শহরের সামান্য এক মোড়ে কোনো কোনো রাতে অসামান্য দৃশ্য প্রতিফলিত হয়।
সেদিন সেপ্টেম্বরের আঠারো তারিখের রাতদুপুর। নগরে রাত গভীর হলে মনে হয় পৃথিবীটা ঘুমায়া যায়। জেগে থাকে কিছু নিশাচর। কিছু কিছু রাতের মতো সেপ্টেম্বরের আঠারো তারিখেও আমি নিশাচরের ভূমিকা পেয়ে গেলে সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ কক্ষে কম্পিউটারের সামনে বসি। উপর মহলের নির্দেশনা খুবই কড়া। এই মোড়ের রাস্তা ধরে কতিপয় নাশকতাকারী স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে। যে করেই হোক তাদের উপর গোপনে নজর রাখা চাই।
রাত তখন দেড়টার কাটা ছুঁইছুঁই, তখন মোড়ের শেষ দোকানটার সাটার নামে। ঠিক তখনি শাহী মুহম্মদের আগমন ঘটে মোড়ের রাস্তায়। সে প্রহর ডাকার মতো বাঁশিতে প্রথম ফুৎকার দেয়। বাঁশির শব্দে তখন মোড়ের বাসিন্দারা রাত গভীর হবার সংকেত পেলে বিছানায় যাবার তাড়া অনুভব করে অথবা গভীর রাত সম্পর্কে তারা সজাগ হয়।
তখন গলির আঁধার থেকে লোম ওঠা দুইটা কুকুর স্ট্রিট লাইটের আলোয় আসে। প্রথমে তারা মুখ ঘষাঘষি করে কিংবা খুনসুটিতে মাতে। তারপর শাহী মুহম্মদের পুনরায় বাঁশির শব্দে ভুতের কান্নার মতো দীর্ঘ হাঁক ছাড়ে। যে হাঁক শাহী মুহম্মদের মনে হয় মধ্যরাতের ভুতুড়ে বিলাপ। তখন তার মনে প্রাচীন ভয় উঁকি দিলে ডান্ডা হাতে সে কাঁপা গলায় ধমকাতে ধমকাতে সামান্য অন্ধকারের দিকে এগিয়ে আসে। কিন্তু কুকুর দুইটা তাতে সামান্য বিচলিত হয় না। বরং প্রভুভক্তির মতো লেজ নাড়ায়, আর মুখ উঁচিয়ে কুঁইকুঁই করতে থাকলে শাহী মুহম্মদের মন থেকে প্রাচীন ভয় কাটে। তখন সে চারিদিকে তাকিয়ে নিজের একাকিত্ব বিষয়ে সজাগ হয়। তার মনে হয় এই নিঃসঙ্গ মধ্যরাতে কুকুর দুইটার সঙ্গ দারুণ কার্যকরী হতে পারে।
কুত্তার জাত দারুণ প্রভুভক্ত হয় বটে।
এমন স্বস্তিদায়ক ভাবনার ভেতরে শাহী মুহম্মদ মোড়ের চারিদিকে টহল দিয়ে আসে। হয়তো তার মনে রোজকার মতো বেদনা উঁকি দেয়। রাতের এই মরা সময়টাতে সবাই যখন নিরাপদ ঘুমে মগ্ন হয়েছে, তখন সে একলা একা বাঁশি ফুঁকে শহর নিরাপদ রাখার ডিউটি করে। কে জানে, উড়ো বাতাসে কখন কোন বিপদ ঘাড়ের উপরে এসে লটকে পড়ে। শাহী মুহম্মদ পদধূলিময় ফুটপাতে বসে মোটা কাপড়ের ব্যাগ হাতড়ে সবজি রুটির বাটিটা বের করে। আর খাবারের গন্ধে কুকুর দুইটা লেজ নাড়তে নাড়তে তার সামনে এসে বসে পড়ে। শাহী মুহম্মদ কিঞ্চিৎ চিন্তিত হয়। একবার সে কুকুর দুইটার মুখে আরেকবার খাবারের বাটির দিকে তাকায়। কিন্তু নিজের মুখের দিকে তাকাতে সক্ষম হয় না। সম্ভবত উদার কোনো বাণী তার মাথার ভেতরে খেলে গেলে মহৎ হবার লোভ সে সামলাতে পারে না। তখন তার ভাগের পাঁচখানা রুটি থেকে দুটো রুটি চার খণ্ড করে কুকুরদের সামনে ছুড়ে দেয়। কাঙ্ক্ষিত খাদ্য ও সঙ্গ পেয়ে কুকুরদের আনন্দিত দেখা যায়। সম্ভবত শাহী মুহম্মদ মায়া চোখে সে দৃশ্য দেখে শব্দ করে কয়, কইলজাটা ভরিয়া খা।
