দুয়ারে পাষাণ তালা (ষষ্ঠ কিস্তি)
খানিক আগের উত্তাল সুখে এখনও মত্ত সে। মনে করতে পারে সেই আনন্দজোয়ারের কথা, যার সুখ রুহের মাঝে ছুইটা বেড়ায় আর উন্মত্ত তরঙ্গের মতন আছড়ে আছড়ে পড়ে আশেকের দেহে। এমন পুরুষেরই এন্তেজারে ছিল সে। এই সেই পুরুষ, এই প্রথম যারে নিজের সবটা উজাড় করে দিছে সে, ভালো মানুষ একটা, কিশোরের মতন সংরক্ষিত আর পবিত্র।
নিজেরে হারাইতে হারাইতে নুরা দেখে তার চারপাশে ফুলে ফুলে স্বর্ণালি প্রজাপতির দল আর তাদের পাশে পাশে গুঞ্জরাইতেছে মধুমত্ত মৌমাছিরা। উড়াউড়ি করতেছে এই ফুল থেকে ওই ফুলে। আচানক তার চোখ পড়ে শাদানের ওপর। ফুঁপাইয়া ফুঁপাইয়া কানতেছে শাদান। তার চোখভরা জল।
ওয়াজেদের কবল থেকে মায়েরে মুক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করছিল শাদান। কিন্তু তার চিৎকার-কান্নার কোনো খবরই ছিল না নুরার এবং ওয়াজেদের কাছেও সে ছিল অদৃশ্য। অবশ্য শাদান যদি তার খুশির মাঝখানে আসতও, তো তারে ধাক্কাইয়া দূরে সরাইত সে।
নুরা ওয়াজেদের কোলে মাথা দিয়া শোয়। শাদানরে টাইনা নেয় নিজের দিকে। কন্যা ঝাঁপাইয়া পইড়া মায়ের বুকে সাঁইটা যায়। নুরা স্তন তুইলা দেয় তার মুখে। শাদানের জিহ্বায় মায়ের স্তন দুধ তো নয় যেন আবেহায়াত। সে শান্ত হয়। নুরা তার মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে বলে: ‘তুই বাপ পাইয়া গেছস বেটি।’ তার গলা ঘোরের মতন শোনায়।
‘হ, নুরা। তুমিই আমার বিবি।’
‘সত্যি বলতেছেন সাঁইজি?’
‘বিলকুল। এটারেই তো শাদি বলে।’
নুরা উইঠা ওয়াজেদের গায়ে গা লাগাইয়া বসে। প্রেমভরা নয়নে আপন মাহবুবের চোখে তাকায়। কয়েক লমহা চাইয়া থাকে। যেন খানিক আগে ওয়াজেদের বলা কথার সাচ্চায়ি খুঁজতেছে তার চোখে।
‘আমি কি আজীবন আপনার বিবি হইয়া থাকব আপনার সাথে? কিন্তু..’
‘কিন্তু কী? তোমার স্বামী আসার আগেই তোমারে এখান থেকে নিয়া যাব আমি। এইটা আমার ওয়াদা।’ ওয়াজেদ নুরার পেরেশানি বুঝতে পারে।
আজাবের যে কুয়ার মধ্যে পইড়া আছি আমি, সেখান থেকে বাইর হইতে পারব? দিনরাতের কড়া মেহনত, হরদম মালিকের হাবেলিতে ফুটফরমায়েশ খাটা, আবার ভুল হইলে ঝাড়ি খাওয়া—এইসব থেকে নাজাত মিলবে? নুরা ভাবে।
‘এইসা যে হবে দিলে কবুল করে না।’ নুরা ওয়াজেদের গালে হাত রাইখা বলে।
‘দিলরে বইলা দাও, এইসাই হবে। গাঁয়ে কই থাকো তুমি?’
