প্রাচ্যতত্ত্ব কি ইসলামতত্ত্ব

কামরুল হাসান নকীব

ভূমিকা

প্রাচ্যতত্ত্ব বিষয়ক আলোচনায় বর্তমান সময়ে অনেক নবীন ও প্রবীণ ইসলামপন্থি গবেষকদের একটি মৌলিক প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায় তাদের অনেকেই (সম্ভবত সবাই) যথাযথভাবে দেখান না প্রাচ্যতত্ত্বকে কেন তারা ইসলামতত্ত্ব হিসেবে হাজির করছেন তারা তাদের আলোচনার পূর্বসত্য হিসেবে ধরে নেন প্রাচ্যতত্ত্ব মানেই হলো ইসলামতত্ত্ব কিন্তু প্রাচ্য কীভাবে কেবলমাত্র ইসলাম হয়ে উঠল কিংবা কেন তারা প্রাচ্যের অপরাপর ধর্মের আলোচনা ও ধর্মের অনুসারীদের আলোচনা বাদ দিয়ে কেবলমাত্র ইসলাম ও মুসলিমদের আলোচনায় প্রবৃত্ত হচ্ছেন তার কোনো যুক্তি তারা সচরাচর দেখান না

আমরা মনে করি এই প্রশ্নের মীমাংসা ছাড়া কিংবা গবেষণার সূচনাপর্বে এই প্রশ্নটিকে যথাযথভাবে খোলাসা না করা ব্যতীত প্রাচ্যতত্ত্ব বিষয়ক আলোচনায় অগ্রসর হওয়া খুবই সমস্যাজনক ও বিভ্রান্তিকর কারণ প্রাচ্য কীভাবে ইসলাম হয়ে উঠল তা প্রতিষ্ঠা না করে ইসলাম নিয়ে আলোচনা করাটা অশোভনীয় ও অশাস্ত্রীয় তাই প্রথমেই গবেষকদের যথাযথ প্রমাণ ও যুক্তির সাথে প্রতিষ্ঠা করতে হবে প্রাচ্যতত্ত্ব মানে কেন ইসলামতত্ত্ব এবং কেন প্রাচ্যের অপরাপর ধর্ম ও ধর্মের অনুসারীদের আলোচনা এখানে গৌণ ও অপ্রধান বিষয় অতঃপর এ বিষয়টি যখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে তখন প্রাচ্যতাত্ত্বিকদের ইসলাম নিয়ে আপত্তির পর্যালোচনাগুলো পাঠক খুব সহজেই ধরতে পারবেন নচেৎ পাঠকের এমন ভাবনার যথেষ্ট অবকাশ আছে যে, গবেষক প্রাচ্যতত্ত্ব শিরোনামটির ব্যাপকতার প্রতি সুবিচার করতে সক্ষম হননি; বরং তিনি নিছক প্রাচ্যের একটি ধর্মের ওপর আলোচনা করে বিষয়টিকে খণ্ডিত ও অসম্পূর্ণভাবে হাজির করেছেন

বক্ষমাণ প্রবন্ধে আমরা তাই দেখানোর চেষ্টা করব প্রাচ্যতত্ত্ব আদৌ ইসলামতত্ত্ব কি না

প্রাচ্যতত্ত্ব কী

সহজ কথায় প্রাচ্যবাদ বা প্রাচ্যতত্ত্ব মানে হলো প্রাচ্য সম্পর্কে পশ্চিমা ভাবনা ও গবেষণা এই শাস্ত্রটিকে জনপ্রিয়তা দেন এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ ওরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যতত্ত্ব নামে তিনি একটি বই রচনা করেন ১৯৭৮ সালে

