সুখ কী? এ আসলে জটিল দার্শনিক এক প্রশ্ন। এমন প্রশ্ন—এক কথায় যার উত্তর দেয়া ভার। কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞায়নে তাকে বেঁধে ফেলাটাও দুরূহ। জ্ঞানের ইতিহাসে বড় বড় সব দার্শনিক জীবন ব্যয় করেছেন এই জিজ্ঞাসাটির উত্তর খোঁজার পেছনে। তারা কোনো একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে পৌঁছতে পারেননি ঠিক তবে তাদের সকলের তত্ত্ব–তালাশ কিংবা ভাবনা সমগ্র সামনে হাজির রাখলে সুখ সম্বন্ধে প্রচ্ছন্ন একটা ধারণা আমরা পাই। জ্ঞানীরা বলেন, সুখ আসলে তৃপ্তি। মনের আহ্লাদ। যে কথা কাজ কিংবা উদ্যোগের প্রভাবে অন্তরে দোলা লাগে, হৃদয় নেচে ওঠে তা-ই তৃপ্তি; তা-ই সুখ।
কেউ একজন ভবনের সর্বোচ্চ তলায় নিবাস গড়েছে। আমরা দূর থেকে বিচার করি, আহা, লোকটা কি সুখী! শহরের সর্বোচ্চ উঁচুতে তার বাস। অথচ তার হৃদয়জাত অতৃপ্তির সংবাদ আমার জানা নাই। জানা থাকলে তাকে কখনোই সুখী বলে ভাবতাম না। আবার ভবনের উঁচু তলাতে বাস গড়লেই যে সে অসুখী—তাও নয়। ভবনের উঁচু তলাতে পৌঁছে গিয়েও কারো হৃদয় তৃপ্ত থাকতে পারে। যেমন ভবনের নিচু তলার মানুষটির মনও হতে পারে অতৃপ্ত; অসুখী।
আমাদের বিচারক্ষমতা সবসময় গাছের মগডালে পৌঁছে যাওয়া ব্যক্তিটিকেই সফল ও সুখী ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, গাছের ছায়ায় নিশ্চুপে বসে থাকা মানুষটাও সুখী হতে পারে। সুখ কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার নাম নয়। সুখ কোনো নির্দিষ্ট কাজ করতে পারার নাম নয়। সুখ নিজের মতো করে নিজের কাজটা করতে পারার নাম।
এখানেই ভুলটা করে বসি আমরা। মানুষকে তার কর্তব্য স্থির করে দিতে যাই। ব্যক্তিকে আমার পথেই সুখী হতে প্ররোচিত করি। আমার চশমার ভেতর দিয়েই সুখের দেখা পেতে তাকে বাধ্য করি। ভুলে যাই, সুখী হওয়ার আরও হাজারটা পথ থাকতে পারে। ভুলে যাই, তৃপ্তির আরও বিচিত্র রূপ হতে পারে।
২,
আমাদের এক অসুখ হলো, মাথা ব্যথার কেবল একটা চিকিৎসা পদ্ধতিই আমাদের জানা : মাথা কেটে ফেলা। মাথাকে স্থ্যান অচ্যূত রেখে ব্যাথাকে কীভাবে নিরাময় করা যায়—সে ভাবনায় ভাবিত হতে যাই না। সম্প্রতি নবীনদের সম্পাদনা বিষয়ে যে আলাপ চলছে তা আমার বক্তব্যের নগদ আরেকটি দৃষ্টান্ত।
নবীনদের সম্পাদক বনে যাওয়ার বিপক্ষে যতগুলো মতামত আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে তার সবগুলোরই মূল কথা হলো, মাথা কেটে ফেলা। সকলেরই দাবি, অন্যেরা যেন তার মতো করে কাজ করে, তার মতো করে তৃপ্তি খুঁজে নেয়। কিন্তু তৃপ্তি যে নির্দিষ্ট কোনো কাজের ভেতর সীমিত নয়। সুখ যে কোনো এক পথের সাথেই বিশিষ্ট নয়!
