দ্বিতল ওই লাল দালানে লুকোনো ছিল আমার স্বপ্নের বুদ্বুদ

আহমাদ সাব্বির

১.

ব্যস্ততম সড়কের অদূরে নির্জন দ্বিতল একটা লাল দালান। দালানের চারপাশে শতাব্দী প্রাচীন শিরিষের ছায়া এসে এলায়ে পড়েছে। দালানটির বয়সও কম নয়। বহিরাঙ্গ থেকে পলেস্তরা খসে পড়ে জায়গায় জায়গায় হা হয়ে আছে। চকিতে দেখে দাদ-আক্রান্ত রোগীর ক্ষতচিহ্নের কথা মনে হয়। শরীরের লাল ফ্যাকাশে হয়ে আসা দালানটির বহুদিন হলো কোনো সংস্কার হয় না। দালানটির খুব কাছাকাছি হলে ভয় হয়—এই বুঝি হুড়মুড় করে সব ভেঙে পড়ে! কী জানি কীসের ভ্রমে কোনো এক শরতের নরোম দুপুরে নিজেকে এই লাল দালানের সমুখে আবিষ্কার করে উঠি।

তখন আমার স্কুল পালানো কৈশোর। কেন যেন ক্লাসরুম ভালো লাগে না। কালো বোর্ড আর সাদা চক ভালো লাগে না। পাঠ্যবইয়ের বিন্যস্ত অক্ষরসমূহ ভালো লাগে না। ভালো লাগে না স্কুলের কোনো বন্ধু কি সহপাঠী কি কোনো শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীর সান্নিধ্য। আমার তখন বুড়ো মৌলভির দরগা ভালো লাগে। আমার তখন হরিণটানা বিলের প্রান্তর ভালো লাগে। ভালো লাগে রূপসা নদীর তীর আর শহরের অচেনা পথসমূহে নিরুদ্দেশ ঘোরাঘুরি।

স্কুল পালানো সেই নিরুদ্দেশ সময়ে একদিন হঠাৎই খেয়াল করি শহর ছাড়িয়ে বহুদূর সড়কের প্রান্তে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি দাঁড়িয়ে আছি। সমুখে হাজতের গরাদের মতো দেখতে পুরোনো মরচেপড়া একটা গেট। গেট পেরিয়ে আমার চোখ আছড়ে পড়ে ঘাসহীন উন্মুক্ত প্রান্তরে। শিরিষের ভাঙা ডালপালা আর শুকনো পাতা সমগ্র প্রান্তর ঢেকে রেখেছে। তখন শরৎকাল বুঝি। থেকে থেকে কোমল হাওয়া এসে মন ছুঁয়ে যাচ্ছে। কী যে হয়! সম্মোহিত আমি লোহার গরাদ সদৃশ গেট, উন্মুক্ত শূন্য প্রান্তর আর শুকনো পাতার মর্মর পেরিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে আসা ওই লাল দালানটার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। দালানের ওপরের দিকে চোখ গেলে দেখতে পাই, সিমেন্ট-বালু-সুড়কির স্থায়ী আঁচড়ে সেখানে ‘খুলনা বিভাগীয় সরকারি গণ গ্রন্থাগার’ খোদিত হয়ে আছে! তার নিচে আপাত ছোটো হরফে লেখা : ‘বয়রা, খুলনা।’

আমি আমূল চমকে উঠি। আমার ঘোর কিংবা তন্ময়তা কর্পূরের মতো উবে যায় তখন। ঘর ও স্কুল পালানো আমি এই এত দূরের বয়রা চলে এসেছি! সেই বুঝি প্রথম আমার একলা একা অতদূর পথ হেঁটে যাওয়া!

পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই আমি ততদিনে পড়তে শুরু করে দিয়েছি। গ্রন্থাগার শব্দটিও পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া আমার কাছে একদম আনোখা নয়। লাইব্রেরির বাংলা অর্থজ্ঞাপক এই শব্দটার সাথে কিঞ্চিৎ পরিচয় আছে আমার। তবে তা কেবল শব্দটির সাথেই। তখন পর্যন্ত বাস্তবিক কোনো লাইব্রেরি কি গ্রন্থাগারে পদচারণা পড়েনি আমার। মহল্লার মসজিদে একটা লাইব্রেরি আছে বটে; তবে তা নামেই কেবল। মসজিদের কোনায় পুরোনো স্টিলের একটা শেলফ। আর তাতে এলোমেলো অগোছালো ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত কিছু বই। আসরের নামাজের পর মসজিদের খাদেম মনসুর ভাইকে ধরলে ঘোলাটে কাচের দেয়াল সরিয়ে দু-একটা বই ধার দেন। ছোটদের বই-ই বরাদ্দ থাকে আমাদের জন্য। ইবনে বতুতার সফরনামা, ছোটোদের আবু জার, বিজ্ঞানী জাবির ইবনে হাইয়ান ইত্যাদি নানা নামের রঙিন ছবিওয়ালা বই মনসুর ভাই থেকে নিত্য ধার নিয়ে পড়া হয় আমার।

কিন্তু তা সত্ত্বেও সে আর লাইব্রেরি কীসে! মসজিদই তো! ফলে লাইব্রেরি যে শব্দটা এবং তার প্রতিনিধিত্বকারী বাস্তবিক যে কাঠামো তা কখনো দেখা হয়নি আমার। সেখানে যাওয়া কি বসে বই পড়া—সে তো অনেক দূরের ব্যাপার!

ফলে, শরতের ওই নির্জন দুপুরে স্কুল পালানো আমি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে নিজেকে বয়রা পাবলিক গ্রন্থাগারের সমুখে হাজির দেখতে পেয়ে বিহ্বল হয়ে পড়ি।

বিহ্বল ও খানিক দোদুল্যমান আমি কর্তব্য স্থির করে উঠতে পারি না। নিচতলার বিরাট যে কাঠের দরোজা তা ঠেলে কি আমি ভেতরে প্রবেশ করব! নাকি আমার এখন বাড়ি ফেরা উচিত! পকেটে আমার কোনো টাকাপয়সা নেই। টিফিন বাবদ যে পাঁচ টাকা আব্বু দেন রোজ সকালে স্কুলের জন্য বের হবার সময় পথে তা দিয়ে সিঙাড়া-খোরমা খেয়ে খরচ করে ফেলেছি। নগর পরিবহন কি রিকশা ধরার জো নেই। হেঁটেই মহল্লায় ফিরতে হবে আমাকে। বেলা এখন দ্বিপ্রহর। লাইব্রেরিতে যদি ঢুকি আর যদি বের হতে দেরি হয়, বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেলা পড়ে যাবে। সন্ধ্যা নামার আগে ঘরে না পৌঁছলে আব্বুর কাছে ধরা পড়ে যেতে হবে নির্ঘাত। মাগরিবের নামাজ শেষ না হতেই দুলাল স্যার চলে আসেন। এসে আমাকে না পেলে নিশ্চিত আমি ধরা। তবে! ভুল করে যদিও, পরিকল্পনা করে নয়, তারপরও কি এতদূর এসে জীবনে প্রথমবারের মতো কোনো গ্রন্থাগারে প্রবেশের সুযোগ পেয়েও দুয়ার থেকেই ফিরে যাব! আবার এও এক সংকোচ—অতটুকু বয়সের আমি, আমাকে দরোজা দিয়ে ঢুকতে দেবে তো!

বিহ্বলিত ও সংকুচিত আমি দ্বিধার কুয়াশা ঠেলে গ্রন্থাগারের ভারী দরোজার কাছে উঠে যাই। নাহ, সেখানে কোনো প্রহরী নেই। বাধা দেবার কিংবা কৈফিয়ত তলবের মতোও কেউ নেই। আমার দ্বিধা কেটে গেল। সম্পূর্ণ ভেতরে যাবার মতো সাহসী হয়ে উঠলাম আমি।

