শায়খ ইউসুফ আল কারদাভি (১৯২৬-২০২২ খ্রি.) একজন সাহসী ও নির্ভীক আলিম, ফকিহ, মুজাহিদ, মুজতাহিদ, কবি এবং লেখক। কারদাভির ব্যক্তিত্ব বিভিন্ন কামালাত ও কৃতিত্বের আধার। সত্যবাদিতা, নিপীড়িতের সমর্থন এবং জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম তাঁর ব্যক্তিত্বের মৌলিক উপাদান। কারদাভি একদিকে কুরআন-সুন্নাহর খেদমতে আত্মনিয়োগ করে জ্ঞান ও চিন্তার প্রদীপ জ্বালিয়েছেন এবং ফিকহ ও ইজতিহাদের ক্ষেত্রে উম্মাহর সেবা করেছেন, অন্যদিকে মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামি বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যা ও সংকটপূর্ণ ইস্যুতে সাহসিকতার সঙ্গে আপন মতামত প্রকাশ করেছেন, পালন করেছেন আপন ভূমিকা।
উম্মাহর খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং গুরুতর এক ইস্যু হলো ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এবং আল আকসার পুনরুদ্ধার। ফিলিস্তিন ইস্যু সবসময়ই শায়খ কারদাভির মনোযোগ ও বহুমুখী তৎপরতার বিষয় হয়ে থেকেছে। ‘সীরাতুন ওয়া মাসীরাতুন’ গ্রন্থে তিনি লিখেন : “আমার হৃদয় ও মস্তিষ্কের মধ্যে যে ইস্যুগুলি ছেয়ে রয়েছে, তার মধ্যে ফিলিস্তিন ইস্যুটি শুরু থেকেই প্রধান ইস্যু। ১৯৪০ সালে, যখন আমি তান্তায় ‘আল মা’হাদ আদ দ্বীনী’তে ভর্তি হই, তখন থেকে, প্রতি বছর ২ নভেম্বর, আমি অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিবের ‘বেলফোর ঘোষণা’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করি।”
২ নভেম্বর ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার ‘বেলফোর ঘোষণা’ করে। এই ঘোষণায় ইহুদিদের জন্য একটি জাতীয় আবাসভূমি ফিলিস্তিনে প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তটির নামকরণ হয় তৎকালীন গ্রেট ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোরের নামে। এই পরিকল্পনার নীলনকশা করা হয় ব্রিটিশ-জায়নবাদী মৈত্রীর যৌথ প্রয়াসের অংশ হিসেবে। এই বেলফোর ঘোষণায় আবেদন জানানো হয় বিশ্বের বিশিষ্ট ব্যাংকার, ফ্রি ম্যাসন সংগঠন এবং গোপনে জায়নবাদী লর্ড রথসচাইল্ডের কাছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড ব্যালফোর্ড জায়নবাদী নেতা লর্ড রথসচাইল্ডের কাছে ইহুদিপ্রশ্নে যে চিঠি লেখেন, তার মর্মই ‘বেলফোর ঘোষণা’ নামে আজ পরিচিত। তিনি তাঁর ঐ চিঠিতে বলেন, ‘ব্রিটেন ফিলস্তিনে ইহুদিদের জন্য একটি জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠায় সর্বোত্তম উদ্যোগ নেবে।’
শায়খ কারদাভি তার একাধিক গ্রন্থে স্পষ্ট করেছেন যে, আমাদের আসল লড়াই হলো ফিলিস্তিনি ভূমি দখলকারীদের বিরুদ্ধে এবং যতক্ষণ না ইহুদিরা আমাদের জমির দখলদার থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের লড়াই জারি থাকবে। ইহুদিদের পক্ষে ফিলিস্তিনের ভূমি থেকে অব্যাহতি গ্রহণের অধিকার কারো নেই। শায়খ কারদাভি আরও বলেন, ইহুদিরা যদি ফিলিস্তিনে ধর্মের নামে যুদ্ধ করে, তাহলে আমাদের জন্যও তাদের ভাষায় তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জায়েজ হবে। তাদের যুদ্ধের অস্ত্র যদি তাওরাত হয়, তাহলে আমরা কুরআনকে অস্ত্র বানাব। যদি তারা মূসা আ. এর নামে একটি বাহিনী প্রস্তুত করে তবে আমরা মুসা, ঈসা এবং মুহাম্মদ (দ.) এর নামে একটি বাহিনী প্রস্তুত করব, কারণ আমরা তাদের চেয়ে মুসা আ. এর বেশি নিকটবর্তী।’