‘ঝিলের ধারে, মজিদ চাচার পাশে আমার কুঠুরি। তয় আপনি ওইদিকে আইসেন না। আমিই চইলা আসব। আপনার ডাইকা পাঠানোর জরুরত নাই।’
ওয়াজেদ নুরার কপালে চুমা খাইয়া তারে আলতো কইরা শোয়ায়। ফের বিছাইয়া দেয় সেই নরম ঘাসের শয্যা। সেই শীতল গাছের ছায়া, মাটির সোঁদা গন্ধ, সেই ফুলে ফুলে মৌমাছি আর রঙিন প্রজাপতির দুনিয়া আবারও দুলতে লাগে। আবারও সেই আবেশ, দ্বিতীয় দফা, এবার আরও মস্তির সহিত, আরও মোহময় আর প্রেমভরা উথালপাথাল দুইজনারে এত গভীরে প্রোথিত করে যেন জুদায়ি তাদের পরান কাইড়া নেবে। ওদিকে শাদান চিল্লাইয়া মরে। তার দুনিয়ায় প্রজাপতি নাই। শীতল গাছের ছায়া বা নরম ঘাসের শয্যা নাই। মাসুম শিশু শুধু আক্রান্ত হইতে দেখে এবং মুক্ত করতে চায়। কিন্তু লাগে না যে যার জন্য তার করুণা সে করুণা পাইতে চায়।
আসরের নামাজের খানিক আগে নুরা চইলা যায়। কুঠুরিতে ফিরা চারপায়ার ওপর শরীর ফেইলা দেয় ওয়াজেদ। সামান্য আগেই যা ঘটে তাতে তার অজুদ টলমল করে। ওই অদ্ভুত অপ্রস্তুত বুকের কাছের গরমি ভাবটা আর নাই। মস্তির খায়েশ রুহের কোন ঘরে গিয়া দুয়ারে তালা দিছে যেন। যাই ঘটছে তা বদতরিন গুনাহ, মহাপাপ, সন্দেহ নাই। কিন্তু এখন আর কী করার? যা ঘটার তা তো ঘটছেই।
তবু এতকিছুর পরেও নুরারে কেমন পিয়ারি লাগে তার। ওর পরশের নেশা এখনও পরাগের মতন মাইখা আছে রুহে। কাশ যদি সে এখনও তার পাশে রইত। তার সাথে কথা না বলত সহি, সেরেফ যদি পাশেই রইত, যখনই তার অজুদের পরশ পাইত, জীবনটা অন্তত শূন্য লাগত না তার।
অস্বস্তিতে খানিকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে ওয়াজেদ। তারপর ঝরনায় গোসল দিতে যায়। নিরালা মসজিদ, পাথুরে ভূমি, ঝরনার স্ফটিকসাদা পানি, চারপাশ হইতে দুলতে থাকা গাছের ছায়া, আর এসবেরই মাঝে দাঁড়াইয়া রইছে সে, এক সদ্য পাপী, রুহের মাঝে অনুতাপ অথচ দেহ ফুরফুরা, নির্বাক সে, আর তা লইয়া পেরেশানও বটে—শরীরে ঠান্ডা পানি বহাইয়া দিতেই নিরুপায়ভাবে চোখ বন্ধ করে।
খোদা মদদগার। রহম করনেওয়ালা জাত। তিনিই পথ দেখান সামনে।
দীর্ঘ সময় নিয়া গোসল করে ওয়াজেদ। আসরের নামাজে কেউই আসে নাই। একাই নামাজ পড়ে সে। লম্বা সিজদায় পইড়া খোদার দরবারে মাফি মাগে।
‘খোদা, যেই পাপ আমি করছি তার আজাব সহার মতন তাকত আমারে দাও। খোদা, আমি যদি পাপ কইরা থাকি, তাইলে না-চাইতেও মনে একটা খুশিভাব কেন? একটা আজব শান্তিভাবই বা লাগে কেন? তুমি কোনো উপায় বাতলাও মাবুদ, যাতে যদ্দ্রুত সম্ভব নুরা আমার বৈধ বিবি বইনা যায়।’
