বইয়ের দোকান ও ইঁদুরের উপদ্রব

সালমান সাদিক

আমি একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমার জমানো টাকা পুঁজি করে ছোট্ট একটি দোকান দেই। বিভিন্ন শ্রেণির গাইড, প্রশ্ন ব্যাংক ইত্যাদি বইয়ের পাশাপাশি কিছু কিছু গল্প ও ওয়াজ-নসিহতের বইও আমি দোকানে উঠাই। এই অঞ্চলে যেসব স্কুল রয়েছে এবং একটি মাত্র কলেজ ও কিছু কিছু আলিয়া মাদরাসা; সেগুলির ছেলেমেয়েরা আমার দোকান থেকে মাঝেমধ্যেই প্রয়োজনীয় বই ও খাতাপত্র কিনতে আসে। তখন অনেকে কৌতূহলবশত গল্পের বইগুলি নেড়েচেড়ে দেখে এবং কখনো কখনো টাকা থাকলে বা টাকা জমিয়ে তারা সেগুলি কিনে নিয়ে যায়। যারা একবার বইগুলো কিনেছে তাদের প্রায় সবাই পরবর্তীতে নিয়মিতভাবেই বই কিনতে আসে এবং বিভিন্ন বইয়ের খোঁজ-খবর করতে শুরু করে। ব্যাপারটি আমার তখন ভালো লাগে। এ ছাড়াও মুরুব্বি ও চাচা বয়সের লোকেরা মাঝে মধ্যে কিছু কিছু ওয়াজ-নসিহত ও অন্যান্য ধর্মীয় কেতাবাদি নিয়ে যায়। সব মিলিয়ে আমি দোকানটা মোটামুটি দাঁড় করিয়ে ফেলি এবং এর থেকে যা আসে তাতে আমার রিযিকের বন্দোবস্ত করতে সক্ষম হই।

আমার এই দোকানটিতে সব ধরনের বই-ই আমি রাখি। মজার ব্যাপার, যখন আমি এই প্লান নিয়ে আমার সমস্ত পুঁজি প্রত্যন্ত এই অঞ্চলে একটি বইয়ের দোকানের পিছনে ঢালার কথা বলি তখন আমার কাছের মানুষজন এমনকি আমার বউ পর্যন্ত আমার এই প্লানকে নিরেট পাগলামি বলে হাসি-তামাশা করে। আমার বউ এমনিতে বইয়ের প্রতি আমার অতিরিক্ত ধ্যানের কারণে বিরক্ত ছিল, তার উপর যখন বইয়ের দোকানের প্লান নিয়ে শহর থেকে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে হিজরতের কথা তাকে বলি তখন সে এতটাই বিরক্ত আর রেগে গেছিল যে, যদি না আমার প্রতি তার অতিরিক্ত টান আর মহব্বত থাকত তাহলে সে ওই মুহূর্তে আমাকে তালাক দিয়ে আলাদা পথ মাপত। তথাপি আমার এই প্লান বাস্তবায়নে দৈবিক সাহায্য না হলে হয়তো এখানে এই বইয়ের দোকান দেওয়া সম্ভব হতো না।