অবাক কাণ্ড, ভেতরে ঢুকে দেখি বিশাল পরিসর। বাইরে থেকে দোতলা মনে হলেও মূল ভবন এক তলাই। কীভাবে বুঝাই! দোতলা সমান ভবন। ভবনের চারপাশ জুড়ে দোতলাতে অনেকগুলো কক্ষ। তবে মূল যে লাইব্রেরি কক্ষ সেটা নিচ থেকে দোতলার ছাদ পর্যন্ত বাধাহীন উঠে গেছে। ভেতরে ঢুকেই উন্মুক্ত ছাদ হয়ে আমার দু-চোখ চারপাশে ঘুরতে থাকে। আমার মাথাও তখন ঘুরে উঠেছিল বোধহয় একবার। ঘুরবে না! জীবনে সেই প্রথম একসাথে অতগুলো বই দেখা হলো আমার। প্রায় ছাদসমান উঁচু একেকটা শেলফ। শেলফের ভেতরে সবটা জুড়ে বইয়ে ঠাসা। কোথাও বিন্দুমাত্র শূন্যস্থান নেই। পৃথিবীতে এত এত বই রচিত হয়ে আছে! অথচ মসজিদ-পাঠাগারের ওই এক শেলফেই আমি এতকাল বিস্ময় মানতাম।

গ্রন্থাগারের জমিন জুড়ে আছে বিরাট সব কাঠের টেবিল ও চেয়ারে। তবে মানুষের উপস্থিতি কম। নেই বললেই চলে! এত বিরাট কক্ষের এখানে-সেখানে দু-চার-ছয়জন মানুষ মৃদু চলাফেরা করছে আর অল্প কজন নিশ্চুপে টেবিলের ওপর মাথা গুঁজে বসে আছে। এ-ই! কোনো কোলাহল নেই। কোনো কলরোল নেই। কেমন হিমশীতল এক নীরবতা চারপাশ আচ্ছন্ন করে আছে।

কী জানি কোন ভাবনায় আমি চকিতে ব্যাগটা গেটের পাশে স্থাপিত কাঠের বাক্সের খোপের ভেতর রেখে এমনিই চোখ যেদিকে পড়ল একটা শেলফের সামনে এসে দাঁড়ালাম। শেলফ থেকে কী জানি কী একটা বই নামিয়ে কাঠের টেবিলের এক প্রান্তে গিয়ে বসবার জন্য উদ্যোগী হলাম। তখন আমি কি সামান্য উত্তেজনাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম! হয়তোবা! বসতে গিয়ে কাঠের চেয়ারে একটা ধাক্কা লাগল। আর তাতেই কর্কশ একটি আওয়াজ সৃষ্টি হলো এবং ফাঁকা লাইব্রেরি কক্ষের সর্বত্র তা ছড়িয়ে পড়লো।

তখন দৃশ্যপটে আগমন ঘটে খয়ের চাচার। পরে জেনেছিলাম, তার পূর্ণ নাম খাইরুল বাশার। গ্রন্থাগারে আগত পাঠকদের মুখে মুখে যিনি খয়ের চাচা। সেদিন উত্তেজিত আমার চেয়ার ও মেঝের ঘর্ষণে সৃষ্ট কর্কশ ধ্বনি কক্ষজুড়ে ছড়িয়ে পড়লে খয়ের চাচা কোত্থেকে যেন এসে আমার পেছনে দাঁড়িয়ে যান। মাথার চুল, মোচ একেবারে ধবধবে সাদা। নাকের ডগায় চিকন একটা রিমলেস পাওয়ারি চশমা। শুভ্রোজ্জ্বল চুল ও মোচ এবং পরিপাটি শার্ট-প্যান্ট ও চশমাতে তাকে খানিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের মতো মনে হয়। আকস্মিক তার উপস্থিতিতে আমি ঘাবড়ে যাই।

খয়ের চাচা কোনো কথা বলেন না। আমার পিঠে আলতো স্পর্শ করে গ্রন্থাগারের উত্তর কি দক্ষিণের এক কোনার দিকে ইশারা করেন। আমি তার ইঙ্গিত ঠিক ধরতে পারছি না যখন তখন তিনি মৃদুস্বরে বলেন, এদিকে এসো।