প্রাচ্যতত্ত্বকে আরবি ভাষায় বলে ইসতিশরাক আরবি থেকেই উর্দু ও ফারসি ভাষায় এই শব্দটি প্রাচ্যতত্ত্ব অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে আজ থেকে প্রায় দেড় শতাধিক বছর পূর্বে ইসতিশরাক শব্দটি প্রাচ্যতত্ত্ব অর্থে আরবি ও উর্দুফার্সি ভাষায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে তার মানে দাঁড়াচ্ছে সাঈদের বহু পূর্বে আরবি ও উর্দুফার্সিভাষী গবেষকগণ প্রাচ্যতত্ত্ব বিষয়ে সচেতন ও সজাগ ছিলেন তবে এটা সত্য যে, সাঈদের আলোচনার সাথে তাদের আলোচনার আঙ্গিকগত কিছু তারতম্য রয়েছে তাদের মধ্যকার এই তারতম্য সত্ত্বেও তারা উভয়েই একমত যে প্রাচ্যতত্ত্ব নিছক প্রাচ্যবিষয়ক জ্ঞান নয় প্রাচ্যতত্ত্ব প্রধানত ইসলামবিষয়ক জ্ঞান

প্রাচ্যতত্ত্ব কেন ইসলামতত্ত্ব

এডওর্য়াড সাঈদ তার ওরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যতত্ত্ব নামক বইটি কিসের ওপর লেখা এবং ওরিয়েন্টালিজম দ্বারা তিনি কী বুঝাতে চেয়েছেন তা আমাদেরকে জানাচ্ছেন—

this book has tried to demonstrate, Islam has been fundamentally misrepresented in the West.

অর্থাৎ “পাশ্চাত্যে মৌলিকভাবে ইসলামের ভুল প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে এই বইয়ে।”[1]Edward W. Said, Orientalism, p. 272

পূর্বোক্ত বইয়ের ২৬২৭ পৃষ্ঠায়ও একই ব্যাপারে বলা হয়েছে।[2]Three things have contributed to making even the simplest perception of the Arabs and Islam into a highly politicised, almost raucous matter: one, the history of popular anti-Arab and anti-Islamic … Continue reading)

তাছাড়া ঐ বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ই নিকটপ্রাচ্যের ওপর পশ্চিমের কোনো না কোনো মাৎস্যন্যায়ের দগদগে ক্ষতের চিহ্ন বহন করে।

তাহলে এখন প্রশ্ন আসে—পশ্চিম কেন প্রাচ্যের অপরাপর ধর্মকে বাদ দিয়ে ইসলামকে বেছে নিল? এই প্রশ্নটির উত্তরও আমরা ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত খ্রিস্টান গবেষক এডওয়ার্ড সাঈদের জবানিতে শুনব—

European interest in Islam derived not from curiosity but from fear of a monotheistic, culturally and militarily formidable competitor to Christianity.”

অর্থাৎ “ইসলামের প্রতি ইউরোপিয়ানদের এই আগ্রহ নিছক জ্ঞানস্পৃহা বা কৌতূহলজাত নয়; বরং ইউরোপিয়ানদের এই আগ্রহ মূলত খ্রিস্টবাদের বিরুদ্ধে একেশ্বরবাদী এবং সাংস্কৃতিক ও সামরিক দিক থেকে ভয়ানক এক প্রতিপক্ষের ভয় থেকে সৃষ্ট।”[3]Edward w. said, Orientalism,p. 343

এই ভয়টা খ্রিস্টবাদের আনুসারীদের অন্তরে বদ্ধমূল ছিল পুরো মধ্যযুগজুড়েই এই ভয় তাদের তাড়া করে ফিরেছে পশ্চিমারা পৃথিবীর যেখানেই পদার্পণ করেছে এই হিংস্র ভয় তাদের পিছু ছাড়েনি তাই তারা তাদের সামুদ্রিক অভিযান ও আবিষ্কারের সময়গুলোতেও ইসলামের ভূমি ও মুসলিমদের পদানত করার কথা তারা ভুলেনি পশ্চিমা ঐতিহাসিকরা লেখেন—