দৈবিক সাহায্যের ব্যাপারে কিছু বলা জরুরি মনে করছি। কারণ পরবর্তী ঘটনাগুলির সাথে এই ব্যাপারটি আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িত। আমি এমন একটি পরিবারে বেড়ে উঠি যেখানে আমার মা বিভিন্ন সময়ে বই চুরি ও চুরি করে ফিকশন পড়ার জন্য নানার কাছে মার খেয়ে এসেছে এবং আমার বাবা একটি দুর্যোগে তার পুরো বইয়ের কালেকশন হারিয়ে রীতিমতো যুদ্ধপরাজিত সেনাপতির মতো কিছুকাল হতাশ হতবুদ্ধি দিন গুজরান করে এসেছে। সুতরাং আমি স্বাভাবিকভাবেই অবাধ বই পড়া ও সংগ্রহের সুযোগ লাভ করি। বিভিন্ন বইয়ের মাঝে আমার আগ্রহ আমাকে ধীরে ধীরে নিষিদ্ধ ও বিভিন্ন মতাদর্শের বৈপ্লবিক কেতাব-পত্রের দিকে ধাবিত করে। যেসব বইগুলি ফ্যানাটিক ও উগ্র চিন্তা লালনকারী বলে নিষিদ্ধ হয়ে এসেছে। যেমন বিভিন্ন নৃশংস সিনেমা দেশে দেশে নিষিদ্ধ করা হয়ে থাকে। আমার মনে হয় আমি নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি অপার আগ্রহ অনুভব করি, কারণ কেন যেন মনে হয় মানবের অপার রহস্য না বুঝতে পারাই দেশ সমাজ ও ব্যক্তি মনে এসব জিনিসের প্রতি ভীতি সৃষ্টি করে, ফলত তারা এগুলি নিষিদ্ধ সাব্যস্ত করে। যেমন এ সার্বিয়ান ফিল্মের মতো বস্তুনিষ্ঠ একটি মৌলিক সিনেমাকে না কি বিভিন্ন জায়গায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এমন নয় যে, এসব বই আমাকে ভিন্ন মতাবলম্বী বা কোনো দলের লোক হওয়ার তাড়না জাগিয়েছে। বরং বইগুলি যেন আমাকে শিখিয়েছে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যাকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কীভাবে দেখা যায় বা বিশদভাবে বললে একটি হাতি দশজন দশ দিক থেকে দেখলে ঠিক কীভাবে হাতিটির স্কেচ করা সম্ভব; সেটা শিখিয়েছে। সাধারণ মানুষ খুব সম্ভব যে কোনো একজন দর্শকের বক্তব্য থেকেই দৃশ্যকল্প এঁকে ফেলবে। কিন্তু বিভিন্ন মত ও পন্থার আলোকে আমার মত যারা, তারা বলবে, না, অপেক্ষা করো এটাই সমগ্র চিত্র নয়, এটা মাত্র একটা অংশ; পুরো পাজল মিলাতে এখনো ঢের বাকি। ব্যাপারটি এই পর্যায়ে আসার ক্ষেত্রে সহযোগী হিসেবে আমি কিছু কিছু মানুষকে পাই। যারা আমার মতোই অজানাকে জানার আগ্রহ অনুভব করত।

সেই মানুষগুলি বিভিন্ন পর্যায়ে আমার জীবনে এসে যুক্ত হয় এবং বিভিন্নভাবে আমাকে প্রভাবিত করে বা আমার দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই যে আমরা কিছু মানুষ বই-পত্রে বুঁদ হয়ে থাকি এবং এমন সব বিষয়ে কথা বলি, যা সাধারণ আট দশজন মানুষ ঠিক গ্রহণ করতে পারে না।

আমাদের এই দলটি বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়েছে। যেমন বিভিন্ন বই গায়েব করে দেওয়া এবং পরবর্তীতে সেগুলি চক্রাকারে সবার হাতে হাতে ঘুরতে থাকা। আমার বউয়ের সাথে পরিণয়ের ক্ষেত্রে আমি মনে করি এই বই গায়েব করার কারিশমা কাজে দিয়েছে। যখন সে আর আমি বিড়ি খেতে খেতে জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ে একদিন আলাপ করছিলাম তখন কথা প্রসঙ্গে সে আমাকে বলছিল একটা লাইব্রেরি থেকে সে কীভাবে আলকেমিস্ট বইটি মেরে দেয়। আমি তখন উৎসাহ পেয়ে বলি, এ ব্যাপারে তো আমি সিদ্ধহস্ত। একদিন আমার সাথে আসো তোমাকে হাত সাফাইয়ের আশ্চর্য কলাকৌশল শিখিয়ে দিবো। ওই থেকেই বোধহয় আমাদের মধ্যে একটা আত্মিক গিঁট বেধে যায়।