নবীনদের সম্পাদনার বিপক্ষে সব চাইতে বহুল ব্যবহৃত যে যুক্তি ‘এতে লেখক সত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়’।
হয়তো হয়। কিন্তু যে নবীন সম্পাদনায় নামল, যে নবীন কোনো কাগজ বের করল সে লেখক হতে চায় কি না—তা এতটা সুনির্দিষ্ট করে বলছি কীভাবে! সে নবীনের সাথে কি আমার কথা হয়েছে! হতে কি পারে না, লেখক নয়, সম্পাদক হওয়াই তার অন্বিষ্ট। হতে কি পারে না, সম্পাদনায় তার একমাত্র ব্রত।
সাহিত্যের ইতিহাসে এমন অনেক সম্পাদকের খোঁজ আমরা পাই, যারা কেবল সম্পাদকই ছিলেন। তাদের লেখক পরিচয় অত্যন্ত ব্রাত্য। ধরুন, সাগরময় ঘোষ। তাকে লেখক হিসাবে ক’জনে জানেন! তিনি তো সম্পাদকই। সম্পাদক পরিচয়েই তিনি ভাস্বর হয়ে আছেন বহু লেখকের চাইতে আরও দেদীপ্যমান হয়ে।
একজন লেখক সম্পাদক হতে পারেন। একজন সম্পাদকও লেখক হতে পারেন। কিন্তু দুজন স্বতন্ত্রভাবে দুটি পরিচয় ধারণ করতে পারেন না—তা তো নয়। কেউ যদি সম্পাদক হতে চায় তাকে কি লেখক হতেই হবে! এ নিয়ম কিংবা বাধ্যবাধকতা কোথায় লেখা আছে?
আসলে, এখানে আমাদের ভাবনার ভ্রান্তির সূচনাটা হলো, আমরা ধরেই নিয়েছি সম্পাদনা অর্থ কেবল অন্যের লেখা সংস্কার। অন্যের লেখাকে ‘মানুষ’ করাই সম্পাদকের একমাত্র কাজ। কিন্তু আদতে তো তা নয়। সম্পাদকের একমাত্র কাজ কিংবা ট্রেডমার্ক তো সেটা নয়। সেটা সম্পাদনার খুবই প্রাথমিক একটা কাজ বটে; একমাত্র নয়। প্রধান কাজ তো নয়–ই। সম্পাদক বরং এর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। যার জন্য রচনা–দক্ষতা তেমন দরকার হয় না বললেই চলে। অধিক দরকার হয় অন্য জিনিস।
আমার কথায় অবাক হলেন! মুখ টিপে আসছেন হয়তোবা। কিন্তু বলি আপনাদের, সম্পাদনা এক অর্থে সাংগঠনিকতাও বটে। ব্যাপারটা আরেকটু খোলাসা করি।
ধরা যাক, একজন ব্যক্তির রচনার প্রসাদগুণ ‘ভালো’ না। তার কোনো সৃজনীশক্তি নেই। তিনি নান্দনিক কোনো শিল্পকর্ম কিংবা রচনা সৃষ্টি করতে পারঙ্গম নন। কিন্তু তিনি ভালো পাঠক। তার পাঠরুচি অসাধারণ। যে কোনো রচনা দেখলেই তিনি তার ভালো–মন্দ বুঝতে পারেন। এখন তিনি যদি কোনো পত্রিকার সম্পাদক হন, কোন রচনাটা তার পত্রিকায় প্রকাশ করবেন আর কোনটা করবেন না—এই সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার যদি তিনি গ্রহণ করেন, তবে কি ধারণা আপনার, তিনি কি যথার্থভাবে তা পালন করতে পারবেন না! তাহলে এই মানুষটার সম্পাদক হতে বাধা কোথায়! তিনি ভালো লিখতে জানেন না—এটাই! কিন্তু তিনি যে ভালো লেখা খুঁজে এনে উত্তম রসনাবিলাসের পসরা সাজাতে পারেন তার কি হবে! সাহিত্যের ইতিহাসে এমন সম্পাদকের উপস্থিতি কি একদমই নেই!
