আল্লামা ইকবালের কাব্যের অন্যতম উপজীব্য হলো স্বাধীনতা। তিনি উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে স্বাধীনতার চিন্তা বপন করেছেন এবং তাদের মনোজগতে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জাগরূক করেছেন। ঔপনিবেশিকতার উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে তাঁর কাব্যিক অভিব্যক্তি মানুষকে আলোড়িত করেছে, অধিকার–বঞ্চিত মুসলমানদের আত্মসচেতন ও অধিকার–সচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাঁর কাব্য ও সাহিত্য এখানকার মুসলমানদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
আল্লামা ইকবাল যেহেতু এই মাটিরই মানুষ, সেহেতু তিনি এখানকার মাটি ও মানুষের সঙ্কট ও দুর্দশার কথা জানতেন। এজন্য প্রধানত এ অঞ্চলের সঙ্কটগুলোর সমাধান–চিন্তায় বিভোর হয়েছেন। তাঁর রচনার মধ্যে আমরা এর প্রকাশ দেখতে পাই। জন্মসূত্রে তিনি এই উপমহাদেশের অধিবাসী হলেও আদতে তো ছিলেন একজন কবি। প্রকৃত কবি আন্তরিকভাবে রাষ্ট্রীয় সীমানা স্বীকার করেন না। মানুষে মানুষে বিভেদের কারণে রাষ্ট্রীয় সীমানা তৈরি হতে পারে, বিভিন্ন কারণে তা আইনানুগভাবে মেনে চলতে মানুষ বাধ্যও; কিন্তু কোনো আইন–কানুন মানুষের হৃদয়ে কাঁটাতারের বেড়া দিতে পারে না। মাটির চেয়ে মানুষের মর্যাদা যাদের কাছে বেশি, তারা ক্ষুদ্র গ্রামে বসেও দূরদেশের মানুষ নিয়ে ভাবতে পারেন। হাজার মাইল দূরের মানুষের দুর্দশাও তাদের বিচলিত করে। এক্ষেত্রে দেশ, ভাষা, বর্ণ— কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এজন্যই আমরা দেখি, আল্লামা ইকবাল এই উপমহাদেশের মুসলমানদের পাশাপাশি ভেবেছেন বিশ্ব–মুসলিমের ইহ ও পরজাগতিক স্বার্থ সম্পর্কেও। কওমিয়াত ও ওয়াতানিয়তের ঊর্ধ্বে উঠে ইসলাম–নির্দেশিত উম্মাহ ও মিল্লাতের কথা উঠে এসেছে তাঁর কাব্য ও সাহিত্যে। তাঁর চিন্তা ও দর্শন ভাষা ও ভূখণ্ডভিত্তিক জাতীয়তার ঊর্ধ্বে প্রসারিত বিশ্বদৃষ্টি লালন করার শিক্ষা দেয়।
আল্লামা ইকবাল ভেবেছেন আরব–আজম সবার মনোদৈহিক স্বাধীনতা নিয়ে। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা জন্মভূমির সীমানা ছাড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বিশেষত ইসলামী বিশ্বের যে কোনো বিপদে তিনি বিপন্নবোধ করতেন, উদ্বিগ্ন হতেন ও চিন্তিত হয়ে পড়তেন। অত্যাচারীর খঞ্জর যেখানেই আঘাত করুক, তার ব্যথা ইকবাল নিজের বুকে অনুভব করতেন।
সারা বিশ্বের মুসলমানদের সংকট, সম্ভাবনা ও আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পর্কে তিনি সম্যক অবগত ছিলেন। বিশেষত ফিলিস্তিনের সমস্যা সম্পর্কে ছিলেন যথেষ্ট সচেতন। নিজের কাব্যের মধ্য দিয়ে তিনি ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি ও ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
