্কার করে। তারপর বাম দিক। সবটুকু পানি মোছে। শেষে মাথা আগে পেঁচিয়ে নেয়, তারপর পুরো শরীর পরিষ্কার সাদা কাপড়ে ঢেকে দেয়। দ্বিতীয় মরদেহের সাথে একই যত্ন করা হয় না তার। একে সম্ভবত তার পরিবারের মহিলারা নাবলুসে নিয়ে গিয়ে নতুন কাফন পরাবে।
বাদিয়া একটু সিগারেট খাওয়ার বিরতি নেয়। স্বাদটা সকালের থেকে অন্যরকম লাগছে। এটা আসলে অপেক্ষার সিগারেট, সামাহ ফিরে আসবে এই আশায় ধূমপান। কিন্তু সামাহ আসে না। অনেক সময় যায়। বাদিয়া তাকে বলেছিল, সে এলে পরে তিন নম্বর দেহ ধরবে। আসলে অজুহাত। অল্প বয়স্ক শরীর তাকে ভয়ে ধরিয়ে দেয়। এমন না যে, হাসপাতালে তরুণ লাশ তার হরহামেশা দেখা। তার তরুণ ক্লায়েন্টদের বেশিরভাগ মেয়ে এবং প্রেম কিংবা সন্দেহের ঘটনায় খুন। স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে মাত্র দুজনের।
সে জানে, বাকি দিনটা তার আঁধার আঁধার লাগবে।
লেবাররা তরুণীর লাশকে কক্ষের মাঝখানে একটি বড় স্ল্যাবের উপর এনে রাখে। হাসপাতালের নীল চাদর দিয়ে ঢাকা। ফ্রিজের তিন দিন পৃথিবীর সবচে নরম শরীরও শক্ত করে দেয়। বাদিয়া হঠাৎ টের পায় জানালা গলে আঁধার ভেঙে একটা আলোর রেখা আসছে। ঘরের বাতাসে ঝুলে থাকা ধুলা দেখা যায়। রাস্তার হকারদের কণ্ঠস্বর টিফিনের বিরতিতে পাশের কাদ্দৌরা ক্যাম্প বালিকা বিদ্যালয়ের শিশুদের কোলাহলের সাথে মিশে যায়। হাসপাতালের বেজমেন্টে বসে বোঝা যায় না কিছু।
মেয়েটির মুখ থেকে চাদর তুলে নেয় সে। বেরিয়ে আসে ঘন, ঢেউ খেলানো লাল চুল, কোমর বরাবর নামছে। স্তনগুলি পাশ দিয়ে ঝুলছে। বাদিয়া থমকে যায়। এক ঝলকে বুঝতে পারে, একটি শিশুর মুখ বৃন্তের চারপাশে আটকে আছে। লালভাব, প্রদাহের চিহ্ন এখনও স্পষ্ট। জরায়ু ও নাভির চারপাশের ত্বক বলছে যে, জন্ম দিয়েছে বেশি দিন হয় নাই। বাদিয়া চামড়া ছুঁয়ে পিছিয়ে যায়। তিন দিন ফ্রিজে রাখা একটি শরীর কীভাবে এত উষ্ণ আর নরম থাকতে পারে?