যাই হোক মূল ঘটনা থেকে কীভাবে যে ছিটকে যাওয়ার প্রবণতা আমার ভিতরে আছে, সেটা আশা করি পাঠক বুঝে ফেলেছেন। যাইহোক, যেটা বলছিলাম, এই ন্যায়-অন্যায় ও সত্য-অসত্যের ব্যাপারে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ আমাকে কেন জানি এরকম ভাবনার দিকে উসকে দেয় যে, আমি মজলুম আর জালেম আমার উপর সর্বদা সবকিছুর উপর বিভিন্ন লেবেল এঁটে দিয়ে জুলুম করে যাচ্ছে। আমি ভাবি, এবং আমার সাথে সাথে আমার সঙ্গী-সাথিরাও এরকমটা ভাবে যে, এই সূত্রানুযায়ী যেখানেই জালেমের বিরুদ্ধে কেউ অবস্থান নিবে আমাদেরকে সেই কেউ বা কাদেরকে সাহায্য করতে হবে বাই এনি মিন্স নেসেসারি। যেমনটা ম্যালকম এক্স বলেছেন বা ফ্রাঞ্জ ফানো বলেছেন। এই ব্যাপারটাই পরবর্তীতে আমাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে লোক-সমুখে চিহ্নিত করে এবং আমার নামে হুলিয়া জারি হয়।

ব্যাপারটা ঘটে অনেক পরে যখন কিছু মানুষ তাদের অধিকার আদায়ে রাজপথে নামে এবং আমরা আমাদের মাপকাঠিতে রাইট এন্ড রংয়ের হিসেব নিকেশ কষে কোনোরূপ স্বার্থ ছাড়াই তাদের অধিকার আদায়ের দাবির স্বপক্ষে তাদের পাশে অবস্থান নেই তখন, সেই সময়ে আমরা চিহ্নিত হই এবং আমাদের নিশ্চিত জীবন-যাপন বিঘ্নিত হয়। সম্ভবত আমিই সর্ব প্রথম নিরুদ্দেশ হই। আমার বউ, যাকে আমি অত্যন্ত ভালোবাসি এবং এডামসদের মতো যাকে ছাড়া আমি একটা রাতও অন্য কোথাও কাটানোর কথা ভাবতে পারি না। ওর থেকে আমাকে আলাদা করা হবে; এটা ভেবেই হয়তো আমি নিরুদ্দেশ হই। অর্থাৎ এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসে বসবাস করা শুরু করি। এটাই সেই দৈবিক ঘটনা, যা আমার প্লান বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেছে। যদিও আমার বউ এই প্লানটি শুরু থেকেই অপছন্দ করে এসেছে তথাপি আমার মনে হয় পরিস্থিতি যখন অমন অনিশ্চিত ও শঙ্কাজনক তখন সে বাধ্য হয়েই রাজি হয়।

শুরুতেই বলে এসেছি দোকানটা আমি মোটামুটি দাঁড় করিয়ে ফেলেছি। বই-পত্র যা বিক্রি হয় এতে বেশ চলে যাচ্ছিল আমাদের। কিন্তু কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা আবারো আমাদের জীবনে বিপত্তি সৃষ্টি করে। ঘটনার শুরুটা হয় অঞ্চলের অন্যান্য বইয়ের দোকানদারদের সাথে। এটারই জের ধরে পরবর্তীতে অন্যান্য ঘটনাগুলি ঘটেছে বলে আমার ধারণা। আমার আশপাশে আরো কয়েকটি এরকম গাইড ইত্যাদি বইয়ের দোকান আছে। গাইড ইত্যাদি বিক্রির ক্ষেত্রে বই মালিক সমিতি থেকে নতুন একটা নিয়ম করে যে, গায়ের দামেই বই বিক্রি করতে হবে। যদি কোনোরকম হেরফের হয় আর তারা তা জানতে পারে তাহলে বই বিক্রির লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হবে বলেও তারা প্রজ্ঞাপন জারি করে।