ইকবাল–দর্শনের অন্যতম প্রধান দিক হলো ‘খুদী’। তিনি এই দর্শনের মধ্য দিয়ে আত্ম–সচেতনতা এবং আত্মোপলব্ধির প্রতি জোর দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রতিটি ব্যক্তি ও জাতির পূর্ণ আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতায় ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। ফিলিস্তিনি জনগণের আত্ম–নিয়ন্ত্রণের অধিকারের সংগ্রাম আল্লামা ইকবালের এই মৌলিক দর্শনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এছাড়াও আল্লামা ইকবাল স্পষ্টভাবে ফিলিস্তিনের জনগণের স্বাধীনতার ব্যাপারে উম্মাহপ্রেমী সচেতন মুসলিম কবি হিসেবে স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন। ফিলিস্তিনের মানুষের স্বাধীনতা যখন বিপন্নপ্রায়, ফিলিস্তিন যখন জড়িয়ে পড়েছিল ভূরাজনৈতিক জটিল জালে—তখন তিনি কবিসুলভ সংবেদনশীলতা ও মুক্তিকামী মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে জোরালো ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর কাব্যিক ও রাজনৈতিক প্রয়াসের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার জন্য ফিলিস্তিনি জনগণের আকাঙ্ক্ষা প্রতিধ্বনিত হয়। তাঁর সামগ্রিক সংগ্রামের লক্ষ্য ছিল মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি ন্যায়সঙ্গত বৈশ্বিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
আল্লামা ইকবাল ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে ফিলিস্তিন সফর করেন। তখন যদিও রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল গঠিত হয় নি, তবে তার জোর চেষ্টা শুরু হয়েছিল। ইহুদিবাদীরা নিয়মিতই ফিলিস্তিনবাসীর ভূমি কেড়ে নিয়ে বসতি স্থাপনের চেষ্টা করত। এ নিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে ইহুদিবাদীরা বিবাদে লিপ্ত হতো। ফলে ফিলিস্তিনের সংকট সম্পর্কে আল্লামা ইকবাল প্রত্যক্ষ ধারণা লাভ করতে পারেন।
ফিলিস্তিনে অবস্থানকালে তিনি বেশ কিছু কবিতা লেখেন। পরবর্তীতে যখন কবিতাগুলো বইয়ে সংকলিত হয়, তিনি ‘ফিলিস্তিনে লিখিত কবিতা’ বলে উল্লেখ করে দেন।
সেখানকার আলো–বাতাস, প্রকৃতি ও পরিবেশ আল্লামা ইকবালকে মুগ্ধ করেছে। সেই মুগ্ধতা তিনি প্রকাশ করেন তার কবিতার মধ্য দিয়ে—
قلب و نظر کی زندگی دشت میں صبح کا سماں
چشمۂ آفتاب سے نور کی ندیاں رواں!
حسن ازل کی ہے نمود چاک ہے پردۂ وجود
دل کے لیے ہزار سود ایک نگاہ کا زیاں!
হৃদয় ও চোখের জীবন, মরুভূমিতে সকালের আকাশ,
সূর্য থেকে আলোর নদী বয়ে যাচ্ছে!
চিরন্তন সৌন্দর্যের প্রকাশ, খুলে গেল ব্রহ্মাণ্ডের পর্দা;
পলকের দেখায় হাজারো ফায়দা।
এই কবিতা লেখার সময় ফিলিস্তিনের বিভিন্ন এলাকার নান্দনিক দৃশ্যগুলো হয়ত কবির মানসপটে ভেসে উঠেছিল। সবুজ উদ্যান, নদীর বহমানতা, ফুল ও ফল, সারি সারি গাছ, বিস্তৃত ফসলের মাঠ, আঙুর, ডুমুর ও মাল্টার বাগান। কী অপরূপ সৌন্দর্য!