ইহুদিরা দাবি করে ফিলিস্তিনের ভূমিতে তাদের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় অধিকার আছে, কিন্তু শায়খ কারদাভি এই দাবিকে ঐতিহাসিকভাবে অসত্য সাব্যস্ত করে বলেন, ইতিহাস দেখায় যে, তারা যখন ভূমিতে প্রবেশ করেছিল, তখন এটি কোনো জনবসতিহীন ভূমি ছিল না এবং তারা যখন এখান থেকে চলে গিয়েছিল, তখন তারা এটিকে খালি রেখে যায়নি, বরং এখানে মানুষের জনসংখ্যা ছিল। এখানে বসবাসরত ছিল ফিলিস্তিনের লোকেরা যাদের কথা স্বয়ং তাওরাতে উল্লেখ আছে। তারা সেখানে ইহুদিদের আগমনের আগেও ছিল, তাদের আগমনের পরেও ছিল এবং ইহুদিদের চলে যাওয়ার পরেও তাদের অবস্থান সেখানে ছিল। অতএব, তারা যে ঐতিহাসিক অধিকারের কথা বলে, তার কোনো সত্যতা নেই, তা নিছক একটি প্রতারণা।’
লর্ড সাইডেনহ্যাম যেমন বলেছেন, “ফিলিস্তিন ইহুদিদের আদি আবাস নয়। এটি তারা দখল করেছিল এক নিষ্ঠুর আক্রমণ অভিযানের পর। আর কখনও তারা গোটা ফিলিস্তিনের অধিকারী ছিল না। এখন তারা প্রকাশ্যে তেমন দাবিই জানাচ্ছে। এই দেশটার ব্যাপারে প্রাচীন রোমকদের বংশধরদের যে দাবি থাকতে পারে তার চেয়ে এই ইহুদিদের দাবি কোনাভাবেই অধিকতর বৈধ হতে পারে না। রোমকরা যতকাল ব্রিটেনকে দখলে রেখেছিল ইসরাইলিরাও অনুরূপকাল ফিলিস্তিন দখলে রাখে। পরে তারা অর্থ্যাৎ রোমকরা ব্রিটেনে অনেক বেশি মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ কর্ম ঐতিহ্য আমাদের দেশে রেখে যায়। যদি হাজার হাজার বছর পূর্বেকার বিজয়ের ভিত্তিতে দাবি করি তাহলে তো গোটা পৃথিবীকে আগাগোড়া উল্টে বা বদলে দিতে হয়।” [1]হ্যানসফোর্ড, লর্ডসভা, ২১ জুন ১৯২২
এই প্রেক্ষিত থেকেই আল্লামা ইকবাল তাঁর বিখ্যাত কবিতায় বলেছেন, যদি ফিলিস্তিনে ইহুদিদের অধিকার থাকে, তাহলে কেন আরবদের স্পেন এবং সিসিলি ও অন্যান্য ইউরোপীয় বিজিত ভূখণ্ডে অধিকার থাকবে না। বস্তুত, ইহুদিদের এই দাবি এমনই যেমন রেড ইন্ডিয়ানদের দাবি আমেরিকার উপর, অথবা ভারতের আর্যরা ইরান এবং রাশিয়ার উপর যদি এমন দাবি করে বসে যে তাদের আসল ভূমি ফিরিয়ে দেওয়া হোক। আগস্ট ১৯১৯ সালে কিং-ক্রেন কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়, ‘.. জায়নবাদী প্রতিনিধিরা গোড়ার দিকে যে দাবি প্রায়ই উত্থাপন করেছেন তা হলো, ফিলিস্তিনের ওপর তাদের দাবি রয়েছে। দুই হাজার বছর আগে দেশটি যে তাদের ছিল সে দাবির ভিত্তিতেই তাঁরা তাদের নিজ জাতীয় আবাসভূমি ফিরে পেতে চায়। কিন্তু সেই দুই হাজার বছর আগে দেশটি তাদের থাকার বিষয়টি আদৌ বিবেচনার জন্য তেমন গুরুত্ব বহন করে না।’
আল্লামা কারদাভি ফিলিস্তিনকে সাহায্য করার জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। বৈষয়িকভাবে সাহায্য করার জন্য জনসেবামূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। যেমন ‘মুআসসাসাতু ইতিলাফ আল খাইর’ এবং ‘মুআসসাসাতু আল কুদস আদ দুওয়ালিয়াহ’। ফিলিস্তিনের আর্থিক সহায়তার জন্য অনেক দেশে প্রচারাভিযান করেছেন। এইভাবে তিনি রাজনৈতিকভাবে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানের জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি অনেক শাসক ও রাজা-বাদশাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদেরকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও আল আকসার পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াইয়ের প্রতি আহ্বান করেন। তিনি ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে চলমান ইসরায়েলি সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে শাসকদের নীরবতার সমালোচনা করেন এবং ফিলিস্তিনি সংগঠনগুলোকে সাহায্য করতে তাদেরকে রাজি করাবার চেষ্টা করেন।