আমি শুরু থেকেই সততার সাথে ব্যবসা করে আসছি। কিন্তু অন্যান্য দোকানীরা এই প্রজ্ঞাপন ও নতুন নিয়ম আসার আগে ইচ্ছামতো দামে বই বিক্রি করে আসছিল। স্বাভাবিকভাবেই এখানে কারো কিছু বলার সুযোগ ছিল না। এমনিতেই অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষই আনপড়, তার উপর দরিদ্র। ফলে তারা না কিছু জানত আর না কিছু বলার সাহস তাদের ছিল। বরঞ্চ এইসব দোকানিদের তারা অত্যন্ত সমীহ করত, যেন বা এদের কারণেই তাদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করার সুযোগ পাচ্ছে। এর ফলে নতুন নিয়মের বিষয়টি এরা ধামাচাপা দিয়ে আগের মতোই স্বেচ্ছাচার চালিয়ে যাওয়ার নিয়ত করে। কিন্তু বিপত্তি বাধে অন্য জায়গায়। গাইড এবং অন্যান্য একাডেমিক বইয়ের গায়ের রেটের চেয়ে তারা বেশি রাখতে পারছিল না। আবার গায়ের রেটের চেয়ে কিছু কম রেখে অসুস্থ ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় নামার সুযোগ তাদের হাতে আসে। যেহেতু আমার দোকানে শুরু থেকেই গায়ের রেটে বই বিক্রি হয়ে আসছে তাই আমার মতোন আগন্তুক বই বিক্রেতাকে তারা এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ব্যবসার জগৎ থেকে ছেঁটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। এর পিছনে অবশ্য কিছু কারণ ছিল। কারণগুলি আমি খোলাসা করলে পরবর্তী ঘটনাগুলি বুঝতে সুবিধা হবে।

শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু কিছু সংস্কার করা হয়। এর পেছনে অনেক কারণই রয়েছে যেগুলি কাহিনির সাথে সবিশেষ সম্পৃক্ত না, বিধায় ওগুলি নিয়ে কোনোরূপ আলাপে যাচ্ছি না। সংস্কারের ফলে মোটামুটি পড়াশোনা জিনিসটা অত্যন্ত কমে যায়। গাইড ইত্যাদি গুরুত্ব হারায়। তথাপি গাইড ব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে স্কুল কলেজের শিক্ষকদের মাধ্যমে এমন একটা পদ্ধতি চালু রাখতে সক্ষম হয়, যার ফলে পড়াশোনা না থাকলেও গাইড ইত্যাদি বিক্রি আগের মতোই চলতে থাকে।

এই অঞ্চলে আমার দোকানেই শুধুমাত্র একাডেমিক বইয়ের বাইরেও অন্যান্য বিভিন্ন বই পাওয়া যেত। ছেলেমেয়েরা এসব বইয়ের প্রতি ধীরে ধীরে দারুণ আগ্রহী হয়ে ওঠে। এর পেছনে–অহংকার বা আত্মগর্ব নয়—আমারও কিছু অবদান রয়েছে বলেই মনে করি। যেমন ছাত্রদেরকে সামান্য কিছু টাকায় বই ধার দেওয়া শুরু করি। এটাকে পরবর্তীতে সদস্যপদ সম্বলিত লাইব্রেরির মতো করে পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে দেই। যার ফলে বেশ কিছু জায়গায় আমার বিশ্বস্ত ছেলেপেলের কাছ থেকে অন্যরাও বই নেওয়ার সুযোগ পায়। এই বইগুলি তাদের মধ্যে কিছু কিছু জাগরণী বার্তা ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়। তারাও তখন আমার মতোন ন্যায়-অন্যায় ও সত্য-অসত্যের নানান দিক বিচার করে দেখার ক্ষমতা লাভ করতে শুরু করে। তাদের পড়াশোনার সাথে সামঞ্জস্য রাখে এমন কিছু বই তাদের হাতে হাতে পৌঁছে দেই আমি। এর পিছনে ঠিক কী কারণ ছিল আমি জানি না। হয়তো আমার নীতি-নৈতিকতার আজগুবি ধারণা থেকেই আমি এটা করি। যাতে করে তারা পড়াশোনাকে শুধুমাত্র শিক্ষকের দেখিয়ে দেওয়া পদ্ধতির মধ্যেই সীমিত না রেখে নিজ থেকেও জানার ও ভুল-সঠিক যাচাইয়ের ক্ষমতা অর্জন করে; এমনটাই আমার উদ্দেশ্য হয়ে থাকবে। অথবা ওই যে প্রাসঙ্গিকতা হারানোর যে ব্যাপারটা আমার মধ্যে আছে ওটাই এসব করার পেছনে ইন্ধন জুগিয়েছে। নয়তো আমি তো বেশ দু পয়সা কামিয়ে জীবন চালিয়ে নিতে পারছিলাম।