ফিলিস্তিন ছিল আরব–বিশ্বের সুন্দরতম অঞ্চলগুলোর অন্যতম। অথচ সেখানে এখন সেখানকার আদি অধিবাসীরাই নিজ দেশে পরবাসী। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এখন আন্তর্জাতিক দুষ্টচক্রের ষড়যন্ত্রে বিলীন ও বিরান। ফুল, ফল ও ফসলের ঘ্রাণ ছাপিয়ে বারুদের গন্ধে প্রাণ ওষ্ঠাগত।
ফিলিস্তিনের ক্রমবর্ধমান সংকট আল্লামা ইকবালকে বিচলিত করে। ফলে বিভিন্ন সময় বক্তৃতা, বিবৃতি ও কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এর ন্যায়সঙ্গত সুরাহার তাগিদ দেন। এ–সময় তিনি এক কবিতায় লেখেন—
جلتا ہے مگر شام و فلسطیں پہ مرا دل
تدبیر سے کھلتا نہیں یہ عقدہَ دشوار
تُرکانِ جفا پیشہ، کے پنجے سے نکل کر
بیچارے ہیں تہذیب کے پھندے میں گرفتار
শাম ও ফিলিস্তিনের জন্য আত্মপীড়ায় ভুগছি,
পরিকল্পনায় খুলবে না এই কঠিন গিঁট।
তুর্কির নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেয়ে
বেচারা পড়েছে সভ্যতার ফাঁদে।
(দামে তাহযীব, যরবে কালীম)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ফিলিস্তিন ও সিরিয়ার দেশগুলো অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো তুর্কিদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত অপপ্রচার চালিয়ে তাদের অত্যাচারী আখ্যায়িত করে আরবদেরকে তুর্কিদের শাসন থেকে মুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুর্কিরা পরাজিত হলে ব্রিটিশ ও ফরাসিরা সিরিয়া–ফিলিস্তিনসহ অন্যান্য আরব দেশগুলো প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে শাসন করে। এর মধ্য দিয়ে আরবদের মধ্যে পশ্চিমা সভ্যতার অনুপ্রবেশ ঘটে। এতে আরবদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা যেমন ক্ষুণ্ন হয়, ক্ষুণ্ন হয় আরব–ইসলামী সংস্কৃতিও। এ প্রেক্ষাপটেই আল্লামা ইকবাল বলেন—সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে যা ঘটেছে তাতে আমার অন্তর জ্বলছে। এটি এমন জটিল সমস্যা, শুধু পরিকল্পনা যথেষ্ট নয়। আরবরা তুর্কিদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে পশ্চিমা সভ্যতার ফাঁদে পড়েছে।
আল্লামা ইকবাল যখন জীবনসায়াহ্নে উপনীত, তখন ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তোড়জোড় শুরু হয়। এতে তিনি বিচলিত বোধ করেন। তিরোধানের এক বছর আগে ১৯৩৭ সালের ২৬ জুলাই মাসে লাহোরে এক ভাষণে তিনি ফিলিস্তিন ইস্যুতে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এই ভাষণে তিনি ফিলিস্তিনের মাটি ও মানুষের প্রতি আবেগ এবং জবরদস্তিমূলক ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি সমাধান–প্রস্তাব পেশ করেন। এই ভাষণে আল্লামা ইকবাল মুসলমানদের পবিত্র ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমি ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটিকে গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এই উদ্যোগকে তিনি বিপজ্জনক পরীক্ষা বলে সাব্যস্ত করেন।
আল্লামা ইকবাল ফিলিস্তিনের সংকট শুধু এখানকার অধিবাসীদের সংকট মনে করতেন না। একে তিনি সমগ্র আরবের, বরং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সংকট বলে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন—দুনিয়ার মুসলমানদের উচ্চৈঃস্বরে ঘোষণা করা উচিত, ব্রিটিশ নেতারা ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে সংকটের সমাধান করবেন বলে ভেবেছেন, তা কেবল ফিলিস্তিনেই সীমাবদ্ধ নয়; এই সংকট এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত সমগ্র ইসলামী বিশ্বকে প্রভাবিত করছে।