খয়ের চাচা সামনে চলতে থকেন। পরিস্থিতির আকস্মিকতায় ঘাবড়ে যাওয়া আমি চলি তার পেছন পেছন। একসময় গ্রন্থাগারের কোনার দিককার এক ঘেরাওয়ের ভেতর তিনি আমাকে নিয়ে হাজির হন। কাঠের দেয়ালে দেখলাম ছোট্ট একটা সাইনবোর্ড। যেখানে স্পষ্ট হরফে লেখা : শিশু কর্নার।

আমার বয়স তখন কম—তা ঠিক। তাই বলে ভদ্রলোক আমাকে একেবারে শিশু বলে বিচার করবেন এবং শিশু কর্নারের ছোট্ট চেয়ার ও কম উঁচু টেবিলের সামনে বসিয়ে দিবেন—অতটাও কম নয়। ভীষণ রাগ হলো আমার। এই রাগ অপমানে পর্যবসিত হলো তখন যখন ভদ্রলোক আমার সামনে কী একটা ভূতের গল্পের বই মেলে ধরলেন।

বাড়িতে আমার শরৎচন্দ্রের দেবদাস আছে। যা পড়ে আমি চোখের জল ফেলেছি। গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী আমি পড়েছি। এনায়েতুল্লাহ আলতামাশের ঈমানদীপ্ত দাস্তানের মতো বড়দের বইও আমার পড়া। আর তিনি কিনা আমাকে কার না কার ভূতের গল্প পড়তে দিচ্ছেন!

‘এটা শেষ করে আমার টেবিলে গিয়ে জমা দিবা। তখন তোমাকে আরেকটা বই দেবো। নিজে কোনো বই ধরবা না।’—এই বলে ভদ্রলোক হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন। গ্রন্থাগারের অপরপ্রান্তে কাঠের বড় এক টেবিলে বসে কী যেন এক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি ভূতের বইয়ের বদলে তাকে পড়তে লাগলাম। এক মনে ভদ্রলোকের মুখের মানচিত্রের পাঠোদ্ধার করতে সচেষ্ট হলাম। কিন্তু কিছুই বুঝি না। তাকে যথার্থ বুঝে উঠতে অনেকগুলো দিন লেগে যায় আমার।

ভূতের গল্প কোনোদিনই টানেনি আমাকে। বিন্দুমাত্র আগ্রহ পাই না। ভয় তো পাই-ই না। আমার কেবল হাসি পায়। বাংলা ভূতের গল্পের ভূতগুলো কী বোকা বোকা আর সরল। তাই বুঝি বাংলার ভূত সাহিত্যের আজ এই দশা।

তো, সেদিন ওই ভূতের গল্পের বই খুলে ইতিউতি চোখ বুলিয়ে বিকাল পর্যন্ত সময়টা কাটিয়ে দিলাম। পড়া হলো না কিছুই। তবে নতুন এক উত্তেজনায় নিজেকে শিহরিত টের পেলাম। কম্পমান আমি বিকাল ঘনিয়ে আসতেই ভূতের গল্পের বই বন্ধ করে গ্রন্থাগার ছেড়ে সড়কে নেমে এলাম।

এই আহ্লাদ অক্ষত ও দীর্ঘস্থায়ী রাখতে হলে আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে, সন্ধ্যা নামার আগেই।

হাঁটার গতি কিছুটা বাড়িয়ে দিলাম। আমার তখন কিছুটা শীত শীত লাগছে।

২.

এখন মনে হলে বেশ হাসি পায়—সে রাতে ঘুম হলো না আমার ঠিকঠাক। নতুন লাল সাইকেলটা কেনার দিনের মতো কেবলই বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে কাটিয়ে দিলাম। সকালে যথারীতি স্কুল ব্যাগ কাঁধে করে বেরিয়ে পড়লাম। সেদিন অন্য দিনের তুলনায় একটু তড়িঘড়িই বেরিয়েছিলাম হয়তোবা। আমতলা থেকে টানা হেঁটে চলে এলাম পাওয়ার হাউসের মোড়ে। সেখান থেকে নগর পরিবহনে বয়রা। নগর পরিবহনের ভাড়া কীভাবে মিটিয়েছিলাম মনে নেই। সেদিনের কিছুই প্রায় সেভাবে মনে নেই। শুধু মনে আছে দশটা বাজার খানিক পরই আমি হাজির হয়ে যাই বিভাগীয় গণ গ্রন্থাগারের গেটের সামনে।

