পদচিহ্ন ধরে : ৫ | ট্রায়াঙ্গল অব ওয়াটার ফোর্ট

হাসান ইনাম

দুর্গ বলতে আমরা কেবল বুঝি লালবাগ দুর্গ। অনেকেই জানি না মুঘল আমলে এই ঢাকাকে রক্ষা করতে নির্মাণ করা হয়েছিল তিনটি দুর্গ। এই তিনটি দুর্গকে ত্রিভুজ জলদুর্গ বলা হতো। বইয়ের পাতায় পড়তে গিয়েই জানলাম দুর্গগুলো এখনও বিদ্যমান। কালের গর্ভে হারিয়ে যায়নি। এক ঈদের ছুটিতে বন্ধু মার্যিউরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম দুর্গ-রহস্য সমাধানকল্পে।

প্রথমদিন গেলাম খিযিরপুর দুর্গে। কেউ কেউ বলে হাজিগঞ্জ দুর্গ। এখন হাজিগঞ্জ দুর্গ নামেই পরিচিত। একসময় এই দুর্গের কোল ঘেঁষে বয়ে যেত শীতালক্ষ্যা নদী। এখন নদী কিছুটা দূরে সরে গেছে। তখন প্রাচীন বুড়িগঙ্গা নদী এসে লক্ষ্যা নদীর সাথে এই স্থানে এসে মিলিত হতো। এই জায়গাটা মুঘল আমলের প্রথম দিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

পর্তুগিজ এবং মগ জলদস্যুরা সুলতানি যুগে লুঠতরাজ করত সোনারগাঁওয়ে। সমুদ্র থেকে ছিপি নৌকা নিয়ে আসত তারা। তবে মুঘল আমলে ঢাকা যখন রাজধানী হয় তখন সোনারগাঁওয়ের আকর্ষণ কমে যায়। তখন ঢাকায় আক্রমণ করা শুরু করে দস্যুরা। ঢাকায় প্রবেশের নদী পথের খোঁজও পেয়ে যায় তারা। শীতলক্ষ্যা দিয়ে উত্তরে অগ্রসর হয়ে বর্তমান সময়ের ডেমরার কাছে ভিড়তে থাকে ডাকুর দল। বালু নদীর শাখা দোলাই নদী এই স্থান দিয়েই পশ্চিম দিকে বয়ে গেছে। দোলাই নদী ঢাকার বুক চিরে পতিত হয়েছে বুড়িগঙ্গায়। জলদস্যুরা দোলাই নদী দিয়ে অগ্রসর হয়ে ঢাকায় আক্রমণ এবং লুঠতরাজ চালাত। ঢাকায় যাতায়াত করার এটাই ছিল এক মাত্র পথ।

দস্যুদের কাছ থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করার জন্য নির্মাণ করা হয় খিজিরপুর দুর্গ। দু্র্গে ঢুকে দেখলাম এখন এটা বেশ জমজমাট খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। এই চত্বরে একসময় তাবু টাঙিয়ে থাকত সৈন্যরা। খেলোয়াড়দের কাছে জানতে চাইলাম এই ইতিহাস তারা জানে কিনা! উত্তরে তারা কী বললো সেটা আর এখানে লেখলাম না। যাইহোক, ঢাকা থেকে হাজীগঞ্জ দুর্গের দূরত্ব প্রায় পনেরো কিলোমিটার। গুগল করে জেনে নিতে পারেন কীভাবে যেতে হয়। আমি বরং পদচিহ্ন ধরে বাকি দুই দুর্গের দিকে এগিয়ে যাই।

সেদিনই গেলাম ট্রায়াঙ্গল অব ওয়াটার ফোর্টের আরেকটি দুর্গ ‘সোনাকান্দা দুর্গ’-এ। এই দুর্গ নিয়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য মিথ। বারো ভূঁইয়ার অন্যতম নেতা মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁ এবং তার স্ত্রী স্বর্ণময়ী জড়িয়ে আছেন সেইসব জনশ্রুতির সাথে। বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদ রায়ের কন্যা স্বর্ণময়ী প্রথম জীবনে অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। চাঁদ রায় ও কেদার রায় ছিলেন ঈশা খাঁ’র অকৃত্রিম বন্ধু। একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন আরাকানের রাজার বিরুদ্ধে। মুঘল সেনাপতি মানসিংহও এই সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আশপাশের রাজ্যগুলোতে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল কেদার রায়, চাঁদ রায় ও ঈশা খাঁর বাহিনী।