তিনি ফিলিস্তিন ইস্যুকে এশিয়ার আরব–অনারব সকল ইসলামী রাষ্ট্রের সম্মান ও মর্যাদার পরীক্ষা বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি মনে করতেন, খিলাফতের সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর এটাই একমাত্র আন্তর্জাতিক বিষয়, যা একই সঙ্গে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয়। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য সময় ও ইতিহাস স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্রসমূহকে আহ্বান করছে। ইসলামী বিশ্বকে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার বিকল্প নেই।
ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠাকে আরবদের জন্য লজ্জাজনক এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বুদ্ধিভ্রষ্ট প্রয়াস সাব্যস্ত করে আল্লামা ইকবাল বলেন—উর্বর জমি ইহুদিদেরকে দিয়ে আরবদের পাথুরে অনুর্বর জমির সঙ্গে কিছু নগদ অর্থ দিয়ে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা কোনোক্রমেই রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়। এটি একটি নিম্নস্তরের ঘৃণ্য দর কষাকষি, যা মহান আরব জাতির জন্য যুগপৎ কলঙ্ক ও লজ্জার বিষয়।
ফিলিস্তিনে যে সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছিল, আল্লামা ইকবাল তার সমাধানকল্পে আরব ও তুর্কিদের সম্মিলিত প্রয়াস গ্রহণ করা অনিবার্য বলে মনে করতেন। তিনি মনে করতেন, মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের জীবন ও রাজনৈতিক স্বার্থ আরব এবং তুর্কিদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার মধ্যে নিহিত। এজন্য তিনি এই দুই জাতিকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সম্মিলিতভাবে পরিস্থিতি উত্তরণের আহ্বান জানান।
আল্লামা ইকবাল রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন, ফিলিস্তিনের সংকট নিরসনে আরব রাষ্ট্রসমূহের রাজতান্ত্রিক শাসকদের যথেষ্ট ভূমিকা রাখার সুমতি হবে না। এজন্য তিনি আরব জনগণকে সমস্যা নিরসনে নিজেদের উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, জাতীয় সমস্যা নিয়ে চিন্তা করার সময় আরব জনগণের তাঁদের শাসকদের পরামর্শের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া উচিত নয়। কেননা এসব রাজা–বাদশাদের বর্তমান অবস্থা এরূপ নয় যে, তারা নিজেদের বিবেক ও ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে ফিলিস্তিন বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে উপযোগী উপসংহারে পৌঁছাতে পারবে।
এখন তো স্পষ্ট যে, আল্লামা ইকবাল অন্তর্দৃষ্টিতে যা দেখতে পেয়েছিলেন, তা বাস্তব সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে। আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, এসব অথর্ব শাসকরা স্বজাতি—নৃতাত্ত্বিকভাবে আরব এবং ধর্মীয়ভাবে মুসলিম—ফিলিস্তিনিদের পাশে সামরিকভাবে তো দাঁড়াতে পারেই নি, এমনকি আন্তর্জাতিক ফোরামে কণ্ঠগত ভূমিকা পালন করতেও সক্ষম নয়।
ফিলিস্তিনের ইতিহাস ও ইহুদিদের সঙ্গে ফিলিস্তিনের সম্পর্ক উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লামা ইকবাল বলেন—ঐতিহাসিক ধারাক্রম অধ্যয়ন করলে স্পষ্ট হয়, ফিলিস্তিন একান্তভাবে এবং সম্পূর্ণরূপে মুসলমানদের বিষয়। ইতিহাস সাক্ষী—হযরত উমর (রা.)-এর ফিলিস্তিন আগমনের পরে আজ তেরোশ বছর পর্যন্ত, এমনকি এর আগেও ফিলিস্তিনের সঙ্গে ইহুদিদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। ইহুদিদেরকে ফিলিস্তিন থেকে জবরদস্তিমূলক বিতাড়িত করা হয় নি। তারা স্বেচ্ছায় বিভিন্ন দেশে চলে গিয়েছে। তাদের বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ ফিলিস্তিনের বাইরেই রচিত হয়েছে।
ফিলিস্তিন ইহুদিদের ভূমি, এই দাবির পক্ষে তাদের দলিল হলো, তারা এখানকার ভূমিপুত্র। তারা একসময় এখানে বসবাস করেছে। আল্লামা ইকবাল তাদের এই ভ্রান্ত দাবি প্রত্যাখান করে বলেন—
خاک فلسطیں پہ یہودی کا ہے اگر حق
ہسپانیہ پر حق نہیں کیوں اہل عرب کا
ফিলিস্তিনের ভূমি ইহুদিদের—এ যদি সত্য হয়
স্পেনের ওপর অধিকার নেই কেন আরবদের?
