অস্বীকার
কোনো এক অনন্তকাল পরে,
তুমি-আমি উতলা, উত্থিত হবো,
কোনো এক বিদীর্ণ নভোপাড়ে;
খসে পড়া নক্ষত্রের দেহে কিংবা
বিচ্ছুরিত জলগঙ্গার ঢলে!
আকাশে উড়া পর্বতের চূড়াগুলো বিচূর্ণ হয়ে গড়িয়ে পড়বে আশপাশ; চারিদিক বিদীর্ণ করে!
অতঃপর, ধূলোয়-আলোয়, অন্ধকারে
কোনো স্মৃতিকাতরতা ছাড়াই; স্মৃতি ছাড়াই
তুমি-আমি নগ্নতা মেখে হাঁটব—
হাঁটব, সীমাছাড়া ঐ গন্তব্যের দিকে!
বলব না কথা কিছুতেই, তবুও;
যতই পেরেশান লাগুক তোমারে, তাহারে!
এ-এক জীবন কতই না অস্বীকার করেছ আমাকে!
তুমি তা-ই!
আমি কবি হতে চাই,
আমি কবিতাও হতে চাই,
চাই শব্দ আর ভাব দিয়ে খেলা করতে বেদুঈন আরবের মত!
চাই নিজেই কবিতার মধ্যে হুলুল হতে;
যেন সমস্ত কবির কাব্যপ্রতিভা একত্রিত করে একটি প্রেমের কবিতা লিখতে পারি!
ইমরুল কায়েস আর লাবিদের আত্মা আমার উপরে ভর করুক;
ফানা-বাকা অতিক্রম করে কবি ও কবিতায় একীভূত হই আমরা!
কাব্যের ঘূর্ণিনাচ আর নূরানী এশকে মন্দীভূত হোক আমার কলম,
চমকপ্রদ উপমা–লক্ষণা আর অসাধারণ চিত্রকল্প এঁকে
জীবন্ত পঙক্তিরা ডানা মেলুক নীল আকাশে;
তাই ধার করি রুমির সুফিয়ানা আর হাফিজের প্রেম;
যেন তোমার নিখুঁত রূপের বর্ণনা কবিতায় মেলে ধরতে পারি অনিয়মিত কোনো ছন্দে;
যেন বড় কবির মতো বলতে পারি—
আমারো পরান যাহা চায়, তুমি তা-ই!
আমার কানে লুপ্ত যা কিছু তুমি পাবে!
মূল : মুসআব আবু ত্বহা
যখন আলতো স্পর্শে তুমি আমার কানকে উন্মুক্ত কর;
আমার মায়ের আওয়াজ ইতস্তত খুঁজে পাবে ভিতরে কোথাও!
তাঁর ডাকের প্রতিধ্বনি আমাকে সামলে নেয়,
যখন সজাগ চেতনেও এক ঘোর লাগা অনুভব আমাকে স্পর্শ করে!
সেখানে তোমার মোলাকাত হবে আপনমনে আবৃত্তি করা আরবি গান আর ইংরেজি কবিতার;
কিংবা উঠানের ভীড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাখিদের জন্য গাওয়া গানের!
ক্ষতটি যখন তুমি সেলাই করবে;
এই সমস্ত, সবটুকু, কানের মধ্যে ফিরিয়ে দিতে ভুলো না যেন!
যথাস্থানে সাজিয়ে দিয়ো;
লাইব্রেরির তাকে সাজানো বইয়ের মতো শোভিত!
গুঞ্জক ড্রোন আর
F-16 এর চিৎকার,
সাজানো বাড়ি, শস্যের মাঠ, আর মানুষের শরীরে বিদ্ধ বোমার তর্জন;
আকাশ কেটে ছুটে চলা রকেটের শব্দ,
এ-সমস্ত অনাহূত সরিয়ে দাও আমার কর্ণকুহর হতে।
বরং, তোমার হাসির মিষ্টতা ছড়িয়ে দাও ক্ষতের সেলাইয়ে,
জীবনের রেশ রয়ে যাওয়া একটি গান পুশ করো আমার শিরায়।
জাগিয়ে তোলো এই নিবৃত্ত চিত্ত,
আমার কানের ভিতরে বাজাও
দফের দরদী স্বর,
যেন আমিও লাফিয়ে উঠি তোমার সাথে;
দিবস-রজনী, হে ডাক্তার!
হে মৃত নদ কুমার
হে মৃত নদ কুমার,
আমি তোমাকে সেই চিরশৈশব থেকে চিনি;
যখন আম্মু-আব্বু শব্দের ভেদরেখা ধরা যেত না,
যখন চাঁদ-সূর্যের আলোর গাঢ়তা ছিল বিস্ময়ের মতো,
যখন অবহেলিত এক শহরের নিঃশব্দ বুক চিরে
জিকে ক্যানাল নামে তোমার নামকরণ হয়েছিল;
ঠিক তখন থেকে আমি তোমাকে চিনি!
আমি তোমাকে চিনি,
যখন আব্বু আমাকে কোলে করে তোমার পাড়ে নিয়ে যেতেন ঈদের চাঁদ দেখাতে,
যখন তোমার পাড়েই মোবারক হত গরীব মুসলমানের ঈদ,
তোমার বুকের মাটি কেটে সাজাতাম ধসে যাওয়া উঠোন-ঘর,
ঠিক তখন থেকে আমি তোমাকে চিনি!
আরো চিনেছি যখন,
মামার বাড়ি যাওয়ার পথে আম্মু দেখিয়ে দিতেন তোমার শান্ত সরুপথ,
আর যখন ভাইয়া জানালার রেলিঙ শক্ত ধরে দেখাতেন বৃষ্টি আর স্রোতের জলকেলি;
বজ্রের বাজনায় যখন মুখরিত হত স্রোতে ভাসা শৈবাল আর শিশুদের হাসি;
ঠিক তখন থেকে আমি তোমাকে চিনি!
হে মৃত নদ কুমার,
আমি তোমাকে সেই চিরশৈশব থেকে চিনি!
হে মৃত নদ কুমার,
তুমি আমার কৈশোরের স্বপ্ন,
প্রথম প্রেমের সাক্ষী!
তোমার পাড়ে কবিতা লিখে
কাটিয়েছি কত না রাত্রি!
তুমি আমার যৌবনের পীড়া
নীরব ঘুমের আবেশ!
তোমায় ঘিরেই আবর্তিত
রঙিন মনোনিবেশ!
হে মৃত নদ কুমার,
এই মৃত্যুযাত্রা পথে আপন ছবির মতো তোমাকেও চিনি না আমি আর!
কোথায় সেই কালোমেঘে ঝলসে উঠা স্রোতের টলকানি!
কোথায় সেই চোখ ধাঁধানো কৃষ্ণচূড়ার আগুনরাঙা সারি,
হাবিবুরের চা, নজরুলের কাব্য, সাহিত্যের আড্ডা আর হাসি?
কোথায় সেই হারিয়ে-না-যাওয়ার ওয়াদা করা অম্লান স্মৃতির আখ্যান?
হে মৃত নদ কুমার,
আজ তোমার মতো আমরাও মরে গেছি!