শায়খ কারদাভি উম্মাহর সামনে ফিলিস্তিনের ভূমিতে চলমান যুদ্ধের প্রকৃতিও স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, ভূমিকে রক্ষা করার জন্য সেই ভূমির মানুষের উপর জিহাদ ফরজ এবং এই জিহাদের পরিধি সমগ্র উম্মাহ পর্যন্তও বিস্তৃত হতে পারে। আর যখন প্রথম কিবলা ও তৃতীয় হারামের মুক্তির কথা আসে, তখন এই পথে জিহাদের দায়িত্ব ও সম্মান আরও বেড়ে যায়। তিনি বলেন, ‘আল কুদসের মুক্তির লক্ষ্যে একটি দীর্ঘ জিহাদের প্রস্তুতি নেওয়া আরবদের উপর ফরজ। কারণ, ইসরাইল আমাদের অধিকারকে কখনোও স্বীকার করবে না।’
শায়খ কারদাভি সন্ত্রাস ও প্রতিরোধযুদ্ধের পার্থক্য ব্যাখ্যা করে ‘ফিকহুল জিহাদ’ গ্রন্থে লিখেছেন, “ইসরায়েল প্রথম দিন থেকেই সন্ত্রাসবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্র। এটি Haganah (ইহুদি সামরিক সংগঠন) গুন্ডাদের সন্ত্রাস এবং তাদের মাধ্যমে দারিয়াসিন এবং অন্যান্য স্থানে ফিলিস্তিনিদের উপর গণহত্যা চালিয়ে ফিলিস্তিনি জনগণকে তাদের বাড়িঘর থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে প্রতিষ্ঠিত হওয়া একটি রাষ্ট্র। তাই ফিলিস্তিনের জনগণ যা কিছু করছে, তা হলো জিহাদ এবং প্রতিরোধ, তারা তাদের ভূমি ও অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য প্রতিরোধযুদ্ধ করছে। এই প্রতিরোধযুদ্ধের নাম যদি সন্ত্রাস হয়, তবে তারা আমাদের সন্ত্রাসী বলতে থাকুক।”
ফিলিস্তিনের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতে ফিদায়ী বা আত্মঘাতী আক্রমণকেও জায়েজ ঘোষণা করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ফিলিস্তিনে ফিদায়ী হামলার ইসলামি অবস্থান সম্পর্কে অনেকেই জানতে চান। প্রকৃতপক্ষে, এটি জিহাদের অন্যতম উত্তুঙ্গ একটি রূপ। এটি শত্রুকে ভয় দেখানোর এমন একটি পদ্ধতি, যার দিকে কুরআনের সূরা আনফালের ৬০ নং আয়াতে ইশারা করা হয়েছে। তার বক্তব্য, ‘ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে এই আত্মঘাতী অভিযান তখনই অনুমোদিত, যখন প্রতিরক্ষার অন্য কোনও উপায় নেই। পরবর্তীতে তিনি স্পষ্ট করেন, ফিলিস্তিনিরা যখন আত্মরক্ষার জন্য ক্ষেপণাস্ত্র এবং অন্যান্য অস্ত্র পায়, তখন আর ফিদায়ী হামলার অবকাশ বাকী থাকে না।”
ফিলিস্তিন ইস্যুটির প্রকৃতি ও বাস্তবতা স্পষ্ট করতে শায়খ কারদাভি শিল্প-সাহিত্য ও মিডিয়া মাধ্যমগুলোও ব্যবহার করেছেন। ফিলিস্তিনিদেরকে তাদের অধিকারের কথা মনে করিয়ে দেয় এমন কবিতা, কাসীদা, খুতবা, আর্টিকেল এবং অডিও-ভিডিও মাধ্যমের সহায়তা নিয়েছেন তিনি। দরবারি আলেম ও খতিবদের ফতোয়া থেকে সরে গিয়ে শায়খ কারদাভি সাহসিকতার সাথে তার মতামত প্রকাশ করেছেন। তিনি জায়নবাদী সরকারের সাথে বন্ধুত্বকে হারাম ঘোষণা করেন। আমেরিকান ও ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের আহ্বান জানান। ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডের মূল্য গ্রহণকে হারাম ঘোষণা করেন। সর্বোপরি তিনি স্পষ্ট করেন যে, আল কুদস থেকে অব্যাহতিগ্রহণ আল্লাহ, রাসূল এবং সমগ্র উম্মাহর সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল।
তথ্যসূত্র:
↑1 | হ্যানসফোর্ড, লর্ডসভা, ২১ জুন ১৯২২ |
---|