মেয়েটির ফাইলের কাছে ছুটে যায়। পড়ে—ঊনত্রিশ বছর বয়সী, নার্স, রক্তে বিষের আলামত। ‘তারা তাকে হত্যা করেছে’—চিন্তাটি মনের মধ্যে লাফিয়ে ওঠে। তারা তাকে হত্যা করেছে। এক মুহূর্তের জন্য নিজের বুক খামচে ধরে। সব মনে রেখেছে সে, যেন এইমাত্র ঘটেছে সব। মাত্র সতেরো বছর বয়সে ওসামার সাথে তার দেখা হয়। কালো পোশাক, একটি সাদা ঘোড়ায় চড়ে আল–বিরহে তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। দেখেই ভালোবেসে ফেলে। সন্ধ্যার নামাজের পর অদূরের মসজিদ থেকে বের হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকে। যতবার তার পাশ দিয়ে যাবার প্রতীক্ষা করে, তত ভালোবাসা বাড়ে। পরে রামাল্লা বাজারের একটি কাপড়ের দোকানে তাদের সাক্ষাৎ হয়।
রামাল্লা আর আল–বিরহের মধ্যে দূরত্ব কতখানি ওই সময় সে টের পেত। এর আগে ভিড়বাট্টার শহরগুলি তার মস্তিষ্কে ছিল একেকটা কাল্পনিক রেখার মতো, কোথায় কী আছে বাসিন্দারা ছাড়া বুঝি কেউ জানে না। আল–বিরহ থেকে, মানে মায়ের বিশাল পরিবারের দৃষ্টি থেকে দূরে রামাল্লাকে মিলনের স্থান হিসেবে বেছে নিলে পরে ধীরে ধীরে রেখাগুলো সড়কের মতো বড় আর স্পষ্ট হতে থাকে।
ইন্তিফাদার প্রথম দিন—তারা বাগদান করে, একসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে এবং সিটি সেন্টার আর বিরজেইত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যবর্তী রাস্তায় ভাড়া গাড়িতে রোমাঞ্চকর মুহূর্তগুলি উড়িয়ে দেয়। মিলনের সেই ক্ষণগুলি ছিল বন্ধুর বাড়িতে আড্ডার চেয়েও মিষ্টি। বন্ধু উম্মে সালামা অবশ্য তখনও ‘সালামার মা’ হয়ে ওঠে নি। কী এক কারণে ওসামা খুন হয়ে যায়, বাদিয়ার পেটে রেখে যায় অনাগত উপহার। কী ঘটতে যাচ্ছে মা যদি তা খেয়াল না করতেন, তাহলে সে নিজেও মরে যেত এতদিনে।
সেই দুর্যোগ থেকে কীভাবে বেরিয়ে এসেছিল তা আর মনে করতে ভালো লাগে না বাদিয়ার। মা তাকে মৃত্যুর কবল থেকে বাঁচাতে যথেষ্ট চতুর ছিলেন। কিন্তু ভ্রূণটি জন্মের পরই মারা যায়। ছেলে না মেয়ে—মা বলতে চান নি, সে–ও জিজ্ঞেস করে নি। একটা ভারী বোঝা নেমে গেছে মনে হয়েছিল, যখন মা বলেছিলেন, ওটা মারা গেছে এবং জেরুসালেম প্রাইভেট হাসপাতালের করিডোরে অদৃশ্য হয়ে গেছে। এখানেই মা তাকে নিয়ে এসেছিলেন এই ধরনের মেয়েদের সুরক্ষায় বিশেষায়িত একটি মহিলা সমিতির সহায়তায়।
বিপর্যয়ের বদলে জায়গা করে নিয়েছিল এক ভয়ানক শূন্যতা। বুক থেকে গর্ভ পর্যন্ত বিস্তৃত সে–শূন্যতা সময়ের ব্যবধানে হাসিতে ভরিয়ে তুলেছে সে—সহকর্মীদের সমস্যা সমাধান আর মরদেহ পরিচ্ছন্ন করার মধ্য দিয়ে। মা মারা যাওয়ার পরে এই পেশায় আসে। মাকে গোসল–কাফন করাতে হাসপাতালে একটি মানুষ খুঁজে পায় নি। ভয় না পেয়ে তাই নিজেই দায়িত্ব নেয়—এটা এমন প্রশান্তি দেয় তাকে, যা আগে কখনও পায় নি। পবিত্র পবিত্র একটা অনুভূতি। এই অনুভূতিই তাকে মরদেহ ধোয়ার পেশায় টেনে আনে। সেদিনের পর থেকে অন্যের দুঃখ–কষ্ট দেখে দেখে সরল জীবনযাপনে তুষ্ট রেখেছে নিজেকে।