পনেরো শতকের শেষের দিকে এবং ষোলো শতকের শুরুর দিকে সময়টা ছিল আধুনিক ও মধ্য যুগের সন্ধিক্ষণ। এসময় ইতালি দখল করা নিয়ে ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার মধ্যকার যুদ্ধটিই সবচে গুরুত্ববহ বিষয় নয়; বরং এছাড়াও আরো বহু ঘটনা এই সময়টাকে তাৎপর্যমণ্ডিত করেছে। অধিকন্তু এসব ঘটনা যুদ্ধসম্পর্কিতও নয়। বলা ভালো এসব ঘটনা খ্রিস্টানবিশ্বে এক নেহায়েত মজবুত ও বীরোচিত সাহসিকতা সৃষ্টি করেছিল। যা তাদেরকে ইসলামি শক্তিসমূহের বিপরীতে বেশ শক্তিশালী ও অধিক ক্ষমতাধর বানিয়ে দিয়েছে।

খ্রিস্টান বিশ্বের এই অপরিমেয় শক্তিমত্তার মূলমন্ত্র ছিল প্রাচ্যের দ্বীপসমূহে ও আধুনিক বিশ্বে স্পেন ও পর্তুগালের সামুদ্রিক আবিষ্কার ও ধারাবাহিক বিজয়। পাশাপাশি প্রাচীন জ্ঞানবিজ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও আধুনিক সাহিত্যের আলোকোজ্জ্বল আবির্ভাব, মুদ্রণশিল্পের বদৌলতে এনলাইটেনম্যান্ট গবেষণা ও আধুনিক জ্ঞানের উন্নতি ইত্যাদি সকল বিষয় খ্রিস্টান সাম্রাজ্যের প্রাণশক্তিকে আরো প্রবলভাবে সমুন্নত করেছে। যার ফলে তাদের আবেগ আরো সংকল্পপূর্ণ হয়ে উঠে এবং কর্মক্ষেত্রের জটিল পরিস্থিতিতে তারা আরো সহিষ্ণু এবং দীর্ঘ শ্রমকষ্ট সহ্য করতে আরো প্রস্তুত হয়ে উঠেএছাড়াও আরো এমন অনেক উপকরণের দেখা মিলে যার দ্বারা বোঝা যায় যে ইউরোপবাসীদের এই নতুন শক্তি ইসলামি দেশগুলো বিজয়ে বেশ কার্যকর সাব্যস্ত হয় কারণ সেসময়েও ধর্মীয় আবেগ ব্যাপক ও মজবুত ছিল। সামুদ্রিক পরিব্রাজকদের আবিষ্কার ও দার্শনিকদের প্রচেষ্টা, শিক্ষকদের অক্লান্ত মেধাশ্রম ও শিক্ষার্থীদের পরিশ্রম এবং সেনাদের বীরত্ব সকল কিছুই ঐ একটি লক্ষ্যকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। অর্থাৎ ক্রুসেডারদের (খ্রিস্টানদের ধর্মযোদ্ধদের) উত্থানের জন্যই ছিল।

তাই তো উত্তাল সমুদ্রের বিপদসংকুল ও অমানুষিক শ্রমসাপেক্ষ অভিযানেও কলোম্বাসের উদ্দেশ্য ছিল এই সমুদ্রযাত্রা থেকে যা কিছু অর্জন হবে তা ‘বদদীন’ মুসলিমদের কাছ থেকে ‘পবিত্রভূমি’ মুক্ত করার কাজে ব্যবহার করা হবে। চার্লস অষ্টম যখন আলপ্স ও নেপলসের মধ্যকার যুদ্ধের উত্তাল ময়দানে যুদ্ধ করে তখন তার মনেও ছিল, সে ইতালি বিজয় করে তুর্কিদের (মুসলিমদের) কাছ থেকে কনস্টান্টিনোপল বিজয় করবে।[4]The Historians’ History of the World,(London and New York: Hooper and Jackson ltd.,1909) V. 24, p. 341.