শাহী মুহম্মদ চওড়া রাস্তার এমাথা ওমাথা পায়চারি করতে করতে ছোটো দুইটা ফুৎকার ছাড়ে। কিন্তু কুকুর দুইটা এবার আর সম্মিলিত হাঁক ছাড়ে না। তখন রুটি সাবাড় করে রাস্তার ওপারে গিয়ে পড়ে থাকা ডিমের খোসায় মুখ ডুবিয়ে খাদ্য টোকায়। তাই দেখে শাহী মুহম্মদ উচ্চস্বরে খিস্তি ছাড়ে, মান্দার পো কুত্তা তো কুত্তাই, ওকে পোলাও দেও আর কোরমাই দেও ও ঘু’তেই মুখ ডুবাইয়া আবে হায়াত উটকায়।
কিন্তু সে খিস্তি ছেড়েই হোঁচট খায়। দুইটা রুটিতে কাঁহাতক আর উদরপূর্তি হয় আর তাছাড়া আজকাল ওরাই বা কতোটুকু খাবার পায়, এখন শহরের গিন্নি বউদের আঙিনায় ধরনা দেবার সুযোগ নাই। ব্যক্তিমালিকানার চরম উৎকর্ষের এই দিনে খাবারের উচ্ছিষ্ট ময়লার গুদামে পাচার হয়ে যায়। আর মানুষের আঙিনা এখন চার দেয়ালের ঘেরাটোপে। অবশ্য ডাস্টবিন বেড়েছে কিন্তু কুত্তাও বেড়েছে বেশুমার। চারিদিকে ততোটাই দখলদারিত্বের ঘেয়ো কামড়াকামড়ি।
রাস্তার এই কুকুর দুইটা তো কঙ্কালসার লোম ওঠা নাক কুচকানো কুত্তা। আবার ভিন্ন জাতও শহরে সংখ্যালঘু নয়। সেকেলে লেঠেলদের মতো মাংস দুলিয়ে চলে আর হাড্ডিসার কাউকে দেখলে বিক্রমাদিত্যের মতো হুংকার ছাড়ে।
শহুরে ডাস্টবিন তাদের দখলে থাকে বারো মাস। মাঝে মাঝে হাড্ডিসার ক্ষুধার্ত কুকুর সেদিকে গেলে শরীরে রক্তের দাগ নিয়ে ফিরে আসে।
‘কেউ খাবে আর কেউ খাবে না তা হবে না’ এই সব মন্ত্র অন্তত কুত্তার জাত জানে না। জানে নাকি?
শাহী মুহম্মদ পরিহাসের হাসি হাসতে হাসতে নিজের লালশার্ট থেকে ধুলা ঝাড়ে। তখন সে নিজের কঙ্কাল-সদৃশ স্বাস্থ্য নিয়ে ভাববার ফুরসত পায়।
আরেকটু হেলদি হলে নিশ্চয়ই মন্দ হতো না। তখন তার কলিকাতা ককটেল হারবাল ঔষধের কথা তার মনে পড়ে।
সদ্য ঝাড় দেয়া চকচকে রাস্তায় শাহী মুহম্মদ পায়চারি করে। সময় সময় বাঁশিতে ফুৎকার করে ঘুমন্ত রাজ্যে বিকট শব্দের বিস্তার ঘটায়। তখন শোনাশুনি প্রক্রিয়ায় অন্যান্য পাড়া-মোড়-মহল্লা থেকে আরো অনেক বাঁশির চিৎকার ভেসে আসে। তখন তার মনের অস্বচ্ছলতা কাটে। সে তো আসলে একা না। বরং সম্মিলিত বাঁশির ফুৎকারে যখন রাতের ছমছমে নীরবতা সস্তা কাঁচের মতো ভেঙে পড়ে, তখন সংখ্যালঘু থেকে গরিষ্ঠের স্বাদ লাগে। অথবা তার একতার বল শিরোনামের গল্প মনে পড়ে।
কিন্তু মনের এই মিছে সন্তুষ্টি সতেজ থাকে না বেশিক্ষণ। অথবা এসব মিছে কোনো আশা নয়। কত কাছেই তো শয়ে শয়ে প্রাণ আছে কিন্তু সত্য হলো সেসব মৃতের মতো অসাড়। এসমস্ত প্রাণের কোনো নৈকট্য হয় না। তারচেয়ে বরং কুকুর দুটোই ঢের ভালো। তারা অন্তত নৈকট্যের ইতিবৃত্ত বোঝে।
কিন্তু কোথায় যে গেলো শালার নেমকহারাম কুত্তার দল!