মেয়েটির দেহ দুই হাতে নড়াচড়া করার আগেই স্ল্যাব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এত নরম যে বাদিয়ার অন্তর ভয়ে ঠক ঠক করে। মাথায় পানি ঢালে। শরীরে হিংস্রতার চিহ্ন তন্ন তন্ন করে খোঁজে। জোড়া দিয়ে দিয়ে মেয়েটির গল্প বোঝার চেষ্টা করে। ফাইলের পাতায় উল্টে দেখে—একটি অনাথ আশ্রমে বেড়ে ওঠা, জন্ম ১৯৯০ সালের অক্টোবরে। বাদিয়ার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়। দেহটা তালুতে আগলে নেয়। পিঠ ধোয়ার জন্য ধড় উঁচু করে। মেয়েটির শরীরের উপরিভাগ বাদিয়ার বাহুতে পরম শিথিলতায় ঝোলে। মাথা বদিয়ার বাম কাঁধে পড়ে থাকে যেন ঘুমাচ্ছে। শান্ত, যেন মায়ের আলিঙ্গনে বিশ্রাম নিচ্ছে। বাদিয়ার গাল বেয়ে অশ্রু বয়ে যেতে শুরু করে, বাধা দেয় না। তার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদে। মেয়েটির জন্য কতটা দুঃখ অনুভব করছে সে কেউ জানে না। সে–ও একজন মা ছিল—ছিল না? কোথায় তার সন্তান? সন্তানের বাবা?
আবার ছুটে গিয়ে ফাইল দেখে। মেয়েটি কি অবিবাহিত ছিল? বিয়ে না করে সন্তান জন্ম দিয়েছে? এ–থেকে মুক্তি পেতেই কি বিষ? লাশ ও ফাইলের মাঝখানে কয়েকবার ছোটাছুটি করে। তারপর মাথার কাছে আসে, নাকের ছিদ্র পরিষ্কার করে, মুখ খোলে এবং যথারীতি ঠোঁটের ভেতরে আঙ্গুল ঢুকায়। যখন বাম কান পরিষ্কার করতে ডান দিকে মুখ ফিরায়, চোখের পাতা খুলে যায়। চোখ দুটি স্থির হয়ে আছে তার দিকে। এই চেহারার মানে সে জানে। নবজাতক মারা গেছে জানার পর যে চেহারা সে তার মাকে দেখিয়েছিল—অবিকল। পুরোপুরি আত্মসমর্পণ, গ্রহণ ও মুক্তির চেহারা।
সামাহ মর্গের ঘরে প্রবেশ করে। হুশে ফিরে আসে বাদিয়া, তবে অনুভূতি ও মরদেহ দুটোই ধরে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু সামাহ’র সেদিকে মনোযোগ নেই—সে বিধ্বস্ত কান্নায়। বাদিয়া দেহটা সোজা করে শুইয়ে দেয়। পুনরায় চাদর দিয়ে ঢেকে রাখে। তারপর সামাহ’র দিকে ফেরে। জানে, সে তাকে এখন সব বলতে প্রস্তুত। বাদিয়া যা সন্দেহ করেছিল তা–ই—সামাহ বিয়ে না করে সন্তান জন্ম দিয়েছে। যাকে ভালবাসত সে তাকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দেয় নি বটে, তবে সামাহ নিশ্চিত ছিল, সন্তান জন্মের পরে না করবে না। প্রসব হয়েছে রামাল্লায়, পরিবারের দৃষ্টি থেকে অনেক দূরে। তাদের তখন বলেছিল যে, সেখানে একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশ নিয়েছে।