এই যে তারা বিভিন্ন বই পড়তে থাকে, এর ফলে ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে নিজ থেকেই একাডেমিক গাইড ইত্যাদির প্রতি অনাগ্রহ তৈরি হয়। তারা নিজেরাই ওইসব সমস্যাগুলি সমাধান করতে থাকে যেগুলির জন্য পূর্বে গাইড ইত্যাদির সহায়তা প্রয়োজন হতো। এমন না যে এটা হুট করেই হয়ে গেছে। রাতারাতি পরিবর্তন হয়নি। ফলে আশপাশের অন্যান্য ব্যবসায়ীই হোক বা স্কুল কলেজের ওই সমস্ত শিক্ষকই হোক—যাদের মাধ্যমে গাইড ব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছিল—কিছুই টের পায়নি। আমার মনে হয় তারা যদি আগেভাগেই এ সমস্ত ব্যাপার টের পেয়ে যেত তাহলে আমার ব্যবসায় তখনই লাল বাতি জ্বালিয়ে ছাড়ত। যাই হোক পরিস্থিতি যখন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়ায় যে, এক বছরে কোনোরকম গাইড বিক্রি হয়নি তখন ব্যবসায়ীদের টনক নড়ে। তারা বিভিন্নভাবে ঘটনা তদন্ত শুরু করে। শিক্ষকরাও ব্যাপার কিছুটা আঁচ করে ফেলে, যখন তারা কলেজের হোস্টেলে কী এক কারণে তল্লাশি চালিয়ে অনেকগুলি বই উদ্ধার করে যেগুলি ছিল আমার ওই লাইব্রেরির সিলসম্বলিত। ওই সময়ে কলেজের হোস্টেলে যে ছেলেটি বই আদান-প্রদানের কাজ করত তার কাছ থেকে লাইব্রেরির সদস্যদের নামসহ তালিকাও উদ্ধার করে তারা।

শিক্ষকরা তখন তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে কিছু নিয়ম জারি করে। যেমন বাইরে থেকে কোনোরূপ বইপত্র-ম্যাগাজিন হোস্টেলে আনা যাবে না। এ ধরনের কোনো লাইব্রেরি, যাকে তারা সংগঠন বলে উল্লেখ করে; করা যাবে না। এর ফলে শিক্ষার্থীরা দাবি পেশ করে যে, কলেজের নিজস্ব লাইব্রেরি গঠন করতে হবে, যাতে করে তারা বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ পায়। কিন্তু শিক্ষকরা এই দাবি মানতে নারাজি হয়। এর পেছনে হয়তো লাইব্রেরির জন্য যে বরাদ্দ বাৎসরিক বাজেটে থাকে তা আর তারা নিজেদের পকেটে ঢুকাতে পারবে না; এমন একটি স্বার্থও কাজ করে। আমি সঠিক বলতে পারব না, গাইড ব্যবসায়ীদের থেকেও কোনোরূপ হাদিয়া তাদের কাছে আসত কি না।

কলেজের শিক্ষার্থীদের এই দাবির বিষয়ে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যখন জানতে পারে তখন তারাও অনুরূপ দাবি জানিয়ে শিক্ষকদের অবহতি-পত্র দেয়। এতে করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী শ্রেণিদ্বয়ের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। আমি আগে মনে করতাম সবকিছু আলাদা আলাদাভাবে চলে, ব্যক্তিমানুষ বা সমাজে গুপ্ত কোনো সংঘ বা এরকম কিছু নাই। এই ঘটনায় আমার ধারণা পরিবর্তন করতে বাধ্য হই। আমার কেন যেন মনে হতে থাকে আড়াল থেকে গাইড ব্যবসায়ীরাই সবগুলি সুতো নিয়ন্ত্রণ করছে।