শাহী মুহম্মদ সার সার দোকানের সিঁড়ির ধাপে বসে খিস্তি ঝাড়ে। মনে মনে অথবা মুখ ঘুরিয়ে কুকুর দুইটাকে তালাশ করে। কিন্তু চোখের ফ্রেমে তাদের ধরা যায় না। কেবল ধরা যায় দূরে একটি গলির মুখে ঘন পাতার একটি গাছ। রাত বলে সবুজের ছিটেফোঁটা বোঝা যায় না। কেবল চোখের তারায় উসকানি দেয় ছায়ার মতো জমে ওঠা গুচ্ছ আঁধার। জায়গাটায় স্ট্রিট লাইটের আলো পৌঁছে নাই বলে সেখান থেকে কেমন চোখ সরে না। আর হঠাৎ তার মন ডেকে যায় ওখানে বুঝি কিছু ঘটে চলছে। কিন্তু মনে তো এমন কতোই ফাল পাড়ানি কথা আসে। এসব আসলেই কিছু না। শাহী মুহম্মদ অন্যদিকে মন ঘোরানোর চেষ্টা চালায়। সে ফুরফুরে চুলে পাঁচ আঙুল চালিয়ে মাথা চুলকায়, যদিও সেখানে কোনো চুলকানি নাই। কিংবা একভাবে খানিকক্ষণ বসে থাকে বলে তার পা ধরে আসে। তারপর পাদুটো দক্ষিণ বরাবর ছড়িয়ে দেয়।
বুঝি গানও ধরে। কিন্তু কণ্ঠে পুরনো কফ আটকে থাকে বলে সুরেলা কোনো সংগীত বাজে না। তখন তার মনে পড়ে ইটভাটা থেকে ঘরে ফেরা রাতগুলোর কথা। সেসব রাতও এমন গভীর হয়। কোনো কোনো দিন গড়াই নদীর মাঝখানে উল্কা পতনের মতো আলো দেখা যায়। কিন্তু কোনো দিন মনে কোনো ভীতি আসে নাই। কারণ ততদিনে সে জেনেছিল ক্ষুধার চেয়ে ভীতিকর পৃথিবীতে আর কিছু হয় না। সেসব রাতে সাইকেল চালাতে চালাতে সে করুণ সুরে গান ধরত। রাতের নীরবতা এফোড় ওফোড় হয়ে ছড়িয়ে যেত দিক-বিদিক। অথচ কোনো শ্রোতা ছিল না। মনের খোরাক জোগানো সেসব গান কতো দিন হয়ে গেল গলা ফুড়ে আর বের হয় না।
তখন সে হতাশার ভেতরেও নগ্নভাবে টের পায় যে, পাথুরে ঘাই খাবার মতো বড্ড খুঁতখুঁত করে চলেছে মনে। তার মানে ফাল পাড়ানি কথা থেকে এই রাতে আর মুক্তি নাই। তাই মনের ভেতরে আর চেপে না রেখে বন্দুকের নলের মতো নিশানা করে টর্চ লাইটের সুইচ চাপে। কিন্তু ব্যাটারি যে কোন ক্ষণে ডাউন মেরে গেছে মনেই পড়ে না। তখন সে মুখভরে খিস্তি করে। অথচ কয়েক পা আগালেই যাবতীয় ফাল পাড়ানি কথা থেকে নিস্তার মিলে যেতে পারে। কিন্তু কে আর ওঠে, আদতেই কি নিগুঢ় ছায়া অন্ধকারে কিছু ঘটে চলেছে?