জায়নামাজে কপাল ঘইষা ওয়াজেদ খোদার দরবারে কালাম করে। জবাব পায় না সই, কিন্তু একটা রাহাতের পরশ ছড়াইয়া পড়ে রুহে। কেউ একজন আছেন, যার দরবারে মনের কথা কওয়া যায়। আয়েন্দা কী ঘটবে তা ভাবা না-মুমকিন। যদি খুশি মেলে, তা হাসিল করা চাই। খোদা মাফকারী। যা কিসমতে আছে, তা তো ঘটবেই। ওয়াজেদ বুঝ দেয় নিজেরে।
এর পরের কয়েক দুপুরে, ধুপ যখন চারদিক থেকে আগুনের হলকা ঝরায় আর অভিশাপের মতন মর্ত্যে নাইমা আসে, নুরা তার কামনার আগুন নিভাইতে বিরান হাবেলিতে আসে। নুরার থাকাকালে, তার শরমমাখা চাহনিতে, মাথা ঝুঁকাইয়া বলা কথায় আর দেহের ললিত কলায়, ওয়াজেদের সামনে পাপপুণ্যের দ্বন্দ্ব হারাইয়া যায়। বিরান হাবেলিতে বে-লেবাস দুই দেহ তাদের সুখ দেয়। বাহুমাঝে জাপটানো নারীদেহে আপন পৌরুষ নিহিত করার পর, হার দফা, ওয়াজেদ সেই ফুরফুরা শান্তি অনুভব করে। আর নুরা তার খুশির মাঝে এক পবিত্র পুলক খুঁইজা পায়। তার বক্ষে মাথা রাখা মানুষটা মসজিদের ইমাম, যার নেকি, বুজুর্গি আর মর্দানা তাকত জগদ্দল পাথরের মতন, অটুট আশ্রয়। যেই সামান্য সময় সে তার সাঁইয়ের কাছে থাকে, তার পাও দাবাইয়া দেয়, কখনো তার নাকের লাল আঁচিল লইয়া খেলা করে, দোয়া চায়। ওয়াজেদের শিরিন দোয়া শুনবার কালে নুরা তার মাথায় দোপাট্টা জড়াইয়া নেয়, মেয়ের মাথায় হাত বুলাইতে থাকে, যেন দোয়ার আছরে হার বালা-মুসিবত হইতে মেয়ের হেফাজত হবে। কখনো কখনো নুরা তার নিজ হাতে পাকানো ক্ষীর লইয়া আসে। এইসব ছোটোখাটো খেদমতেও বে-ইনতেহা মহব্বত, বে-পানাহ চাহাত জুইড়া থাকে তার আচরণে, শরীরের ভাষায়।
এরকমই এক দুপুরে, নুরা আর ওয়াজেদ বিরান হাবেলিতে একটা গুলমোহর গাছের ছায়ায়, ঘাসের ওপর, নিশ্চিন্ত শান্তিতে শুইয়া আছে। হাবেলিরে নিয়া গাঁয়ের মানুষের অলীক ভীতি আর কল্পনার মায়াজাল দুর্গের মতন বলয় দিয়া রাখছে তাদের। কার এত সাহস যে এদিকে আসবে। লু হাওয়ার ভয়ে গাঁয়ের লোকেরা জোহর তো বটেই এমনকি আসরের নামাজে পর্যন্ত আসে না।