(শাম ও ফিলিস্তিন, যরবে কালীম)
আল্লামা ইকবাল এই কবিতার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের একটি অনালোচিত বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। স্পেনের ইতিহাস মুসলমানদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণের ইতিহাস। ৭১১ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে মুসলিম–বাহিনী সেখানকার অত্যাচারী শাসক রাজা রডারিককে পরাজিত করে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এর এক দশকের মধ্যে আইবেরীয় উপদ্বীপের অধিকাংশ ভূখণ্ড তাঁদের অধীনে চলে আসে। এরপর সাতশ বছরের বেশি সময় মুসলমানরা দেশটি শাসন করেন। এই ভূখণ্ডের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ ইসলাম ছায়াতলে আশ্রয় নেন। এর রাজধানী কর্ডোভা ছিলো মুসলিম বিশ্ব ও ইউরোপের জ্ঞানপিপাসুদের তীর্থস্থান। পরবর্তীতে মুসলিম শাসকদের অন্তর্কোন্দলের সুযোগ নিয়ে খ্রিস্টান শাসকরা এই দেশটিকে অধিকার করে। এর কয়েক বছরের মধ্যে মুসলিমদেরকে হয় দেশ থেকে বিতাড়িত, নয়ত জোরপূর্বক খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করা হয়। ইকবাল এই কবিতায় উপর্যুক্ত ইতিহাসের প্রতি ইঙ্গিত করে বলছেন—কয়েক হাজার বছর আগে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের বসবাস থাকার কারণে এই ভূখণ্ডটির মালিকানা তাদের হলে, যে স্পেন একসময় মুসলমানদের অধিকৃত ছিল, যে–দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ মুসলিম ছিলেন, মুসলমানরাই যে–দেশকে তৎকালীন সময়ের বিবেচনায় জ্ঞান, বিজ্ঞান ও শিল্পকলায় উন্নতির শিখরে নিয়ে গিয়েছিলেন—সে–দেশের মালিকানা মুসলমানদের কেন হবে না?
ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড কেড়ে নিয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে আল্লামা ইকবাল দেখেছেন ব্রিটিশ রাজের বড় একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য শুধু এই নয় যে, এখানে তারা বসবাস করে শুধু এই ভূখণ্ডটির ফল, ফসল ও আলো–বাতাস উপভোগ করবে। বরং তাদের উদ্দেশ্য মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের একটি আঞ্চলিক ঘাঁটি তৈরি করে আরবদের মধ্যে পারস্পরিক অনৈক্য সৃষ্টি করা, আরবদের তটস্থ রাখা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা। ইকবাল বলেন—
مقصد ہے ملوکیتِ انگلیس کا کچھ اور
قصہ نہیں نارنج کا یا شہد و رطب کا
ইংরেজ শাসকদের অভিপ্রায় ভিন্ন;
কমলা, মধু আর খেজুর নয়।
(শাম ও ফিলিস্তিন, যরবে কালীম)
আল্লামা ইকবালের মৃত্যুর দশ বছর পর ইসরায়েলের জন্ম। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অতিক্রান্ত হয়েছে পঁচাত্তর বছর। এত বছরের কর্মকাণ্ডে প্রমাণিত, আল্লামা ইকবাল প্রতিষ্ঠার আগেই এই ইহুদি রাষ্ট্রটির উদ্দেশ্য যথার্থ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। সত্যিই, ইসরায়েল পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের ‘জমিদারি’র আঞ্চলিক প্রতিনিধির ভূমিকা পালন করছে।
ঐতিহাসিকভাবেই আরবরা স্বাধীনচেতা। তাঁদের শৌর্য–বীর্য প্রবাদতুল্য। তাঁরা ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে একের পর এক রাজ্য জয় করেছেন এবং শত শত বছর সে–সব দেশ শাসন করেছেন। আল্লামা ইকবাল আশাবাদী ছিলেন, পূর্বপুরুষদের রক্তের উত্তাপ উত্তরপুরুষদের ধমনীতেও প্রবাহিত। আরবদের রক্তের উত্তাপ এখনো নিঃশেষিত হয়ে যায় নি। সময়মতো রক্ত কথা বলবেই। প্রয়োজনমতো ঝলসে উঠে তাঁরা ঠিকই পরাধীনতার জিঞ্জির ছিন্ন করবে। তাঁদের স্বাধীনচেতা পূর্বপুরুষদের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আল্লামা ইকবাল বলেন—