ভেতরে ঢুকে দেখি পাঠক বলতে কেউই তখন পর্যন্ত আসেনি। কর্মকর্তারাও বুঝি তখনও এসে পৌঁছেননি। একজন নারী পরিচ্ছন্নতাকর্মী টেবিলগুলো কাপড়ের টুকরোর সাহায্যে ঝাড়ছেন-মুছছেন। আর একজন বয়োবৃদ্ধপ্রায় পরিচ্ছন্নকর্মী মেঝের ঝাঁট সেরে হাতের কোষে করে পানি ছিটাচ্ছেন।

ঢুকেই আমার চোখ চলে যায় গ্রন্থাগার কক্ষের দক্ষিণদিকের বড় সেক্রেটেরিয়েট টেবিলটার দিকে। যাক, ভদ্রলোক চলে এসেছেন। তাকে দেখতে পেয়ে আমি যেন স্বস্তি ফিরে পেলাম। পরিবেশটাও হঠাৎই কেমন যেন খুব পরিচিত হয়ে উঠল। মনে হলো, এই গ্রন্থাগার, তার উন্মুক্ত কক্ষ, কক্ষজুড়ে বিস্তৃত কাঠের বড় বড় সব টেবিল, ভারী কাঠের শেলফ, শেলফভর্তি রাশ রাশ বই, কাজে মগ্ন পরিচ্ছন্নতাকর্মীদ্বয় সব আমার অতিপরিচিত। যেন আমার নিজস্ব মণ্ডলেই আমি এসেছি। এখানে মাত্র আমার দ্বিতীয় দিন নয়। বহুদিন ধরেই এইখানে আমার গতায়ত।

আমি অভ্যস্ত ভঙ্গিতে টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেলাম।

আশ্চর্য, ভদ্রলোক আমাকে চিনলেন। রিমলেস চশমার ওপর দিয়ে বড় অদ্ভুত ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন, তোমার এখন স্কুল নেই!

আমি ভীষণ ঘাবড়ে গেলাম। ভয়ও কিছুটা পেয়েছিলাম হয়তোবা। মাত্রই অনুভূত যে অভ্যস্ততা এক নিমিষেই তা অস্বস্তিকর অনভ্যস্ততায় পর্যবসিত হয়ে পড়ল। ভদ্রলোক আমাকে একদমই কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মুখের ওপর বলে বসলেন, এখন যাও। স্কুল ছুটির পর আসবে।

ভদ্রলোকের এই কথার ভেতর কী ছিল জানি না, আমার একটুও রাগ হলো না। অন্য কেউ এভাবে বললে নিশ্চিত আমার মেজাজ বিগড়ে যেত।

আমি বিষণ্ণ মুখে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। পরে মনে হয়েছিল, আমার পরনের স্কুল ড্রেস থেকেই বোধহয় স্কুল ফাঁকি দেওয়ার ব্যাপারটা তার চোখে ধরা পড়েছে। কী জানি, আমার চেহারাতেও স্কুল পালানোর বিষয়টা ফুটে উঠে থাকতে পারে।

আমি তখন কী করি!

আমি তখন কোথায় যাই!

সেই অবেলায় না স্কুলে ফেরার সুযোগ আছে না লাইব্রেরিতে বসার সাহস। অগত্যা এলোমেলো হাঁটতে থাকি। বিভাগীয় গ্রন্থাগার এলাকারই আশেপাশে। রাস্তার পাশের সস্তার রেস্তোরাঁতে বসে টিভি দেখি, কিছু সময় নির্মীয়মাণ নতুন বয়রা সোনাডাঙ্গা বাইপাস ধরে হেঁটে বেড়াই আর কিছু সময় বয়রা মহিলা কলেজের মাঠে উদাস বসে থাকি। তারপর যখন দুপুর আসন্ন আমি সব ছেড়ে এক দৌড়ে বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারে পৌঁছে যাই।