এরই মধ্যে উভয়ে শরীরের ভালোবাসা বিনিময় শেষ করছে। শাদান কাছেই একটা ময়লা পুরাতন পুতুল লইয়া খেলতেছে। নুরা চারপাশে নজর ফিরায়। বারান্দার ফাটল ধরা মেঝেতে জায়গায় জায়গায় গজাইয়া উঠছে ঝোপঝাড়। দেওয়ালে বারিশের শ্যাওলা রেখা। অনেক বিম ধইসা পড়ছে। স্তূপ হইয়া উঠছে মাটির ঢিবি। দালানের ভাঙা দরজা দিয়া লাগে যেন কেউ চোখ লাগাইয়া দেখতেছে। উঠানের মাঝে দেখা যায় একটা ভগ্ন চাতাল, যার অর্ধেকটা এখন মূলত ইটের স্তূপ। নুরার চোখ বারবার ওইদিকে যায়। হাবেলির বিরান দশা দেইখা একটা হু হু অবসাদ ছড়াইয়া পড়ে তার মনে।
‘গ্রামের বুড়িদের কাছে গল্প শুনছি, যখন হাবেলি আবাদ ছিল, গরমকালের রাতগুলাতে এই চাতালের ওপর গালিচা বিছানো হইত। হাবেলির মালকিন ওইখানে উইঠা নাচতেন।’ নুরা চাতালের দিকে ইশারা কইরা বলে।
ওয়াজেদ নুরার বুকে মাথা দিয়া শুইয়া ছিল। শান্তিতে চোখ বুইজা ছিল তার। নুরার কথা শুইনা সে চোখ খুইলা চাতালের দিকে তাকায়। ফের তার চোখ গিয়া পড়ে সেই সরু গলিপথের মাথায় যা বাইরে গাঁয়ের দিকে চইলা গেছে। রোদের তাপে সমস্ত রাস্তাটা হলুদ পোড়া ঘাসে ঢাকা। দুইপাশে কী একটা সাদা ফুলে ভরতি ঝোপঝাড়। ক্ষণিকের জন্য ওয়াজেদ একগুচ্ছ ফুল তুইলা আনতে চায়। কিন্তু রোদের তাপে ওগুলার খুশবু আর তাজাভাব হারাইয়া গেছে। এখন ওগুলা দিয়া কোনো কাম নাই, ভাবে ওয়াজেদ। ওইভাবেই শুইয়া শুইয়া আলতো হাতে সে নুরার চুল থেকে শুকনা পাতা বাছতে থাকে।
‘হাবেলির মালকিন মনে হয় তোমার মতনই সুন্দরী আছিলেন।’ কল্পনায় ওয়াজেদ সেই নর্তকীর খুবসুরতির তাসাব্বুর করে।
‘শুনছি ওই দিনগুলাতে শহর থেকে বাদ্যবাদক ভাড়া কইরা আনা হইত। কয়েক দিন পর্যন্ত চলত নাচগান। একসময় সবই হারাইয়া গেল। মিয়া-বিবি মইরা গেলেন। মালিক তাদের জায়গাজমির দখল নিল। বিরান পইড়া থাকল হাবেলি, হয়তো আজীবনের জন্যই। আমার তো লাগে, এখানকার কুফা গ্রামেও ছড়াইয়া পড়ছে।’ নুরা বলে।
‘নাদানি কথা বইলো না তো।’ ওয়াজেদ নুরারে থামায়।
‘এই তো কয়দিন আগের কথা, শিখ আর হিন্দুদের চারপাঁচটা ঘর ছিল এইদিকে। ওদেরই একজনরে মাইরা খেতের ভিতর ফালাইয়া রাখা হয়। জানের মায়ায় পরে সবাই এখান থেকে ঘরদোর উঠাইয়া চইলা যায় দূরে। যাইতে যাইতে মহিলাদের কী কান্না আর বিলাপ। ভাবতেই আমার মন ভাইঙা যায়। এক মহিলা তার বাড়ির চৌকাঠে চুমা খাইতে খাইতে বলতেছিল, “আমাদের উজাড় কইরা সুখ পাইবা না কইলাম।” কে জানে এবার কার পালা।’ নুরার গলায় উদাসভাব ধরা পড়ে।
দুঃখের কাহিনি শুনতে ভালো লাগে না ওয়াজেদের। কথা পালটাইতে সে জিগেশ করে, ‘তুমি নাচ পারো?’
‘না তো.. আপনে?’