শিক্ষকদের থেকে বই ব্যবসায়ীরাও ব্যাপারটি জেনে যায়। অপরদিকে শিক্ষকরা অভিভাবকদের ডেকে নিয়ে গোপনে বুঝাতে থাকে এইসব বই পড়ে পড়ে ছেলে-মেয়েগুলি বেয়াদব হয়ে গেছে। যে কারণে এখন তারা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছে, তাদের মধ্যে বিদ্রোহী মনোভাব তৈরি হচ্ছে। এরা যদি শিক্ষকদের সাথে বিদ্রোহ করতে পারে তাহলে অশিক্ষিত বাবা-মার সাথে তারা কীরূপ আচরণ করবে এটা ভেবেই শিক্ষকরা শিউরে উঠছেন। অভিভাবকরাও ভেবে দেখে শিক্ষকদের মতোন মহান ব্যক্তিত্বদের সাথে তাদের বাচ্চাগুলি কীরূপ অবাধ্য আচরণ করছে। তারা তখন বাসায় গিয়ে ছেলে-মেয়েদের বইগুলি খুঁজে খুঁজে বের করে এবং সেগুলি জ্বালিয়ে দেয়।

ব্যবসায়ীরা তো এমনিতেই আমাকে শুরু থেকে ছেটে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছিল। এখন তারা ভালোরকম সুযোগ পেয়ে যায়। তারা বই মালিক সমিতিতে আমার নামে অভিযোগ করে যে, আমি বই বিক্রির নাম করে লাইব্রেরি করে ব্যবসা করছি। বই মালিক সমিতি তখন আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তারা আমাকে বলে, আমি নাকি বই বিক্রির নাম করে লাইব্রেরি বানিয়েছি। লাইব্রেরির জন্য নাকি আলাদা লাইসেন্স প্রয়োজন, যা আমার নেই। এহেন ব্যবসার কারণে তারা আমার লাইসেন্স বাতিল করে।

আমি মোটামুটি তখন হতবুদ্ধি হয়ে গেছি। আমি আসলেই ভেবে পাই না, লাইব্রেরি করতে হলে সত্যি কি লাইসেন্স প্রয়োজন হয় নাকি হয় না। আমার যখন এই অবস্থা তখন বউ আমাকে বলে যথেষ্ট হয়েছে। এবার এখান থেকে চলে গেলেই ভালো হয়। আমি বলি, এতদিনের পরিশ্রম বৃথা যাবে! সে বিরক্ত হয়। আমার এই একরোখা মনোভাব সে বুঝে ঠিকই, কিন্তু বিভিন্ন সুবিধাবঞ্চিত এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে বন্ধু-বান্ধবহীন যাপনে সে হয়তো হাঁপিয়ে উঠেছে। আমি ঠিক জানি না। আমি হয়তো লাইব্রেরি নিয়ে আজগুবি এই অভিযোগ খতিয়ে দেখতাম। কিন্তু সেই সুযোগই আমি পাইনি।

বই বিক্রেতারা মানে আমার প্রতিদ্বন্দ্বীরা শুধুমাত্র আমার লাইসেন্স বাতিল করেই ক্ষান্ত হয়নি। গাইড ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে শিক্ষকদেরকে জানিয়ে দেয় যে, এতকিছু যে ঘটেছে এর পেছনে মূল কালপ্রিট হলাম আমি। শিক্ষকদের হয়ে এই ব্যাপারটা অভিভাবক ও এলাকার মাতব্বর শ্রেণিতে ছড়িয়ে পড়ে। তারা তখন এলাকার ছেলে-মেয়েদের মন মানসিকতা নষ্ট করার অভিযোগে আমার দোকানে তালা ঝুলায় এবং আমাকে গ্রাম ছাড়তে বলে।