ভেতরে ঢুকেই সোজা চলে গেলাম খয়ের চাচার সামনে। তখনও আমি হাঁপাচ্ছি। আমার স্কুলের সাদা শার্ট শরতের ওই নাতিশীতোষ্ণ হাওয়ার মধ্যেও ঘামে জবজব। ভদ্রলোক কাচের গ্লাসে করে পানি এগিয়ে দিলেন। আমি ঢকঢক করে গ্লাসের সবটুকু পানি খেয়ে নিলাম। আর তারপর ভদ্রলোক আমাকে নিয়ে গেলেন সেই কর্নারটিতে, গতদিন যেখানে তিনি আমাকে ভূতের গল্প পড়তে দিয়েছিলেন। এবারে তিনি বেশ সাবলীল। বেশ ফুরফুরে। দারুণ সপ্রতিভ। আমার দিকে চেয়ে বললেন, গতদিনের বইটা পড়েছিলে!

আমি তার সহাস্য আন্তরিক জিজ্ঞাসার সামনে কিছু আর গোপন করলাম না। দুর্দান্ত সাহসী হয়ে বললাম, না। ভূতের গল্প আমার ভালো লাগে না।

তিনি দেখলাম সামান্যও বিচলিত হলেন না। মুচকি হাসলেন কেবল। আর বললেন, রহস্য? গোয়েন্দা গল্প?

আমি তো ঈমানদীপ্ত দাস্তান পড়ি। সেখানের গোয়েন্দা আলী আমার ভীষণ পছন্দের। ফলে একবিন্দুও চিন্তা না করে বলে বসলাম, হুম। তা পড়ি। ভালোও লাগে।

তিনি আমার সামনে মোটা একটা বই বের করে আনলেন। ফেলুদাসমগ্র। বললেন, এটা দেখো তো! ভালো লাগে কি না!

বলেই তিনি চলে গেলেন। আর আমি চেয়ার টেনে ফেলুদাসমগ্র পড়তে শুরু করলাম। রুদ্ধশ্বাসে একে একে পড়ে যেতে থাকলাম : বাদশাহি আংটি, গ্যাংটকে গণ্ডগোল, সোনার কেল্লা, বাক্স রহস্য, কৈলাসে কেলেঙ্কারি, রয়েল বেঙ্গল রহস্য, জয়বাবা ফেলুনাথ, ফেলুদা এন্ড কোং, গোরস্তানে সাবধান, ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি ইত্যাদি সব গল্প। দিন যায়। আমি ফেলুদাসমগ্রে বুঁদ হয়ে থাকি। দেখতে দেখতে প্রথম ভলিউম শেষ হয়ে এলো। তারপর শেষ হলো ভদ্রলোকেরই নির্দেশিত ব্যোমকেশসমগ্র এবং শার্লক হোমস অমনিবাসও। রহস্যগল্পের পাঠ এগিয়ে চলার সমান্তরালে তার সাথেও আমার সম্পর্ক গভীর ও গাঢ় হয়ে উঠতে থাকল। একসময় নিয়মিত আর সবার মতো তিনিও হয়ে উঠলেন আমার খয়ের চাচা।

এবং অতঃপর নিয়মিত স্কুল ফাঁকি দিয়ে আমার ওই বিভাগীয় গণগ্রন্থাগার যাপন চলতেই থাকে। একসময় স্কুলের পাঠে মনোযোগ কিছুটা বৃদ্ধি পেলে গ্রন্থাগার গমন কমে আসে। তবে একেবারেই বাদ যায় না। খয়ের চাচার সাথে সম্পর্কের সুতোয়ও কোথাও টান লাগে না। পঞ্চম শ্রেণি থেকে নিয়মিত বিরতি দিয়ে টানা ছয় বছর বিভাগীয় গ্রন্থাগারে আমার বইপাঠ অব্যাহত থাকে।