এখন রোজ কাজের বিরতিতে বুকের দুধ খাওয়াতে যায়। শিশুকে রেখে আসে বাবার কাছে। কিন্তু এর থেকে রেহাই পেতে লোকটা একবার শিশুকে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করেছে। সামাহ এখন কঠিন সঙ্কটে। সন্তানকে বাবার থেকে রক্ষা করতে চায়, আবার পরিবারের হাতে ধরা পড়ার ভয়ও পায়। বাদিয়া সামাহ’র হাত টেনে নেয়, বলে, সব ঠিক হয়ে যাবে। আগে এই মেয়ের দেহটি সাধ্যমতো প্রস্তুত করতে দাও।
সামাহ একেবারে আরাম করে বসে। তার দেখা সেরা অনুষ্ঠানটি করতে দেখে বাদিয়াকে—ব্যাগ থেকে সে প্রথমে ভারতীয় ধূপ, একটি তামার বাটি, সাদা কাপড়, নাবলুস সাবান, জেসমিন কোলোন এবং কারি বাসেতের কোরআন তেলাওয়াতের একটি টেপ নেয়। পুরানো রেকর্ডারে সুরা নিসার পাঠ চলতে থাকে, আর মেয়েটির গা ধুতে থাকে বাদিয়া। সামাহকে সে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি নির্দেশ দেয়। তাকে একবার এদিকে একবার সেদিকে সরায়। মরদেহের জঙ্ঘায়, উরুতে পানি ঢালে। তারপর তামার পাত্রটি নেয় এবং লাশের শরীর থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল সংগ্রহ করতে শুরু করে। শেষে পরম শ্রদ্ধার সাথে বাটিটা টেবিলে রাখে।
তারপর দেহটি ভালো করে মুছে কয়েক স্তরের ধবধবে সাদা কাপড়ে মুড়ে দেয়। দূর সরে শরীরের চারপাশে কোলোন স্প্রে করে। তারপর লাশের পাশে চুপচাপ এসে বসে, একবার বুকে জড়িয়ে ধরে। সামাহকে অবাক করে দিয়ে দীর্ঘক্ষণ কাঁদে। সামাহ আশাই করে নি যে, বাদিয়ার মতো শক্তিশালী নারী সন্তানহারা মায়ের মতো কোমলপ্রাণ হতে পারে।
কাজ শেষ। সামাহকে সে কর্মকর্তাদের বলতে বলে যে, দেহটি প্রস্তুত, নিয়ে যেতে পারে। নিজে টেবিলে বসে সিগারেট জ্বালায়। সামাহকে জিজ্ঞেস করে, তার সন্তানের বাবা কোথায় থাকে। জোর দিয়ে বলে যে, সামাহ তার সাথে যোগাযোগ করিয়ে না দিলে নিজে থেকে তার কাছে যাবে না।
পরদিন। বাদিয়া ধীর পায়ে লাইব্রেরি স্ট্রিট পার হয়। একটি নির্জন বাড়ির বাগান থেকে একমুঠো জুইঁ তুলতে একটু থামে। প্রতিদিন এ–বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে হাসপাতালে যায়। সংসদ গোলচত্বরে উম্মে সালামার সাথে দেখা হয়। তাকে জিজ্ঞেস করে, চামড়া–ওঠা রোগে আক্রান্ত মেয়েটি তার সাথে দেখা করতে এসেছিল কিনা। না, আসে নি। মনে হয় মেয়েটি তাকে বিশ্বাস করে নি। যদিও তাকে বলে দিয়েছিল যে, বাদিয়ার থেকে একটু মৃতধোয়া জাদুর পানি ব্যবহার করলে নিরাময় হয়ে যাবে। মেয়েটির জন্য দুঃখ হয়, যারা বিশ্বাস করে না তাদের জন্য বাদিয়ার কী–ইবা করার আছে। উম্মে সালামা সম্মতি জানিয়ে মাথা নীচু করে।