আমি হয়তো এগুলি নিয়ে তর্ক করতাম, তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করতাম বা বই মালিক সমিতি—যার মূল হর্তাকর্তা ওই গাইড ব্যবসায়ীরাই—ওদের থেকে লাইসেন্স উদ্ধারের চেষ্টা চালাতাম। কারণ পরবর্তীতে আমি জানতে পারি এ ধরনের লাইব্রেরি করা কোনো অবৈধ কাজ নয় আর এ জন্য লাইসেন্সও প্রয়োজন হয় না। কিন্তু আমার স্ত্রী আমাকে বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে যায় যে, আমাদের এখানে থাকাটা ঠিক হবে না। আমরা আগন্তুক অনাহুত, কোনো বিপদ হলে কেউ আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে না। তাছাড়া যে জন্য আমরা শহর ছেড়ে এসেছি সেই হুলিয়াও এখন আর আমাদের তাড়া করবে না। সবকিছু স্বাভাবিক, এখন আমরা আমাদের পরিচিত সেই জায়গায় ফিরতে পারি, যেখানে আমাদের চেনা-জানা মানুষ আছে, যেখানে আমরা আগন্তুক নই।

আমি বুঝতে পারি আমার স্ত্রী এখানে আর থাকতে চাইছে না। তাছাড়া এই ব্যাপারগুলি আমাকেও দারুণভাবে বিচলিত করেছে। আমি ভেবে পাই না, কেন এই মানুষগুলি সবকিছু বিবেচনা না করেই অন্যদের কানপড়ায় বিশ্বাস করল। কেনই বা তারা সবকিছুর জন্য আমাকে দোষী করল! তা ছাড়া তারা কেন তাদের বাচ্চাদের দাবিটা পর্যালোচনা পর্যন্ত করল না। এমন তো নয় যে, শিক্ষক এবং বই বিক্রেতারা সমস্ত ভুলের ঊর্ধ্বে। পরক্ষণেই আমি বুঝে ফেলি, তারা তো ওই সমস্ত লোক যারা সন্ধ্যে থেকে মাঝরাত পর্যন্ত বিড়ি খেতে খেতে টিভি দেখে আর টিভির ওই দৃশ্যগুলিই তাদের মধ্যে রেখাপাত করে।

যখন পানি এতদূর গড়ায় যে, কিছু যুবক এই নিয়ত করে যে, তারা আমার বাড়ি জ্বালিয়ে দিবে এবং আমাদেরকে গ্রাম থেকে উৎখাত করে ছাড়বে তখন আমি আর আমার স্ত্রী আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হই। এই খবরটা আমাকে জানায় একটা ছেলে। সে আমার দোকান থেকে বিভিন্ন সময়ে বই-পত্র নিত এবং পরবর্তীতে আমার ভক্ত হয়ে যায়। আমি তাকে আমার ঠিকানা দিয়ে আসি। বলি, আমার সাথে যোগাযোগ রাইখো। যদ্দুর পারি তোমাদের জন্য বই-পত্র পাঠাবোনে।

পরবর্তীতে আমরা যখন শহরে এসে সঙ্গী-সাথিদের সাথে মোলাকাত করি ও বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি এবং ওই সব বিভীষিকাময় দিনগুলির স্মৃতি যখন মলিন হতে থাকে তখনকার কথা, একটা ছেলে আমাদের বাসায় আসে। আমি প্রথমে তাকে চিনতে পারিনি। পরে যখন সে বলে, আমি রাজিব। তখন আমি চেনার আপ্রাণ চেষ্টা চালাই, তাকে বলি, কোন রাজিব! তখন সে বইয়ের দোকানের কথা বলে। তখন মনে পড়ে এ তো সেই ছেলে যে শেষ মুহূর্তে আমাদেরকে জানাতে এসেছিল যে, আমাদের উপর হামলার প্লান করা হচ্ছে।

আমি তার সাথে অনেকটা সময় আলাপ করি। সে জানায় সে শহরেই উচ্চতর জ্ঞানার্জনের জন্য নামকরা এক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। আমি শুনে আনন্দিত হই। তখন সে আমাকে বলে, আপনি থাকলে আরো কতগুলি ছেলেমেয়ে যে নিজেদের উন্নতি করতে পারত! সে আফসোস করে। আমি তার চেহারায় দুঃখ ও পরিতাপের নানান চিহ্ন দেখে কষ্ট পাই। আমি বলি, জ্ঞানার্জন জিনিসটাই এমন, তোমাকে বিভিন্ন ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই যেতে হবে। যদি এমনটা না হয় তাহলে সবাই-ই জ্ঞানী হয়ে উঠত এবং মূর্খের মতো ওইসব সন্ধ্যেগুলি টিভি দেখে কাটাত না। সে তখন আমাকে ইঁদুরগুলির বিষয়ে জানায়।