আসলে মন একবার কিছু কয়ে ফেললেই যতো গোল বাঁধে। এই গোল নিয়ে মনের ভেতরে মহা গোলমাল সৃষ্টি হচ্ছে বলে শাহী মুহম্মদ এবার মুখে বাঁশি পুরে কেয়ামতের ফেরেস্তা ইসরাফিলকে স্বরণ করে। যেন মধ্য রাতে তেমনি এক চরিত্র পেয়ে নিঃশ্বাস জমিয়ে বুক ফুলায়। তারপর দীর্ঘ এক ফুৎকার তোলে। কিন্তু তাতে আঁধার কি একটু কেঁপে উঠল?
শাহী মুহম্মদ চারিদিকে একবার তাকায়। নাহ, আঁধার আদতেই কাঁপে নাই কিংবা বিচলিত হয় নাই সামান্য। তখন এক আলোক সমাবেশের কথা তার মাথায় আসে। পৃথিবীতে অন্তত এক আলোক সমাবেশ হোক, আর সেখানে মানুষের অন্তর খুলে যাক। পৃথিবীর যাবতীয় আলো-আঁধার তো সেখানেই। সে হোক বা না হোক, এই নিষ্প্রাণ রাতে সে সত্যিই এমন উড়ো ভাবনা আমলে আনতে চায় না। তখন তার মনে সংসারের খুঁটিনাটি অনুসঙ্গ চিন্তার প্রধান আসন জুড়ে বসে। আর এভাবে একাধিক অনুসঙ্গে ভ্রমণ করতে করতে তার ক্লান্ত মগজে ঘুমের ঘোর বাসা বাঁধতে শুরু করে। সে ঘোর থেকে সজাগ হতেই তার মনে হয় কালব্যাপী কোথাও কোনো বাঁশির শব্দ শোনা যায় না। তবে কি রাতের এই ঘনিষ্ঠ প্রহরে সবাই ঘোর আচ্ছন্নতায় ডুবল? শালার কুত্তার জাত নাকি রাত জাগে কিন্তু তাদেরও তো কোনো হদিস মেলে না।
তখন সে রাজ্য হারানো তরুণ রাজার মতো মাথাটা নিচু করে বসে থাকে। তার মন বুঝি নিদারুণ বিষিয়ে ওঠে, তাই সে কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়াতে শুরু করে এক সময়। যেন মৃতদেহ জেগে উঠতে শুরু করেছে কিংবা পঞ্চাশ বছরকালের ক্লান্তি তার দেহ মনে ভর করেছে। তবু সে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে প্রথমে উত্তরের রাস্তায় এবং তারপর দক্ষিণের রাস্তায় পায়চারি করতে করতে বাঁশিতে ফুৎকার তোলে। কিন্তু হায়, কইলজার তলায় চাপা পড়া আশঙ্কা ভুস করে ভেসে ওঠে। তখন কেউ তার বাঁশির প্রত্যুত্তর করে না আর। সবাই কি তবে আচ্ছন্নতায় ডুবেছে? আর সে একাই খোলা আকাশের তলে দাঁড়িয়ে দুনিয়া রক্ষার খেল শুরু করেছে!
তখন হঠাৎ দূরের একটি ধারালো আলো তার চোখে এসে জ্বালা ধরায়। কয়েক মুহূর্ত মাত্র, একটি মোটরবাইক সশব্দে তার পাশ কেটে দক্ষিণের রাস্তায় মিলিয়ে যায়। শাহী মুহম্মদের মনে হয়, নীরব রাইতে মৃত্যুর ঘোড়া যন্ত্রের শব্দ নিয়া টগবগাইয়া যায়। তার পিঠে বসা আছে আস্ত সে আযরাইল, আর আযরাইল বুঝি শস্যের মতো মরণের দানা ছিটায়। কখনো কখনো আযরাইল উপর পানেও ওড়ে। তখন বালাখানার পাথর খসে খসে পড়ে। তারপর ঝিলিমিলি আলোকের তলায় একশ একটা মোম জ্বালিয়ে শোকগাঁথা তৈরি হয়।
শাহী মুহম্মদ এবার দক্ষিণমুখো হয়। কিন্তু ভিন্ন স্বরে। সে তাকায় সেই গলির মুখে ঘন পাতার গাছটার নিচে যেখানে আঁধার জমে উঠেছে। আর তার মনে অশুভ বাজিমাত তিরতিরিয়ে কেঁপে চলেছে, সত্যিই বুঝি সেখানে কিছু ঘটছে। নয়তো এমন টান টানবে কেন মনটা কিংবা এমন ফাল পাড়ানি কু ডাকবে কেন ও আঁধার?