নিকট প্রাচ্যের ধর্ম ইসলাম ও তার অনুসারীদের নিয়ে ভয় ও আতঙ্ক মধ্যযুগের পুরোটা সময় তাদেরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল আর এই ভয় ও আতঙ্কের মূল কারণ কী ছিল তা আমরা সাঈদের বরাতে জেনেছি সাঈদ জানাচ্ছেন এই ভয় ছিল—ইসলামের একেশ্বরবাদ, ইসলামের সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্য্য ও সামরিক শক্তিমত্তার কারণে এজন্যই পশ্চিম নিকট প্রাচ্যের (ইসলামের ভূমি তথা মধ্যপ্রাচ্যের) ব্যাপারে যতটুকু জ্ঞানতাত্ত্বিক পরিশ্রম করেছে ততটুকু পরিশ্রম সুদূর প্রাচ্যের কোনো ধর্ম বা দেশের জন্য করেনি বা করতে হয়নি। কারণ সুদূরপ্রাচ্যে ইসলামের মতো শক্তিশালী কোনো (পশ্চিমের ভাষায় ভয়ানক) প্রতিপক্ষের মুখোমুখি তাদের হতে হয়নি। তাই তো আমরা পশ্চিমকে দেখি ইসলাম ও মুসলিমদের নিয়ে বিপুল রচনা ও বিরল জ্ঞানগবেষণায় অবতীর্ণ হতে অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, পশ্চিমকে মোটামুটি ১৮০০ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত নিকট প্রাচ্য তথা মধ্যপ্রাচ্য, ইসলামের উৎসভূমি ও ইসলামের অনুসারীদের সম্পর্কে ৬০ হাজার বই রচনা করতে হয়[5]Edward w. said, Orientalism,p. 204 যার বেশির ভাগই ছিল সাম্রাজ্যবাদী কিংবা মিশনারি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। যদিও এর সূচনা হয় অনেক আগেই।[6]ড. মুসতফা সিবাঈ জানাচ্ছেন এর সূচনা হয় দশম শতকে। [ওরিয়েন্টালিজমের প্রথম পাঠ, … Continue reading

ইসলাম ও মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে পশ্চিমের এই প্রাচ্যতাত্ত্বিক অভিলাষ ও দুরভিসন্ধি সম্পর্কে সাঈদ যে পর্যালোচনা পেশ করেছেন তার সত্যতা পাই আমরা ১৩ শতকের বিখ্যাত খ্রিস্টান পলিম্যাথ ও বহু ভাষাবিদ দার্শনিক রেমন্ড লুলের (কিংবা রেমন) রচনাবলিতে তিনি তার আত্মজীবনী[7]Ramon Llull, (2010). A Contemporary Life, Edited and translated by Anthony Bonner. Barcelona/Woodbridge: Tamesis. pp. 33–35. ও বিভিন্ন রচনাবলিতে বারবার বলেছেন ইসলামিক জ্ঞানবিজ্ঞান শেখার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো মুসলিমদের খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করা সেই লক্ষ্যে রেমন্ড লুল আরবিভাষী এক নাগরিককে দাস হিসেবে ক্রয় করে কেবল আরবি ভাষা শেখার জন্য[8]Ramon Llull, (2010). A Contemporary Life, Edited and translated by Anthony Bonner. Barcelona/Woodbridge: Tamesis. pp. 37–39.

ঠিক একইভাবে ড. মুসতফা সিবাঈও দেখিয়েছেন এসব প্রাচ্যতাত্ত্বিক মহাজনরা কেনো ইসলাম ও মুসলিমদের দুরভিসন্ধিমূলক চর্চায় নিমগ্ন হয়েছিলেন তিনি বলেন—

তাদের (পশ্চিমাদের) প্রথম কার্যকারণ বা উদ্দেশ্য ছিল খ্রিস্টধর্মীয়। (খ্রিস্টধর্মীয় চেতনার দরুন তারা প্রাচ্যতাত্ত্বিক রচনাকর্মে প্রবুদ্ধ হয়) যেটার সূচনা হয় সন্ন্যাসীদের দ্বারা এবং তা আমাদের আধুনিক যুগ পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে তারা ইসলামের ওপর নগ্ন অপবাদারোপ, ইসলামের সৌন্দর্য ও বাস্তবিকতাকে বিকৃত করতে উদ্যত হয়েছেন। এর পিছনে তাদের উদ্দেশ্য ছিল, পশ্চিমের খ্রিস্টধর্মীয় নেতাদের কৃতকর্মের দরুন বিব্রত ও লজ্জিত সাধারণ জনগণের সামনে এটা প্রমাণ করা যে, ইসলাম হচ্ছে প্রচারের অযোগ্য একটি ধর্ম। মুসলিমরা হচ্ছে বর্বর, চোর, রক্তপিপাসু একটি জাতি (কারণ পশ্চিমাদের কাছে ইসলামই ছিল খ্রিস্টবাদের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী)। এদের ধর্ম এদেরকে দৈহিক ভোগবৃত্তির প্রতি উৎসাহিত করে। আর যাবতীয় আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক উন্নতি থেকে বিরত রাখে।