সে বলে, আপনি চলে আসার পর অনেক পরিবর্তন ঘটে যায়। ছেলে-মেয়েরা ধীরে ধীরে আগের মতো হয়ে যায়। অনেকেই একটা পর্যায়ে এসে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। তারা সন্ধ্যেগুলি তাদের বাপ-দাদার মতো বিড়ি ফুকে আর টিভি দেখে কাটানো শুরু করে। কিছু কিছু ছেলেমেয়ে আপনার থেকে পাওয়া বইগুলি লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। তারা সেগুলি পড়তো লুকিয়ে এবং সেগুলি নিয়ে আলাপ করতে ভয় পেত। এই সময়ে এলাকায় ইঁদুরের উপদ্রব হয়। বাসায় বাসায় ইঁদুরগুলি ছড়িয়ে পড়ে।

একদিন আপনার দোকানটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় এলাকাবাসী। এখানে একটি সিনেমাহল করার সিদ্ধান্ত হয়। তো তারা যখন দোকানটি ভাঙে তখন দেখা যায় দোকানের নিচে একটি গর্ত এবং সেই গর্ত দিয়ে একের পর এক ইঁদুর বের হয়ে আসছে। তারা বিভিন্নভাবে ইঁদুরগুলিকে মারার চেষ্টা করে। সেই গর্তে তারা পানি ঢালে প্রথমে। তাতেও যখন কাজ হয় না তখন তারা কেরোসিন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তারপরেও ইঁদুরের উপদ্রব কমে না। তখন তারা পুরো জায়গাটি খুড়ে ফেলে। তখন দেখা যায় মাটির গভীর থেকে একের পর এক ইঁদুর উঠে আসছেই, যেন এই গর্তের কোনো শেষ নাই।

যদ্দুর মনে পড়ে,  আমি রাজিবকে শুধু এতটুকুই বলেছিলাম, আসলে কি তুমি একটা দোকান দীর্ঘদিন বন্ধ রাখলে সেখানে ইঁদুরই আস্তানা গাড়ে। ইঁদুরের উপদ্রব হলে সমূলে এর মূলোৎপাটন মোটামুটি অসম্ভব হয়ে যায়।

রাজিব সেদিন আমাদের সাথে রাতের খাবার খেয়েছিল। এরপর সে আমাকে সেই জায়গায় আর কী কী ঘটে বা সেই সিনেমাহল আদৌ হয় কি হয় না; এসব নিয়ে নানান গল্প শুনায়। আমি তার কোনো কথাই তখন শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমার মাথায় তখন একটাই দৃশ্য, একটা গর্ত থেকে একের পর এক উঠে আসছে ইঁদুরের দল আর তারা ছড়িয়ে পড়ছে।

আমার স্ত্রী হয়তো ওর ওই গল্পগুলি শুনে আনন্দ পেয়েছিল। কারণ সে রাজিবকে আরো খুটিয়ে খুটিয়ে প্রশ্ন করে খুটিনাটি আরো নানান কিছু জেনে নিচ্ছিল।

তাকে আমরা রাতে থেকে যেতে বললে সে রাজি হয়নি। তবে আমরা তার থেকে ওয়াদা নেই, যেন সে মাঝে মধ্যে আমাদের এখানে আসে এবং আমাদেরকে তার ওইসব আজগুবি গল্পগুলি শোনায়।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
4 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
আবদুল গনী
আবদুল গনী
7 months ago

অসাধারণ লিখেছেন সালমান ভাই।♥️

শেখ মুজাহিদুল ইসলাম
শেখ মুজাহিদুল ইসলাম
7 months ago

বিগ ফ্যান গল্পকার বস!

সাখাওয়াত
সাখাওয়াত
7 months ago

খুব ভালো লাগলো

তা মি ম
তা মি ম
1 month ago

তারপর? তারপর কী হলো? ইদুরের দলকে কি বাঁধা দিতে পেরেছিলো বই-ব্যবসায়ী আর শিক্ষকরা?

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