পদচিহ্ন ধরে | বিবি মিরণের মসজিদ

হাসান ইনাম

পদচিহ্ন ধরে | বিবি বিনতের মসজিদ

ঝুনুর পোলাও খাওয়া তো হলো এবার একটু চা হলে মন্দ হয় না। রাস্তার মোড়ে মোড়েই চায়ের দোকান। চাইলেই কোনো একটাতে বসে পড়া যায়। তবে এসব টং দোকানের চা না খেয়ে একটু বিশেষ জায়গায় যেতে চাই। যেখানে একটু ছায়াঘেরা পরিবেশ পাওয়া যাবে, চায়ের পাশাপাশি একটু মিষ্টি বা দই হলেও খারাপ হয় না। মাথায় এলো, বিউটি বোর্ডিংয়ের কথা। যেই বিউটি বোর্ডিংয়ের হলদে দেয়াল থেকে আসে ইতিহাসের গন্ধ। এ প্রজন্মের বই পাড়ার সবার কাছেই পরিচিত নাম এই বোর্ডিং। আগের প্রজন্মের কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডাস্থল। যেই কথা সেই কাজ, বিউটি বোর্ডিংয়ের পথ ধরলাম।

আজকে যে মসজিদটির গল্প শোনাবো সেটি বিউটি বোর্ডিংয়ের একদম কাছে। বিউটি বোর্ডিংয়ের গেটে দাঁড়িয়েই একটি প্রাচীন দেউড়ি বা তোরণ দেখতে পাবেন। সেই তোরণ থেকে কয়েক কদম পা বাড়ালেই মসজিদটি দেখা যাবে। বছরের পর বছর আমরা বিউটি বোর্ডিংয়ে আড্ডা দিয়েছি, ছবি দেখেছি বা যাওয়ার প্ল্যান করেছি। কিন্তু বিবি মিরণের মসজিদের কথাটা কখনও শুনিনি। যে মসজিদের সাথে জড়িয়ে আছে অন্যরকম এক গল্প। ইতিহাসের চাপা দীর্ঘশ্বাস। চলুন তবে শুরু করা যাক…

বিবি মিরণের নাম আপনি না শোনার কারণও আছে। মসজিদটির বর্তমান নাম ‘বাইতুত ত্বাকওয়া জামে মসজিদ’। মসজিদের বাইরে ছোট করে একটি ফলক উৎকীর্ণ, সেখানে লেখা ‘বাইতুত-ত্বাকওয়া জামে মসজিদ, ৩ নং শিরিশ দাস লেন, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০, বিবি মিরণ কর্তৃক প্রথম স্থাপিত ১২৩০ হিজরী, মসজিদ উন্নয়ন ও পরিচালনা কমিটি কর্তৃক পূণঃ নির্মিত ১৯৯১ ইংরেজি মুতাবিক ১৪১১ হিজরী’।

মসজিদের দেয়ালে একটি প্রাচীন ফলকও বিদ্যমান। ফার্সি ভাষায় লেখা সেই ফলকটির মর্মোদ্ধার করা যায়নি। এই লেখার সাথে ফলকটির ছবি সংযুক্ত থাকবে। আমি আশা করবো কেউ না কেউ ফলকটির লেখাগুলোর বাংলা অনুবাদ করবেন।

মসজিদের দেয়ালে উৎকীর্ণ ফলক

মসজিদটির নাম নিয়ে বেশ দ্বন্দে পড়েছিলাম আমি। ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান তার বইতে মসজিদটির নাম লিখেছেন, ‘বিবি মেহেরের মসজিদ’। পুনর্নির্মাণের পর মসজিদটির আদি অবয়ব আর দেখা না গেলেও ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসানের বই থেকে খানিকটা ধারণা পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, ‘ঢাকার শায়েস্তখানী রীতিতে বর্গাকার একগম্বুজ মসজিদের ভূমি নকশার উপর ভিত্তি করে বিবি মেহেরের মসজিদটি নির্মিত। পূর্বদিকে তিনটি খিলান পথ রয়েছে এবং চার কোনায় ক্ষুদ্রাকৃতি টাওয়ার। অভ্যন্তরে কিবলাপ্রাচীরে তিনটি অবতালাকৃতি মিহরাব রয়েছে।’

বিবি মিরণ কে ছিলেন সেটা বলার আগে আমরা একটু আগে দেখে আসা দেউড়ির কাছে ফিরে যাই। আপনারা কী জানেন দেউড়ি মানে কী? দেউড়ি হচ্ছে প্রধান প্রবেশদ্বার। নবাববাড়ীর মানে আহসান মঞ্জিলের একটি দেউড়ি ছিল, এখনও আছে। ইসলামপুরের পাঞ্জাবির দোকানগুলো মাঝখানে চাপা পড়ে আছে। এশিয়াটিক সোসাইটির পেছনে আছে নিমতলী দেউড়ি। কেবল দেউড়িই টিকে আছে, নিমতলি প্রাসাদ আর নেই। আর এই দেউড়িটা? নাম কী এই দেউড়ির? কোন প্রাসাদের প্রধান তোরণ ছিল?

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আরেকটি তথ্য জানিয়ে রাখি। আমরা যেই রোডের গল্প বলছি, বিউটি বোর্ডি যেই রোডে, বিবি মিরণের মসজিদটি যেই রোডে, সেই রোডের নামটা মনে আছে তো? শিরিশ দাস লেন। শিরিশ দাস কে ছিলেন?