অতঃপর আধুনিক যুগে পশ্চিমারা যখন দেখল আধুনিক সভ্যতা ও জ্ঞানবিজ্ঞান তাদের ধর্মবিশ্বাসের মূলভিত্তিগুলোকে নড়বড়ে বানিয়ে দিয়েছে তখন তারা ইসলামের ওপর আক্রমণের প্রয়োজনীয়তা আরও তীব্রভাবে অনুভব করতে থাকে। তাই প্রাচ্যতাত্ত্বিকগণ ইতোপূর্বে তাদের ধর্মীয় নেতাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাসমূহ দ্বারা পশ্চিমের সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত করতে শুরু করল। কিন্তু প্রাচ্যতাত্ত্বিকদের ইসলামের বিরুদ্ধে আক্রমণের মাত্রার এই বাড়বাড়ন্ত ও আধিক্য পশ্চিমাদের কাছে বিদ্যমান পবিত্র গ্রন্থাদি ও ধর্মবিশ্বাসের সমালোচনা থেকে পশ্চিমের সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকে মোটেই অন্যত্রে নিবদ্ধ করতে পারেনি। বরঞ্চ ইসলামের প্রথম বিজয়সমূহ, ক্রুসেড যুদ্ধ ও উসমানি সাম্রাজ্যের বিজয়সমূহ পর্যায়ক্রমে পশ্চিমের সাধারণ মানুষের অন্তরে ইসলামের সামর্থ্য সম্পর্কে যে সমীহা সৃষ্টি করেছে তা সম্পর্কে পশ্চিমের সাধারণ মানুষগণ মোটেই বেখবর ও উদাসীন ছিল না।[9]ড মুসতাফা সিবাঈ, ওরিয়েন্টালিজমের প্রথম পাঠ, অনুবাদ: কামরুল হাসান নকীব (ঢাকা : … Continue reading

এসব পর্যালোচনাকে সামনে রাখলে আমরা বুঝতে পারি কী করে প্রাচ্যতত্ত্ব ইসলামতত্ত্বে রূপান্তরিত হলো পাশাপাশি প্রাচ্যতত্ত্বকে ইসলামতত্ত্ব হিসেবে নিরীক্ষা করা এবং সেই আলোকে পশ্চিমের ভাবনাকে সমালোচনা করার দ্বারা মুসলিমবিশ্বের গবেষকরা আদতে কোনো পদ্ধতিগত ভুলের শিকার হননি

যাই হোক, এভাবেই প্রাচ্যতত্ত্বের পূর্ণরূপ আরোপিত হয় মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক তত্ত্বে তথা ইসলাম ও মুসলিমবিষয়ক তত্ত্বেতাই তো প্রাচ্যের অপরাপর দেশ ও তথাকার ধর্ম (যেমন : হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধর্ধম ও শিখধর্ম ইত্যাদি) ও সংস্কৃতির সাথে পশ্চিমের একটা অলিখিত সন্ধি হয়ে গেলেও মধ্যপ্রাচ্যের ধর্ম ও মানুষের সাথে সন্ধি হওয়ার সুদূরতম কোনো সম্ভাবনাও দেখা যায় না। বরং উত্তরোত্তর পূর্বাপেক্ষা আরও সুসংহত ও সুপরিকল্পিতভাবে মধ্যপ্রাচ্যের ধর্ম (ইসলাম), সংস্কৃতি ও মানুষের প্রতিপক্ষতা করা হচ্ছে।