হাসপাতাল পৌঁছে দেখে সামাহ তার জন্য মর্গের দুয়ারে উদ্বিগ্নভাবে অপেক্ষা করছে। বাদিয়াকে দেখেই দৌড়ে নেমে আসে। চোখেমুখে তার প্রশ্ন—কী এমন করেছে সে? তার সন্তানের বাবা গত রাতে নিজেই কেন তাকে ফোন করে বিয়ে করতে কাকুতি মিনতি করেছে? বাদিয়া হাসে। তার ব্যাগে রাখা তামার বাটির জলে ঠিকঠাক ধরা পড়েছে মাছ। ‘আমার জাদুর পানি সব রোগ নির্মূল করতে পারে, সোনা—সব ধরনের রোগ,’ সে বলে। তার চোখের তারায় ভেসে ওঠে সামাহ’র প্রেমিক যুবকটির মুখভঙ্গি। যখন সে জাদুর পানিভরা বাটিটা যুবকের চারপাশে ঘুরাতে ঘুরাতে বলেছিল, এই পানি তার সারা গায় এমন ফুসকুড়ি জাগাবে, যার দাগ কোনওদিন মুছবে না, যদি সে সামাহকে বিয়ে না করে। রামাল্লা হাসপাতালের মরদেহ ধোয়া পানি আর বাদিয়ার কাণ্ডকারখানা এতকাল সে শুধু গল্পের ছলে শুনেছে। কাল সামনাসামনি দেখে আতঙ্কে কেঁপে উঠেছে ছেলেটা, তারপর চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে গেছে।
বাদিয়া সামাহকে আর কোনও প্রশ্নের সুযোগ দেয় না। শুধু দিনের কখন কী সময়সূচি জিজ্ঞেস করে। আজ মৃত নেই—সূচি ঘর ফাঁকা। বাদিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গা থেকে কোট খুলে ঝুলিয়ে রাখে, হাসপাতালের পরিষ্কার সাদা গাউন চড়ায়। নিজের হাতে বিশেষ ভেষজের তৈরি এক গ্লাস চা পান করে।
লেখক পরিচিতি :
মায়া আবুল হায়াত (জন্ম ১৯৮০)। বৈরুতে জন্ম নেওয়া ফিলিস্তিনি ঔপন্যাসিক, কবি ও শিশুতোষ গল্পকার। বাস করছেন জেরুসালেমে, কাজ করছেন রামাল্লায়। তার কবিতার বই ‘ইউ ক্যান বি দ্য লাস্ট লিফ (মিল্কউইড, ২০২২)’, গল্প ‘দ্য ব্লু পুল অব কোয়েশ্চেন’ (পেনি ক্যান্ডি বুকস, এলএলসি, ২০১৭) এবং উপন্যাস ‘নো ওয়ান নোন হিজ ব্লাড টাইপ’ (দারুল আদাব, ২০১৩) কয়েকটি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। তার দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ‘আ বার্ড ইজ নট এ স্টোন : অ্যান অ্যান্থোলজি অব কনটেম্পরারি প্যালেস্টাইন পোয়েট্রি’ (ফরেইন বুকস, ২০১৪) এবং ‘দ্য বুক অব রামাল্লা: এ সিটি ইন শর্ট ফিকশন’ (কমা প্রেস, ২০২১) সম্পাদনা। তিনি ফিলিস্তিনি শিশু ও শিক্ষকদের গল্প বলা ও লেখার প্রকল্প ‘প্যালেস্টাইন রাইটিং ওয়ার্কশপ’র পরিচালক এবং আরবি টেলিভিশন সিরিজ ‘ইফতাহ ইয়া সিমসিম’র উপস্থাপক। ২০১৯ সালে তিনি মুয়ায়াদ আলিয়ান পরিচালিত ‘লাভ, থেফ্ট অ্যান্ড আদার প্রবলেমস’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
বৈরুতে জন্ম নিলেও মায়া বেড়ে উঠেছেন জর্দানে। তার মা লেবানিজ এবং বাবা ফিলিস্তিনি। আন–নাজাহ ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছেন। পেশাদার জীবনের সূচনা হয় প্রকৌশলেই। এ পর্যন্ত তার ৬টি উপন্যাস, চারটি কাব্য, ২টি অনুবাদ ও ৯টি গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৬ সালে তিনি ‘কাতার ফাউন্ডেশন’ থেকে সেরা তরুণ লেখক সম্মাননা লাভ করেন।
‘বাদিয়া’স ম্যাজিক ওয়াটার’ শিরোনামের গল্পটি ‘বুক অব রামাল্লা’ বই থেকে নেওয়া হয়েছে; যাকে ২০২২ সালে ‘আরব লিট’ ফিলিস্তিনি নারীদের লেখা শ্রেষ্ঠ ৯টি গল্পের একটি বলে উল্লেখ করেছে।
ভালো লাগলো গল্পটা।