হায় হায়, রুইতনের মায়ের মনেও নাকি এমন কু ডাকতো ঘরের পেছনে অশ্বত্থ গাছের রাত্রিকালীন ছায়ায়! খোলা মাঠ থেকে ধেয়ে আসা বাতাস এসে আছড়ে পড়ত গাছে। তখন নূপুরের উদ্দাম নৃত্যের মতো ঝনঝন করে বাজনা বাজত। তখন রুইতনের মায়ের মুখখিস্তি শুনে পারলে বাতাস চিরতরে আবসরে যায়। অশ্বত্থের ছায়ায় নাকি সে তার আত্মার শত্রুকে দেখত, শুনে শিক্ষিতরা বাড়তি বিনোদনে দাঁত ক্যালাইয়া হাসত।
কিন্তু একদিন, অশ্বত্থের পাতায় ঝনঝনানো বাজনা বাজার রাইতে রুইতনের মায়ের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার হলো। তখন আর শিক্ষিতরা দাঁত ক্যালাইয়া হাসে না। মনে কি এমনি এমনিই কু ডাকে! নাকি রুইতনের মায়ের মতো কখনো কখনো মনে অর্থবহ ফালপাড়ানি কথা আসে!
কিন্তু সে দেখে, ঘন পাতার গাছের ছায়ায় গলিত এক ডাস্টবিন। আর সারা দিনের জমানো ময়লায় ছুঁচোরা দলবেঁধে মহা উল্লাসে দৌড়ঝাঁপ পাড়ে। শাহী মুহম্মদ হতাশ হতে হতে আবারো ডাস্টবিনের দিকে তাকায়। প্রথমে মাছের কাঁটার মতো কুট করে এক খটকা কইলজায় বিঁধে। তাই ভালো করে আবারো তাকিয়ে দেখে, আঁধারের ভেতরে আরো এক কড়া আঁধার ফুটে আছে। এবার সে চট করে ডাস্টবিনের উপরে ঝুঁকে শকুনের মতো চোখে কড়া আঁধারের রহস্য খোঁজে। তখন দেখে ডানা ছড়িয়ে বড়ো জাতের কোনো পাখি ময়লায় ঠোঁট ডুবিয়ে লুটিয়ে আছে। সে চোখ আরো ধারালো করে ঠাহর করতে গেলে সহজেই ধরা পড়ে। হ্যাঁ দাঁড়কাক-ই হবে। কিন্তু এ শহরে বহুকাল হয় দাঁড়কাকের অস্তিত্ব নাই। তার মনে পড়ে, পদ্মার ধারে শহর রক্ষার বাঁধের উপরে যেখানে বটবৃক্ষের ছায়া তরুণ তরুণীদের মনোযোগের কারণ হয়েছে, সে গাছের ডালপালায় দু’চারটা দাঁড়কাকের ঘর-বসতি ছিল। এছাড়া গত বারো বছরে শহরে কোথাও আর দাঁড়কাকের দেখা মেলে নাই। এখন এই গাছের আঁধারে বাসি ময়লায় মুখ ডোবানো মরা দাঁড়কাক তো ভুল কিছু না। টিকে থাকার লড়াইয়ে জয় পাওয়া সহজ না। তখন তার মনে হয়, এটাই বুঝি এই শহরে দাঁড়কাকের শেষ সদস্য কিন্তু শহরবাসী তা টের পাবে না।
শাহী মুহম্মদ উপরে বালাখানার শার্সির আড়ালে বা বেলকনিতে চোখ ঘোরায়। আর ভুতের আলোর মতো জ্বলতে থাকা লাল নীল আলোর লীলা দেখতে দেখতে পায়চারি করে, যেন মরা মানুষ দৈবগুণে হাঁটে। শহরে রাতের রাস্তায় নাকি ভূতও বিচরণ করে। তখন তার ঘাড়েও বুঝি কিছু চড়াও হয়, যেন দাঁড়কাকের আত্মা। তখন তার বাঁশিতে আর ফুঁৎকার ওঠে না। তার মাথার ভেতরে কী এক রক্ত গরমের খেলা যেন খেলে যায়। সে অস্থির বাঁশি নাড়তে নাড়তে এলোমেলো পায়চারি করে। আর সেই সাথে তার গা বেয়ে দরদরাইয়া ঘামের তরল ছোটে। তখন হয়তো সে ভাবে, কেয়ামতের ফেরেস্তা ইসরাফিলের বাঁশিখানা যদি অধিকারে পাওয়া যেত, একবার যদি যেত, এই রাতে দুনিয়াটা আর এইসব বালাখানা শিমুল তুলার মতো ফুরফুর করে উড়ত। উড়ত বইকি, মানুষেরা যে কত সুখে ঘুমায়। দাঁড়কাকেরা চিরতরে ঘুমের পাশ পেয়ে যায়, সত্যিই পায় কি?