কিন্তু অতি অল্পকাল ছিল এই বন্ধুত্ব, এই সম্মিলিত বাহিনী। চাঁদ রায়ের অকাল বিধবা মেয়ে স্বর্ণময়ী প্রেমে পড়েছিলেন ঈশা খাঁয়ের।  ধর্মপ্রাণ চাঁদ রায় এই সম্পর্ক কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি।  স্বর্ণময়ী পরবর্তীতে হয়েছেন সোনাবিবি। কেদার রায় এবং চাঁদ রায় হয়ে গিয়েছেন ঈশা খাঁর স্থায়ী শত্রু।

এই দুর্গের সাথে স্বর্ণময়ীকে নিয়ে দুইরকম জনশ্রুতি আছে। সবথেকে প্রচলিত গল্পটা হচ্ছে স্বর্ণময়ী শীতলক্ষ্যা নদীতে স্নান করতে গিয়ে জলদস্যু দ্বারা অপহৃত হন। সোনারগাঁর শাসক ঈশা খাঁ তাকে উদ্ধার করে দুর্গে নিয়ে আসেন ও চাঁদ রায়কে অনুরোধ করেন মেয়েকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। চাঁদ রায় তাকে মুসলমানের ঘরে রাত কাটানোর দায়ে ফিরিয়ে নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। স্বর্ণময়ী এই দুর্গে বসে অনাবরত কান্নাকাটি করতেন বলে এই দুর্গের নাম হয়েছে সোনাকান্দা।

আরেকটি মত হচ্ছে, স্বর্ণময়ীকে  জোরপূর্বক বিয়ে করে এনে এই দুর্গে বন্দি করে রেখেছিলেন ঈশা খাঁ। স্বর্ণময়ী এই দুর্গে বসে কেঁদেছিলেন বলে এই দুর্গের নাম হয় সোনাকান্দা।

আসল ইতিহাস কোনটা? স্বর্ণময়ী বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে এসেছিলেন ঈশা খাঁ’র কাছে। স্বর্ণময়ীর সাহস দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে গ্রহণ করেছিলেন মসনদে-আলা-ঈশা খাঁ। তার নাম হয় সোনাবিবি। ইতিহাস চলে ইতিহাসের পথে, জনশ্রুতি চলে আপন গতিতে। ইতিহাসের সংকীর্ণ গলিপথে জনশ্রুতি হাঁটে না।

ইন্টারনেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তথ্যাবলিতে স্বর্ণময়ীকে বলা হয়েছে কেদার রায়ের কন্যা। ‘মধ্যযুগের বাংলা’ বইতে খন্দকার স্বনন শাহরিয়ার লিখেছেন স্বর্ণময়ীর পিতা ছিলেন চাঁদ রায়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ বলেন, কেল্লার সঙ্গে স্বর্ণময়ীর কাহিনীর কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এর নির্মাণশৈলী দেখলে বোঝা যায় এটি মুঘল আমলের। আর ঈশা খাঁর শাসনকাল ছিল এটি নির্মাণের বেশ আগে।

ইতিহাস আরো বলে এই দুর্গ বানিয়েছে মীর জুমলা। ঈশা খাঁ মারা গেছেন ১৫৯৯ সালে আর মীর জুমলার জন্ম ১৫৯১ তে।

জলদস্যুদের হাত থেকে ঢাকাকে রক্ষা করার জন্য ট্রায়াঙ্গল অব ওয়াটার ফোর্টের আরেকটি দুর্গ এটি।

ইতিহাসের সংকীর্ণ পথে হাঁটলে কোনো হিসাবই মিলে না। আমি তাই গল্পের পথে হাঁটতে চাই। যেখানে মীর জুমলা, চাঁদ রায় আর ঈশা খাঁ পাশাপাশি বসে থাকে গল্পের চরিত্র হয়ে। যেখানে কান পাতলেই শোনা যায় স্বর্ণময়ীর কান্না…