‘পারি নাকি? বুজুর্গদের ওরশে যখন মাজারে যাই, কাওয়ালি শুইনা সবার মতন আমিও ঝুমতে থাকি। ওইটারে নাচ বলে?’
নুরা হাসে। ওয়াজেদ উইঠা শাদানরে লইয়া দুই-তিন পাক ঘুরান দেয়। শাদান হাইসা ওঠে। নুরাও মুসকারায়। মা-বেটির খুশি দেইখা ওয়াজেদের খুব ভালো লাগে।
‘আমি তোমারে ওরশে নিয়া যাব। তুমিও আমার সাথে কাওয়ালির তালে তালে নাচবা।’ হালকা গলায় বলে ওয়াজেদ।
নুরা কিছু বলতে যাবে কিন্তু সেই সুযোগ পায় না। হঠাৎ এক ভয়ার্ত চিৎকারে লাফ দিয়া খাড়া হয় সে। সামনে যে রাস্তাটা গাঁয়ের দিকে চইলা গেছে, যেদিকে পিঠ দিয়া বইসা আছে ওয়াজেদ, নুরা দেখে, সেই রাস্তার মাথায় লাঠি হাতে দাঁড়াইয়া রইছে মজিদ। ওয়াজেদরে খবরদার করার আগেই দমাদম লাঠির বাড়ি পড়ে তার পিঠে। ব্যথায় কুঁকড়াইয়া ওঠে ওয়াজেদ।
‘না না চাচা, তার ওপর জুলুম কইরেন না।’ নুরা কানতে কানতে হাতজোড় কইরা মিনতি জানায়।
কিন্তু মজিদ থামে না। রাগে-ঘিন্নায় তার চোখ দিয়া যেন আগুন ঝরে। দাঁতে দাঁত পেষে মজিদ। নিচের ঠোঁট কামড়াইয়া ধরায় তার থুতনির কাছের দাড়িগুলা দেখায় চোখা চোখা।
‘হারামজাদা.. কুত্তার অওলাদ.. আমি শুরু থেকেই জানতাম তুই একটা আস্ত হারামি। তোর ইমামতি আসলে ভন্ডামি।’ মজিদ রাগে উন্মাদ হয়।
মাথা বাঁচাইতে ওয়াজেদ হাত দিয়া লাঠির বাড়ি ঠেকায়। জোয়ান বিধায় মজিদের তাবড়তোড় লাঠির বাড়ির মুখে কোনোমতে টিকা থাকতে পারে সে। তার কোর্তা ছিড়া যায়। শরীরের জায়গায় জায়গায় জইমা ওঠে ছোপ ছোপ রক্ত।
‘মাফ কইরা দেন, বখশে দেন, দয়া করেন, খোদার দোহাই।’ ওয়াজেদ আর্তনাদ কইরা বলে। ব্যথায় তার গলা দিয়া আওয়াজ বাইর হয় না যেন।
‘না বাবা.. না.. এবার একটু থামেন,’ নুরা হাত বাড়াইয়া ঠেকাইতে আসে।
মজিদের চোখ এবার নুরার ওপরে পড়ে। নুরারে মারতে ছুইটা আসে সে। ভয়ে পিছু হটতে গিয়া নুরা মাটিতে আছড়াইয়া পড়ে।
‘বেশরম.. বেলাজ.. বাজারি মহিলা কোথাকার.. দুর্গন্ধ ছড়াইতে ছড়াইতে তুই এই মসজিদ পর্যন্ত চইলা আসছস?’ ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে মজিদ নুরার কোমরে লাঠির ঘা বসায়। নুরা গগণবিদারী চিৎকার দিয়া ওঠে।
নুরারে মারাটা নিতে পারে না ওয়াজেদ। সে বিজলির বেগে তড়াক কইরা খাড়া হয়। ছোঁ মাইরা কাইড়া নেয় মজিদের লাঠি। সেই সাথে ধাক্কা মারে মজিদরে। ভূপাতিত হয় মজিদ।