দাঁড়কাকেরা তো আজন্ম ডাস্টবিনে মুখ ডুবিয়ে জেগে থাকে। দাঁড়কাকেরা পরান নিয়ে বাঁচবার পাশ পায় না।
শাহী মুহম্মদ যখন রাতের শেষ প্রহরের বাঁশি ফোঁকে, তখন তার রক্তের গতিতে রাত জাগার ক্লান্তি প্রবাহিত হয়। কিন্তু হঠাৎ আসমান থেকে দারুণ হাওয়া নাজেল হয়। রাস্তায় ধুলোর ঝড় ওঠে। শাহী মুহম্মদ দুচোখ চেপে ধরে হঠাৎ ঝোড়ো বাতাসে টালমাটাল হয়। সে আসলে এতোটাই বেখবর ছিল যে কিচ্ছু টের পায় নাই। কখন যে ভাদ্র মাসের তারা ফোঁটা ঝকঝকে আকাশে বুনো হাতির পালের মতো মেঘ এসেছে, তারাগুলি নিখোঁজ হয়েছে, আর অমাবস্যার মতো আঁধার রাতে ঘোর অমাবস্যার বান ডেকেছে। অথচ রাত ক্রমশ সাদা হয়ে উঠছিল। পাখিরা পালক ফুলিয়ে বিশ্রাম শেষের আলস্য ছাড়তে শুরু করেছিল। আর শাহী মুহম্মদ, ভোরের আশায় রাতের আঁধারে বুক পেতে ছিল। কিন্তু সময় যেন ঘুরে দাঁড়ায়। ভোর যেন আবার সন্ধ্যার দিকে ছুট লাগায়। এই রাত যেন আর শেষ হবার নয়।
আকাশ কালো শামিয়ানার মতো ছেয়ে থাকে। বার কয়েক বাতাসের দমক গায়ে মুখে ঝাপটা মারে। তারপর শান্ত হয়ে বয়ে চলে, কিন্তু এক ফোঁটা বৃষ্টি পর্যন্ত হয় না। কিন্তু সে বড়ো মন উতলা করা বাতাস। ছোটো ছোটো ঢেউয়ের মতো বয়ে এসে আদুরে ভঙ্গিতে ছুঁয়ে যায়। তখন সারা রাত না ঘুমানো শাহী মুহম্মদের কইলজার ভেতরে ধুকপুক করে তড়পায়। কিন্তু ভোর তো দূরে সরে যায়। তখন সে আরো দুয়েক বার বাঁশি ফোঁকে। তারপর হোমিওপ্যাথির ডিসপেন্সারির চুনকামহীন দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে। আর হাঁটি হাঁটি পায়ে খুব কাছে চলে আসা ভোরের অপেক্ষা করে। দারুণ হাওয়া আসে তখনো। এসে তার ফুরফুরে চুলে আদুরে বিলি কাটে। যেন কোনো জাদুকর মন্ত্রণায় বশ করে। শাহী মুহম্মদের মাথা ডান দিকে কাত হয়ে দেয়ালে ঠেকে যায়।
কোথায় যেন কুকুর দুইটা হাঁক ছাড়ে, যেন স্বপ্নের ওপার থেকে। কুয়াশার নদীর মতো এপার-ওপারে ঝাপসা কিছু শোনা যায় বটে দেখা যায় না। কুকুর দুইটাই হবে, হারামজাদারা তাহলে ফিরে আসতে লেগেছে সারা রাত কোথাও ফূর্তি করে। কিন্তু কাণ্ড হলো অন্য। দুই-তিনটা ঘেয়ো কুকুরের পাগলা ডাক শুনে শাহী মুহম্মদ ধড়ফড় করে ওঠে। এবং উঠেই তার মনে হয় বুঝি ভোর হয়ে গেছে। কিন্তু তখনো পাতলা আঁধার তার চোখে জলের মতো গড়িয়ে এসে ভুল ভাঙ্গায়। তারপর ঘেয়ো কুকুরগুলো যেদিকে ডাকে সেদিকে সে মুখ ফেরায়। দেখে সেই ঘন পাতার গাছের তলায় পাতলা আঁধারের ভেতরে দুটো তিনটে ছায়া নড়ে চড়ে। ওই গলিপথ দিয়ে কোনো ছিচকে চোর ঢুকেছে কি-না ভেবে পা চালিয়ে সেখানে আসে। দেখে ছেঁড়া চট পরা পাগল একটা ডাস্টবিনের উপরে উপুড় হয়ে বুঝি খাবার টোকাচ্ছে। কাছেই দাঁড়িয়ে তখনো কুকুর দুইটা ওমন পাগলা হয়ে জান কাঁপানো হাঁক ছাড়ছে।
তখন পাগলটা দু’হাতে কী সব বস্তু তুলে নিয়ে ডাস্টবিনের উপরে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। শাহী মুহম্মদের মনে হয় সেই দাঁড়কাকই বুঝি। কিন্তু চোখের পর্দা আরো পরিস্কার হলে দেখা যায় ফ্যাকাশে কিছু। পাগলটা যে আবার কী সব বস্তু আবিষ্কার করে বসে, ভাবতে ভাবতে আরো কাছে গিয়ে দেখে যাকে সে দাঁড়কাক ভেবেছিল, আদতে সেটা একটা আধেক ফোটা মানবের বাচ্চা।
হায় হায়, এখানে কখন যে কার গর্ভ থেকে আধেক ফোটা মানবের বাচ্চা নাজেল হলো। আর তার দায়ভার পড়লো পাগলটার উপরে, এটাও তবে ঘটলো! কুকুর দুইটা তখনো কোরাসে ডেকে চলে। পাগলটা মানবের বাচ্চাটাকে মমতাভরে বুকে আঁকড়ে মোড়ের দিকে যাত্রা করে। শাহী মুহম্মদও তার পিছু পিছু হাঁটে। কিন্তু পাগলটা মোড়ের উপরেই যাত্রা বিরতি দিয়ে হোমিওপ্যাথির ডিসপেন্সারি বরাবর কালো রাস্তায় বসে পড়ে। শাহী মুহম্মদ বাচ্চাটাকে পরিষ্কার আলোয় দেখে। আহা সোনামুখ! বুকের ভেতর সে তীব্র মায়া টের পায়। কুকুর দুইটাও সোনাবরণ বাচ্চাটা দেখে ঘেয়ো ডাক থামিয়ে লেজ নাড়িয়ে কুঁই কুঁই করতে থাকে। তখন হুট করে সব স্ট্রিট লাইট নিভে গেলে শহরটা রাতের শেষে লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে। ততক্ষণে আঁধার গা ঝাড়া দিয়ে প্রস্থানের আয়োজন করতে শুরু করেছ। কিন্তু দূরের জিনিসটি তখনো ঝাপসা। হঠাৎ শাহী মুহম্মদের মনে আবারো ফালপাড়ানি কু ডাকতে শুরু করে। রাতের শেষে যখন ঠাণ্ডা হাওয়ায় সবার ঘুম জমে উঠেছে তখন সে দুইটা কুত্তা, পাগল আর আধেক ফোটা মানবের বাচ্চা নিয়ে আঁধারে মুখোমুখি হয়েছে।
শাহী মুহম্মদের মনে ধুকপুক করে কু ডাকতেই থাকে। আধেক ফোটা এক মানবের বাচ্চা যেন এই আঁধারে দাঁড়কাক হয়ে যাবে। না ওটা দাঁড়কাকই ছিল যেন চোখ মিথ্যে রায় দিয়েছে। তখন সরল হয়ে আসা আঁধারে পাগলটার চোখে চোখ পড়লে কইলজার ভেতরে তার ছ্যাৎ করে ওঠে। সেখানে যেন ভৌতিকতা নয়, জ্বলজ্বলে পরিহাস ফুটে আছে।
সুন্দর! পুরোটা পড়লাম।