এবার একে একে উত্তরগুলো খোঁজা যাক। প্রথম প্রশ্ন, বিবি মিরণ কে ছিলেন? ড. সৈয়দ মাহমুদুল হাসান বলছেন যে বিবি মেহের (মূলত মিরণ) ছিলেন গোলাম মোহম্মদের জনৈকা আত্মীয়া।

পরের প্রশ্ন, দেউড়িটা কার বানানো? আগে দেউড়িটার নাম জানা যাক। নাম হলো গোলাম মোহাম্মদ দেউড়ি। সুতরাং নাম থেকেই অনুমেয় যে দেউড়িটি বানিয়েছিল গোলাম মোহাম্মদ নামক কোন এক ব্যক্তি।

গোলাম মোহাম্মদ দেউড়ি

এবার এই গোলাম মোহম্মদের পরিচয় খোঁজা যাক। এই গোলাম মোহাম্মদের পরিচয় জানার আগে আমাদের একটি পরিবারের ইতিহাস জানতে হবে। ‘গোলাম রসূল-গোলাম নবী পরিবার’। মুনশী রহমান আলী তায়েশ জানাচ্ছেন, “শেখ গোলাম নবী ত্রিপুরা জেলার টুরা পরগনার জমিদার ছিলেন। তাঁর জমিদারীর বছরে আনুমানিক আয় ছিল প্রায় এক লাখ টাকা। এ শহরের বাংলাবাজার মহল্লায় এখনো তাঁর বাড়ি আছে।” আলী তায়েশ মৃত্যুবরণ করেন ১৯০৮ সালে। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় ‘তাওয়ারিখে ঢাকা’। সুতরাং আলী তায়েশ ‘এ শহরের বাংলাবাজার মহল্লা’ বলতে যে মহল্লার কথা বলছেন সেটা আমরা সহজেই অনুমান করে নিতে পারি। তায়েশ আরো লিখেছেন, “শেখ গোলাম আলী, শেখ গোলাম মুস্তফা, শেখ গোলাম মুহম্মদ ও শেখ গোলাম রসূল নামে তার (গোলাম নবী) চার পুত্র ছিল। গোলাম নবীর মৃত্যুর পর চার ভাই আলাদা হয়ে যায়।”

বিস্মৃত হয়ে যাওয়া এই জামিদার পরিবারের কোনো নাম-গন্ধ কেন এখন নেই? কেন তাদের জমিদারি এলাকার রাস্তার নাম শিরিশ দাস লেন? ও আচ্ছা, শিরিশ দাস কে ছিলেন সেটা এখনও বলা হয়নি। তার আগে জমিদারি বেহাত হওয়ার গল্পটা শোনা যাক। ঢাকা গবেষক হাশেম সূফী বলেন, “১৭৫৭ সালের পর গোলাম রসূল-গোলাম নবী পরিবার ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহে জড়িত হয়ে পড়েছিল, এই কারণে তাদের সম্পত্তিগুলো সিজ করে তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। বিউটি বোর্ডিংয়ের যে আর্চ গেটটা আছে ওটা ওদের বানানো। তারা তাদের হিন্দু কর্মচারীদেরকে ব্রাহ্ম সমাজ গঠন করতে সাহায্য করেছিল। ব্রাহ্ম সমাজ মূলতঃ সৃষ্টি হয় ওদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বৃটিশদের সহযোগিতায়। তারা বাঁচার জন্য এটা করেছিল। কারণ, তখন স্যার ব্যারিস্টার কে জি গুপ্ত এবং ব্যারিস্টার শিরিশ দাসকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল নিজেদের সম্পত্তিগুলো যেন কিছুটা উদ্ধার করে দেয়, সেজন্যে। কিছু মালিকানা ফিরে পেলেও প্রকারান্তরে বাকি সম্পত্তিগুলোর মালিকানা স্যার কে জি গুপ্ত আর ব্যারিস্টার শিরীষদাস পেয়ে যায়। যার কারণে বিউটি বোর্ডিংয়ের গেটের দু’পাশের ভবনগুলো নিয়ে একটা বিরোধ আছে।”

আশা করছি এতক্ষণে সব প্রশ্নের পেয়ে গেছেন আপনারা। তবে বিবি মিরণের মসজিদের নাম বাইতুত-ত্বাকওয়া হয়ে যাওয়াটা দুঃখজনক। ও হ্যাঁ, ঢাকা গবেষক হাশেম সূফীর মতে বিবি মিরণ ছিলেন মূলত গোলাম মোহম্মদের স্ত্রী। আমি গল্পের মানুষ। ইতিহাসের গলি-ঘুপচিতে ঘুরি বটে, তবে সেটা গল্প পাওয়ার লোভে। এই পরিবারের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে দারুণ একটি গল্প পেয়েছি। আপাতত বিউটি বোর্ডিং থেকে এক কাপ চা খেয়ে সেই গল্পটা লেখার প্রস্তুতি নিবো। আপনারা বাংলাবাজার আসলে বিবি মিরণের মসজিদ ও গোলাম মোহাম্মদ দেউড়িটা দেখে আসবেন আশাকরি।

 

চলবে…

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
কাজী আফসানা
কাজী আফসানা
1 year ago

চমৎকার লেখনী, আগ্রহ ধরে রাখে। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