আলবৎ রয়েছে।
৩,
সম্পাদনা লেখক সত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নাকি লেখক হতে না চাওয়া বা হতে না পারার আক্ষেপ থেকে কেউ সম্পাদনায় আসে—সে এক দীর্ঘ তর্কের বিষয়। কিন্তু অন্যের লেখাকে পিটিয়ে মানুষ করার নামে যে সম্পাদনা আমাদের এখানে ‘প্রখ্যাত’ হয়ে আছে তা যে লেখক সত্তার কিছু ক্ষতি করেই তা স্বীকার করে নিতে দ্বিধা নেই। ফলে যার ব্রত লেখক হওয়া, লেখক হতেই হবে—জীবনের কাছে এই বাজি ধরেছে যে নবীন সে এ বন্ধুর পথ সহজে মাড়াবে না বলেই অনুমান। কিন্তু যে নবীনের আরাধ্য হলো সম্পাদনা। নিজের সাংগঠনিক আস্থার আশ্রয়ে যে নবীন সম্পাদনার সুফলা মাঠে ফসলের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে চায় কিংবা নিজের রচনার কোনো ক্ষতি হবে না—এমন প্রবল আস্থাবান কেউ যদি সম্পাদনায় আসতে প্রয়াসী হন কিংবা নিজের রচনার প্রতি সবিশেষ নজর রাখার ব্যাপারে প্রত্যয়ী থেকেই যে নবীন সম্পাদনার দায়ভার কাঁধে তুলে নিতে চান—তাকে ফিরিয়ে রাখবো কোন যুক্তিতে! দু–ই সামলেছেন সমান দক্ষতায়—এমন নজির কি আমাদের সামনে নেই! এই নবীন যে সেই নজীরের উত্তরাধিকার হবে না—তা এত নিশ্চয় করি বলি কোনো উপায়ে!
হ্যাঁ, সে তুফান ভারী, পথও বড্ড বন্ধুর। এখন আমি সে মর্মে সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে পারি। পথ চলার সহজতার জন্য আলোর আয়োজন করতে পারি। কিন্তু মাথা কেটে ফেলার যে পথ্য—তা নির্দেশ করি কোন যুক্তিতে!
বলি, সম্পাদনা একটা আর্ট। সম্পাদনা নিজেই একটা শিল্প। এটাও দীর্ঘ চর্চা ও সাধনার মাধ্যমে আয়ত্ব করতে হয়। সম্পাদক হতে চাওয়া কোনো নবীন যদি তার সে সাধনার সূচনা করতে চায় ক্ষতি কি তাতে!
আমি তাকে ফেরাব না। আমি তার যাত্রাপথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াব না। তবে, আমি তাকে পথের বিপদ সম্বন্ধে সতর্ক করতে চাইব। তার রসদ ও পাথেয়’র এন্তেজাম করে দিতে সচেষ্ট হব। ভবিষ্যতের ‘আমাদের’ জন্য আন্তরিক ক’জন সম্পাদক প্রয়োজন। আজ যে নবীন সে পথে নেমে পড়ছে আগামীকাল আমি তাকে চূড়ান্ত গন্তব্যে দেখতে চাই। এই আমার অভিলাষ। দুর্বিনীত বাসনা।
শিরোনাম দেখে ভেবেছিলাম, হয়ত নিরাশ করবেন। সূক্ষ্ম বকাঝকাও থাকবে। কিন্তু শেষতক পড়বার পরে খুশিই হলাম। আলহামদুলিল্লাহ।
চমৎকার আলাপ। ধন্যবাদ।
এ এক অসাধারণ লেখনি, স্বপ্নে ভার দিয়ে যেই নবীনরা পথ হাঁটতে চেয়েছে। তাদের জন্য একটি আশার আলো।
লেখাটা আপনার ওয়েবসাইট থেকে আগেই পড়েছিলাম। আবারও পড়ে যা মনে ছিল তা ঝালাই করে নিলাম। আন্তরিক শুকরিয়া জানবেন, সাব্বির ভাই!
পড়লাম। ❣️
ভালো লেগেছে!
দারুণ প্রসঙ্গ— যেখানে তেমন আলাপ চোখে পড়েনি।