হুমায়ূন বলেন, আহমদ ছফা বলেন, শরদিন্দু বলেন, মুজতবা আলী বলেন, হুমায়ুন আজাদ কি বনফুল কিংবা আরও আরও দিগ্বজ সব লেখকের কথা বলেন, বয়রার বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারেই তাদের সাথে আমার পরিচয়। বিভাগীয় গণগ্রন্থাগার এবং খয়ের চাচার সুবাদেই আমি জানতে পারি, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ গোলাম মোস্তফা, কাজী নজরুল, মানে, পাঠ্যবইয়ে যাদের নাম দেখি আরকি, তাদের বাইরেও অনেক লেখক আছেন। স্কুলের পাঠসহায়িকা ছাড়াও পঠিতব্য আরও বিপুল এক দুনিয়া আছে; জীবনের অকস্মাৎ এক মুহূর্তে বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারের আবিষ্কার এবং খয়ের চাচার আনুকূল্যে যেই দুনিয়ার সাথে আমার মোলাকাত।

আর তারপর তো চলছেই, অবারিত সেই দুনিয়ার পরিভ্রমণ এখনও চলমান।

মাঝেমধ্যে ভাবি, ভেবে ভেবে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হই—সেদিনের ওই ভুলে যদি আমি না পড়তাম, অকস্মাৎ কালের ঘূর্ণিপাকে যদি আমি বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারের সামনে গিয়ে হাজির না হতাম, যদি আমি খয়ের চাচার মতো মানুষের অবাধ আনুকূল্য না পেতাম, কী হতো তবে!

কী হতো!

জীবনের এই অপরিমেয় সুখ, অবিরাম এই স্বপ্নের দিন তবে আমি কোথায় পেতাম!

আমি জানি না।

কেউ কি জানে কোথায় কোন লাল দালানের ভেতর লুকোনো রয়েছে তার অবারিত স্বপ্নের বুদ্বুদ!

কেউ জানে না।

বিজ্ঞাপন

Subscribe
Notify of
guest
7 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
জুনাইদ বিন আজিজ
জুনাইদ বিন আজিজ
6 months ago

অনেকদিন পরে আপনার গদ্য পড়লাম। ভালো লাগলো অনেক। আর সাথে জানাও হলো—আপনার পাঠক হওয়ার গল্প, যা আমার অত্যন্ত আগ্রহের বিষয়।
অনেক অনেক ধন্যবাদ, সাব্বির ভাই।

শেখ আসাদুল্লাহ
শেখ আসাদুল্লাহ

গদ্যটি আসলেই অনেক সুন্দর

clipart1567258
ASHRAFUJJAMAN ZAKARIA
ASHRAFUJJAMAN ZAKARIA
1 month ago

আহ্ কি ঘোর লাগা গদ্য!

দ্বিপ্রহর
দ্বিপ্রহর
1 month ago

সুমিষ্ট।

মাসউদ সরওয়ার
মাসউদ সরওয়ার
20 days ago

ভালো

Abu Bokor - আবু বকর
Abu Bokor - আবু বকর
10 days ago

অনেক অনেক ভালো লাগলো। প্রথমে পড়তেই চাচ্ছিলাম না আপনার সেই ভুতের গল্পের মতো আর যখন পড়তে থাকলাম ফেলুদাসমগ্র এর মতো পুরো গদ্য ফিনিশ করে দিলাম। কি যে ভালো লাগলো। যা বলার মতো নয়। মনে হয় আপনার পাঠক জীবনে টাইম ট্রাভেল করে আসলাম। কখনো হাসি, কখনো আবার গভীর মনোযোগ আর শব্দের কথামালা যে অসাধারণ। আমি কখনো কল্পনা করিনি আপনার লেখাগোজা এত এত ভালো। আপনার বই পড়িনি অন্যজনের কাছে থাকা একটা বইয়ের কয়েক পাতা পড়েছিলাম যা অনুকূলে না থাকায় শেষ করতে পারিনি। আপনাকে পড়ে খুবই ভালো লাগলো আপনার বইগুলোও পড়তে পারলে আরোও ভালো লাগবে আশা করি।

আরেকটা কথা আপনার সেই শিরিষ গাছের শৈশবের মতেো আমারো এই গাছের সাথে শৈশব মিছে আছে। ধন্যবাদ….

স্বত্ব © ২০২৩, যোগাযোগ | ই মেইল : jogajogbd.org@gmail.com

যোগাযোগ-এ প্রকাশিত কোনো লেখা, ছবি কিংবা শিল্পকর্ম লেখক অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও প্রকাশ করা অবৈধ৷