زمانہ اب بھی نہیں جس کے سوز سے فارغ
میں جانتا ہوں وہ آتش ترے وجود میں ہے
যাদের উত্তাপ থেকে সময় এখনো মুক্ত নয়,
আমি জানি, সেই আগুন তোমাদের মধ্যে সু্প্ত আছে।
এরপর বলেন—
تیری دوا نہ جنیوا میں ہے، نہ لندن میں
فرنگ کی رگِ جاں پنجہ یہود میں ہے
سُنا ہے میں نے غلامی سے اُمتوں کی نجات
خودی کی پرورش و لذّتِ نمود میں ہے
তোমার রোগের চিকিৎসা জেনেভাতেও নেই, নেই লন্ডনেও;
ইংরেজদের প্রাণশক্তি ইহুদিদের করতলে।
শুনেছি, পরাধীনতা থেকে মুক্তি—
আত্মমর্যাদাবোধ লালন করা ও তা কার্যকর করার মধ্যে।
(ফিলিস্তিনি আরব সে, যরবে কালীম)
আল্লামা ইকবাল এই কবিতায় পরাধীনতার শেকল ছিঁড়ে স্বাধীনতা লাভের মন্ত্র বাতলে দিয়েছেন। প্রথমে তিনি আরবদের পূর্বপুরুষদের বীরত্বের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের ধমনীতে বীরপুরুষ রক্ত বহমান। এরপর তিনি বলেছেন, তোমাদেরকে যে পরাধীনতার জিঞ্জির পরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, এ থেকে মুক্তি জেনেভাও দিতে পারবে না, লন্ডনও দিতে পারবে না। কারণ ইউরোপের পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ইহুদি সম্প্রদায় অত্যন্ত শক্তিশালী। অর্থনৈতিক শক্তির কারণে রাজনৈতিক বিষয়ের লাগামও তাদের হাতে। ফলে পশ্চিমারা ইহুদিদের বিরুদ্ধে যেতে পারবে না। তাহলে সমাধান কী? সমাধান আরবদের নিজেদেরই করতে হবে। আত্মমর্যাদাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেদের স্বাধীনতা নিজেদেরই ছিনিয়ে আনতে হবে।
আমরা দেখি, আল্লামা ইকবাল পুরোপুরি বাস্তবধর্মী ছিলেন। তিনি সমস্যার গোড়ায় হাত দিয়েছেন। যারা সমস্যা তৈরি করে, তারা এর সমাধান করতে পারে না। সমাধান অন্য কাউকে করতে হয়। ফিলিস্তিনে ইহুদি–সংকট তৈরি করেছে পশ্চিমারা। তারা এর সমাধান করতে পারবে না। সেই সদিচ্ছাও তাদের নেই, আর কখনো তা হবেও না। এর সমাধান ফিলিস্তিনি ও আরবদেরই করতে হবে। এটাই আল্লামা ইকবালের মতে ইসরায়েল–সংকটের একমাত্র সমাধান। আমরা আনন্দিত যে, ফিলিস্তিনিরা তাঁদের পিতৃভূমি পুনরুদ্ধার, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে চলেছেন সামর্থের সবটুকু দিয়ে। চারদিক থেকে অবরুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও পিতৃভূমি পুনরুদ্ধারের লড়াই থেকে তারা কখনো পিছপা হন নি। যাদের কাছে জীবনের চেয়ে স্বাধীনতা মূল্যবান, তাদেরকে পৃথিবীর কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। আজ হোক বা কাল তারা বিজয়ী হবেই, প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস আবার মুক্ত হবেই—এই আমাদের বিশ্বাস। আল্লামা ইকবালের ভাষায়—
آسماں ہو گا سحر کے نور سے آئینہ پوش
اور ظلمت رات کی سیماب پا ہو جائے گی
شب گريزاں ہو گي آخر جلوہ خورشيد سے
يہ چمن معمور ہوگا نغمہ توحيد سے
ভোরের আলোয় আলোকিত হবে আকাশ,
ঘুচে যাবে রাতের আঁধার।
সূর্যের প্রভাবে রাত শেষ হবে,
এই বাগান তাওহীদের গানে মুখরিত হবে।
(শামা আওর শায়ির, বাঙ্গে দারা)
তথ্যপঞ্জি:
-
কুল্লিয়াতে ইকবাল—ইকবাল অ্যাকাডেমি, পাকিস্তান
-
আল্লামা ইকবাল কে আখিরি দো সাল— ইকবাল অ্যাকাডেমি, পাকিস্তান
-
সফরনামা ইকবাল— ইকবাল অ্যাকাডেমি, পাকিস্তান
মাশাআল্লাহ, খুব চমৎকার লেখনী।
আল্লাহ তায়ালা যোগাযোগের এ প্রচেষ্টা কবুল করুন।
মা শা আল্লাহ।
আল্লামা ইকবালের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা কেমন ছিল—তা সহজেই অনুমান করতে পারলাম।
হা-মা-স বাহিনী ইকবালের এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটাবেই। ইন শা আল্লাহ।