এরপর দিন গেলাম, তৃতীয় ও শেষ জলদুর্গ ‘ইদ্রাকপুর’ দুর্গে। অবস্থান বর্তমান মুন্সীগঞ্জ সদর। মুঘল শাসনামলে বিখ্যাত বারোভূঁইয়ারা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাধীনভাবে দেশ শাসন করতেন। বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম ছিলেন বিক্রমপুরের চাঁদ রায়, কেদার রায়। চাঁদ রায়-কেদার রায়দের শায়েস্তা করার লক্ষ্যে মুন্সীগঞ্জের ইদ্রাকপুর নামক স্থানে মুঘল ফৌজদার একটি কেল্লা নির্মাণ করেন। ধলেশ্বরী-ইছামতির সংগমস্থলে চাঁদ রায় ১৬১১ খ্রি. ডাকচেরা ও যাত্রাপুর দুর্গ হারিয়ে পরাজিত হন। ফলে সমগ্র বিক্রমপুর মুঘলদের শাসনে চলে আসে। বিশাল বিক্রমপুরকে মুঘলদের করতলে রাখতে এবং বিদেশি সৈন্যদের হাত থেকে সুবে-বাংলার রাজধানী ঢাকাকে রক্ষার জন্য মুন্সীগঞ্জের ইদ্রাকপুর নামকস্থানে মুঘল সুবেদার মীর জুলমা ১৬৬০ খ্রি. একটি দুর্গ বা কেল্লা নির্মাণ করেন। কেল্লাটি লালবাগের চেয়ে ছোট হলেও গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি।

১৬৬০ সালে ইদ্রাকপুর এলাকাটি ইছামতি-ধলেশ্বরী, ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা ও শীতলক্ষ্যার সংগমস্থল ছিল। মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র, ইছামতি ও ধলেশ্বরীর গতি পরিবর্তনের ফলে এখন মুন্সীগঞ্জ শহরের কেন্দ্রস্থল মাকহাটী-কাচারী সড়কের পশ্চিম পাশে কোর্টগাঁও এলাকায় অবস্থিত। চতুর্দিকে প্রাচীর দ্বারা আবৃত দুর্গের মাঝে মূল দুর্গ ড্রামের মধ্যে। দুর্গের প্রাচীর শাপলা পাপড়ির মতো। প্রতিটি পাপড়িতে ছিদ্র রয়েছে। ছিদ্র দিয়ে কাঁসার ব্যবহার করা হতো। দুর্গের উত্তর দিকে বিশালাকার প্রবেশদ্বার রয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে মূল দুর্গের চূড়ায় ওঠা যায়। মূল ভূমি হতে ২০ ফুট উঁচু। দেয়ালের বর্তমান উচ্চতা প্রায় ৪/৫ ফুট। প্রাচীরের দেয়াল ২-৩ ফুট পুরু। দুর্গে প্রবেশদ্বারের উত্তর পাশে একটি গুপ্ত পথ রয়েছে। কথিত আছে, এ গুপ্ত পথ দিয়ে লালবাগ কেল্লায় যাওয়া যেত। এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। তবে গুপ্ত পথ দিয়ে লালবাগ কেল্লায় নয়, অন্য কোথাও পালানো যেত। ২১০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ২৪০ ফুট আয়তনের এ দুর্গখানি এখনও অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। ইদ্রাকপুর কেল্লার নির্মাণ কাজ শুরু হয় সম্ভবত ১৬৫৮ সালে এবং ১৬৬০ সালে তা শেষ হয়। কেল্লাটি দুইভাগে বিভক্ত—পশ্চিমাংশ ও পূর্বাংশ। ড্রামের মধ্যখান বরাবর একটি ৫ ফুট উচ্চতার দেয়াল রয়েছে। প্রাচীরের উত্তরপাশে কামান বসানোর তিনটি মঞ্চ। দক্ষিণ পাশেও তিনটি থাকার কথা। কিন্তু সেখানে রয়েছে ২টি। দুর্গে প্রবেশের মূল পথটি উত্তর পাশে। এই দুর্গটি হতে আব্দুল্লাপুরে মঙ্গত রায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল। মীর জুমলার সেনাপতি সদলি খান ও মগ রাজা মঙ্গত রায় উভয়েই মারা যান। মঙ্গত রায় শাহ সুজার সেনাপতি ছিলেন বলে অনেকে ধারণা করেন। ইদ্রাকপুর কেল্লায় আবুল হোসেন নামে একজন সেনাধ্যক্ষ সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকতেন। আবুল হোসেন ছিলেন নৌ বাহিনীর প্রধান। তার নিয়ন্ত্রণে ২০০ নৌযান পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী ও ইছামতির তীরে প্রস্তুত থাকত। যে সব নৌযান ইদ্রাকপুর কেল্লার নিয়ন্ত্রণে থাকত তা হলো কোষা, জলবা, গুরব, পারিন্দা, বজরা, তাহেলা, সলব, অলিল, খাটগিরি ও মালগিরি। ইদ্রাকপুর কেল্লার নিয়ন্ত্রণে যে সব পদাতিক বাহিনী ছিল তার প্রধান ছিলেন সদলি খান।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