উপরন্তু পশ্চিম তার প্রাচ্যতাত্ত্বিক বয়ান দ্বারা প্রাচ্যের অপরাপর ধর্মমতের অনুসারীদেরও মোহাবিষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে তাই তো ইসলাম ও মুসলিম নিধনে ভারত ও চীনকে আমরা দেখতে পাই পশ্চিমের বয়ানের নির্লজ্জ অনুকরণ করতে চীন রাজনৈতিক ও আধিপত্যবাদী স্বার্থে পশ্চিমের প্রতিপক্ষতার জন্য মুসলিমদের পাশে দাঁড়ালেও মুসলিম নিধনে তার ভূমিকা সর্বজনবিদিত

তাছাড়া প্রাচ্যতত্ত্বের হাত ধরে জন্ম নেওয়া বিপর্যয়কর ইসলামোফোবিয়া থেকেও অনুমান করতে কষ্ট হয় না পশ্চিম প্রাচ্যতত্ত্বের বিভিন্ন মুখোরোচক ও মনোরোচক বয়ানের আড়ালে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে নিরন্তর অপচর্চা চালিয়ে গেছে

পরিশেষে বলা যায়, প্রাচ্যতাত্ত্বিকদের বিরাট অংশ নিকট প্রাচ্যকে নিয়ে গবেষণা করেছেন প্রাচ্য ও পশ্চিমের মধ্যকার কল্পিত অমানবিক বিভেদরেখাকে মুছে দেয়ার জন্য নয়; বরং সেই অমানবিক বিভেদরেখাকে পূর্বের চেয়ে আরও প্রকটতর ও অতিকায় করে তোলার জন্য। যেন তাঁরা প্রাচ্যকে আরও নিখুঁতভাবে অবদমিত ও মারাত্মকভাবে শৃঙ্খলিত করে রাখতে পারে।

তথ্যসূত্র:

তথ্যসূত্র:
1 Edward W. Said, Orientalism, p. 272
2 Three things have contributed to making even the simplest perception of the Arabs and Islam into a highly politicised, almost raucous matter: one, the history of popular anti-Arab and anti-Islamic prejudice in the West, which is immediately reflected in the history of Orientalism; two, the struggle between the Arabs and Israeli Zionism, and its effects upon American Jews as well as upon both the liberal culture and the population at large; three, the almost total absence of any cultural position making it possible either to identify with or dispassionately to discuss the Arabs or Islam. Furthermore, it hardly needs saying that because the Middle East is now so identified with Great Power politics, oil economics, and the simple-minded dichotomy of freedom-loving, democratic Israel and evil, totalitarian, and terroristic Arabs, the chances of anything like a clear view of what one talks about in talking about the Near The East is depressingly small. My own experiences of these matters are in part what made me write this book. (Orientalism, p. 26-27
3 Edward w. said, Orientalism,p. 343
4 The Historians’ History of the World,(London and New York: Hooper and Jackson ltd.,1909) V. 24, p. 341.
5 Edward w. said, Orientalism,p. 204
6 ড. মুসতফা সিবাঈ জানাচ্ছেন এর সূচনা হয় দশম শতকে। [ওরিয়েন্টালিজমের প্রথম পাঠ, অনুবাদ : কামরুল হাসান নকীব (ঢাকা : গ্রন্থিক প্রকাশনী, তৃতীয় সংস্করণ ২০২৪ ইং) পৃ. ৪১]
7 Ramon Llull, (2010). A Contemporary Life, Edited and translated by Anthony Bonner. Barcelona/Woodbridge: Tamesis. pp. 33–35.
8 Ramon Llull, (2010). A Contemporary Life, Edited and translated by Anthony Bonner. Barcelona/Woodbridge: Tamesis. pp. 37–39.
9 ড মুসতাফা সিবাঈ, ওরিয়েন্টালিজমের প্রথম পাঠ, অনুবাদ: কামরুল হাসান নকীব (ঢাকা : গ্রন্থিক প্রকাশনী, তৃতীয় সংস্করণ ২০২৪ ইং) পৃ. ৪৫ ও ৪৬

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Unknown
Unknown
1 year ago

ভালো লেগেছে বরাবরের মতোই!

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