‘আমারে মারেন, মারেন। কিন্তু খবরদার নুরার গায়ে হাত লাগাইছেন তো..’ বলতে বলতে ওয়াজেদ জব্বর ঘা লাগায় একটা।
মজিদ সাহায্যের জন্য চিল্লাইয়া ওঠে। মসজিদের খানিক দূরেই কিষানদের বসতি। মজিদের চিৎকার শুইনা তাদের কয়েকজন ছুইটা আসে হাবেলিতে। দেখে, মজিদ চিত হইয়া পইড়া আছে মাটিতে, চিল্লাইয়া সাহায্য চাইতেছে, আর ইমাম ওয়াজেদ লাঠি হাতে তারে মারবে মারবে ভাব। অথচ ইমামের গায়ে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। কাছেই কোমর ধইরা দাঁড়াইয়া আছে নুরা। ব্যথায় কাতরাইতেছে সে। কিষানরা কিছুই বুইঝা উঠতে পারে না।
‘এই জানোয়ারের হাত থেকে আমারে বাঁচাও। এ আমারে মাইরা ফেলবে। এই শয়তান আমার বেটির ইজ্জত লুটতেছিল। আমি হাতেনাতে ধইরা ফেলছি দেইখা এখন আমার ওপর চড়াও হইছে।’ মজিদ কিষানদের ঘটনা জানান দেয়।
থ বইনা যায় কিষানেরা। পরক্ষণেই রাগ চরমে ওঠে তাদের। মজিদ জালেমই সই, এটাও ঠিক যে খরার দিনে সে তাদের দিয়া বেগার খাটাইছে, পই পই কইরা ফসল আদায় করছে, কিন্তু তারপরেও সে গ্রামের লোক, আপনা লোক। নুরাও গ্রামেরই মেয়ে। কিন্তু ইমাম বাইরের লোক, পরায়া। বাইরের কেউ আইসা গ্রামের মানুষরে পিটাবে, বিষয়টা গায়ে লাগে তাদের। গালি বকতে বকতে ওয়াজেদের ওপর টুইটা পড়ে তারা। ওয়াজেদ হাতের লাঠি দিয়া খানিকক্ষণ ঠেকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কিষানেরা অভিজ্ঞ। দ্রুতই তারা ওয়াজেদের হাত থেকে লাঠি কাইড়া নেয়। পরক্ষণেই অজস্র চড়থাপ্পড় লাত্থি কিল ঘুসিতে নিস্তেজ হয় ওয়াজেদ।
‘এই হারামিরে মালিকের কাছে নিয়া চলো।’ মজিদ গজরায়।
মারের চোটে ওয়াজেদ আধমরা। কাকুতিমিনতি এখন বেকার, বোঝে সে। কিষানেরা তারে ঘাড়ে ধাক্কাইয়া নিয়া চলে। সবার পিছনে ল্যাংড়াইতে ল্যাংড়াইতে আসে মজিদ।
হইহাঙ্গামার মধ্যে নুরার কথা সবাই ভুইলা যায়। নুরাও বুইঝা ফেলে তার মিনতি এখন বেকার। সে কাঁপা হাতে শাদানরে কোলে তুইলা নিয়া জঙ্গলের রাস্তা দিয়া দিকহীন দিশাহীন ছুটতে থাকে। কাঁটাদার ঝোপে তার সালোয়ার আটকায়। গাছের শুকনা ডালপালা তার মুখে-মাথায় বাড়ি খায়, আঁচড় কাটে। কিন্তু নুরা থামে না। সে দৌড়ায় আর দৌড়ায়। সে জানে না কোথায় যাইতেছে। শুধু জানে, মসজিদ ছাইড়া হাবেলি ছাইড়া জঙ্গল ছাইড়া গাঁও ছাইড়া দূরে কোথাও যাইতে হবে। নিজের জিল্লতি আর মালিক জহিরের গজব থেকে বাঁচার এইটাই একমাত্র উপায়।
চলবে…